আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

রবীন্দ্র ভাবনায় ও ভাষ্যেঃ হাসিম শেখ বনাম রামা কৈবর্ত্ত

অশোক সিংহরায়


"এই মঙ্গল ছড়াছড়ির মধ্যে আমার একটি কথা জিজ্ঞাসার আছে, কাহার এত মঙ্গল? হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্ত্ত দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাথায়, খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্মবিশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া চষিতেছে,উহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?" - সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে। যিনি তাঁর 'রাজসিংহ' উপন্যাসের বিজ্ঞাপনে বলেছেন, "হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য"; ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় লেখা 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের শেষে শত্রুনিধনের পরে মহাপুরুষের বয়ানে বলেছেন-"শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজা।"; যাঁর 'সীতারাম' উপন্যাসের প্রতিপাদ্য "হিন্দুকে হিন্দু না রাখিলে কে রাখিবে?"; হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের পুরোহিত সেই বঙ্কিমচন্দ্রও হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্তদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করছেন এবং পাঠকদের উপলব্ধি করাতে চাইছেন - রাজা হিন্দু বা মুসলমান বা ইংরেজ যেই হোক, দরিদ্র হিন্দু-মুসলমান চাষি একইরকম দুঃখে দুর্ভাগ্যে জীবন কাটায়।

রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের উত্তরাধিকারী হলেও, মানসিকতায় তিনি ছিলেন রামমোহন-বিদ্যাসাগরের উদারতা, মানবতা ও যুক্তিবাদের অনুসারী। প্রথম জীবনে পারিবারিক সূত্রে তাঁর উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ছিল দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর লেখা চারখানি ঐতিহাসিক নাটক - 'পুরুবিক্রম', 'সরোজিনী' , 'অশ্রুমতী' এবং 'স্বপ্নময়ী'-র মধ্যে - শেষের তিনটি নাটকেই মুসলিম রাজাদের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজপুত রাজাদের বীর্যবত্তা বা দেশাত্মবোধ দেখিয়েছেন, যার মধ্যে হিন্দু-জাতীয়তাবোধের প্রবণতা লক্ষণীয়। বালক এবং কিশোর বয়েসে বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসুদের আয়োজিত 'হিন্দুমেলা'-য় নিজের লেখা কবিতাপাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথ; পরবর্তীকালে লিখেছেন 'শিবাজী-উৎসব' কবিতা (১৯০৪)। যদিও শিবাজী-উৎসব পালনের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুপুনরুজ্জীবনবাদ; কিন্তু কোনো মুসলমান-বিদ্বেষ কিংবা হিন্দুরাজ্যের কথা এই কবিতায় বা কোনো লেখায় রবীন্দ্রনাথ কখনও লেখেননি। সম্প্রসারণবাদী শক্তির (মোঘল) বিরুদ্ধে রাজ্যস্থাপনকারী শক্তির দ্বন্দ্বই হয়েছে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য। সে তো তিনি 'কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল'-এর নির্মাতা মোঘল-সম্রাট শাহ্জাহানকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন (১৯১৪)। কিন্তু হিন্দু-পুনর্জাগরণের পক্ষে তিনি কখনই ছিলেন না। তাঁর রচনায় - "হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ - এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল… একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়।" (প্রবন্ধঃ বৃহত্তর ভারত, ১৯২২)।

 

বাংলায় সাম্প্রদায়িকতার পূর্বকথা

গুপ্তযুগে খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকে বাংলায় বর্ণাশ্রমবাদী ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করল। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম চরম বিস্তার লাভ করল পরবর্তীকালে বর্মন-সেন-দেব রাজাদের আমলে প্রত্যক্ষ রাজ-পৃষ্ঠপোষকতায়। মাঝখানে পাল-চন্দ্র রাজাদের আমলে বৌদ্ধধর্মেরই জয়জয়কার ছিল। নবম শতক থেকে সুফি দরবেশরা এদেশে এসেছিল ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ১২০৪ খীষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজী বাংলাদেশে মুসলমান শাসন কায়েম করলে ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী ছিল সুফী প্রচারের স্বর্ণযুগ। এই সময়ে শাসক হিসেবে কিংবা সেনাবাহিনীতে মুসলমান ধর্মীয় কিছু আরবী, ইরানী, তুর্কী, আফগানী, হাবশী, মোগল এলেও বাংলার বেশিরভাগ মুসলমানই হ'ল ধর্মান্তরিত। ঘোর ব্রাহ্মণ্যবাদী, কর্ণাটক থেকে আগত সেন রাজাদের আমলে বৌদ্ধ, নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং অল্পসংখ্যক জৈন এবং আজীবিক ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষদের সমানাধিকার তো দূরের কথা, সামান্যতম অধিকারও ছিল না। নিম্নবর্ণের লোকেদের ছোঁয়া লাগলে এমনকি ছায়া মাড়ালেও উচ্চবর্ণের লোকেদের জাত যেত। তাই এই মানুষদের একটা বড় অংশ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আকুতিতে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো ধর্মই সেই অর্থে সাম্যবাদী নয়। তবে সেসময় প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের তুলনায় জাতিভেদ না থাকা, পারস্পরিক ছোঁয়াছুঁয়িতে বাধাহীন, তত্ত্বগতভাবে সব মুসলমানের সমতায় বিশ্বাসী ধর্ম তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে আকৃষ্ট করেছিল। তবে রাজানুগ্রহের লোভে (পদ-প্রাপ্তির আশায়), রাজরোষের ভয়ে (বলপূর্বক ধর্মান্তর), এমনকি স্পর্শদোষ-খাদ্যদোষ-ঘ্রাণদোষেও কিছু উচ্চবর্ণের হিন্দু, মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছিল বইকি! ষষ্ঠদশ শতকের প্রথম থেকেই চৈতন্য-অদ্বৈত-নিত্যানন্দের আচন্ডালে প্রেম দিয়ে গড়া বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতা রুদ্ধ হয়েছিল। চৈতন্যদেব হিন্দু ধর্মের কঠোর বিধি-বিধান কিংবা বর্ণাশ্রমী জাতিভেদ প্রথা মানতেন না। তাঁর মতে কৃষ্ণে ভক্তি এবং তাঁর নাম-সংকীর্তনের মাধ্যমেই মোক্ষ লাভ হয়। সেজন্য চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে আকৃষ্ট হয়ে নিম্নবর্ণের হিন্দু ছাড়াও অনেক মুসলমানও বৈষ্ণব হয়েছিল। মুসলমান সমাজে ধর্মীয় সাম্য এবং সৌভ্রাতৃত্ব থাকলেও সমাজের নেতৃত্ব ছিল বিদেশ থেকে আগত মুষ্টিমেয় তুর্কী, আফগানী, ইরানী, আরবী মুসলমানদের হাতে, যারা নিজেদের শরীফ বা আসরাফ অর্থাৎ অভিজাত বলে পরিচয় দিত। মুসলিম শাসনকালে মুসলমান সুলতান, সুবেদার বা নবাবদের সাথে হিন্দু রাজা বা জমিদারদের ধর্মীয় সংঘাতের সম্পর্ক থাকলেও নিজেদের স্বার্থে একটা সমন্বয়ও ছিল।

পলাশীর যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে জমিদারি, রাজস্ব বিভাগ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মহাজনী কারবারে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল; বিচার ও সামরিক বিভাগে প্রাধান্য ছিল মুসলমানদের। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পরে অভিজাত মুসলমানরা শাসক থেকে শাসিত হয়েছিল; কিন্তু অভিজাত হিন্দুদের কেবল প্রভু পরিবর্তন হয়েছিল। কানিংহাম, ডাফ এবং টডের কথায় অভিজাত হিন্দুরা বিশ্বাস করেছিল যে ইংরেজ তাদের রক্ষাকর্তা। কাজেই তারা ইংরেজ শাসনের সহায়ক হিসেবে ধনী হিন্দু এবং মিশনারিদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে, শিক্ষা-দীক্ষায়, পেশায় এবং সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অনেক দশক কেটে গেলে অভিজাত মুসলমানরা বুঝতে পারল যে মুসলমানরা অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তখন হান্টারের কথায় এগিয়ে থাকা মুসলমানরা বিশ্বাস করল যে হিন্দু প্রাধান্য থেকে ইংরেজ তাদের রক্ষা করবে। তারা নিজের সম্প্রদায়ের মানুষকে বোঝাল যে বিধর্মী হলেও ইংরেজ যেহেতু কারও ধর্মকর্মে বাধা দেয় না কাজেই ভারতবর্ষ দারুল ইসলাম (শান্তিভূমি); তাই খ্রিস্টান শাসকদের বিরুদ্ধে জেহাদ (ধর্মযুদ্ধ) শাস্ত্রের নির্দেশের পরিপন্থী। এতদিন ইংরেজ মুসলমানদের ফরাজি, ওয়াহাবি প্রভৃতি আন্দোলনের বিরুদ্ধে বন্ধুভাবাপন্ন হিন্দুদের ব্যবহার করেছিল; এবার তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অনুগত মুসলমানদের ব্যবহার করতে লাগল। দেশের নেতাদের জাতীয়তাবাদের সাথে হিন্দুত্ববাদকে মিলিয়ে ফেলার ঘটনা ইংরেজদের এ কাজে সুবিধা করে দিয়েছিল। ধর্মান্তরিত সাধারণ মুসলমান এবং অনভিজাত হিন্দুরা রয়ে গেল একই দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিয়ে। তবে তাদের মধ্যে কি মেশামেশিই ছিল? রেষারেষি কিছুই ছিল না? মুসলমান রোজা রাখে, ইদ পালন করে; হিন্দু ব্রত-উপবাস করে, পুজো করে। মুসলমান আচারে প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল; হিন্দু ধর্মমতে প্রবল নয়, আচারে প্রবল। কাজেই তাদের দুরাবস্থার জন্য কে দায়ি তা তারা না বুঝলেও, এটা বুঝত যে তারা আলাদা। হিন্দু বা মুসলমান নেতারা এই বৈষম্য-বোধটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সম্প্রদায়ের মানুষদের ব্যবহার করত তাদের নিজেদের গোষ্ঠীগত স্বার্থে।

 

রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও ভাষ্য

হিন্দু-জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্তের মঙ্গল অন্বেষণ করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন; রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শুরু কিন্তু ওইখান থেকেই। শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরে জমিদারির কাজে নিযুক্ত থাকার সময়ে তাঁর শুধু পদ্মাপারের পল্লী-প্রকৃতির সাথেই পরিচয় হয়নি; হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত্তদের মতো দরিদ্র প্রজাদের জীবনের সাথেও তিনি পরিচিত হয়েছিলেন; তাদের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়েছিলেন সাধ্যমতো। এই সময়েই তাঁর কবিতায় এসেছে নতুন বাঁক; সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর ছোটগল্পের সম্ভার। হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক সমস্যা ও তার মানবিক উত্তরণের সার্থক কাহিনী হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি তাঁর লেখা 'সমস্যাপূরণ', 'মুসলমানীর গল্প' প্রভৃতি ছোটগল্পকে।

রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে সমকক্ষ না হয়ে উঠলে সমকক্ষের ব্যবহার পাওয়া যায় না - কাজেই বঙ্গভঙ্গ রদ বা বিদেশী দ্রব্য বর্জন (যা নিয়ে তাঁরও আপত্তি ছিল) আন্দোলনের সময় অধিকাংশ মুসলমানের সমর্থন না পাওয়ার বিষয়টির সঠিক বিশ্লেষণ উঠে এসেছে তাঁর 'ব্যাধি ও প্রতিকার' প্রবন্ধে (১৯০৭) - "আমরা যতই গভীররূপে বেদনা পাই-না কেন, সে বেদনার বেগ আমাদের গবর্মেন্টের নাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে কিছুমাত্র বিচলিত করিতে পারে না। ...ইহার কারণ আমাদের দ্বারা কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নাই। কেন নাই। আমরা বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত। ...আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। ...মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই - আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে - অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে। ...আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। ...আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেকস্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমান বসে না - ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়। ...আজ আমাদের ইংরেজি-পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে 'আমরা উভয়ে ভাই' - তখন এই ভাই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে না।... কোনো বিখ্যাত 'স্বদেশী'-প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। ইহাতে তাঁহারা বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু চাষা ঠিক বুঝিয়াছিল। ...হিন্দু-মুসলমান এক হইলে পরস্পরের কত সুবিধা একদিন কোনো সভায় মুসলমান শ্রোতাদিগকে তাহাই বুঝাইয়া বলা হইতেছিল... শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক। আমাদের পরস্পরের মধ্যে, সুবিধার চর্চা নহে, প্রেমের চর্চা, নিঃস্বার্থ সেবার চর্চা যদি করি তবে সুবিধা উপস্থিত হইলে তাহা পুরা গ্রহণ করিতে পারিব এবং অসুবিধা উপস্থিত হইলেও তাহাকে বুক দিয়া ঠেকাইতে পারিব।" এই গভীর পর্য্যবেক্ষণ তাঁর ছিল বলেই তিনি বঙ্গ-ভঙ্গ রোধের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন চলাকালীন শুধু 'বাংলার মাটি, বাংলার জল…' গান লিখেই দায় সারেননি, ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং বিদ্বান মানুষদের নিয়ে সারা বাংলায় দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে সঙ্গে নিয়েই রাখী-বন্ধনের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।

দুই সম্প্রদায় যে কেবল স্বতন্ত্র নয়, বিরুদ্ধ - এই উৎকন্ঠা তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। জাহাজের খোলের মধ্যে ফাটল থাকলে ঝড় উঠলে সে ফাটল বেড়ে জাহাজ ডুবির সম্ভাবনা হয়; তাই তিনি দেশের নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন - "অতএব কাপ্তেনদের কাছে দোহাই পাড়ছি, যেন তাঁরা কন্ঠস্বরে ঝড়ের গর্জনের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে ফাটল মেরামতের কথাটা একেবারে চাপা না দেন।" (প্রবন্ধ: সমস্যা, ১৯২৩)। গো-হত্যা নিবারণের নামে আসলে যে ওই ফাটলটাকে বড় করার চেষ্টা করা হয় তা তিনি শুধু প্রবন্ধে নয়, 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে (১৯১৬) নিখিলেশের বয়ানে প্রকাশ করেছেন, "এ দেশে মহিষেও দুধ দেয়, মহিষেও চাষ করে, কিন্তু তার কাটামুন্ড মাথায় নিয়ে সর্বাঙ্গে রক্ত মেখে যখন উঠোনময় নৃত্য করে বেড়াই তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে মুসলমানের সঙ্গে ঝগড়া করলে ধর্ম মনে মনে হাসেন, কেবল ঝগড়াটাই প্রবল হয়ে উঠে। কেবল গোরুই যদি অবধ্য হয় আর মোষ যদি অবধ্য না হয় তবে ওটা ধর্ম নয়, ওটা অন্ধ সংস্কার।" মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণাকে তিনি কখনই ধর্ম বলে মানেন নি, 'গোরা' উপন্যাসে (১৯১০) প্রাজ্ঞ পরেশবাবু তাই সুচরিতাকে বলেন - "একটা বিড়াল পাতের কাছে বসে ভাত খেলে কোনো দোষ হয় না অথচ একজন মানুষ সে ঘরে প্রবেশ করলে ভাত ফেলে দিতে হয়, মানুষের প্রতি মানুষের এমন অপমান এবং ঘৃণা যে জাতিভেদে জন্মায় সেটাকে অধর্ম না বলে কী বলব?" রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন - "বৈচিত্র্যই সংসারের স্বাস্থ্যরক্ষা করে। পৃথিবীতে শীতাতপ সব জায়গায় সমান নহে বলিয়াই বায়ু চলাচল করে।" (প্রবন্ধঃ সমাজভেদ, ১৯০১)।

কাজেই আজ যখন 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান'-এর স্লোগান দিয়ে সেই ধর্মীয়, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যটাকেই মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয় শিক্ষার, আদর্শের, সংস্কৃতির আদানপ্রদানের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হওয়ার বিজ্ঞানটাকেই অস্বীকার করা হয় তখন সেটা ফাটলটাকে বাড়িয়ে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধিরই অপচেষ্টা করা হয়। এই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করতে গেলে চাই বৈচিত্র্যকে সম্মান জানানোর চর্চা, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে প্রীতির, অখণ্ড ভ্রাতৃভাবের, ঐক্যবন্ধনের চর্চা। দরকার সামাজিক আন্দোলন।