আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস’

গৌতম সরকার


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে সমাজ ও সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, তার সঙ্গে তাল রেখে বেড়ে চলেছে মানুষের চাহিদা। আরো ভালো আরো ভালো ভাবে বাঁচার নেশায় মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, আর নির্বিচারে পরিবেশ-প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, আর তাদের সেই অবিমৃষ্যকারিতার ফল হয় তারা নয়তো তাদের পরের প্রজন্ম ভোগ করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা তারা কেন করছে? পরিবেশ দূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের মারাত্মক ফল সম্বন্ধে আমরা সকলেই ওয়াকিবহাল, কিন্তু তবু নিরাসক্তভাবে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে চলেছি... কেন? উত্তরটা লুকিয়ে আছে আমাদের প্রবন্ধের শিরোনামে, ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস’।

এই লেখাটির জন্যে কিছুটা পড়াশোনা করতে গিয়ে একটা আর্টিকেল চোখে পড়লো। আর্টিকেলটি একটি বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে বেরিয়েছিল। আর্টিকেলটি আমরা যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি সেটার সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত না হলেও, তার উপসংহারের প্রতিপাদ্য বিশ্বাসের সাথে আমাদের আলোচনাটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। আর্টিকেলটির নাম - ‘National Security in Nuclear World.’ সেই আর্টিকেলের উপসংহারে J. B. Wiesner এবং H. F. York বলেছেন, “Both sides in the arms race are... confronted by the dilemma of steadily increasing military power and steadily decreasing national security. It is our considered professional judgement that dilemma has no technical solution.” প্রবন্ধটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দাবি হলো, কিছু কিছু সমস্যা আছে যার কোনো প্রায়োগিক সমাধান নেই। অর্থাৎ মানবজাতির সমস্ত সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি হাতে তুলে দিতে পারেনা, কিছু সমাধানের রাস্তা খুঁজতে তার বাইরেও কিছু ভাবতে হয়। প্রায়োগিক সমাধান বলতে বোঝায়, যেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কৌশলগত পরিবর্তন বা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাধানের পথ বের করা হয়, মানুষের আচরণগত এবং চরিত্রগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়না। তাই যে সমস্যার সমাধান বিজ্ঞানের রাস্তায় আসেনা, সেখানে মানবিক মূল্যবোধের পরিবর্তন খুব জরুরী। আর যেহেতু এই মূল্যবোধ বাইরে থেকে আইন করে চাপিয়ে দেওয়া যায়না, তাই মানুষ এ'ব্যাপারে ব্যবহারিক পরিবর্তনের কোনো দায় অনুভব করেনা, আর সেখানেই ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমনস’ চূড়ান্ত রূপ পায়।

ব্যাপারটি খোলসা করে বোঝার জন্য একটি গল্প শোনা যাক -

মধ্যযুগীয় এক ছোট্ট শহরের মানুষদের অন্যান্য জীবিকার সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ জীবিকা ছিল মেষপালন। শহরের প্রায় প্রত্যেক পরিবারেরই নিজস্ব মেষ ছিল এবং মেষের উল বিক্রি করে তাদের সংসার চলতো। এই সমস্ত মেষ শহরের চারিপাশে যে ঘাসজমি ছিল (কমনস) সেখানে মনের আনন্দে চরে, ঘাস খেয়ে বড় হচ্ছিল। এই ঘাসজমির কোনো নির্দিষ্ট মালিক ছিল না, শহরের সমস্ত পরিবার যৌথভাবে এর মালিকানাস্বত্ব ভোগ করতো; তাই বিনা বাধায় সকলেই নিজ নিজ মেষ এই তৃণভূমিতে চরাতে পারতো। প্রাথমিকভাবে সমস্ত পরিবার এতে উপকৃত হয়েছিল, কারণ প্রত্যেকের মেষগুলি ঘাস খেয়ে বড় হয়ে উঠছিল এবং তাদের উল বিক্রির টাকায় প্রতিটি পরিবারের উপার্জন বাড়ছিলো।এই অর্থনৈতিক উন্নতির পিছনে মূল কারণটি ছিল - মেষের সংখ্যা সীমিত এবং তৃণভূমির বিস্তার অগাধ।

কিন্তু এই লাভজনক সমীকরণ বেশিদিন থাকল না। আর্থিক লাভের আশায় প্রত্যেক পরিবারে মেষের সংখ্যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে লাগলো এবং একটা সময়ের পর তৃণভূমির ধারণ ক্ষমতার থেকে মেষের সংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায়, সবুজ তৃণভূমি আস্তে আস্তে এক ধুসর ভূমিখণ্ডে পরিণত হলো, অর্থাৎ পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে গেল। ফলতঃ এতদিনকার লাভজনক এক পেশা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে শহরের অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রভাব পড়লো।

এখন স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা উঠে আসে, কি কারণে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটল? মেষপালকরা কোন নেশায় তাদের মেষের সংখ্যা এমন ভাবে বাড়ালো যাতে শহরের একদা গর্বের তৃণভূমি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেল? মূল কারণ নিহিত আছে দ্রব্যটির প্রকৃতির উপর। এখানে দ্রব্যটি হলো ‘সর্বসাধারণের সম্পদ’ (common resource) অর্থাৎ যে সম্পদে কারোর ব্যক্তিমালিকানা নেই। এই ধরণের দ্রব্যের বৈশিষ্ট্য হলো দুটি: ১. নন-এক্সক্লুডেবল, অর্থাৎ এই সম্পদের ব্যবহার থেকে কাউকে বিরত করা যাবেনা; এবং ২. রাইভ্যাল ইন কনসামশন, অর্থাৎ এই সম্পদ কেউ ব্যবহার করলে, অন্যদের ভাগে পড়ে থাকা সম্পদের পরিমাণ কমে যায়। এখান থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, প্রত্যেক পরিবার দ্রব্যটির প্রথম বৈশিষ্ট্যের সুযোগ গ্রহণ করেছে এবং দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের আশঙ্কায়, সর্বজনের সম্পদ বেশি বেশি ভোগের তাড়নায় সার্বজনীন বিপদটি ডেকে এনেছে। এর সাথে যেটা যুক্ত হয়েছে সেটা হলো, কোনো একটি পরিবার যখন একটা বা দুটো মেষের সংখ্যা বাড়িয়েছে তখন তারা এটাই ভেবেছে, একটা-দুটো মেষ বাড়লে কী বা এসে যায়, দুটো মেষ কতটুকুই বা ঘাস খাবে! কিন্তু সমস্যা হল সব পরিবার একই ভাবনা ভেবেছে এবং সেই ভাবনার সামগ্রিক প্রতিফলন একটা সুন্দর ও ভীষণ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে দিয়েছে। অথচ এই সম্পদ যদি কারোর ব্যক্তিমালিকানায় থাকতো, সে কিন্তু কখনোই এই কাজ করত না, সবসময় তৃণভূমির উৎপাদন এবং মেষের সংখ্যার মধ্যে একটা ভারসাম্য রেখে চলত। অর্থাৎ যে সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানা স্বত্ব নেই অর্থাৎ সামাজিক সম্পদ সেটি রক্ষা করার কোনো দায়বদ্ধতা সাধারণ মানুষ অনুভব করে না। অন্যদিকে সর্বসাধারণের সম্পদ কে কত বেশি ভোগ করতে পারে তার একটা তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হল - ধ্বংস। আপনি আপনার বাড়ির লনটির সাথে পাশের রাস্তাটির তুলনা করুন - ঝকঝকে তকতকে লনের পাশেই নোংরা আবর্জনায় ভরা রাস্তাটি বড়ই বেমানান। আপনি লনে কখনই থুতু ফেলেন না, কিন্তু রাস্তায় অক্লেশে ফেলেন, আপনি ঘরে ঢোকার আগে যাবতীয় আবর্জনা রাস্তায় ফেলে আসেন, সেই কারণেই তো রাস্তা অপরিষ্কার আর আপনার ঘর অনাবিল। সেই একই পথ অবলম্বন করে আমরা তৃণভূমি, রাস্তার সাথে সাথে বাতাস, জল, নদী, সাগর, নালা-নর্দমা নিয়ে সমগ্র প্রকৃতিকে কলুষিত করে চলেছি। আর এসমস্ত কিছু করছি জীবনে আরও বেশি আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, মর্যাদা কিনতে। কিন্তু তার জন্য পরিবেশ, প্রকৃতিকে যে মূল্য চোকাতে হচ্ছে তার হিসাব রাখি না বা রাখলেও পাত্তা দিই না, কারণ সেটি আমার ব্যক্তিগত ভোগে বা সম্পদে কোনো আশুপ্রভাব ফেলছে না।

তাহলে এর হাত থেকে পরিত্রানের উপায় কী! এইভাবে চলতে থাকলে সমগ্র পৃথিবীটাই তো ওই তৃণভূমির মতো রুক্ষ, শুষ্ক, প্রাণহীন এক গ্রহে পরিণত হয়ে পড়বে! বিশেষজ্ঞরা তাদের মত কিছু কিছু উপায় বাতলেছেন, সব উপায়গুলিতেই সরকারের যোগদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সরকার কতকগুলি ব্যবস্থা গ্রহণ মারফত সর্বসাধারণের সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারে। তৃণভূমিকে বাঁচানোর জন্য দেশের সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। যেমন, এক, পরিবার পিছু মেষের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়া; দুই, মেষ পিছু কর ধার্য করা; এবং তিন, খোলাবাজারে নিলাম করে মেষপালনের অনুমতিপত্র বিক্রয় করা। এই তিনটি পদ্ধতিতেই যেহেতু মেষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে মেষপালককে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যেতে পারে মেষের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই থাকতো এবং ট্র্যাজেডি অব কমনস-এর মতো ঘটনা ঘটত না। বিপদ কিন্তু সম্পূর্ণভাবে কাটল না, এত সহজে সমস্যার সমাধান হলে সমগ্র বিশ্বে আজ কোভিড-১৯ লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি আর কোটি কোটি মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখত না। পৃথিবীতে আরেক ধরনের মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ আছে যেগুলো এরকম সরকারী নিয়মের বেড়াজালে আটকানো সম্ভব নয়। যেমন বাতাস - বিভিন্ন কলকারখানা এবং গৃহস্থ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া, ধুলো এবং দূষিত গ্যাস বাতাসকে কলুষিত করছে আর তার ফলে মানুষ বিভিন্ন ধরনের অসুখের সম্মুখীন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাড়িতে, কারখানায়, অফিস, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালে ব্যবহৃত ঠান্ডা মেশিন থেকে নির্গত গ্যাস (ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন) অন্তরীক্ষের ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব কমিয়ে দিয়ে সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মির পৃথিবীতে পৌঁছনোর পথ সুগম করে দিচ্ছে, তার ফলেও আবার মানুষ বিভিন্ন রোগের শিকার হচ্ছে। কারখানার বর্জ্য নদী, সমুদ্র, জলাশয়কে দূষিত করে জলে বেঁচে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। ক্যাপিটালিস্টিক সোসাইটিতে এই সবকিছুই নির্বিচারে ঘটে চলেছে আরো আরো মুনাফা লাভের নেশায় এবং আরো বেশি ভোগের মোহে। সর্বোপরি এইভাবে পরিবেশকে দূষিত করার জন্যে আমাদের দেশে দূষণকারীকে কোনো ট্যাক্স দিতে হয়না। তাই পরিবেশ দূষণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের খুশিমত উৎপাদন আর ভোগের সমুদ্রে আমরা ডুবে রয়েছি, আর আমাদের সেই অবিমৃষ্যকারী কার্যকলাপ আরও ভয়ংকর ভয়ংকর ‘ট্র্যাজেডি অব কমনস‘দের ডেকে আনছে।

উন্নত দেশগুলিতে উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদকদের উপাদানের সাথে সাথে দূষণ ব্যয়ের দায়ও বহন করতে হয়। সরকার হয় একক পিছু উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূষণকর ধার্য করে, অথবা বাধ্যতামূলকভাবে উৎপাদন পদ্ধতিতে দূষণ লাঘবকারী কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নির্দেশ থাকে। এতে করে উৎপাদন ব্যয় যায় বেড়ে এবং মুনাফা যায় কমে। ফলতঃ যে সমস্ত দ্রব্যোৎপাদন বেশি দূষণ সৃষ্টি করে উন্নত দেশগুলো সেগুলো উৎপাদন না করে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলি থেকে আমদানি করে। দূষণ সংক্রান্ত সরকারি শিথিল নিয়মকানুনের সুবিধা নিয়ে ভারতবর্ষের মতো গরিব দেশগুলি রপ্তানি বাড়িয়ে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের লোভে সেই সমস্ত দ্রব্যগুলি তৈরি করছে আর পরিবেশ-প্রকৃতি, সমগ্র জীবকুলকে ভয়ানক বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মোট জাতীয় আয়, মাথাপিছু জাতীয় আয়, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদি জাতীয় সমস্যাগুলোর কথা ভেবে সরকার এই ব্যাপারে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারছে না - সেটা যেমন সত্যি, তেমনি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে নীতিজ্ঞান পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে দূষণের খেলায় মেতে উঠেছে সেটাও নির্মমভাবে সত্য।

সরকার হয়তো একদিন এ'ব্যাপারে কড়া আইন প্রণয়ন করবে। কিন্তু সেই নিয়ম যতদিন না সর্বান্তকরণে সমর্থন করে প্রতিটি নাগরিক সম্পূর্ণভাবে মেনে চলছে ততদিন সবচেয়ে ভয়ংকর ‘ট্র্যাজেডি অব কমনস'-এর বিষ নিঃশ্বাস আমাদের ঘাড়ের উপর অনুভব করতে হবে সেই ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। মানুষের বোধগত এবং আচরণগত চরিত্রের পরিবর্তন খুব জরুরি। আর যেহেতু এই পরিবর্তন সরকারের হাতে নেই বা অনুকূল পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘ সময়ের পরিবর্তন, তাই সরকারকে নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিতে হয়। একটা সত্য গল্প বলে লেখাটা শেষ করি। এখানে গল্পটি ‘ট্র্যাজেডি অব কমনস’-এর দিকে যেতে যেতে বাঁক ঘুরে একটা বন্যপ্রাণীকে কীভাবে চিরকালের মতো হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিল, তার বর্ণনা পাওয়া যাবে।

একটা সময় সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের জঙ্গলে প্রচুর হাতি পাওয়া যেত। কিন্তু ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে এই প্রাণীটির সংখ্যা সাংঘাতিকভাবে কমে যায়। চোরাশিকারীরা মূল্যবান দাঁতের (আইভরি) লোভে নির্বিচারে এই প্রাণীটিকে হত্যা করতে লাগলো, ফলে হাতির সংখ্যা কমতে কমতে আফ্রিকায় এই প্রাণীটি লুপ্তপ্রায় হতে বসেছিলো। হাতির সংখ্যা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পিছনেও ওই একই কারণ ছিল - হাতি সর্বজনের সম্পদ (common resource)। ফলতঃ চোরাশিকারীদের মধ্যে সবসময়ই একটা প্রতিযোগিতা চলতো - কে কত বেশি হাতি মারতে পারে। সরকার-পুলিশ-প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে এই নিরীহ প্রজাতিটিকে পৃথিবী থেকে প্রায় নির্মূল করে ফেলেছিল। ব্যাক্তিমালিকানা না থাকায় হাতিদের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না, জলে-জঙ্গলে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতো আর চোরাশিকারীরা সহজেই বিনা বাধায় শিকার করতো। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ বনভূমির প্রতিটি অঞ্চল প্রশাসনের কঠিন বেড়াজাল দিয়ে চোরাশিকার আটকানো সম্ভব নয়, দেশগুলির প্রশাসনও সেটা বুঝতে পেরেছিল। সরকার নিজের মতো করে দুটি ব্যবস্থা নিয়েছিলো এবং যার ফলশ্রুতিতে এই জীবটি লুপ্তপ্রায় হতে হতে বেঁচে গিয়েছিল।

প্রথমটি হলো, আফ্রিকার কিছু কিছু দেশে যেমন, কিনিয়া, তানজানিয়া এবং উগান্ডায় হাতি শিকার এবং আইভরি বিক্রি কঠোর দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হল। কিন্তু আইনকে কলাগাছ দেখিয়ে এই সমস্ত দেশে হাতি শিকার চলতেই লাগল এবং দিনে দিনে এই প্রাণীটির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে লাগল। অন্য ব্যবস্থাটি হল, বৎসোয়ানা, মালয়ি, নামিবিয়া, জিম্বাবোয়ে ইত্যাদি দেশে জঙ্গলের জমি ইজারা দেওয়া হলো এবং আইন করা হলো ইজারার মালিক তার নির্দিষ্ট অংশে থাকা হাতিদের মারতে পারে। অর্থাৎ সরকার আইন করে হাতিকে সর্বসাধারণের সম্পদ থেকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিবর্তন করল। আর এই আইনের জাদুছোয়াঁয় শেষ হতে থাকা একটি বন্যপ্রজাতি পুনরায় সংখ্যায় বাড়তে শুরু করলো। এখন আফ্রিকা মহাদেশে হাতির সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে কোনো খবর শোনা যায় না। নিয়মের চমকটা কোথায় লুকোনো ছিল সেটা আমরা সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছি। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমরা সবসময় বুক দিয়ে আগলে রাখি। চোরাশিকারীদের সাধ্য কী ইজারামালিক এবং তাদের লোকজনের চোখে ধুলো দিয়ে ব্যক্তিসম্পত্তি চুরি করে নিয়ে যায়!

পরিশেষে আবার সূচনার অনুত্তর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এই বিশ্বলোকে সব সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা সম্ভব নয়; সব অভাবের সুরাহা উৎপাদন বাড়ালেই হবেনা, সব প্রয়োজন অর্থ বিনিময়ে মিটবে না। এই বোধিস্বত্ববোধে সমগ্র মানবজাতির জেগে ওঠা খুব জরুরি। আচরণগত পরিবর্তন এবং পরিমার্জনই এই পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য করে তুলবে। এই অঙ্গীকার গ্রহণের সময় কিন্তু এসে গেছে।