আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

কোভিড এবং/বনাম থিয়েটার

অশোক মুখোপাধ্যায়


এতে কোনো সন্দেহ নেই যে কোভিড ১৯-এর সুনামি এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে গত ন'দশ মাস যাবত যে-পৃথিবীতে আমরা বাস করছি তার সঙ্গে তার আগের আমাদের চেনা পৃথিবী, চেনা জীবনের অনেকটা তফাৎ হয়ে গেছে। যতই আমরা 'নব স্বাভাবিক' আখ্যা দিয়ে এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করি না কেন, কাজটা যে সহজ নয় তা সবাই বুঝছেন। একে তো সংক্রমণ কমার কোনো লক্ষণ নেই, তার ওপর প্রতিষেধক ভ্যাকসিন কবে যে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছবে সে-কথাও জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছে না। ওষুধের কার্যকারিতার প্রশ্নের সঙ্গে সমান তালে চলছে এটার ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষের জীবনের থেকে এই ধনবাদী সভ্যতায় অনেক বড়ো মুনাফার প্রশ্ন। এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক লাভের জন্য কোভিড-চিকিৎসাকে ব্যবহারের ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যে দেখলাম রাষ্ট্রনায়কেরা বিবেকহীনভাবে 'ভোট দিলে আগে ভ্যাকসিন' এই রকম টোপ ব্যবহার করতেও পিছ-পা হলেন না।

এবারের এই অতিমারি আমাদের সমগ্র গ্রহটিকে আক্রমণ করেছে। গোটা পৃথিবীর মানব-সমাজ কম বেশি এর আওতায়। বিমূঢ় বিষ্ময়ে দেখছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমস্ত আস্ফালনকে অগ্রাহ্য করে এই ব্যাধি তার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এরই দাপটে অনিবার্য হয়ে উঠেছে অর্থনীতির বিপর্যয়।

কল-কারখানা-অফিস-আদালত-পরিবহণ সর্বস্তরে এর প্রকোপে অভাবনীয় মন্দার আশঙ্কায় কাঁপছে দুনিয়া। অর্থনীতির ওঠা-পড়ার জটিল চিত্রনাট্য যে বোঝে না সেই সাধারণ মানুষও দেখতে পাচ্ছে ছাঁটাই-বেকারি-মূল্যবৃদ্ধি-দারিদ্র্য কীভাবে আরও বিপন্ন করে তুলছে তার বেঁচে থাকার চিরন্তন লড়াইকে। এই বিশাল সংকটের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থিয়েটারের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে সংকোচ হয়। আগে মানুষ চিকিৎসা পাবে, খাদ্য পাবে তবে তো শিল্প! তবু মানুষ যেহেতু শুধু রুটি খেয়েই বাঁচে না, তার মন-ও খাবার চায়, তাই সে এই সামূহিক বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও আপ্রাণ চেষ্টা করছে জানালাগুলোকে খুলে রাখতে। মনের জানালা। থিয়েটারও তেমনি একটি জানালা। ছোটো। অন্তরঙ্গ। কিন্তু জানালা। অনেকের কাছেই জরুরি। এই অতিমারিতে কেমন ছিল/আছে সেই থিয়েটার তারই একটু খোঁজ-খবরের চেষ্টা করি এই ছোট্ট প্রতিবেদনে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। ১৯ মার্চ ২০২০ তারিখটা ভুলতে পারব না। ২২ মার্চ গিরিশ মঞ্চে আমাদের দল থিয়েটার ওয়ার্কশপের নতুন নাটকের প্রথম অভিনয় ঠিক হয়ে আছে। তার আগের দু'দিন ঐ মঞ্চেই স্টেজ রিহার্সাল। ১৯ তারিখ বিকেলে সরকারের নির্দেশে বন্ধ হয়ে গেল সব মঞ্চ। গিরিশ মঞ্চে যোগাযোগ করে জানা গেল তাঁরাও সেদিন সন্ধ্যা থেকেই বন্ধ করে দিচ্ছেন প্রেক্ষাগৃহ। তীরে এসে তরী ডুবল। আসন্ন প্রযোজনা বন্ধ হল। সন্ধেবেলা দলের ঘরে বসে সবাই ঠিক করলাম, কাজ এবং ঘর বন্ধ থাক ক'দিন। কিন্তু নতুন করে কিছু ভাবার আগে ২৩ মার্চ থেকে গোটা দেশে জারি হয়ে গেল লকডাউন। গিরিশ মঞ্চ সেই যে বন্ধ হয়েছিল আজও খোলেনি। আমাদের সেই আটকে যাওয়া নাটক আজও অভিনয় হয়নি। বেসরকারি মঞ্চ কয়েকটি খুলেছে বটে তবে তাতে তেমন লোকজন নেই। সরকারি মঞ্চ খোলেইনি এখনও। কবে খুলবে এখনও এই নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহেও কোনো খবর নেই।

আমার বেলগাছিয়ার বাসস্থান থেকে শ্যামবাজারে আমাদের দলের ঘরের দূরত্ব বড়জোর ২ কিলোমিটার, এখন মস্ত দূরত্ব হয়ে দাঁড়াল। কাজ থাক না থাক, সন্ধেবেলা দলের ঘরে যাওয়া চাই। সেই অভ্যেসে ছেদ পড়ল। গত ৫৫ বছরে আমাদের দলের ঝাঁপ বন্ধ হয়নি কখনো। এবার আর ঠেকানো গেল না। বাড়িতে কয়েকটি চেনা মুখের মধ্যে ছোটো হয়ে এল পৃথিবী। ফোন-সর্বস্ব, ফোন-সম্বল জীবন। খবরের কাগজ বন্ধ হওয়ায় মুঠো-ফোনের ছোটো পর্দায় অনলাইনে পাওয়া কাগজ পড়তে গলদধর্ম হতে হল। সংক্রমণের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে লাগল। চেনা মানুষদের আক্রান্ত হবার খবর আসতে লাগল। নানারকম বিদেশি শব্দের আক্রমণে জেরবার হতে থাকল শব্দভান্ডার - সোশ্যাল ডিসটান্স, স্যানিটাইজেশন, মাস্ক, কোয়ারান্টাইন, কন্টেইনমেন্ট জোন, আইসোলেশন হোম, ভেন্টিলেশন, প্লাজমা আরও কত কি! গত ক'মাসে এই ছবির বিশেষ পরিবর্তন নেই।

কবিতা লেখা বা ছবি আঁকার মত ঘরে বসে তো করা যায় না থিয়েটারের কাজ। একদল মানুষ করবে, একদল মানুষ দেখবে, তবে তো থিয়েটার। তাই অতিমারিতে থিয়েটারের কোলাপ্স হল সর্বব্যাপী। তারই মধ্যে একধরনের খবর আসতে লাগল যাতে মন ভালো হয়। আশা জাগে। থিয়েটারের কাজ থেকেই সম্পূর্ণতঃ জীবিকা নির্বাহ করেন বেশ কিছু নেপথ্য কর্মী, কলাকুশলী ও কিছু অভিনয় শিল্পী। ভালো কথাটা হল, এঁদের বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন থিয়েটারের সামনের সারির বহু নাট্যজন। সম্মিলিত উদ্যোগে গড়া হল তহবিল। এতটাই সাড়া পাওয়া গেল যে গত প্রায় আট-মাস ধরে মহানগরী কলকাতা এবং মফঃস্বলের বহু দুঃস্থ নাট্যকর্মীকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করা যাচ্ছে। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক স্তর থেকে অনেক এককালীন সাহায্যও পাওয়া গেল। থিয়েটারের সমাজের লোকজনের নিজস্ব দায়বোধ ও সহমর্মিতার এই সংগঠিত প্রয়াস একটা নির্মম সত্যকেও কিন্তু আবার প্রকট করে দেয় যে থিয়েটার নিয়ে কোনো অবহিতি নেই রাষ্ট্রের। না রাজ্যে, না কেন্দ্রে।

মঞ্চ বন্ধ হলেও অভিনয়-শিল্পীরা নানাভাবে কাজ করার চেষ্টা করে দেখেছেন। ক্যামেরা-বন্দি এই রকম নানা নাট্যপ্রয়াস অনেকের মতো আমার কাছেও পৌঁছেছে। কোনোটাই আমার বিশেষ মনে ধরেনি। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে! এখন একটু একটু করে আবার শুরু হচ্ছে মঞ্চাভিনয়। আনলক্ ১ থেকে ৫ পর্যন্ত পার করে আবার স্বাভাবিকতা খুঁজছে জীবন। কিন্তু খবর পাচ্ছি, সিনেমা হলের মতো রঙ্গালয়েও দর্শক ঘাটতি চলছে। এখনও ভয় কাটেনি মানুষের। কাটার কথাও নয়। এরই মধ্যে ভালো খবর যে প্রধানতঃ মফঃস্বলের নানা দল নিজেদের মতো করে ছোটো-ছোটো নাটকের আখড়া গড়ে তুলছে। এখানে তারা নিজেরাও যেমন অভিনয় করতে পারবে, তেমনি এলাকার অন্য দলেরাও ওই পরিসর ব্যবহার করতে পারবে কম খরচে। শুধু অভিনয় কেন, মহড়া কিংবা চর্চা ও গবেষণার নানা কাজেও ব্যবহার করা যাবে এই সব কেন্দ্র। এই ধরনের উদ্যেগের মধ্যে থিয়েটারের স্বাবলম্বী হবার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। রাজ্যব্যাপী অন্তরঙ্গ নাটমঞ্চের সমান্তরাল নেটওয়ার্ক যদি গড়ে তোলা যায়, তবে সেইটা হবে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থিয়েটারের একটা বড়ো লাভ। আমার তো মনে হচ্ছে, অন্ততঃ আগামী দু-এক বছর বড়ো কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বড়ো মঞ্চ ভাড়া করে ঢাক-ঢোল পেটানো থিয়েটারের বদলে অন্তরঙ্গ থিয়েটারের চর্চা বেশি ফলপ্রসূ হবে।

করোনা-কালে অনেক প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় নাট্যস্বজন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। লকডাউনের শুরুতেই চলে গেলেন ঊষা গাঙ্গুলি। আর এই সেদিন আমাদের সবার সম্মানের ও আদরের মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে শেষ বিদায় জানাতে হল। আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে। তালিকা দীর্ঘ করতে চাই না। যেটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে এঁদের চলে যাওয়ার কষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে এঁদের শোকযাত্রায় যেতে না পারার কষ্ট। তার ওপর আবার 'ভার্চুয়াল' স্মরণসভায় 'ভার্চুয়াল' শোকবার্তা পাঠাবার নয়া রীতিও জানতে হচ্ছে উপায়ান্তর না থাকায়। তবে মনে হচ্ছে, এই 'নব স্বাভাবিক' সময়ে বাঁচতে গেলে হাত ধোয়া-মুখ ঢাকার মতো এসবও জীবনের অঙ্গ হয়ে যাবে। ব্যস্ত জীবনের অঙ্গ হয়ে থাকবে এই 'ছায়াজীবন'। সুখের কথা, এই সময়ে অনেক প্রিয় বন্ধু, প্রিয় জন, নিকট আত্মীয় করোনায় আক্রান্ত হয়ে এবং অতিমারিকে হারিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। এঁদের সবাইকে অভিনন্দন। আমাদের রাজ্যের জরাজীর্ণ চিকিৎসা-কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়েও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যে বিরাট দল অসীম সাহসে অসম লড়াই লড়ছেন, তাঁদের জন্য কুর্ণিশ রইল। ক'দিন আগে খবর পেলাম, দিল্লির রাষ্ট্ৰীয় নাট্য বিদ্যালয়-এর পরিচালক সুরেশ বর্মা করোনা-কে হারিয়ে দিয়ে এসে আবার শুরু করতে চলেছেন কাজ। এনএসডি প্রাঙ্গণের মঞ্চে সপ্তাহান্তের থিয়েটার চালু হয়েছে ও চলছে। দিল্লির ব্যাধি-সংকটের মধ্যে এসব খবর ভরসা যোগায়।

নিজের কথা দিয়েই শেষ করি। যথেষ্ট বয়স হয়েছে, কিন্তু আক্কেল হয়নি। তাই আবার ফিরতে চাই মঞ্চের অভ্যস্ত জীবনে। জানি না কবে তা সম্ভব হবে। সত্যিকারের কার্যকর ভ্যাকসিন ছাড়া কী করেই বা মানুষ মুক্ত মনে নিশ্চিন্তে শিল্প-সৃজনের কাজ করতে পারবে, দেখতে পারবে। তবে সেই সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেই তো রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠি।