আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সমসাময়িক

গো-সংস্কৃতি


অন্ধকার গর্তে থাকে অন্ধ সরীসৃপ - কবেই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থে।

লিখেছেন, ছুটিয়াছে জাতিপ্রেম মৃত্যুর সন্ধানে।

মৃত্যুর সন্ধানেই বটে। দেশের বহু মানুষ যখন কুপরিকল্পিত লক ডাউন, নোট বন্দি, জিএসটি, কর্পোরেটতোষী অর্থনীতির কারণে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে তখন মানুষকে ভোলাতে অপধর্ম ও অপসংস্কৃতির বন্যা বওয়াতে চাইছে ভারতের বৃহত্তম পরিবার সঙ্ঘ পরিবার। একদিকে অপধর্মের তাস খেলে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি, অন্যদিকে তার হাত ধরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় তথা নন-ইস্যুকে ইস্যু করা হচ্ছে। বায়রন লিখেছিলেন, দেশে দারিদ্র্য বাড়লে উৎসব বেড়ে যায়। মানুষ মরছে না খেয়ে ওদিকে রামের বিশাল মূর্তি হচ্ছে, ছয় লাখ প্রদীপ জ্বলছে, কার্তিক পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে কোটি কোটি টাকার আলোকমালায় সাজানো হচ্ছে বারাণসী নগরী। অথচ মোদী আসবেন বলে উচ্ছেদ করা হচ্ছে হেলিপ্যাড সংলগ্ন বস্তিবাসীদের। মধ্যপ্রদেশের অবস্থাও করুণ। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে ৭৫০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে চাকরিতে দুর্নীতি আড়াল করতে। চলছে আয়ারাম গয়ারামের খেলা। পল্টুবাবুদের লীলা। তার মাঝে ঘোষণা হয়েছে নতুন ক্যাবিনেট মন্ত্রী পদ। গো ক্যাবিনেট। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ চৌহান একদা উমা ভারতীর বড় অনুগত ছিলেন। পরে তাঁকে পদ ছাড়তে অস্বীকার করেন। ১৫ বছরের বেশি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। রাজ্যে বেকারত্বের হার বাড়ছে। নিবন্ধীকৃত বেকার ছিল ২০১৮ এর অক্টোবরে ২০,৭৭,২২২ জন। ২০১৯ সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২৭,৭৯,৭২৫ জন। এ-বছর সংখ্যা ৩৪ লাখ পার। তিন লাখ সরকারি কর্মচারীর পদ শূন্য। কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থা দুর্বিষহ।

এই সময় মধ্যপ্রদেশের ভাজপা সরকার সিদ্ধান্ত দেশের প্রথম গো ক্যাবিনেট হবে মধ্যপ্রদেশে। এ-জন্য ছয়টি দপ্তর একযোগে কাজ করবে। রাজস্ব, অরণ্য, স্বরাষ্ট্র, কৃষক উন্নয়ন, পঞ্চায়েত ও গ্রামীণ উন্নয়ন, প্রাণীসম্পদ ও সামাজিক ন্যায় দপ্তর। তৈরি হবে কামধেনু গো অভয়ারণ্য। আগর মালোয়া জেলায়। এই গো অভয়ারণ্যে তৈরি হবে গোরু রক্ষার জন্য সুবিশাল শেড। সেই শেড নির্মাণে গো/কাউ সেস বসাবে। আর শিশুদের ডিম খেতে দেবে না। ওটা আমিষ। তাই অপুষ্টি জোগাতে দুধ খাওয়াবে। এতে শরীর ভালো হবে। ভালো হবে অর্থনীতিও। গোরুর বয়স হলে কোথায় পাঠানো হবে - সেই প্রশ্ন কেউ করেনি উত্তরও মেলেনি। তবে গিমিক ও মিথ্যাচারে ভাজপার সীমা নেই। গত ২২ নভেম্বর ২০২০ তে মুখ্যমন্ত্রী বললেন দেশের প্রথম গো অভয়ারণ্য হচ্ছে আগর মালওয়া জেলায়।

অথচ তিন বছর আগে 'দি উইক' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে আগর মালওয়া জেলার বোভিনে একটি গো অভয়ারণ্য আছে। এবং সেখানে ৪০০ গোরু একসঙ্গে মারা যাওয়ায় তদন্ত আদেশ দিয়েছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। এবারে তাঁর ঘোষণা - দেশের প্রথম গো অভয়ারণ্য। ওই রাজ্যে গো উন্নয়ন পর্ষদ আছে। তার তৎকালীন অধ্যক্ষ স্বামী অখিলেশানন্দ বলেন দৈনিক ৪০-৫০ টি গোরু মরছে গোশালায়। কেন? ঠিক মতো খাবার না পাওয়া। গোখাদ্য চুরি হচ্ছে। খিদেয় প্লাস্টিক খাচ্ছে। মরছে। গোরুর নামে বরাদ্দ অর্থ চুরি করছে ভাজপা নেতারা।

গত বছর মোরেনার দেওরি গোশালায় ১০০০ গোরু মারা যায় অপুষ্টি অনাহার ও অনাচারে। এ-বছরের ১২ আগস্ট আবার ১০ টি গোরু মারা গেছে দমবন্ধ হয়ে ও না খেতে পেয়ে। ভূপাল থেকে মাত্র ৩১২ কিমি দূরে শিবপুরী জেলায়। মধ্যপ্রদেশ নাকি গো নির্ভর অর্থনীতি গড়বে। দেখা যাক।

এদিকে গোরুদের জন্য গোশালা গড়ছে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ গোরুদের আধার কার্ড বানাচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী ভাজপা দলের লক্ষ্মীনারায়ণ চৌধুরী বিধানসভায় বহুজন সমাজ পার্টির সুষমা প্যাটেলের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, ২০১৯-এ উত্তরপ্রদেশে সরকারি গো আশ্রয়স্থলে ৯২৬১টি গো-শাবক মারা গেছে।

কেন? স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি তাই কারো শাস্তি হয়নি। ভাজপার সাংসদ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, শুধু ভারতমাতা কী জয় বা গোমাতা কী জয় বললেই হবে না - গোরুকে রক্ষায় দায়িত্ব নিতে হবে। প্রসঙ্গত গো মাংস রপ্তানিতে উত্তরপ্রদেশ এক উল্লেখযোগ্য স্থানের অধিকারী।

গোরু ক্যাবিনেট হচ্ছে, আশ্রয়স্থল হচ্ছে, কিন্তু দেশের ২৭ জন প্রখ্যাত সঙ্গীত চিত্র ও নৃত্যশিল্পীকে সরকারি ঘর ছাড়া করল দিল্লির মোদী সরকার। এদের মধ্যে আছেন, নৃত্যশিল্পী বিরজু মহারাজ, চিত্রশিল্পী যতীন দাস, ধ্রুপদী সঙ্গীত শিল্পী সাইফুদ্দিন ডাগরসহ ৩০ জন। আর এরাই গোরুদের জন্য ঘর বানাচ্ছে।

একে কি শিল্পীদরদ বলে? অথচ অমিত শাহ বাংলায় এসে শিল্পী দরদ দেখাতে অজয় চক্রবর্তীর বাড়ি যান।

মুখে শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতি দরদ। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে?

১। নাটকের দলগুলোকে অর্থ দেওয়া বন্ধ গত তিন বছর ধরে।
২। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ শিল্পীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর কাঁদুনি গাওয়া হয়েছে।
৩। গত ছয় বছরে ৫৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন।
৪। ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, জি এন সাই বাবা, গৌতম নওলাখা, আনন্দ তেলতুম্বে সহ অন্তত ২০ জন শিল্পী সাহিত্যিককে জেল বন্দি করা হয়েছে। অতি বৃদ্ধ পার্কিনসন রোগী স্ট্যান স্বামীকে খাওয়ার জন্য সিপার/চামচ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না।
৫। লেখক কালবুর্গি, গোবিন্দ পানসরে, সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশ, অধ্যাপক সাবরেওয়ালকে হত্যা করা হয়েছে।
৬। লেখক অনন্তমূর্তিকে দেশছাড়া করার ঘোষণা।
৭। বহু চলচ্চিত্র দেখাতে দেওয়া হয়নি অথবা কার্যত‌ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আরেকটি বিপজ্জনক দিক হলো ভারতের সংস্কৃতির ইতিহাস লেখার জন্য ১৬ সদস্যের এক কমিটি গড়া হয়েছে। যার সিংহভাগ সদস্যের নাম মানুষ জানেন না। বিশ্ব ব্রাহ্মণ ফেডারেশনের নেতা সঙ্ঘ পরিবারের লোক মাখনলালদের মতো লোকদের দেওয়া ভরানো হয়েছে কমিটি। তামিলনাডুর ডিএমকে সাংসদ কানিমোঝি প্রশ্ন করেছেন, দলিত সংখ্যালঘুরা কি সংস্কৃতির বাইরে? তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই কেন? প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী টি এম কৃষ্ণ বলেছেন, এই কমিটি বিদ্বেষী, জাতিবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক্ কোনো মহিলাকে রাখা হয়নি কমিটিতে।

আর গোরুদের পক্ষে সওয়াল করা অন্যতম প্রতিনিধি অজয়কুমার বিস্ট ওরফে যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, আগ্রায় তাজমহলের কাছে মুঘল মিউজিয়ামের নাম হবে শিবাজী মিউজিয়াম।

ঐতিহাসিকরা বলছেন, একি মূর্খামি। আগ্রার সঙ্গে তো শিবাজীর কোনো সম্পর্ক নাই।

সম্পর্ক নাই। তাতে কী?

বিদ্বেষ তো আছে।