আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ সপ্তদশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২০ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৭

সমসাময়িক

সংক্রমণ আবহে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ


স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন সম্প্রতি (অক্টোবর ২৮, ২০২০) পরিণত বয়সে (৯৫) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ভারতের প্রায় ১০০ শতাংশ মানুষই তাঁর নাম শোনেননি। মেঘালয়ের প্রত্যন্ত প্রান্তের সামান্য কিছু লোকজন তাঁকে জানতেন। তাঁদের কাছে তিনি ছিলেন 'কঙ স্পেলিটি'। তাঁকে চিনত মেঘালয় সরকার। তাঁর দুর্দমনীয় প্রতিবাদী মানসিকতাকে সমীহ করত ভারত সরকারের সংস্থা ইউরেনিয়াম করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড সংক্ষেপে ইউসিআইএল।

ভারতে সবচেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম আকরিক মজুত রয়েছে উত্তর-পূর্বের পার্বত্য রাজ্য মেঘালয়ের ভূগর্ভে৷ বিশেষজ্ঞদের অনুমান মেঘালয়ের ডমিয়াসিয়াট, লস্টোওন এবং ওয়াখিন এলাকায় মজুত রয়েছে প্রায় ৯২ লক্ষ টন ইউরেনিয়াম৷ দেশের পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির প্রয়োজনে ইউসিআইএল সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলায় ইউরেনিয়াম আকরিক উত্তোলনের একটি প্রকল্প প্রণয়ন করেছিল৷ তবে এখনও বাস্তবায়িত হয়নি৷ কেন?

সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় থাকার জন্য মেঘালয়ে বহিরাগতদের জন্য জমি বাড়ি কেনা-বেচা আইনত নিষিদ্ধ। প্রথম দিকে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় গ্রাম প্রধানদের বুঝিয়েসুজিয়ে কাজ শুরুর অনুমতি আদায় করে। কিছুটা জমিও পাওয়া যায়। গাছপালা কেটে জমি সমতল করে রাস্তাঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হয়। স্থানীয় মানুষের মনে দ্বিধা ছিল। তবুও মনে হয়েছিল যে স্বতন্ত্র রাজ্য হওয়ার পর (২১ জানুয়ারি ১৯৭২) বোধ হয় মেঘালয়ে উন্নয়নের বাতাস বইতে শুরু করেছে। ইউসিআইএল-এর কথায় বিশ্বাস করে অনেকের ধারণা হয় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে এলাকার উন্নতি হবে। রাস্তাঘাট দোকানপাট তৈরি হবে। স্থানীয় যুবক-যুবতীরা কাজ পাবে। এতসব দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যেই ১৯৯২ নাগাদ শুরু হল ইউরেনিয়াম খনি তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজকর্ম।

কঙ স্পেলিটি এক প্রবীণ গৃহবধূ। শিলং থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরের সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলার ডমিয়াসিয়াট এলাকার বাসিন্দা কঙ স্পেলিটি খেয়াল করলেন ইউরেনিয়াম খনন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। গৃহপালিত পশুগুলিও অসুস্থ হচ্ছে। এমনকি মারাও যাচ্ছে। কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। নদীর মাছ মরে যাচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমে কলোরাডো নদীর গিরিখাত জুড়ে বসবাস করা নাভাজো জনজাতির মানুষ কিন্তু বুঝতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর হাত ধরে পরমাণু বোমা তৈরির সময় থেকেই এই এলাকায় শুরু হয়েছিল ইউরেনিয়াম খনন। ম্যানহাটন প্রজেক্ট জন্ম দিয়েছিল পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে চমকপ্রদ ও ভয়ানক ঘটনা। কিন্তু চাপা পড়ে গিয়েছে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আধিপত্য বিস্তার ও জনজাতি ধ্বংসের নির্মম ইতিহাস। ১৯১৫ সালে বেলজিয়ামের শাসনাধীন কঙ্গোর শিঙ্কোলোবুই প্রদেশে ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বের সন্ধান দেন ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ রবার্ট রিচ শার্প। এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে ইউরেনিয়াম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়। সুসান উইলিয়ামস লিখিত ‘স্পাইসেস ইন দ্য কঙ্গো’ বইতে ছড়িয়ে আছে ইউরেনিয়াম খনির কার্যকলাপের যাবতীয় খুঁটিনাটির বিবরণ। বিভিন্ন পথ ঘুরে, সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় পাচার করা হত ইউরেনিয়াম। শিঙ্কোলোবুই গ্রামের মানুষকেই সেই কাজে লাগানো হত। এই অঞ্চলের মানুষ আজও শরীরে বহন করে চলেছেন ইউরেনিয়ামের বিষ। কঙ্গোর মতোই ম্যানহাটন প্রজেক্টে ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছিল কানাডার গ্রেট বেয়ার লেক সংলগ্ন খনি। ১৯৩০ সালে সেখানে ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া যায়।

শুধুমাত্র নাভাজো, শিঙ্কোলোবুই বা কানাডার গ্রেট বেয়ার লেক অঞ্চলে নয়, গোটা বিশ্বেই ইউরেনিয়াম খনন জনিত দূষণে স্থানীয় জনজাতির মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। খনি তৈরির জন্য তাঁদের বাসভূমি কৃষিজমি হারাতে হয়। তার উপর রয়েছে তেজস্ক্রিয়তা। সেই জন্যেই হয়তো আরেক ভুক্তভোগী অস্ট্রেলিয়ার প্রাচীন জনজাতিদের গান ও প্রচলিত গল্পগুলোয় বারে বারে উচ্চারিত হয় - পৃথিবীর বুকের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে বিষ। সেই বিষকে সেখানেই থাকতে দিতে হয়। এই সাবধানবাণীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতেই বোধ হয় ২০২০-র ১৬ জুলাই এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের মঞ্চে বিশ্বের প্রথম ইউরেনিয়াম অ্যাটলাস প্রকাশ করল জার্মানির রোজা লুমেক্সবার্গ ইনস্টিটিউট।

এই বইয়ে নথিভুক্ত হয়েছে গোটা বিশ্বের ইউরেনিয়াম খননের মানচিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত কোন দেশ কত পরিমাণ ইউরেনিয়াম খনন করেছে, কোন কোন খনিতে এখনও কাজ চলছে এবং কোন খনি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, রয়েছে তারও সম্পূর্ণ খতিয়ান। তবে এই বই প্রকাশের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র তথ্যপ্রদান নয়, বরং ইউরেনিয়াম খননের ফলে যাঁরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

বইপ্রকাশের তারিখটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে ট্রিনিটি টেস্ট-এর হাত ধরে জন্ম নিয়েছিল প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র। এই ইতিহাস কমবেশি সকলের জানা। কিন্তু ১৯৭৯-র চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিল-এর ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার কথা তেমনভাবে আলোচিত হয় না। এই দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই নাভাজো জনজাতির মানুষ। এই ঘটনায় দূষিত হয়ে যায় নাভাজোদের নদী-সহ সমস্ত জলাধার। ফল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মারণরোগ বহন। চার্চ রক ইউরেনিয়াম মিলের দুর্ঘটনার দিনটাও ছিল ১৬ জুলাই। তেজস্ক্রিয়তা ও জনজাতির বিপন্নতাকে প্রচারের আলোয় আনার জন্যেই হয়তো বই প্রকাশের তারিখ হিসেবে ১৬ জুলাই নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তেমন প্রচার হল কী? চূড়ান্ত বিচারে মুনাফা ভিত্তিক বিশ্ব বাজারে ইউরেনিয়াম খনন যে অন্যতম লাভজনক ব্যবসা।

কঙ স্পেলিটি কিন্তু এতসব জানতেন না। নিজের পর্যবেক্ষণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা শুরু করলেন। একই সঙ্গে শুরু করলেন প্রচার। বিকিরণের ভয়াবহতা সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন হয়তো পুরোপুরি না হলেও নিজের নিজের অভিজ্ঞতায় কিছুটা বুঝতে পারলেন। ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার বার্তা পাঠালেন কঙ স্পেলিটি ওরফে স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন-এর নেতৃত্বাধীন প্রমীলা বাহিনী। ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ইউসিআইএল অনেক কাকুতিমিনতি করে তাঁর কাছে আবেদন নিবেদন জানাতে থাকে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে অর্থ দিয়ে তাঁদের স্বাধীনতা কেনা যাবে না। নিজের বাড়ির সামনে টাঙিয়ে দিলেন 'ব্যক্তিগত সম্পত্তি' এবং 'অবৈধভাবে প্রবেশ নিষেধ' লেখা বোর্ড। শুরু হয় এক গণ-আলোড়ন। ফলে ইউসিআইএল কোনোরকমে খুঁড়ে ফেলা খনি গহ্বরের মুখে পাথর চাপা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। সেই পাথর আজও সরেনি।

এতদিন বিষয়টি চাপা পড়ে থাকার পর হঠাৎ করে ২০২০-র অক্টোবর মাসে ডমিয়াসিয়াট আবার একবার সংবাদের শিরোনামে চলে আসায় চতুর্দিকে সাড়া পড়ে গেছে। মেঘালয়ে ইউরেনিয়াম খনির বর্জ্য বাইরে বেরিয়ে আসছে বলে উদ্বিগ্ন স্থানীয় মানুষের অভিযোগ পেয়েই সরকার বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সাউথ ওয়েস্ট খাসি হিলস্ জেলার ইউরেনিয়াম খনি প্রকল্প এলাকায় তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ বিভিন্ন পরীক্ষায় ধরা পড়েছে বলে স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা, বিষাক্ত ইউরেনিয়াম বর্জ্য বাইরে বেরিয়ে আসছে৷ তবে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই চলে গেলেন কঙ স্পেলিটি অর্থাৎ স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিন।

কঙ স্পেলিটি রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন না। চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি। খেলোয়াড় হিসেবে কোনো পরিচিতি নেই। এখন তো আবার এইসব পেশার মানুষই প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত। এমনকি প্রমথ নাথ বসু-র মতো বিখ্যাত ভূ-তাত্ত্বিক তথা শিক্ষাবিদের পরিচয় দেওয়ার সময় প্রথমেই বলা হয় তিনি চলচ্চিত্রকার ও অভিনেতা মধু বসুর পিতা। জামশেদপুরের ইস্পাত কোম্পানি কিন্তু তাঁকে মনে রেখেছে। সংস্থার প্রধান ফটকে স্থাপিত রয়েছে প্রমথ নাথ বসু-র আবক্ষ মূর্তি। ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষা করে জামশেটজী টাটা-কে এখনকার জামশেদপুরে ইস্পাত উৎপাদনের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রমথ নাথ বসু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংস্করণ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের জন্য যাঁরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যেও ছিলেন প্রমথ নাথ বসু। এবং তিনি ছিলেন জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রথম অধ্যক্ষ।

প্রমথ নাথ বসু-র মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট ভূ-তাত্ত্বিক তথা শিক্ষাবিদ আজ বিস্মরণের আড়ালে হারিয়ে গেছেন। সেখানে কঙ স্পেলিটি বা স্পেলিটি লিংডো লাংগ্রিনকে কে মনে রাখবে? তাঁকে তো মেঘালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক দুর্গম গ্রামের স্বল্পসংখ্যক ক্ষতিগ্রস্ত জনজাতির মানুষ ছাড়া আর কেউ চেনেই না! হয়তো এটাই বাস্তব। তবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বিরোধী যে আলোড়নের সূচনা তিনি করে দিয়ে গেছেন তা তো হারিয়ে যাওয়ার নয়। বিশেষত এখনকার অল্পবয়সী যুবক-যুবতী যাঁরা মুঠোফোনের পর্দায় পৃথিবীকে দেখতে অভ্যস্ত তাঁরা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে অনেক বেশি খবরাখবর রাখেন। নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতায় এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বিষয়ে প্রতি মুহূর্তের ঘটনা নজরে থাকায় তাঁরা নিজেদের বাসভূমি এবং কৃষিজমি রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। আপাত দৃষ্টিতে কঙ স্পেলিটি অনালোচিত অপরিচিত নাম হলেও জনজাতির স্বার্থ রক্ষায় তাঁর অবদান ইতিমধ্যেই স্বীকৃত। একই সঙ্গে ভারতের ইউরেনিয়াম চর্চার ক্ষেত্রে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।