আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ক্ল্যাসিক্যাল থেকে কোয়ান্টামঃ বিজ্ঞান ছুঁতে চাইছে কল্পবিজ্ঞানকে

শুভময় মৈত্র


কম্পিউটার (গণকযন্ত্র) আর কম্যুনিকেশন-এর (যোগাযোগ ব্যবস্থা) ফলিত ক্ষেত্রে এমন উন্নতি হয়েছে গত তিন দশকে, যে কল্পবিজ্ঞানের অনেকটাই এখন বাস্তব। তবে মূল সমস্যা এখন গোপনীয়তার। তাই জগতজুড়ে মানুষের গান থেকে স্নানঘরের ছবি মুহূর্তে জনগণের সম্পত্তি। আর এই নজরদারির খুঁটিনাটি বোঝা সাধারণ মানুষের পক্ষে বেশ শক্ত। তবে বিশেষজ্ঞ না হলেও, মুঠোয় থাকা অতি শক্তিশালী কম্পিউটারটা যে কখন কি করছে সেটা একেবারে না বুঝলে কিছুটা অরক্ষিত থাকতেই হবে। বিছানার ওপর ফেলে রাখা স্মার্টফোন একটানা ঘরের বিভিন্ন শব্দ এবং চলছবি আপনার অনুমতি ছাড়াই গোপনে পাঠিয়ে দিতে পারে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে। তাই ঝুঁকির বিষয়গুলো জানার চেষ্টা শুরু হওয়াটাই কাম্য। বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতি সাধারণভাবে বাজারের খবর হিসেবে খুব জনপ্রিয় হয় না। তবু তত্ত্বের আবিষ্কার এবং ফলিত ক্ষেত্রে তার রূপায়ণে যে অসম্ভব গতিতে বিজ্ঞান এগিয়েছে শেষ শতকে, তারই ফলাফল আজকের মুঠোফোন। সেই ইতিহাসের রূপরেখা পেশ করতে গেলে আলোচনায় আনতে হবে গণক-বিদ্যা, যোগাযোগ-প্রযুক্তি এবং সংকেতবিদ্যা গবেষণার বিভিন্ন বিষয়।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের গনগনে সময় - বাষ্প শকটের হাত ধরে। শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত ভাবনাও তৈরি হচ্ছে সেই পরিসরে। মালিকপক্ষ বুঝতে পারছিল যে মানুষকে দিয়ে কাজ করানো শক্ত দুটো কারণে। প্রথম কারণ হল যে কোনো ব্যক্তির একক শক্তির সীমাবদ্ধতা আছে। তাই খুব ভারি কাজ করাতে গেলে একসঙ্গে অনেককে একসঙ্গে নিয়ে সেই কাজ পরিচালনা করতে হবে। আর দুই হল একসঙ্গে গাদাগাদা মানুষকে নিয়ম মেনে একই ধরনের কাজ বারবার করানো শক্ত। তারা বিদ্রোহ করবে অনেক বেশি। গায়ের জোরের বিষয়টা পশুদের ক্ষেত্রেও সত্যি। তাই গোরু, গাধা বা ঘোড়াকে দিয়ে গাড়ি টানানোর মধ্যে অনেক বেশি অনিশ্চয়তা আছে। কিন্তু যন্ত্রের না আছে মন, না আছে শরীর। জীবন নেই, নেই মৃত্যুও। সারিয়ে নিয়ে আবার কাজ করানো যায়। একেবারে ভেঙে গেলে তার কল কবজা কিছু ফেলে দিতে হয়, বাকিটা লাগিয়ে দেওয়া যায় অন্য যন্ত্রে। প্রাণীদের থেকে যন্ত্রের গায়ের জোর অনেক বেশি, আর মন তো একেবারেই অনুপস্থিত। এরকম ভৃত্য পাওয়ায় খুব খুশি হল মানবসভ্যতা। দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমতে শুরু করল বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। তবে যে বিষয়টা মানুষ একেবারেই সামলাতে পারল না তা হল দূষণ। যাই হোক, আজকের দিনে কোভিড-১৯ এসে কীভাবে বাতাসের বিষ কমাচ্ছে সেটা এই আলোচনার বিষয় নয়। এখানে যেটা বলার কথা তা হল পেশিশক্তিকে মোটামুটি সরিয়ে দিল যন্ত্র। জন হেনরির হেরে যাওয়ার গান তাই শ্রমিকের লড়াইয়ের থেকেও অনেক বেশি করে যন্ত্রের তুলনায় শ্রমজীবী মানুষের পিছিয়ে পড়ার গল্প। মালিকদের মুনাফালাভের গতি বাড়াল শিল্পবিপ্লব।

পেশি না হয় প্রতিস্থাপিত হল, কিন্তু মস্তিষ্ক? সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একঘেয়ে গণনার কাজ বাড়তে শুরু করেছিল সভ্যতার শুরুর দিন থেকেই। হিসেব না থাকলে মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা হবে কীভাবে? তখন তো একজন বেশি আর একজন কম পাওয়ার অঙ্ক তো শুরুই করা যাবে না। সেই হিসেব করতে গেলে মানুষের ভুল হবেই, আর একঘেয়ে হিসেব করার জন্যে দিনরাত একই লোককে বসিয়ে রাখাও শক্ত। তাই মস্তিষ্কেরও যে একটা যান্ত্রিক বিকল্পের দরকার তা বুঝতে দেরি হয়নি সভ্যতার। পাটিগণিতকে যন্ত্রে বেঁধে ফেলার উপায় উনিশ শতকের শুরুতে তাই যথেষ্ট পরিণত। তার পর থেকে চলছে অন্য এক শিল্প বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীতে জীবন বাঁধা পড়ে গেছে কম্পিউটার আর কম্যুনিকেশনে। সমাজের পিছিয়ে থাকা অংশের হাতেও এখন মুঠোফোন। বারবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে আজকের যে কোনো স্মার্টফোনের গণনা ক্ষমতা আশির দশকের দশখানা আলমারির আয়তনের কম্পিউটারের সমান। সঙ্গে প্রত্যেক ফোন যুক্ত দূরযোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে। অর্থাৎ মোবাইলের টাওয়ার চালু থাকলে মুঠোফোন হাতে প্রত্যন্ত গ্রামে বসে থাকা যে কোনো মানুষ অবলীলায় বিশ্বনাগরিক।

দর্শন ছেড়ে বিজ্ঞানে ফিরে এবার কম্পিউটার বুঝতে ব্যাটারি আর অঙ্ককে বেঁধে ফেলা যাক। ব্যাটারির মাথার দিকটাকে বলে ধনাত্মক (পজিটিভ) আর নিচের দিকটা ঋণাত্মক (নেগেটিভ)। একটা টুনি বালব যদি সরু তার দিয়ে ব্যাটারির দু দিকের মধ্যে লাগিয়ে দেওয়া যায় তাহলে আলো জ্বলে, আর তার খুলে দিলে আলো যায় নিভে। এই আলো জ্বলাকে যদি বলেন ১ (এক) আর নিভে থাকাকে ০ (শূন্য), তাহলে জ্বলা-নেভাকে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে ০ আর ১ দিয়ে সমস্ত পূর্ণসংখ্যা তৈরি করা যায়। আমরা সাধারণভাবে যে অঙ্কগুলো নিয়ে কাজ করি তা শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত, অর্থাৎ দশটা চিহ্ন। কিন্তু একটু ভাবলে বোঝা যাবে দশটা চিহ্নের আসলে খুব দরকার নেই, এর মধ্যে মাত্র দুটো দিয়েই সব কাজ সারা যায়। আর সেই দুটো অঙ্ক আমরা চিহ্নিত করতে পারি ভোল্টেজ বা বিভব দিয়ে। বেশি মানে ১ (ধরা যাক পাঁচ ভোল্ট, ব্যাটারির মাথার দিক), আর একেবারে কম মানে ০ (অর্থাৎ শূন্য ভোল্টের একেবারে কাছাকাছি, ব্যাটারির নিচের দিক)। এই যে শূন্য আর এক দিয়ে দুনিয়া জয় করা যেতে পারে, সে কথা বেশ গুছিয়ে বলেছিলেন জর্জ বুল। জন্মেছিলেন ১৮১৫ সালে, মারা যান ১৮৬৪-তে - পঞ্চাশ পূর্ণ হয়নি। প্রায় তিন মাইল বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে নিউমোনিয়া বাঁধিয়েছিলেন এই গণিতজ্ঞ। যুক্তি বা লজিককে নিয়ে যে অঙ্ক, তার একটা বড় অংশ যে শুধু শূন্য আর এক দিয়ে সামলে নেওয়া যায় সেকথা বুঝতে পেরেছিলেন এই বিজ্ঞানী। তাঁর নামেই তাই আজকের দিনে বহুল পরিচিত বুলিয়ান অ্যালজেব্রা, কম্পিউটারের মূল অঙ্ক।

তবে যন্ত্র ব্যবহার করার সময় আপনাকে এত অঙ্ক শিখতে হবে না। জটিল বৈদ্যুতিন নকশার ভিত্তিতে তৈরি করা হার্ডওয়্যার-এর ওপরে লেখা হয় সফটওয়্যার। যা কিনা আপনাকে বুঝতেই দেয় না এইসব গোলানো অঙ্কের গোলমাল। স্মার্টফোনে এই সমস্ত সফটওয়্যার পরিচিত ‘অ্যাপ’ নামে, আর গৌরবে বহুবচন করলে ‘অ্যাপস্’। অর্থাৎ সতেরো তলার টেরেসে লঙ্কা গাছে জল দেওয়ার সময় যেমন কুলি-মজুর কবিতার “বল তো এসব কাহাদের দান? তোমার অট্টালিকা?” ইত্যাদি শব্দবন্ধ মনে থাকে না, তেমনই হাতের মুঠোয় জগৎ জয় করার যন্ত্র থাকলে তার ভেতরে আদতে কী কী হচ্ছে তা বোঝার প্রয়োজন অত্যন্ত কম। কোনোভাবে যন্ত্রটা ব্যবহার করে নিজের সুবিধের কাজটুকু করে ফেলাতেই জীবনের মোক্ষলাভ। তবে সে লাভের গুড়ে ক্ষতির পিঁপড়ে বেড়ে গেলেই মুশকিল। সেই কারণেই বিমূর্ত ভাবনায় পুরোটাই মুঠোফোনের হাতে ছেড়ে দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার থেকে কিছুটা গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করা অনেক সময় বুদ্ধিমানের কাজ। তবে আপাতত নেতিবাচক ভাবনায় না ঢুকে গণকযন্ত্রের শুরুর ইতিহাসে নজর দেওয়া যাক।

প্রযুক্তির পেছনে থাকে বিজ্ঞান। বোঝাই যাচ্ছে যে ফিজিক্সের ইলেকট্রন এবং সেই সংক্রান্ত নকশা (সার্কিট), কেমিস্ট্রির ব্যাটারি আর অঙ্কের সাবলীল পাটিগণিত হাতে হাত না মেলালে কম্পিউটার তৈরি হত না। তবে বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তিতে পৌঁছতে গেলে চিন্তাশীল মানুষদের কাজে লাগেই। সেই জায়গাতেই স্মরণ করতে হবে বেশ কিছু মানুষের কথা। প্রথমেই আলোচনা করা যাক চার্লস ব্যাবেজের অবদান নিয়ে। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন এই বিজ্ঞানী, বেঁচেছিলেন প্রায় আশি বছর। অঙ্ক এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এই দুই ক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ ছিল ব্যাবেজের। বৈদ্যুতিক কিংবা বৈদ্যুতিন নয়। অঙ্কের ভিত্তিতে ভাবা যন্ত্রগণক হাতেকলমে কিভাবে বানানো যেতে পারে তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন ধারণার ব্যাখ্যা করে। সেই তত্ত্বের আরও উন্নত ব্যাখ্যা করেন জন ভন নয়ম্যান (১৯০৩-১৯৫৭), বিশ শতকের শুরুতে। তিনি বুঝিয়ে দেন যে কম্পিউটারের মূলত দুটো অংশ। এক, সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট (সিপিইউ) আর দুই, মেমোরি। এদের দুজনের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে তার দিয়ে। সেই তারের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হবে ইলেকট্রন। তথ্য পৌঁছে যাবে সিপিইউ থেকে মেমোরিতে অথবা উল্টোদিকে। সিপিইউ হল কম্পিউটারের মস্তিষ্ক, যে কিনা সমস্ত অঙ্ক কষে দেয়। তাকে তথ্য পৌঁছে দেয় মেমোরি। আবার সেই অঙ্কের ফলাফল ধরা থাকে মেমোরিতে। এত সহজ মডেল কিন্তু আসলে ব্যাপক শক্তিশালী। একে দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় গণকবিজ্ঞানের প্রচুর জটিল বিষয়কে। মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে সিপিইউ হচ্ছে মস্তিষ্ক। অঙ্কের বই মেমোরির একটা অংশ। সেখান থেকে অঙ্ক নিয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে করা হচ্ছে তার সমাধান। উত্তর লেখা হচ্ছে খাতায়। সেটা মেমোরির আর একটা অংশ। মস্তিষ্কের মধ্যে অঙ্ক কষার সার্কিট ছাড়াও আছে কিছু মেমোরি, যার জন্যে আমাদের মনে থাকে অনেক পুরনো কথা। তবে সিপিইউ-র মধ্যে কিছুটা মেমোরি থাকলেও, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে সেই সব তথ্য সাধারণভাবে মুছে যায়। তাই বাস্তবের কম্পিউটারে গাদা গাদা তথ্য ধরে রাখতে হয় হার্ড ডিস্ক কিংবা পেন ড্রাইভে। আজকাল মোবাইল ফোনের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেওয়া যায় অনেকটা মেমোরি। এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত কম্পিউটারের যে তাত্ত্বিক নকশা তাতে বিশ শতকে সবথেকে বড়ো অবদান সম্ভবত অ্যালান টুরিং-এর। তাঁর জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত ছায়াছবি “দ্য ইমিটেশন গেম”। ২৩শে জুন ১৯১২ থেকে ৭ই জুন ১৯৫৪, এই ছোট্ট জীবনে গণকযন্ত্র এবং সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর অবদান অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হবে। ক্রিপ্টোলজি অর্থাৎ সঙ্কেতবিদ্যাতেও তাঁর কাজ আছে প্রচুর।

টুরিং সাহেবের জীবন সম্পর্কে বিশদে জানতে গেলেই বোঝা যায় যে বিজ্ঞানকে পরিচালনা করে সমাজ এবং রাজনীতি। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যই কম্পিউটার আর কম্যুনিকেশনের অগ্রগতির একটি মূল কারণ। কোনো একনায়ক অন্য দেশ দখল করতে উৎসাহ দিয়েছেন বিজ্ঞানে, কোনো নেতা হয়তো বা দেশ বাঁচানোর তাগিদে বিজ্ঞানীদের চেপে ধরে কাজ করিয়েছেন। দেশের কাজ করতে গিয়ে অনেক গবেষক তাঁদের আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করতে পারেননি গবেষণা পত্রিকায়। সে অবিচারের গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতিটি ছত্রে। তবে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা তুলনায় অনেক স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পান। আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণার পেছনে খরচ হয়তো পশ্চিমের মতো অতটা বেশি নয়, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বেশ কম। তবে গবেষণার ইতিহাস আলোচনায় এ প্রশ্ন উঠবেই যে কম্পিউটারের জগতে দেশে বসে কাজ করা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান কতটা? অবশ্যই নিয়মিত গবেষণা হয়ে চলেছে এই সমস্ত ক্ষেত্রের অঙ্ক, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে। তবে প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এখনও সুযোগ সুবিধে কিছুটা কম। সেই কারণেই তো ভারতবর্ষের সেরা ছাত্র-ছাত্রীরা এখনও পশ্চিমমুখী। এ দেশে সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত গবেষকদের মাইনে অবশ্যই অনেকটা বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে গবেষণায় বিনিয়োগ একেবারে অপ্রতুল। কম্পিউটার, দূর-যোগাযোগের যন্ত্রপাতি, উন্নত স্মার্টফোন এসব বানানোতেও ভীষণ পিছিয়ে আমরা, সবটাই প্রায় বিদেশ থেকে আমদানি। অর্থাৎ ছক ভেঙে বেরিয়ে বিশ্ব প্রযুক্তিকে নতুন দিশা দেখানোর মতো জায়গায় আমরা এখনও পৌঁছতে পেরেছি বলে মনে হয় না। আত্মনির্ভর ভারতের আলোচনায় এ দেশে মুঠোফোন বানানোর পরিকল্পনা শোনা যাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। যদিও রূপায়ণের বিষয়টা এখনও খুব পরিষ্কার নয়।

তবে যন্ত্র না বানালেও, বিদেশ থেকে উন্নততম প্রযুক্তি আমদানিতে সাধারণভাবে কোনো দেশের ক্ষেত্রেই তেমন কোনো বাধা নেই। ফলে প্রযুক্তির সুফল ভোগ করছে প্রায় সব দেশই। আন্তর্জাতিকতাবাদ বা বিশ্বায়নের কচকচি বিভিন্ন দেশকে যতটা কাছে আনতে পেরেছে, তার থেকে সেই দেশগুলোর মানুষকে অনেক কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে একটা মুঠোফোন, যা কিনা একই সঙ্গে একটা কম্পিউটার এবং দূর-যোগাযোগের যন্ত্রবিশেষ। আর সেই সঙ্গেই ভীষণ বিপদের মুখে পড়েছে গোপনীয়তার ধারণা। যে কোনো মানুষের হাতের যন্ত্রে অন্য কিছু লোকের বানানো বিভিন্ন রকমের অ্যাপস্ ভীষণভাবে জীবন্ত। আর অন্যকে বলতে চাওয়া প্রতিটি কথা ০ আর ১ এর দীর্ঘ বিন্যাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোলা রাজপথে। সে সব ঝামেলা সামলানোর জন্যে সুরক্ষার যে সমস্ত পদ্ধতি তাতেও প্রচুর অবদান এই কম্পিউটার আর কম্যুনিকেশন জগতের গবেষকদের। তবে মাথায় রাখবেন সেই প্রযুক্তি কিন্তু নজর রাখছে আপনার প্রতি মুহূর্তের কার্যকলাপের। ইংরিজিতে প্ৰিভেসি বলে যে শব্দটি আছে, তার পুরো দফারফা। তাই সেই জায়গায় সাবধান হতে গেলে সবথেকে সহজ উপায় কাজ না থাকলে আঙুলের চাপে মুঠোফোনকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। কিন্তু সে কথা শুনছে কে?

যে কথা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, তা হল আমাদের বসবাস এখন তথ্যের রাজপথের একেবারে মাঝখানে। ফুটপাথ পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে, ফলে সুরক্ষার প্রশ্নটা উঠে আসছে বারবার। ধরুন বড়ো রাস্তার একদম পাশে আপনার একতলা বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির এতো কাছে শপিং মল, যে ছোটবেলার গল্পে রান্নাঘর থেকে পেত্নির লম্বা হাত বাড়িয়ে লেবু পেড়ে আনার মতো সহজে আপনি পেতে পারেন যা ইচ্ছে তাই। কিন্তু সঙ্গের মুশকিলগুলোকেও মেনে নিতে হবে। গাড়ির দূষণ তো থাকবেই। দরজায় তালা দিয়ে চলে গেলে পেছন দিকের পাঁচিল টপকে কেউ সবার অজান্তে আপনার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করতেই পারে। অন্তর্জালের যুগে ব্যাপারটা একদমই তাই। আপনার হাতের কাব্যিক মুঠোফোন অথবা কোলের গণকযন্ত্র হাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতি মুহূর্তে গাদা গাদা বৈদ্যুতিন কণা আদানপ্রদান করছে দুনিয়ার যে কোনও প্রান্ত থেকে। আর এই তথ্যবাহী কণা মোটেও প্রাণহীন নয়, রীতিমতো যান্ত্রিক। ফলে অতি জীবন্ত এইসব অস্তিত্বরাশি আমাদের প্রাণপ্রিয় যন্ত্রপাতির মস্তিষ্ক থেকে হৃদয় পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে। এরপর “যেমন নাচাও তেমনি নাচি” বলে নিজেদের দোষস্খালন করাটাই একমাত্র পথ। আরও বড় দার্শনিক হলে “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” এই কথাকে অন্তর্জালের মর্মবাণী বলে মেনে নেওয়াই ভালো। সভ্যতা এতোটাই কম্পিউটার এবং অন্তর্জাল কেন্দ্রিক যে হার্ডওয়্যার, মোবাইল, কম্পিউটার, সফটওয়্যার, ভাইরাস, অ্যাপস্, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই, ব্লুটুথ, ফেসবুক, ট্যুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ এই সমস্ত শব্দ বাংলা অভিধানে শুধু ঢোকার অপেক্ষা। শহরের দূষণে ফুসফুসের দৈনন্দিন ব্যাপ্টিসিম মেনে নিয়েও আমরা যেমন সব ভুলে থাকি, হাতের মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও তাই। যথেষ্ট জ্ঞানী হয়েও আমরা মোবাইলে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বা ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের নম্বর লিখে ফেলি, সেখানেই আসে আমাদের তথাকথিত সুরক্ষাকবচ ওটিপি, আর সেই মোবাইলেই থেকে যায় অজানা অচেনা লোকের বানিয়ে দেওয়া অ্যাপ। এরপরও গভীর রাতে মার্কিন দেশের কোনো কোণা থেকে নিজের টাকা চুরি হয়ে গেলে আমরা বুক চাপড়াই, ব্যাঙ্কে গিয়ে ঝগড়া করি।

এ পর্যন্ত পড়ে যদি ভাবেন অন্তর্জালে বাজার করার সময় সুরক্ষার প্রশ্নে মোবাইল ফোনে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর দেবেন কিনা সেই নিয়ে এই আলোচনা, তাহলে ভুল ভাবছেন। বিপদ আসলে অনেক বেশি আর তার কারণ কোয়াণ্টাম কম্পিউটার, যদিও হাতিবাগানের ফুটপাথে সেটা আপনি মোটেও খুঁজে পাবেন না। বিশ্ববাজারেও সস্তায় এই ধরনের গণকযন্ত্র আপাতত পাওয়া যাচ্ছে না, তবে বিষয়টা সম্পর্কে কিছুটা খবরাখবর দেওয়ার প্রয়োজন আছে। এই প্রসঙ্গে আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক গণকযন্ত্র (কম্পিউটার) আর বৈদ্যুতিন যোগাযোগব্যবস্থার (ইলেকট্রনিক কমুনিকেশন) ব্যাপারস্যাপার। আজকের দুনিয়ার পুরোটাই এই দুই প্রযুক্তি নির্ভর। মোবাইল ফোনও একধরনের কম্পিউটার, যে কিনা যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সোজা বাংলায় আপনার জীবন-জীবিকার সমস্ত তথ্য ধরা থাকছে কম্পিউটারে আর তার আদানপ্রদান ইন্টারনেটে। এই তথ্য যে রাস্তা দিয়ে এক যন্ত্র থেকে আর এক যন্ত্রে যাচ্ছে সেটা একেবারে খোলা মাঠ। অর্থাৎ সমস্ত ইলেকট্রন কিংবা তরঙ্গ লোকজন পড়ে ফেলতে পারে (এই জায়গাটা আপাতত একটু মনে রাখুন, শেষের দিকে আবার এই আলোচনায় ফিরতে হবে কোয়ান্টামের কচকচিতে)। তাহলে প্রশ্ন হল কীভাবে দুজন মানুষ (কিংবা দুটি কম্পিউটার) গোপনীয়তা বজায় রেখে যোগাযোগ করতে পারে? আমরা যে ভাষায় কথা বলি তাতে যোগাযোগ করলে লোকজন কান পেতে পুরো কথাটাই শুনে নেবে। তখন এক অতিবাম যদি অন্য অতিবামকে খবর পাঠায় যে “রাত আটটার আগে যাদবপুরে চলে এসো”, ডানপন্থীদের সেটা জেনে যেতে কোনো অসুবিধেই হবে না। তাই দরকার অর্থহীন শব্দরাশি, যা কিনা নিশ্চিন্তে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে খোলা রাস্তার ওপর দিয়ে। অর্থাৎ দু'জন লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলবে সাংকেতিক বার্তায়। এর বাস্তবায়নের জন্যে অর্থপূর্ণ ভাষায় লেখা খবরকে অর্থহীন একটা যদ্দৃচ্ছ আকার দিতে হবে। অর্থপূর্ণ ভাষা থেকে অর্থহীন হাবিজাবিতে রূপান্তরের জন্যে দরকার এক গোপন চাবিকাঠি।

ধরুন আগে থেকে বুঝে রাখা হল যে প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণকে বদলে তার তিনটি পরের অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হবে, আর মুছে দেওয়া হবে দুটি শব্দের মাঝের ফাঁক। অবশ্য স্বরবর্ণগুলো একই রেখে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে শব্দের ফাঁক মুছে “রাতআটটারআগেযাদবপুরেচলেএসো” বদলে গিয়ে দাঁড়াবে “শাধআঢঢাশআচেবাপযভুশেঝষেএঢ়”। যিনি জানেন কীভাবে এই শব্দরাশিকে গোলমাল করে দেওয়া হয়েছে, তিনি তিন অক্ষর পেছিয়ে যাবেন। বাকিদের পক্ষে কিন্তু এর অর্থোদ্ধার করতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হবে। অর্থাৎ কোনো ব্যঞ্জনবর্ণকে যে তার কিছুটা পরের কোনো অক্ষর দিয়ে বদলাতে হবে সেটা হল নিয়ম, আর বদলানোটা যে তিন অক্ষর পরে, সেই তিনটা হল আপনার গোপন চাবিকাঠি। এই চাবিকাঠি জানেন আপনি আর আপনার দলের বন্ধুরা। অর্থাৎ নিয়ম এবং গোপন চাবিকাঠি জানা থাকলে অর্থপূর্ণ ভাষা থেকে অর্থহীন সংকেতে যেমন যাওয়া যায়, তেমনই অর্থহীন শব্দরাশি থেকে ফিরে আসা যায় অর্থপূর্ণ বার্তায়। সংকেতবিদ্যার এরকম প্রচুর উপায় এখন জানা আছে যার সাহায্যে নিশ্চিন্তে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গোপনে বার্তা পাঠানো যায় যে কোনো খোলা রাস্তায়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় ইংরিজিতে একে বলে “সিমেট্রিক কী ক্রিপ্টোগ্রাফি”, যার ইতিহাস বহু শতকের পুরনো। “সিমেট্রিক” অর্থে দুজনের কাছে একই “কী” (গোপন চাবিকাঠি), আর “ক্রিপ্টোগ্রাফি” বোঝায় সংকেতবিদ্যা। এর প্রযুক্তিগত প্রসার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। তাহলে আজকের দিনেও বৈদ্যুতিন লেনদেনে সুরক্ষা নিয়ে এত গণ্ডগোল কেন? তার কারণ গোপন চাবিকাঠি রাখা থাকে আপনার মোবাইলে, আর সেখানে চলে বিভিন্ন লোক বা কোম্পানির বানানো সফটওয়্যার। এর মাধ্যমে যদি চুরি হয়ে যায় গোপন চাবিকাঠি, সেটা জেনে যায় অন্য কোনো লোক, সেক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা যথেষ্ট। এ আসলে ভাবের ঘরে চাবি চুরি। অর্থাৎ এটা বুঝতে হবে যে সংকেতবিদ্যার যত উপায় আমাদের জানা আছে, তা সুরক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তা সুরক্ষাকে সামগ্রিকভাবে নিশ্চিত করে না।

প্রযুক্তির সুবিধা পেতে গেলে কিছুটা তো বিশ্বাস করতেই হবে। তাই আপাতত ধরে নেওয়া যাক আপনার চাবিকাঠি সুরক্ষিত। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে যে এই চাবিকাঠি তো যাদের মধ্যে বার্তা লেনদেন করা হচ্ছে তাদের দুজনকেই জানতে হবে। আজকের দিনে এমন হতেই পারে যে আপনি যার কাছ থেকে কোনো জিনিস কিনছেন সে সম্পূর্ণ কোনো অন্য দেশের ব্যক্তি। সেক্ষেত্রে গোপন চাবিকাঠিটি দুজন মিলে এক টেবিলে বসে স্থির করা যাবে না। সেটাও করতে হবে অরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। এই ধরনের উপায় অবশ্যই আছে যার পরিচিতি “পাবলিক কী ক্রিপ্টোগ্রাফি” নামে। যে অঙ্কের সাহায্যে এই রকমের গোপন চাবি অনেক দূরের দুজন মানুষ ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে সুরক্ষিত ভাবে স্থির করতে পারে তা হল গুণ এবং ভাগ। এর মূল তত্ত্ব হল “দুটি মৌলিক সংখ্যাকে গুণ করা খুব সহজ, কিন্তু শুধু গুণফল দিয়ে দিলে তার থেকে সংখ্যাদুটিকে খুঁজে বার করা অত্যন্ত শক্ত”। একটি সহজ উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। প্রথমে দেখুন ৯৭ আর ৫৩ কে গুণ করতে কত সময় লাগে। দেখবেন এটা চটজলদি হয়ে যাবে। এবার চেষ্টা করুন ২২৯১ কোন দুটি দু-অঙ্কের মৌলিক সংখ্যার গুণফল সেটা বার করতে। দেখবেন আপনার সময় লাগছে অনেক বেশি।

এ তো গেল ছোট্ট উদাহরণ। আমরা আজকাল যে ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করি তাতে এই উৎপাদক খুঁজে বার করার উপায় সত্যিই খুব শক্ত। সাধারণভাবে যে ধরনের মৌলিক সংখ্যা এখানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে তা প্রায় সাতশো ঘর লম্বা, যার প্রতি ঘরে থাকতে পারে ০ থেকে ৯ পর্যন্ত কোনো অঙ্ক। এরকম দুটো সংখ্যাকে যে কোনো কম্পিউটার (এমন কি ছোট্ট মোবাইল ফোনও) গুণ করে ফেলতে পারে যখন তখন। কিন্তু বিশ্বের সমস্ত কম্পিউটার কয়েকশো বছরের জন্যে ব্যবহার করলেও এরকম দুটো মৌলিক সংখ্যার গুণফল (যা হবে কিনা মোটামুটি চোদ্দশো ঘর লম্বা) থেকে তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বার করতে পারবেন না। এই ধরনের নীতি ব্যবহার করে সুরক্ষার উপায় জানা হয়ে গেছিল সত্তরের দশকে, যার আবিষ্কর্তা রিভেস্ট, শামির আর অ্যাডলেম্যান নামে তিন বিজ্ঞানী। তাদের উপাধির প্রথম অক্ষরগুলোকে নিয়ে একে বলা হয় “আরএসএ ক্রিপ্টোসিস্টেম”। শুনতে অবাক লাগলেও একথা সত্যি যে শুধুমাত্র এই ধরনের আঙ্কিক সুরক্ষার ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্বের সমস্ত ব্যাঙ্কে সম্পদ সঞ্চয় এবং লেনদেন করা হয়। অর্থাৎ আপনি যদি কোনো সংখ্যাকে সহজে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করার নতুন উপায় আবিষ্কার করতে পারেন তাহলে সারা বিশ্বের সমস্ত টাকাপয়সার মালিক হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে। তবে এই নিয়ে গত প্রায় দুশো বছর ধরে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা এবং তার থেকে এ ব্যাপারটা মোটামুটি নিশ্চিত যে আজকের দিনের ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারের সাহায্যে বড়ো বড়ো দুটি মৌলিক সংখ্যার গুণফল থেকে সংখ্যাদুটিকে খুঁজে বার করা বাস্তবে অসম্ভব।

বিংশ শতকের প্রথমে কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে প্রচুর কাজ হলেও, এর নিয়ম মেনে যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কথা ভাবা যায় সেকথা অনেক দিন পরে বুঝতে পারেন বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান। ১৯৮১ সালে এই বিষয়ক তাঁর বক্তৃতা ছাপা হয় পরের বছরের ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে। এরপর বেশ কিছু অঙ্ক কষার কাজ হয়, যা কিনা প্রমাণ করতে শুরু করে যে ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারের তুলনায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক বেশি তাড়াতাড়ি গণনার কাজ করতে পারে। এ নিয়ে প্রথম দিকের বিখ্যাত কাজ ডয়েশ এবং যোশা নামক দুই বিজ্ঞানীর, ১৯৯২ সালে। ১৯৯৬ সালে লভ কুমার গ্রোভার এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান যে ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারে দীর্ঘ তালিকা থেকে বিশেষ কোনো পদ খুঁজে বার করতে যা সময় লাগে, কোয়ান্টাম কম্পিউটারে লাগে মাত্র তার বর্গমূল পরিমাণ সময়। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে ইনি ভারতীয়। ১৯৮১ সালে আইআইটি দিল্লি থেকে স্নাতক হওয়ার পরে তিনি বিদেশে গবেষণা করতে চলে যান। মোটামুটি একই সময়ে কোয়ান্টামের তাত্ত্বিক গবেষণায় যুগান্তকারী কাজ করেছেন পিটার শোর। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রমাণ করেন যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে খুব সহজে বড়ো সংখ্যাকে উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা যায়, যা কিনা ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারে আজকের দিনেও জানা নেই। অর্থাৎ শোর সাহেবের গবেষণা বুঝিয়ে দিল যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার যদি সত্যি তৈরি হয়, তাহলে ডিজিটাল দুনিয়া জুড়ে যে তত্ত্বের মাধ্যমে সমস্ত সম্পদ সুরক্ষিত আছে তার দফারফা।

স্বভাবতই শোরের কাজে বিশাল শোরগোল উঠল। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করলেই তো সবটুকু বাস্তবায়িত হল না। এর জন্যে চাই সত্যিকারের কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সেই দিকে বিদেশের নামকরা জায়গায় গবেষণা চলছে প্রচুর, কিন্তু বাজারে সস্তায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার পাওয়ার ভাবনা আপাতত অলীক। তবু বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই বেশি যে এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব ভেবে নিয়ে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ প্রচুর অর্থ খরচ করছে এই সংক্রান্ত গবেষণায়। ভারতেও টুকটাক কিছু কাজ হচ্ছে তবে তা বিদেশের থেকে অনেক পিছিয়ে। সে আলোচনা আপাতত থাক। আমরা এবার একটু বোঝার চেষ্টা করি ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারের (অর্থাৎ যা আমরা ব্যবহার করি) সঙ্গে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল তফাতটা কোথায়। কোয়ান্টামের ক্ষেত্রে খেলা শুধু ০ আর ১ নিয়ে নয়, বরং তাদের ব্যবহার করে এখানে লেখা যাবে অনেক জটিল আঙ্কিক পদ। শুধু শূন্য আর পাঁচ ভোল্ট দিয়ে কাজ চলবে না, হানা দেবে ফোটন। আমার আপনার তো মাধ্যমিক কিংবা উচ্চমাধ্যমিকের পর পদার্থবিজ্ঞানের দৌড় থেমে গেছে। তাই ফোটন বুঝতে উইকিপিডিয়া স্মরণ করতে পারেন। "পদার্থবিজ্ঞানে ফোটন একটি মৌলিক কণা, তড়িৎচুম্বক ক্রিয়ায় আলো এবং অন্যান্য সকল তড়িৎচৌম্বক বিকিরণের মৌলিক একক। তড়িৎচৌম্বক বলের শক্তি সরবরাহকারী মূল কণিকাও ফোটন। ফোটন তরঙ্গ এবং কণা উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে।” ক্ল্যাসিকাল কম্পিউটারে ছিল মাত্র দুটো ভোল্টেজ নিয়ে কারবার, সেটা বদলে কোয়ান্টামে একেবারে ফোটনের অনিশ্চিত নড়াচড়া (স্পিন)। স্বাভাবিকভাবেই সেই সব ফোটনদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তাবড় বিজ্ঞানীরা। তবে গত তিন দশক ধরে এই নিয়ে গভীর কাজ হচ্ছে, এবং সামনের দু দশকের মধ্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার সংক্রান্ত প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতির আশা করছেন বিজ্ঞানীরা।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানানোর ক্ষেত্রে কাজ অনেকটা বাকি থাকলেও, সুরক্ষিত কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থায় কাজ হয়েছে প্রচুর। এর কারণ খুব অদ্ভুত। সাধারণ কম্পিউটার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হয় “বিট” যা নাকি চিরায়ত ক্ল্যাসিকাল ফিজিক্সের অন্তর্গত। কোনো একটা বিট কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা না বুঝতে পারলেও তাকে কিন্তু নকল করে ফেলা খুব সহজ। অর্থাৎ আপনার কাছে যদি থাকে একটা সিনেমার ডিভিডি, তাকে আর একটা ডিভিডিতে খুব সহজে কপি করা সম্ভব। কোনো ডিভিডি-র মধ্যে থাকা ডেটা (তথ্য) যদি গোপনীয় হয়, তাহলে তার মানে বোঝা যাবে না। কিন্তু সহজেই অন্য জায়গায় সেটার আর একটা অনুলিপি বানিয়ে রেখে দেওয়া যাবে। ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ানো সমস্ত ইলেকট্রনের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি। হাতের কাছে পেলেই তাদের প্রতিলিপি তৈরি করে রাখা সম্ভব। এর মূল কারণ তাদের ব্যাখ্যা হয় ০, নয় ১। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের ফোটনের ক্ষেত্রে এরকম করা অসম্ভব। ধরুন আমি নিজে একটা ফোটন বানিয়েছি যার সম্পূর্ণ প্রকৃতি আমার জানা আছে। কিন্তু সেই ফোটনের প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু না জানিয়ে আমি যদি আপনাকে তা হস্তান্তর করি, যা কিনা একটা কিউবিট হিসেবে ভাবা হচ্ছে, তাহলে সেটা আপনার পুরো দখলে রেখেও তার কোনো প্রতিলিপি আপনি বানাতে পারবেন না। যদি সে চেষ্টা করেন, অথবা তার সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করেন, সেক্ষেত্রে ফোটনটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যাবে। ১৯৯২ সাল নাগাদ এ ব্যাপারটি সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে আলোকপাত করেন ঊটার আর জুরেক এবং স্বতন্ত্রভাবে ডিয়েক। এই বিষয়টি বিজ্ঞানীমহলে জনপ্রিয় “নো-ক্লোনিং থিওরেম” নামে।

সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ এক দারুণ খবর। আপনার সব তথ্য রয়ে যাবে আপনার কাছে, কারণ সেই কিউবিটগুলো বানিয়েছেন আপনি নিজে। আপনি চাইলে আপনার বন্ধুদের কাছে প্রকাশ করে দেবেন সেগুলোর ধর্ম। কিন্তু অন্য কেউ যদি সেগুলো সম্বন্ধে জানতে চায়, সেক্ষেত্রে ফোটনের গুড়ে বালি। অর্থাৎ একদিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটার চট করে বড়ো সংখ্যার উৎপাদক খুঁজে বার করতে সমর্থ, যার ফলে ক্ল্যাসিকাল ক্রিপ্টোগ্রাফি বিপর্যস্ত। আবার সে-ই কিনা অন্য উপায়ে আমাদের সামনে হাজির করছে বিপুল সুরক্ষার সম্ভাবনা। এই উপায় আপাতত সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রযুক্তিতে এক নতুন দিগন্ত এনেছে। এমনকি এই ধরনের প্রযুক্তির বাস্তবায়নও হয়ে গেছে এর মধ্যে। এই বিষয়ে বেনেট আর ব্রাসার্ড নামে দুই বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র “কোয়ান্টাম কী ডিস্ট্রিবিউশন” প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে বাঙ্গালোরের একটি বৈজ্ঞানিক অধিবেশনে। অর্থাৎ সত্যিই যদি ভবিষ্যতে কখনও কম পয়সায় কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানিয়ে সুইস ব্যাঙ্কের সুরক্ষার বারোটা বাজানো যায়, তার সমাধানও ইতিমধ্যেই বাস্তবায়িত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরীক্ষামূলক সফলতা পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে চিন আর অস্ট্রিয়ার মধ্যে সুরক্ষিতভাবে পাঠানো গেছে একগাদা কিউবিট, যার ধারক এবং বাহক পদার্থবিদ্যার ভরহীন ফোটন কণা কিংবা তরঙ্গ।

উপসংহারে সারমর্ম হিসেবে বলা যায় যে ফোটনের এই দ্বৈত সত্তাকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যথেষ্ট পোষ মানানো গেছে, কিন্তু বানানো বাকি আছে শুধু সস্তায় পুষ্টিকর বাজারি কোয়ান্টাম কম্পিউটার। আপাতত সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন না হলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের তত্ত্ব এবং প্রযুক্তি এগিয়ে চলেছে দ্রুতবেগে। গুগুল কিংবা আইবিএম বানিয়ে ফেলেছে ছোটোখাটো কোয়ান্টাম কম্পিউটার। সে নিয়ে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তর্ক বিতর্কও চলছে অনেক। সব মিলিয়ে কোয়ান্টাম গণকযন্ত্র এবং তার নিরিখে ফোটন ব্যবহার করে সুরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা আজকের প্রযুক্তি গবেষণায় অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। কোভিড জমানাতেও সে গবেষণা থেমে নেই।