আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

লভ জিহাদ - নতুন বোতল, পুরোনো মদ

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


এখন বাজার গরম 'লভ জিহাদ' নিষিদ্ধকরণ বিষয়ক প্রস্তাবিত আইন নিয়ে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি তোড়জোড় করছে একটি আইন প্রণয়নের যার মাধ্যমে আন্তঃধর্মীয় বিবাহ অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হবে। বিস্তারিত এখনও প্রকাশিত হয়নি। এই আইনের আওতায় কোনো হিন্দু পুরুষ বিধর্মী নারীকে ধর্মান্তরিত করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সেটাও 'লভ জেহাদ' ঘোষিত হয়ে নিষিদ্ধ হবে কিনা জানা নেই। নাকি সে 'প্রেম-যোদ্ধা'র শিরোপা পেয়ে ধর্মের সেবক হিসেবে সেই মানুষেরা রাষ্ট্রের দ্বারা সম্মানিত হবে।

বিজ্ঞ লিবারেলদের অনেকেই একে নিছক ভোট কুড়োনোর খেয়াল হিসেবে ভাবছেন। ভাবছেন, এটা মানুষের মৌলিক সমস্যা থেকে নজর ঘোরানোর একটি রাজনৈতিক অপকৌশল মাত্র। বামপন্থী মানসিকতার অনেকেরও তাই ধারণা। তাঁদের মতে, সুতরাং প্রতিষেধক হচ্ছে, জীবন জীবিকার সংগ্রাম তীব্রতর করা। এতে এই অপকৌশলগুলো এমনিতেই পরাস্ত হয়ে যাবে। আজ এন-আর-সি, কাল ৩৭০, পরশু 'লভ জিহাদ' - এগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন কতগুলি অপকৌশল, পরিস্থিতি বুঝে যার একেকটি বাজারে ছাড়া হয়। অন্যদিকে, অশিক্ষিত ধর্মান্ধরা উৎফুল্ল, এতদিনে ব্যাটাগুলোকে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা হচ্ছে। শিক্ষিত লিবারেলমুখো ধর্মবিদ্বেষীরা নিজেদের মহলে ফিসফিস করে বলে, এগুলোরও একটু প্রয়োজন আছে। শিক্ষিত সত্যিকারের লিবারেল বা একাংশ বামপন্থী মনোভাবের মানুষদের জন্য ওপরের মূল্যায়নটি সঠিক নয়। এটা শুধুমাত্র ভোট কুড়োনোর বিচ্ছিন্ন কৌশল নয় এবং একে শুধুমাত্র জীবন জীবিকার সংগ্রামকে জোরদার করে পরাস্ত করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের বর্তমান শাসকদের উদ্দেশ্য শুধু সরকারে থাকাও নয়। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন। যে শ্লোগানগুলি বাজারে তারা আনছেন তা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন কৌশলের খেয়ালি উচ্চারণ নয়। এগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং একটি পুরোনো নীলনকশার দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল।

খুব বেশিদিন আগেকার কথা নয়। মাত্র পঁচাশি বছর আগে হিটলারের জার্মানিতে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ১৯৩৫ সালের ১০-১৬ সেপ্টেম্বর ন্যুরেমবার্গ শহরে নাৎসি দলের সপ্তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই দলীয় সম্মেলনের স্থলেই তৃতীয় রাইখ বা তৎকালীন জার্মান সংসদের অধিবেশনও আহ্বান করে দু’টি আইন পাশ করা হয়েছিল। একটি আইন ছিল জার্মান জাতির রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার আইন। আর দ্বিতীয়টি ছিল প্রকৃত জার্মান নাগরিকত্ব নির্ধারণ বিষয়ক আইন। প্রথম আইনের সুবাদে জার্মান ও ইহুদিদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ও দণ্ডণীয় ঘোষিত হয়েছিল। শুধু বিবাহ নয়। জার্মান ও ইহুদিদের মধ্যে বিবাহ বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক স্থাপনও নিষিদ্ধ হল তখন। আইন করে বলা হল, ৪৫ বছর বয়স না হওয়া অবধি একজন জার্মান নারী কোনো ইহুদি পরিবারে পরিচারিকার কাজ নিতে পারবে না। এই আইন পাশ হওয়ার আগে যাদের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, সেই বিবাহ বাতিল করার ব্যবস্থা হল আইনে। বৈবাহিক সম্পর্ক বাতিল করার অধিকার সম্পূর্ণত থাকল সরকারে হাতে। নাগরিকত্ব বিষয়ক আইনে বলা হল, বিশুদ্ধ রক্তের জার্মানরাই একমাত্র রাইখ নাগরিকত্ব বা আইনত নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবেন। এর বাইরে যারা থাকবেন তাদের বলা হবে 'জার্মান সাবজেক্ট' বা প্রজা যাদের প্রায় কোনো সাংবিধানিক অধিকারই থাকবে না। বিশুদ্ধ জার্মান রক্তের অধিকারীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছিল, যে সমস্ত জার্মান অধিবাসীদের অনধিক এক অষ্টমাংশ ইহুদি রক্ত রয়েছে তারা জার্মান জাতির একজন হিসেবে জার্মান নাগরিকত্ব পাবেন। এ ছাড়া, যারা তিন অষ্টমাংশ থেকে এক চতুর্থ ইহুদি রক্ত বহন করছে শরীরে তারাও জার্মান নাগরিকত্ব পাবে, তবে তাদের পরিচয় হবে মিশ্র জাতির। তবে মিশ্র জাতির ইহুদিরা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে যদি তারা ধর্মবিশ্বাসে ইহুদি হন কিংবা ইহুদি পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে। অর্থাৎ রক্তের শতাংশের হিসেব করে যারা জার্মান নাগরিকত্বের জন্যে যোগ্য বিবেচিত হবে তাদের নাগরিকত্বও সুনিশ্চিত নয়। ধর্মবিশ্বাস বা বৈবাহিক সম্পর্কের ছুতোয় মুহূর্তে তারা নাগরিকত্ব হারাতে পারে। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ ইহুদি সহ তিন চতুর্থাংশ ইহুদি রক্তের অধিকারীরা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবে। তাদের পরিচয় হবে জার্মান রাষ্ট্রের প্রজার। পরবর্তী সময়ে আইনে সংশোধনে এনে এই বর্গের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হল যাযাবর ‘রোমা’ ও কৃষ্ণাঙ্গদেরও।

এই ইহুদি রক্তের শতাংশের হিসেবের সাথে আমাদের দেশের ১৯৫১, ১৯৬৬, ১৯৭১, ২০১৪ ইত্যাদি ভিত্তিবর্ষ স্থির করার হিসেব নিকেশের কূটিল রাজনীতির কী আশ্চর্য মিল! ইহুদিদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল হিটলার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথেই। ১৯৩৩ সালের ১ এপ্রিল হিটলার ইহুদিদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৭ এপ্রিল আইন প্রণয়ন করে সমস্ত অনার্য ব্যক্তিদের আইন ব্যবসা ও প্রশাসনিক বিভাগ থেকে বহিষ্কারের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এর পরপরই অন্যান্য ব্যবসা থেকে ইহুদিদের বহিষ্কারের উদ্যোগও শুরু হয়ে যায়। জার্মানির শহরে নগরে নাৎসি দলের সদস্যরা ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর হিংস্র আক্রমণ শুরু করে দেয়। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতাতেই রাষ্ট্রের উদ্যোগে বন্দী শিবির, গ্যাস চেম্বার, ইহুদিদের নিষ্ঠুর গণহত্যা ও সবশেষে বিধ্বংসী দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ।

বিজ্ঞ লিবারেলরা বলবেন, আজকের 'লাভ জিহাদ’ আইন, সিএএ ও এনআরসি-র আলোচনায় হিটলারের জার্মানিকে টেনে আনাটা একটু বাড়াবাড়ি। সত্যিই কি তাই? একটু পেছন ফিরে দেখি যখন জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি শাসন ইহুদিদের ওপর ওই বর্বর আক্রমণ নামিয়ে আনছে, তখন এই ভারতবর্ষে বসে আরএসএসের নেতারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে? আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান ও গুরু গোলওয়ালকার হিটলারের জার্মান রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষায় ইহুদিদের ওপর নামিয়ে আনা আক্রমণের ঘটনায় মুগ্ধতা প্রকাশ করছেন তার লেখায়। তিনি লিখেছেন,
“German national pride has now become the topic of the day. To keep up the purity of the nation and its culture, Germany shocked the world by her purging the country of the Semitic races – the Jews. National pride at its highest has been manifested here. Germany has also shown how well-nigh impossible it is for races and cultures, having differences going to the mot [?], to be assimilated into one united whole, a good lesson for us in Hindustan to learn and profit by (Nagpur, 1939, p-37).”

একই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ভারতে মুসলিমদের প্রতি একই মনোভাব নিতে তিনি ওই নিবন্ধেই লিখছেন,
“in one word, they [Muslims] must cease to be foreigners or may stay in the country wholly subordinated to the Hindu nation claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment, not even citizen’s rights (op cit, p-52)।

এ তো গেল ১৯৩৯ সালের কথা। তর্কের খাতিরে না হয় ধরে নেওয়া গেল যে তখনও আরএসএসের নেতারা জার্মানির ভেতরে চলতে থাকা ইহুদির ওপর নৃশংস অত্যাচার ও গণহত্যার কথা জানতেন না। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৪৯ সালে যখন সারা পৃথিবী জেনে গেছে হিটলার মুসোলিনি শাসনের বীভৎসতার কথা, যখন মানুষ জেনে গেছে যে এই নৃশংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬০ লক্ষ নিরীহ ইহুদি নরনারী ও শিশু, যখন মানুষ জেনে গেছে যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষ, তখন আজকের বিজেপি-র আদর্শ পুরুষ সাভারকার বলছেন, আমরা যদি জার্মানদের মতো শক্তিশালী হতে পারি তবে ভারতের মুসলমানদের অবস্থা হবে জার্মানির ইহুদিদের মতো।

প্রকৃতপক্ষে, ভারতের বর্তমান শাসকদের 'লভ জিহাদ', 'এনআরসি', 'সিএএ' এবং ৩৭০ বাতিলের রাজনীতি ১৯৩৫ সালের 'ন্যূরেমবার্গ আইন'-এরই সুপরিকল্পিত অনুকৃতি। ওখানে ছিল ইহুদি। এখানে লক্ষ্যবস্তু মুসলিম। তবে অভিযান শুধু মুসলিমদের অধিকার খর্ব করায় থেমে থাকবে না। কারণ দেশটা ভারতবর্ষ। এখানে একটি শক্তিশালী বর্ণব্যবস্থা রয়েছে যার প্রতি বিজেপি-আরএসএসের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। এছাড়া, উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শবাদীদের চোখে আর্যাবর্তের বাইরের উচ্চবর্ণের লোকেরা ঠিক যথার্থ উচ্চবর্ণ নয়। এই উগ্র ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রেরই সম্প্রসারিত রূপ আর্যাবর্ত ও বর্হি-আর্যাবর্ত রাজনৈতিক সংঘাত, যার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ফলে মুসলিম বিদ্বেষের রাজনৈতিক কর্মসূচির ক্রমে সম্প্রসারিত হয়ে আর্যাবর্তের আধিপত্য কায়েমের পথ ধরে এগিয়ে উচ্চবর্ণের শাসন কায়েমের দিকে যাবে। জার্মানির ইহুদি বিদ্বেষও গোটা ইউরোপে ছড়িয়েছিল। আবার ইহুদি বিদ্বেষের পাশাপাশি যাযাবর রোমা জনগোষ্ঠী ও কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণও বিদ্বেষ ও আক্রমণের শিকার হয়েছিল।

আরএসএস-বিজেপি-র নীলনকশাও তেমনি একটি ফ্যাসীবাদী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে, এন-আর-সি, সিএএ রাজনীতির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিলাম শিলচরের এক অনুজ বন্ধুর সাথে। সে খুব জোরের সাথেই বলেছিল, এগুলোর স্পষ্ট উদ্দেশ্য ভারতের মুসলিম জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া সহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। এগুলোকে ন্যায়সঙ্গত প্রতীয়মান করার জন্য নানাধরনের বিভাজনের বয়ানগুলোকে ওরা ক্রমেই তীব্রতর করছে। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে ভারতবাসীর একটি বড় অংশও হিটলারের জার্মানির মতই এই অসত্য ও অর্ধ সত্য বয়ানগুলোকে বিশ্বাস করছে এই মুহূর্তে।

ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিরোধের পন্থা হিসেবে বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক মোর্চা গড়ে তোলার কথা উনিশশো কুড়ির দশকেই বলেছিলেন গ্রামশি। ইতালির কমিউনিস্ট আন্দোলনের তৎকালীন নেতারা তো বটেই তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নেতৃবৃন্দও তাকে গ্রাহ্য করেননি। তাঁদের মত ছিল, ইতালির ফ্যাসিবাদ সে দেশের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য বুর্জোয়াদের শেষ অস্ত্র। এর কোনো গণভিত্তি নেই। শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেকে টিঁকিয়ে রাখতে চাওয়া ফ্যাসিবাদ উত্তাল শ্রমিক আন্দোলনের আঘাতে শেষ হয়ে যাবে। ইতালির জনগণের সাথে সম্পর্কহীন এই ফ্যাসিবাদকে এককভাবে কমিউনিস্ট পার্টিই রুখে দিতে সক্ষম। ফলে সোসালিস্ট, ক্যাথলিক এবং নৈরাজ্যবাদী চিন্তার সমর্থকদের সাথে কমিউনিস্টদের সম্মিলিত গণফ্রন্ট গড়ে তোলা নিরর্থক ও শেষ পর্যন্ত তা বিপ্লব বিরোধিতারই নামান্তর। পক্ষান্তরে, গ্রামশির মতে, ইতালিতে ফ্যাসিবাদ নিছক রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে সন্ত্রাস ও নিপীড়নকে আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল ইতালির সমাজের এক ব্যাপকতম অংশের ভাবনা ও বিশ্বাসকে ফ্যাসিস্ট আদর্শের অনুসারী করে তুলতে পারার সাফল্য। অত্যন্ত সুকৌশলে জনগণের অনগ্রসরতা ও ইতালির ইতিহাসের নানা ঘটনাপর্বকে নিজেদের মতো করে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেই তারা মানুষকে ফ্যাসিস্ট ভাবাদর্শের পক্ষে টেনে আনতে সমর্থ হয়েছিল। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নেতৃবৃন্দের তরফেও প্রথম অবস্থায় ফ্যাসিবাদী ও সোসাল ডেমোক্র্যাটদের প্রায় এক পংক্তিতে বসানো হয়েছে। সোস্যাল ফ্যাসিস্ট অভিধাগুলির জন্ম এমন ধারণা থেকেই। জীবদ্দশায় গ্রামশি কোনো স্বীকৃতিই পাননি সতীর্থদের কাছে। জার্মানিতে নাৎসি শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৩৩-এর পর কমিনটার্ন বা তৃতীয় আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবিরোধী গণফ্রন্ট গড়ে তোলার পথ গ্রহণ করে। ক্রমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির সামরিক জোট ও ডিমিট্রভের ব্যাপক মঞ্চের তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়।

আমাদের দেশের এই হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান কি দেশের রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের চকিত পরিবর্তনের ফল? কিংবা কতগুলি রাজনৈতিক কৌশলের সাফল্য ও ব্যর্থতার ফলে ওপর থেকে ঘটা একটি অনভিপ্রেত ঘটনা? গ্রামশি যেভাবে তৎকালীন ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বরদিগার নেতৃত্বে প্রভাবশালী অংশের বিপরীতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন যে ইতালির ফ্যাসিবাদের গণভিত্তির কথা, তেমনি ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরও গণভিত্তি থাকা সম্ভব? ইতিহাসের কোন পর্ব থেকে শুরু হওয়া উচিত এই অন্বেষণ? নব্বইয়ের রাম-বাবরি সংঘাতের রাজনীতি থেকে? নাকি দেশভাগের ইতিহাস থেকে? নাকি আরো অনেক পেছন থেকে? দেশের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে গ্রামশির দ্বারস্থ হওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেই নয়ের দশক থেকেই। সমাজকর্মী ও গবেষকরা তাই করেও চলেছেন। হিন্দুত্বের রাজনীতির উদ্ভবের ইতিহাসকে খোঁজা হচ্ছে ব্রিটিশ ভারত বা ব্রিটিশপূর্ব ভারতের নানা পর্বের অলিগলিতে। কিন্তু রাজনৈতিক স্তরে এখনও ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় গ্রামশির চিন্তাকে তত্ত্বে ও প্রয়োগে নিয়ে আসার কাজটি অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এদেশে এখনও আমরা ভাবছি শুধুমাত্র জীবন জীবিকার আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গেই পরাস্ত করা সম্ভব হবে হিন্দুত্বের বিভাজনের রাজনীতিকে।

আমরা কি অতিসরলীকরণ করছি? অলমিতি বিস্তরেন। বাকিটা অন্য কোনো আলোচনায়।