আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সমসাময়িক

অনলাইন পুলিশি


যেই সরকার মানুষের খাদ্য কী হবে তা নিয়ে মাথা ঘামায়, যেই রাজনৈতিক দল মানুষ কার সঙ্গে কে প্রেম করবে বা করবে না, তা নিয়ে ফরমান দেয়, যারা মনে করে যে সরকারের বিরোধীতা দেশদ্রোহ, তারা যে অনলাইনে পুলিশি করতে চাইবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। একটি বিজ্ঞপ্তির দ্বারা সরকার নিউজ ওয়েবসাইট এবং আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্সের মতন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে সরাসরি সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের আওতায় নিয়ে এসেছে। আগে এই মাধ্যমগুলি সরকারের ইলেক্ট্রনিক্স দপ্তরের অধীন ছিল, যেখানে ইনফরমেশন টেকনোলজি আইনের আওতায় তারা আসত। এখন সরকার সরাসরি খবরদারি করার উদ্দেশ্যে এই মাধ্যমগুলিকে তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধীনে নিয়ে এল।

আমাজন, নেটফ্লিক্স তথা অনলাইন পোর্টালগুলিতে এমন অনেক কিছু দেখানো হয়েছে যা বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলবে। নেটফ্লিক্সে সদ্য প্রকাশিত ভারতের চোর ডলার বিলিয়নেয়ারদের নিয়ে তথ্যচিত্র দেখানো নিয়ে আদালত অবধি মামলা গড়িয়েছে। পাতাললোক, ঘাউলের মতন সিরিজ সরাসরি বর্তমান রাজনৈতিক নেতা ও হিন্দু রাষ্ট্রের রাজনীতিকে আক্রমণ করে। আবার দ্য ওয়ার, স্ক্রোল, নিউজলণ্ড্রীর মতন ওয়েবসাইটে লাগাতার মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সত্যকে সামনে রেখে সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। অনলাইন হওয়ার ফলে মোদী সরকার সরাসরি এই মাধ্যমগুলিতে নিজেদের নাক গলাতে পারেনি এতদিন। এবারে সেই চেষ্টাই করা শুরু হল।

ইন্টারনেট তৈরি হয়েছিল এমন এক মাধ্যমের কল্পনা নিয়ে যেখানে রাষ্ট্রের খবরদারির বাইরে মানুষ সহজে তথ্যের আদানপ্রদান করতে পারবেন। কিন্তু শুরুর থেকেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা বারবার ইন্টারনেট স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করে এসেছে। চীন বা রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়া যেমন একদিকে রয়েছে, যেখানে ইন্টারনেট স্বাধীনতা বলে আদতে কিছু নেই। তেমনি ভারতে লাগাতার এই স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী ইন্টারনেট স্বাধীনতার নিরিখে ভারত ৫৫তম স্থানে রয়েছে। বেশ কিছু বছর ধরে ফেসবুক থেকে কন্টেন্ট সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ সব থেকে বেশি গেছে ভারত সরকারের তরফে। অন্যদিকে, ফেসবুক বা ট্যুইটারে সরকার বিরোধী কোনো বক্তব্য লিখলে বহু মানুষকে বিজেপি-র কর্মীদের অত্যাচার, মারধোর সহ্য করতে হয়েছে।

এবারে তার সঙ্গে যুক্ত হল সরাসরি অনলাইন মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার সরকারী নির্দেশ। অনেকে বলছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যৌনতা, গালিগালাজ বেশি দেখানো হচ্ছে, তাই এগুলি নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। যেকোনো সিরিয়াল বা অনলাইন সিরিজের নির্দিষ্ট বয়স সীমা রয়েছে। সেগুলি মেনে চলা ব্যক্তির দায়িত্ব। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তার পছন্দ মতন যৌনতা বা গালিগালাজ সম্পন্ন সিরিজ কেন দেখতে পারবেন না? প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের রুচি অনুযায়ী তিনি তা দেখবেন বা পরিত্যাগ করবেন। রাষ্ট্র কেন জনগণকে শিশুর মতন কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক এই জ্ঞান দেবে? যদি কোনো আইনের সীমা লঙ্ঘিত হয়, তার জন্য ইনফরমেশন টেকনলজি আইন বা ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্যান্য ধারা রয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্র বারবার মানুষের পছন্দ-অপছন্দের উপর কেন হস্তক্ষেপ করবে? এইভাবেই নিয়ন্ত্রণকামী ফ্যাসিস্ত শক্তির হাত শক্ত হয়।

তাহলে কি কোনো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন নেই? সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের ১৫টি ওটিটি বা অনলাইন সিরিজ প্ল্যাটফর্ম আত্মনিয়ন্ত্রণের কিছু বিধি প্রকাশ করে। সেখানে তারা জানিয়েছে যে কোনো সিরিজ কোন বয়সী দর্শকের জন্য উপযুক্ত, তাতে হিংসা বা যৌনতা অথবা গালিগালাজ রয়েছে কি না তা আগে থেকে জানানো হবে যাতে উপভোক্তা নিজের পছন্দ অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেখতে পারেন। এর পরে এই প্রশ্নে সেন্সর বোর্ডের মতন সংগঠনকে নিয়ে আসার কোনো মানে নেই। ভারতে বহু বছর ধরে সেন্সর বোর্ড কাজ করছে। কিন্তু ভারতের চলচ্চিত্রে তারা কী উদ্ভাবন নিয়ে আসতে পেরেছেন? বর্তমানে, সেন্সর বোর্ড রাজনৈতিক দাবা খেলায় শাসক দলের বোড়ে হয়ে গেছে। শাসক দলের মনমর্জি মতন সেন্সর ছাড়পত্র দেয় বা দেয় না।

আসলে, মত প্রকাশের অধিকার বা শিল্পীর অধিকারের মাপকাঠি তার শিল্প। সেখানে বাকিদের পুলিশগিরি রাষ্ট্রের মতাদর্শকেই জোর করে শিল্পীর উপর চাপিয়ে দিতে চায়। অবশ্যই বিদ্বেষমূলক ক‌োনো সৃষ্টি বা পর্নোগ্রাফির কথা আমরা বলছি না। এর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট আইন আছে যা প্রয়োগ করা উচিত। কিন্তু কিছু জ্যাঠামশাই বসে ঠিক করে দেবে কোনটা দেখা যাবে আর কোনটা দেখা যাবে না, তা একটি সমাজের শৈল্পিক বিকাশের জন্য মোটেই কাম্য নয়।

মনে রাখতে হবে, এই দেশে খাজুরাহো মন্দির কয়েক শতাব্দী আগে তৈরি হলেও অশ্লীলতার দায়ে মকবুল ফিদা হুসেনকে দেশ ছাড়তে হয়, ভেঙে দেওয়া হয়েছে বহু শিল্প প্রদর্শনী, মারা হয়েছে হাবিব তণভিরের মতন নাট্যকারকে, ভাঙা হয়েছে ফিল্পের সেট এবং সিনেমা হল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংঘ পরিবারের লুম্পেনরা তাদের প্রভুদের আশীর্বাদধন্য হয়ে এই সব কাজ করেছে। এমনকি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাওয়ার পরেও বিভিন্ন ফিল্মের বিরুদ্ধে হিংসার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, সাংগঠনিকভাবে কিছু জ্যাঠামশাইকে অনলাইন কন্টেন্টের তদারকি করতে দেওয়া হলে সমস্যা কমবে না বাড়বে। রাষ্ট্র তথা শাসকদলের মতাদর্শকে শিল্পী তথা সাংবাদিকদের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এই পরিবর্তন। আগামীদিনে, অনলাইন মাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং তাকে চাপ দিয়ে ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিকতম এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করা প্রগতিশীল শক্তির অবশ্য কর্তব্য।