আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ অষ্টাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ ডিসেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

ইতিহাস সব মনে রাখবে


রাষ্ট্র যদি দমনমূলক হয়, তাহলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার থেকে বড় দেশপ্রেম আর কিছুতে নেই - এই আপ্তবাক্য আজ চোখের সামনে সত্যি হতে দেখা যাচ্ছে রোজ রোজ। কৃষি বিলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক যে চলমান আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি, সেখানে খোদ রাষ্ট্রকেই দেখা যাচ্ছে দেশদ্রোহীর ভূমিকায়, খাদ্যব্যবস্থার মূল ভিত্তি কৃষকদের ওপর উৎপীড়ন ও সন্ত্রাস নামিয়ে আনার মধ্যে দিয়ে যে ভূমিকা সুস্পষ্ট।

বস্তুত বিজেপি-র নয়া-উদারবাদী অ্যাজেন্ডা প্রয়োগের জন্য তার তাঁবেদার রাজ্যগুলি কতদূর অব্ধি যেতে পারে সেটাই দেখিয়ে দিচ্ছেন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর। কংগ্রেস শাসিত পাঞ্জাব দিয়ে যে কৃষকদের গতি ছিল অবাধ, হরিয়ানায় তাকে আটকে দেওয়া হয়েছে। কৃষকদের মিছিলে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া এবং ঠান্ডায় জলকামান ব্যবহার করা নিয়ে হরিয়ানা পুলিশের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। খট্টর জানিয়েছেন যে হরিয়ানার কৃষকরা এই প্রতিবাদ থেকে দূরে, এবং পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী এই প্রতিবাদে হাওয়া দিচ্ছেন, তাঁর দফতরের আধিকারিকরা এই প্রতিবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন। ইতিমধ্যেই লাগাতার কৃষক বিক্ষোভের জেরে দিল্লি হরিয়ানা টিকরি সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে।

তবে কৃষকরাও বসে নেই। পাঞ্জাব, রাজস্থান, কেরালা, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা সহ একাধিক রাজ্যের কৃষকরা এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন। পুলিশ লাঠি, ব্যারিকেড, টিয়ার গ্যাস, জলকামান, রাস্তা কেটে দেওয়া ভেদ করে তাঁরা পোঁছে গেছেন দিল্লি সংলগ্ন পাঁচটি সীমান্ত অঞ্চলে। লাগাতার বিক্ষোভের জেরে দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে কৃষকদের দিল্লি প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। যদিও সেই অঞ্চল দিল্লি সংলগ্ন বুরারি অঞ্চলের নিরঙ্কারি গ্রাউন্ডে জমায়েত হতে তাঁরা অসম্মত হন। সিঙ্ঘু সীমান্তে রাস্তাতেই বসে পড়ে যন্তর মন্তর অথবা রামলীলা ময়দানে যাবার সিদ্ধান্তে তাঁরা অনড় থাকেন। এই সম্পাদকীয় লেখার মুহূর্তে দিল্লি সংলগ্ন তিনটি হাইওয়ে জুড়ে কৃষকরা রাস্তায় বসে রয়েছেন। তাঁদের আটকাতে এখনও বহু জায়গায় কাঁটা তারের বেড়া, ট্রেঞ্চ কাটা হয়েছে। দিল্লির নারেলা অঞ্চলের সিঙ্গু সীমান্ত, দিল্লি বাহাদুরগড় হাইওয়ে, দিল্লি সোনেপথ এর রাস্তা বন্ধ আছে। এছাড়াও দিল্লি হরিদ্বার-এর রাস্তায় আপাতত বন্ধ। উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত কৃষকরা সেখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

ট্রেঞ্চ কাটা, মারাত্মক ঠাণ্ডায় জলকামান, এগুলো ব্যবহার হচ্ছে কাদের বিরুদ্ধে? সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে? উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে? বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে? না, ব্যবহার হচ্ছে কৃষকসমাজের বিরুদ্ধে, যেখানে মনে রাখতে হবে যে একসময়েই এরাই ছিল বিজেপি-র সমর্থনের মূল ভিত্তি। মনে রাখতে হবে, দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকার কৃষকদের অভিযান রুখতে নিজে ট্রেঞ্চ কেটেছে, এমনকি মাওবাদীদের বিরুদ্ধেও যা কখনো করেনি। শুধু সেটাই নয়। মধ্য রাতে চলেছে কৃষক নেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি। গ্রেপ্তার সত্তর জনের বেশি কৃষক নেতা। রাজ্যে ১৪৪ ধারা। উত্তর প্রদেশ আগামী ছ’মাসের জন্য জারি করেছে এসমা। ওড়িশা সরকার বিধানসভায় এসমা আইন সংশোধন করে তাতে যুক্ত করেছে জেল-জরিমানা। ইতিমধ্যেই লাঠি ও জলকামানে শহিদ হয়েছেন কয়েকজন। দেশপ্রেমের ধ্বজাধারী বিজেপি আজ দেশের প্রধানতম অর্থনৈতিক স্তম্ভটিকেই আঘাত করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

তবে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। বিজেপির অ্যাজেন্ডা হল নয়া উদারনীতি, এবং নরেন্দ্র মোদীর টিকি বাঁধা আছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি ও আদানি আম্বানী জাতীয় শিল্পপতিদের কাছে। কাজেই তাদের কর্মসূচিই বিজেপি বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সেক্ষেত্রে কৃষি ঋণ হোক অথবা বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে অবাধ কাজকর্মের ছাড়পত্র হোক, এতে যদি কৃষকসমাজের একটা বড় অংশের সর্বনাশ হয়ও, বিজেপির কিছু আসবে যাবে না। তাদের টাকা আসে বৃহৎ শিল্পপতিদের কাছ থেকে, তাই তারা সেখানেই দায়বদ্ধ। কৃষক সমাজ হল শুধুমাত্র ভোটব্যাঙ্ক, নির্বাচনের আগে যাদের সামনে কিছু প্রতিশ্রুতির গাজর ঝুলিয়ে দিলেই কাজ চলে যায়। অন্তত বিজেপি এমনটাই মনে করে।

কিন্তু তাদের হিসেব এবারে কিছুটা ভুল হচ্ছে, কারণ কৃষকরা যে অগ্নিমুর্তি ধারণ করবেন এভাবে, ভাবতে পারেনি বিজেপি। তাঁরা ঐক্যবদ্ধ ও মারমুখী আন্দোলন করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে পড়ে পড়ে মার খাবার দিন এবার শেষ। ইতিমধ্যেই খালসা ব্রিগেড রাস্তার পাশে লঙ্গরখানা খুলে বসে আছে। কৃষককে যেন খালি পেটে লড়তে না হয়। এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মসজিদকমিটিগুলি, তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য পানীয় যোগাচ্ছে নিজের সাধ্যমত। প্রশংসনীয় পদক্ষেপ রেখেছেন অরবিন্দ কজরিওয়াল, সম্ভবত অনেকদিন পর। প্রথমে দিল্লিতে কৃষক বিক্ষোভের অনুমতি প্রত্যাখান করে পরে মতবদল করে আন্দোলনরত কৃষকদের পক্ষেই কথা বললেন। ন'খানা স্টেডিয়ামে মেকশিফট জেল বানাবার অনুমতি দেননি, উলটে বলেছেন বিক্ষোভ দেখাবার অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। প্রতিবাদে মুখর হয়েছে নাগরিক সমাজের একাংশ। যতই মোদীর পয়স্য মিডিয়া এই বিক্ষোভের মধ্যে খালিস্তান আন্দোলনের ষড়যন্ত্র খুঁজে বার করুক না কেন, এই সত্যিটা আর কিছুতেই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না যে ব্যাপক গণক্ষোভ ফেটে পড়বার প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে আছে, কেন্দ্রীয় সরকার তিনটে বিল প্রত্যাহার না করলে যে ক্ষোভের সুনামিতে তারা ভেসে যেতেও পারে।

আর এখানেই বাম ও কংগ্রেসের ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা ২৬শে নভেম্বরের ধর্মঘট একটা মস্ত প্রাসঙ্গিকতা পেয়ে গিয়েছে, যেহেতু এই ধর্মঘট ছিল কৃষি আইনেরও বিপক্ষে, এবং কৃষক সংগঠনগুলি একে সমর্থন জানিয়েছিল। ধর্মঘট কতটা সফল হল, সেই নিয়ে চুলচেরা বিচার আপাতত থাকুক। কিন্তু ধর্মঘটের যে মূল দাবী, সেগুলোকে দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া গিয়েছে, যার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে চলতি কৃষি বিক্ষোভ - এই কথা চোখ বুজে বলা যেতে পারে। ন্যূনতম আয়, কর্মসংস্থান, খাদ্য সরবরাহ, পেনশন, শ্রম আইন, কৃষি আইন, মেয়েদের নিরাপত্তা, ইত্যাদি যে সমস্ত দাবিতে এই ধর্মঘটের আহ্বান, সেগুলির সঙ্গে বিভিন্ন শ্রমজীবী বর্গের স্বার্থ জড়িত ছিল। এবং এই মুহূর্তে এই শ্রমজীবী মানুষের অ্যাজেন্ডাতেই কাজ করছে বাম সংগঠনগুলি। স্বাভাবিকভাবেই কৃষক আন্দোলনও তাই ধর্মঘটকে অক্সিজেন জুগিয়েছে বলা যায়।

কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি এই শ্রমজীবী অ্যাজেন্ডাতে সাড়া দিলেন? দুর্ভাগ্যজনভাবে, না। তিনি মুখে বিজেপি বিরোধীতার কথা বললেন, কৃষক আন্দোলনে সংহতি জ্ঞাপন করলেন, এবং কার্যক্ষেত্রে? কয়েকদিন নরম অবস্থান নেবার পর ধর্মঘটের দিন আবির্ভুত হলেন স্বরূপে। রাজ্যের দিকে দিকে পুলিশের বর্বর আক্রমণ, গ্রেফতারী, জোর করে গাড়ি চালানো, দোকানপাট খোলানোর চেষ্টা এবং সর্বোপরি ধর্মঘটের আগের দিন দফতরে হাজিরা সংক্রান্ত নির্দেশনামা প্রকাশ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি এই লড়াইয়ে কোন পক্ষে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিই যদি সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ফ্যাসিবাদকে রুখতে চান, যদি ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বাঁচাতে চান, ত্রুটি থাকলেও বিদ্যমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ও সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করতে চান, যদি শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত, দলিত, নারী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, অ-হিন্দী,অ-হিন্দু এই সকলের ওপর ফ্যাসিবাদী আক্রমণকে রুখতে চান, তাহলে তাঁকে বামেদের দাবীর পক্ষে দাঁড়াতেই হবে। কিন্তু সেটা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব, কারণ চেতনায় ও রাজনৈতিক বীক্ষায় তিনিও বিজেপির পথেরই সহযাত্রী। সেক্ষেত্রে পক্ষ নির্বাচনে তিনি ভুল করেননি।

ইতিহাস সব মনে রাখবে। যারা শ্রমজীবী মানুষের উপর জলকামান, কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করেছিল, যারা নিজের দেশবাসীকে আটকাতে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে সামরিক কায়দায় মহড়া নিয়েছিল তাদের যেমন মনে রাখা হবে, তারই সঙ্গে মনে রাখা হবে, যারা মুখে এগুলোকে বিরোধীতার কথা বলে কার্যক্ষেত্রে সমর্থন যুগিয়েছিল, তাদেরও।