আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

লর্ড অফ দি ফ্লাইজঃ ভালোমানুষের ভাষ্য নির্মাণে রুটগার ব্রেগম্যান

স্বপন ভট্টাচার্য


রুটগার ব্রেগম্যান এদেশে এখনও খুব পরিচিত কিনা জানা নেই, তবে এই ডাচ ঐতিহাসিক সম্প্রতি খুব বিখ্যাত হয়েছেন 'Humankind: A Hopeful History' নামক বেস্টসেলারটি লিখে। এই নবীন ইতিহাসবিদ তথা সমাজবিজ্ঞানীর ভক্তসংখ্যাও ঈর্ষনীয় । ব্রেগম্যানের মূল প্রতিপাদ্য এক কথায় বলতে গেলে - মানুষ গভীরে ততটা খারাপ নয় বা অধিকারবাদী নয় যতটা তাকে ম্যাকিয়াভেলি থেকে ফ্রয়েড থেকে বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স পর্যন্ত মনে করে এসেছেন। সে আসলে ‘কাইন্ড’।

চিত্র-১: রুটগার ব্রেগম্যান ও তাঁর গ্রন্থ 'Humankind: A Hopeful History'-এর প্রচ্ছদ।

এই প্রতিপাদ্যের সমর্থনে যে গোটাকয়েক সত্য ঘটনার কথা ব্রেগম্যান উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে একটি হল নোবেল পুরস্কারে ভূষিত ইংরেজ কথাসাহিত্যিক উইলিয়াম গোল্ডিং-এর ‘লর্ড অফ দি ফ্লাইজ’ একটা আকস্মিকভাবে ঘটে যাওয়া প্রায় অ্যান্টিপ্যারালাল বা প্রতি-সমান্তরাল প্রতিরূপ। 'লর্ড অফ দি ফ্লাইজ'-এর পাঠকেরা এই কাহিনীর পাঠ প্রতিক্রিয়া থেকে সারা জীবনে রক্তে-মাংসে বেরোতে পারবেন বলে মনে হয় না। মানুষের মধ্যে স্বার্থচিন্তা, অধিকারবোধ, লোভের যে সিনিক্যাল প্রতিচ্ছায়া এই চটি উপন্যাসখানার মধ্যে বিধৃত আছে তার মূল চরিত্ররা ছিল বিমান দুর্ঘটনায় কপালজোরে বেঁচে যাওয়া একদল ব্রিটিশ বালক। বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো এক মানুষের ছাপ না পড়া দ্বীপে আশ্রয় নেয় তারা। প্রথম দিন থেকেই তারা এক ধরনের গণতান্ত্রিক শৃঙ্খলা মেনে নেবার সংকল্প করে এবং সবাই মিলে তাদের এক নেতাও নির্বাচিত করে। সমুদ্রে বা আকাশে তাদের বেঁচে থাকার সঙ্কেত পৌঁছে দেবার জন্য একটি ধোঁয়ার উৎস জাগরূক রাখার কথাও ছিল তাদের। কিন্তু এই নির্বাসিত জীবনে কয়্যার সঙ্গীতের চর্চা করা কিছু সুন্দর বালক যেভাবে একদল নিষ্ঠুর প্রায় ক্যানিবালে পর্যবসিত হয় তা বস্তুত সভ্যতা গড়ে ওঠার প্রাথমিক শর্তগুলির প্রতি একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। কাহিনীর শেষে দেখতে পাই সেই দ্বীপভূমিকে এই একদল একদা নিষ্পাপ বাচ্চা এক আধপোড়া ওয়েস্টল্যান্ডে পর্যবসিত করে ছেড়েছে, তাদের দু’জন তখন খুন হয়ে গেছে নিজেদেরই হাতে। যে ব্রিটিশ ন্যাভাল অফিসার তাদের শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে তার মনে হয় - “I should have thought,” the officer says, “that a pack of British boys would have been able to put up a better show than that.” - ভেবেছিলাম একদল ব্রিটিশ বালকের কাছ থেকে এর চেয়ে একটু ভালো প্রদর্শনী দেখতে পাওয়া যাবে। উইলিয়াম গোল্ডিং দেখান এই বাচ্চারা বিচ্ছিন্ন হলেও প্রাথমিকভাবে শৃঙ্খলাবোধ ও নির্বাচিত আনুগত্য দিয়ে তারা নিজেদের জন্য যে সভ্যতা তৈরি করতে চেয়েছিল তা যে ক্রমশ সমাজবিরুদ্ধ স্বেচ্ছাচারিতা এবং ভীতির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় তার কারণ, এই বাচ্চারা, গোল্ডিং-এর কথায়, ‘মানুষ’ নামক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিল - they were suffering “from the terrible disease of being human”.

।। দুই ।।

উইলিয়াম গোল্ডিং-এর ১৯৫৪-তে প্রকাশিত এই কাজটি কিছু বিতর্ক তৈরি করেছিল বিশেষ করে আমেরিকায়। মানুষের মধ্যকার পশুত্বের বন্দনা বলে সমালোচিত হয়েছে এই গ্রন্থ । সমালোচনা হয়েছে জাতি ও বর্ণবিদ্বেষের দায়ে দায়ী করে। বাচ্চারা দ্বীপে থাকতে থাকতে মুখ রঙ করে, বুনো শুয়োরের মাথা টাঙিয়ে শয়তানের টোটেম বানায় এমন কি সঙ্গীকে শয়তান অপবাদে হত্যা করে। কোথাও কোথাও 'নিগার' শব্দটাও ব্যবহৃত হয়েছে। সব মিলিয়ে যা কিছু সামাজিক বলে চিহ্নিত, অ্যাবরিজিন এবং অশ্বেতকায়দের তার প্রতিস্পর্ধী বলে দেখানোর অভিযোগ আছে। এমন কি যৌনতা ও মাত্রাতিরিক্ত হিংসার অভিযোগও আছে এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে। আমেরিকা ও কানাডার বহু স্কুল বোর্ড এই লেখাকে স্কুলে পড়াবার উপযুক্ত বলে মনে করেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য এই যে, 'লর্ড অফ দি ফ্লাইজ' হল একটি ফিকশনের নাম যার সব চরিত্রই কাল্পনিক।

চিত্র-২: উইলিয়াম গোল্ডিং এবং তাঁর 'Lord of the Flies'-এর প্রচ্ছদ।

রুটগার ব্রেগম্যান অবশ্য মানুষের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা মানুষকেই তার ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা পশুর তুলনায় বেশি বিশ্বাস করতে চান এবং তার হিউম্যানকাইন্ড প্রকল্পের সাপেক্ষে অনুমান করতে চান যদি সত্যিই কিছু মানুষ কোনো প্রাকৃতিক বা আরোপিত কারণে গিয়ে পড়ে কোনো জনমানবহীন দ্বীপে তাহলে কেমন ব্যবহার করতে পারে পরস্পরের প্রতি? তাঁর ভাষ্যে ব্রেগম্যান, উইলিয়াম গোল্ডিং-কে এমন একজন অসুখী মানুষ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন যিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন নাৎসিদের তিনি বোঝেন কেন না তিনি নিজেই একজন তেমন মানসিকতার লোক। হলোকাস্ট পরবর্তী ইউরোপ হল অসুখী পিতাদের ইউরোপ যেখানে পিতাদের দাঁড়াতে হয় সন্তানদের প্রশ্নের সামনে - তোমরা সত্যিই এটা করেছিলে? কেন? গোল্ডিং-এর 'লর্ড অফ দি ফ্লাইজ' সম্ভবত সেই প্রশ্নের অসুখী উত্তর - আসলে সবার ভিতরে ঘুমিয়ে আছে এক নাৎসি ঘাতক। রুটগার ব্রেগম্যান খুঁজতে থাকেন এমন নজির যা উপন্যাসের মত কিন্তু উপন্যাসের নয়, জীবনের।

।। তিন ।।

গুগল ঘাঁটতে গিয়ে ব্রেগম্যান সন্ধান পান ততটা নজর কাড়া নয় এমন একটা ব্লগের। এটির বিষয় ছিল ১৯৭৭ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ টোঙ্গা থেকে নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ভেসে পড়া ছয়টি উপজাতি বালকের খবর যারা নৌকোডুবির শিকার হয়ে মানুষের পা না পড়া একটা দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। চালুনি দিয়ে আরো ছেঁকে ব্রেগম্যান বোঝেন, ঘটনা আসলে ১৯৬৬-র এবং একটা টাইপোর কারণে ওই সময়বৈকল্য। ৬ অক্টোবর ১৯৬৬ তে অস্ট্রেলিয়ার কাগজ ‘এজ’ খবর দিচ্ছে ‘টোঙ্গা কাস্টঅ্যাওয়ে’ বলে ইতিমধ্যেই পরিচিত হয়ে ওঠা ছয় বালকের যাদের তার তিন সপ্তাহ আগে উদ্ধার করা হয়েছিল ‘আটা’ নামের একটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ থেকে।

চিত্র-৩: অস্ট্রেলিয়ার 'Age' কাগজের খবর। ৬ অক্টোবর, ১৯৬৬।

ব্রেগম্যান তাঁর হিউম্যানকাইন্ড প্রজেক্টের তাগিদে খোঁজ নিতে শুরু করেন এরা এখনো বেঁচে রয়েছে নাকি এবং পেয়েও যান আর একটা খবর আর ছবি ওই আন্তর্জালেই যার বিষয়বস্তু ছিল পঞ্চাশ বছরের সখ্য - ‘Mates share 50-year bond’ । ছবির অসমবয়সী মানুষ দু’জনের মধ্যে যিনি বড় তিনি তখন তিরাশি, নাম পিটার ওয়ার্নার, এই ঘটনায় তিনি ছিলেন উদ্ধারকারী আর অপর জনের নাম মানো (Mano Totau), তুলনায় নবীন, বয়স তখন সাতষট্টি আর পিটারের গলায় তিনি ঝুলিয়ে রেখেছেন বিশ্বাস ও ভালোবাসার হাত।

চিত্র-৪: পিটার ও মানোঃ পঞ্চাশ বছরের সখ্য - ‘Mates share 50-year bond’.

তাসমানিয়ায় পিটারের নিজের মাছ ধরার একটা পুরো ফ্লিট ছিল - ট্রলারের ফ্লিট। ১৯৬৬তে তেমনই একটা মাছ ধরার অভিযানে পিটার চলে যান নিরিবিলি দ্বীপ টোঙ্গায়। টোঙ্গাকে কেন্দ্র করে জলজগতে ঘোরাঘুরির সময় ছোট্ট একটা দ্বীপ ‘আটা’ নজর কাড়ে তাঁর। আটা দ্বীপ সব সময় একদম যে জনশূন্য ছিল তা নয়, তবে ১৮৬৩ সালে দাস ব্যবসায়ীরা দ্বীপবাসী সবাইকে ধরে নিয়ে চলে যাবার পরে সেখানে আর মানুষের পা পড়েনি বলেই জানা ছিল সবার। বাইনোকিউলারে চোখ রেখে পিটার দেখেন দ্বীপের উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে যেন আগুন জ্বালিয়ে তৃণভূমি ফাঁকা করে নেওয়ার চিহ্ন রয়েছে। পিটার যখন ভাবছেন এটা দাবানলের ইঙ্গিত কি না, ঠিক তখনই এক নগ্ন বালকের চেহারা ওই পাহাড়চূড়ায় চোখে পড়ে তাঁর। সে তখন গলার সব চেয়ে উঁচু পর্দায় চেঁচিয়ে নীচে নামছিল। দেখা গেল সে একা নয় তার পিছনে আরো কয়েকজন। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে পিটারের ডিঙ্গিতে এসে যে সবচেয়ে আগে এসে পৌঁছয় সে পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে - আমি স্টিফেন, আমরা ছ’জন বোধহয় পনের মাস এই দ্বীপে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছি। এই ছটি বালক - সিওন, স্টিফেন, কোলো, ডেভিড, মানো এবং লিউক যাদের ডাকনাম, তারা আদতে টোঙ্গা দ্বীপের নাকুয়ালোফা (Nuku‘alofa)-তে 'সেন্ট অ্যানড্রুজ অ্যাংলিকান স্কুল' নামক একটা আবাসিক মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিল। পিটার তার ব্যাটারিচালিত রেডিওতে যোগাযোগ করে নাকুয়ালোফার প্রশাসনের সঙ্গে। বিশ মিনিট পরে কান্নাভেজা গলায় উত্তর আসে সেখান থেকে - এই ছেলেরা যাদের আপনি উদ্ধার করেছেন তাদের আমরা সবাই মৃত বলে ধরে নিয়েছিলাম। এদের শ্রাদ্ধশান্তিও হয়ে গিয়েছে।

।। চার ।।

ঘটনার পঞ্চাশ বছর পরেও তাদের মধ্যে চারজন জীবিত, পিটারও নবতিপর কিন্তু তাঁদের স্মৃতি এবং সখ্য দুইই অমলিন। ১৯৬৫’র জুনে যখন এই ছ’জনের মধ্যে বড়টির বয়স ষোল আর কনিষ্ঠটির তেরো, তখন এই পলিনেশিয়ান উপজাতিভুক্ত বোর্ডিং স্কুলের কড়া শাসনে বোর হতে থাকা বালকেরা ঠিক করল সমুদ্রে ভেসে পড়বে। হয়ত যাবে ফিজি দ্বীপে যা সমুদ্রপথে অন্তত পাঁচশো মাইল দূর অথবা আর কিছুটা উজিয়ে গিয়ে হয়তো বা নিউজিল্যান্ডে। জলযাত্রার জন্য তারা রসদ নিল দু’বস্তা কলা, কয়েকটা নারকেল এবং একটা গ্যাস বার্নার। বোট ভাড়া করল তারা এমন এক দ্বীপবাসীর কাছ থেকে যাকে ওরা খুব একটা পছন্দ করত না। ম্যাপ বা কম্পাস ব্যবহার করতে তারা জানতো না। যেদিন ওরা সমুদ্রে ভাসল সেদিন বাতাস নির্মল, আকাশ নীল, দিনের বেলা কেটে গেল বেশ ভালোভাবেই। তারা ভুল করল রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ঢেউয়ের ধাক্কায় আপাদমস্তক ভিজে গেলে তারা বুঝলো বিপদে পড়েছে। পাল খাটিয়ে ভাসবার চেষ্টা ব্যর্থ হল বাতাসের দাপটে সেসব ছিঁড়ে ফেটে গেলে। ডিঙি ঢেউয়ের টানে নিশানাহীনভাবে ভেসে চলল ৩৫০ মাইল প্রায়। আটদিন তারা ভাসল এলোমেলো, জল ও খাবার ছাড়া। ফাঁকা নারকেলের খোলে বৃষ্টির জল ধরে ভাগ করে খেলো কিছুটা। আট দিনের দিন চোখে পড়ল একটা দ্বীপ আর তার তটভূমি। ততক্ষণে তাদের নৌকা আর ভাসবার উপযোগী নয়, ফলে ভাঙা নৌকার কাঠ নিয়ে ভেসে পড়ল তারা। উত্তাল ফিরতি ঢেউয়ের উপর প্রায় সার্ফিং’এর নিয়মে দু'খানা হাতকে দাঁড় বানিয়ে ওদের সেই ছোট্ট দ্বীপ ‘আটা’য় পৌঁছতে ৩৬ ঘন্টা সময় লেগেছিল এবং প্রথম মাটি ছুঁয়েছিল মানো এবং তারপর একে একে অন্যরা। দ্বীপ যে খুব একটা সবুজ, তা কিন্তু নয়। মোটামুটি পাথুরে, সমুদ্রতল থেকে হাজারখানেক ফুট উঁচুতে তার চূড়া। এই তাদের দ্বীপ আর এখানেই তাদের সত্যিকারের লর্ড অফ দি ফ্লাইজ হয়ে নির্বাসন।

পিটার পরে লিখেছেন - যখন তিনি পা রাখলেন এই দ্বীপে ততদিনে এই ছ’জন সেখানে একটা পুরোদস্তুর কমিউন বানিয়ে ফেলেছে। গাছের গুঁড়ি ফাঁপা করে জলাধার, একটা ঘিরে রাখা সবজি বাগান, একটা জিম, মুরগি পোষার খাঁচা এবং একটা নিভে যাওয়া অগ্নিশিখা। উপন্যাসের বালকেরা তাদের আগুন নিভিয়ে ফেলেছিল, এরা তা নিভতে দেয়নি অন্তত বছরখানেক। দ্বীপে পা রাখার পর প্রথম তিন মাস তারা কাটিয়েছিল আগ্নেয়শিলার ভিতর গড়ে ওঠা একটা প্রাকৃতিক গুহায়। এই সময়টায় সামুদ্রিক পাখি মেরে কাঁচা রক্ত পান করে তৃষ্ণা মেটাতো তারা। সামুদ্রিক পাখির ডিম কাঁচা খেয়ে এবং কাঁচা মাছ খেয়ে টিঁকে থাকতে থাকতে তারা ঠিক করল দ্বীপটাকে যদি বাসভূমি বানাতে হয় তাহলে সেটাকে চিনতে হবে। দু’দিনের পায়ে চলা পথ পেরিয়ে তারা পাহাড়চূড়ায় একটা আগ্নেয় জ্বলামুখ খুঁজে পেয়ে গেল। দ্বীপের এই সর্বোচ্চ পয়েন্টের নাম ‘কোলোমাইল’। এখানেই এককালে এ দ্বীপের আদিবাসীরা থাকত। তাদের চাষ থেকে ফেলে যাওয়া টারো কন্দ আর কলার বুনো ফলন তখনও সেখানে ছিল আর তারা চলে যাবার একশো বছর পরেও তাদের ফেলে যাওয়া মুরগির বংশ সেখানে বাচ্চা ফুটিয়ে যাচ্ছিল। স্টিফেন সেখানে দুটো কাঠির সাহায্যে আগুন জ্বালিয়ে ফেলতেও সমর্থ হয়েছিল। এর ফলে তাদের জীবন কিছুটা তুলনায় কিছুটা সহজ হল।

নির্বাসিত জীবনে তারা দু’জন দু’জন করে সব কাজ ভাগ করে নিয়েছিল। জল ধরা, সবজি ফলানো, রাতপাহারা সব কিছুই রোস্টার মেনে। দিন শুরু আর শেষ করত তারা প্রার্থনা করে আর গান গেয়ে। কোলো নামের ছেলেটি কাঠ দিয়ে, নারকেল খোল দিয়ে আর তাদের ভাঙ্গা নৌকো থেকে তার সংগ্রহ করে একটা গিটার বানিয়েছিল যা দিয়ে তাদের সঙ্গীতচর্চা চালু ছিল। নির্বাসনের দিনগুলোতে সে পাঁচখানা গান, লিখে আর সুর দিয়ে তৈরি করে ফেলেছিল। এই পনের মাসের মধ্যে বার পাঁচেক কোনো না কোনো জাহাজ তাদের দৃষ্টির ভিতর দিয়েই ভেসে গেছে। হয় তারা দেখতে পায়নি এই ছেলেদের অথবা জলদস্যু ভেবে এড়িয়ে গেছে। একবার তারা গাছের গুঁড়ি দিয়ে পাটাতন বানিয়ে ভেসে পড়ার চেষ্টা করেও মাত্র মাইলখানেকের বেশি এগোতে না পেরে ফিরে আসে। একদিন স্টিফেন পাহাড়চূড়া থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে ফেলল। বাকিরা কাঠ আর কঞ্চি দিয়ে সে পা ফিক্স করে দিয়ে তাকে বলেছিল - যা করার আমরা করছি, তুই রাজার মত শুয়ে শুয়ে কাটা। শুরু শুরুতে তারা মাছ আর নারকেল দিয়ে কোনোমতে চালিয়েছিল। তাদের উদ্ধার করার পরে ডাক্তাররা তাদের সুগঠিত স্বাস্থ্য, বিকলনহীন মন আর স্টিফেনের সম্পূর্ণ জুড়ে যাওয়া পা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল এই সত্যিকারের লর্ড অফ দি ফ্লাইজ-রা পনের মাস ধরে পরস্পরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার জীবন কাটিয়েছিল বলে । তাদের এই বন্ধুত্ব আজীবন অটুট থেকে গিয়েছিল। মজার কথা হল, যে বোট মালিক তাদের বোট ভাড়া দিয়েছিল, টোঙ্গায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করে তাদের জেলে ঢুকিয়ে ছাড়ে প্রায়। সে বিপদ থেকেও উদ্ধার করেন পিটার। তিনি অস্ট্রেলিয়ান টিভিতে এই সত্য কাহিনীর ফিল্ম স্বত্ব বেচে বোট মালিকের ক্ষতিপূরণ করে দিয়েছিলেন।

 

 

 

চিত্র-৫: উদ্ধার হওয়া ছয় দ্বীপান্তরী বন্ধুঃ পিছনের সারি বাম দিক থেকে লুক ভেইকোসো, ফাতাই লাতু, সিওনে ফাতাতুয়া; বাম দিক থেকে সামনের সারি টেভিটা সিওলা, কোলো ফেকিতোয়া, মানো টোটাউ। ছবি: রুটগার ব্রেগম্যানের টুইটার পোষ্ট থেকে।

।। পাঁচ ।।

পঞ্চান্ন বছর পরে সেই বালকদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তিয়াত্তর বছর বয়সের ‘সিওন’ উলুফোনুয়া ফাতাউয়া ছিলেন চার্চ অফ টোঙ্গার প্রধান প্যাস্টর। এখন অবসর নেওয়ার পরে থাকেন আমেরিকায়। 'পিপল' পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন - গরীব ঘরের ছেলে ছিলাম সবাই, যা পেতাম ভাগ করে নিতাম আমরা। প্রার্থনা করতাম রোজ। ঝগড়াঝাঁটি আমাদের মধ্যেও হত, কিন্তু তখন দুজনে চলে যেতাম দ্বীপের দু’দিকে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন প্রশান্ত হয়ে এলে ফিরে আসতাম যে যার কাছে। কিছু খারাপ লাগলে বলে দিতে হত।’ বয়সে বড় বলে সিওনেই ছিল তাদের নেতা। তার মধ্যস্থতাতেই মিটমাট হয়ে যেত - ‘সরি’ বললেই ঝগড়া শেষ। ‘লিউক’ ভেইকোসো এখন বাহাত্তর। প্যাসিফিক হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। অবসর নেবার পরে তিনিও এখন আমেরিকা প্রবাসী। সিওনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এখনও তাঁর। ৭৩ বছর বয়সী ‘মানো’ সিওনে ফিলিপে টোটাও এখন থাকেন কুইন্সল্যান্ডে। রুটগার ব্রেগম্যানের যার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে এই কাহিনী জনসমক্ষে আনেন তিনি এই মানো। ‘ডেভিড’ টেভিটা ফিফিটা সিওলা ছিলেন এদের মধ্যে কনিষ্ঠতম। থাকেন নিউজিল্যান্ডে। ঘটনা সামনে আসার পরে বলেছিলেন - আমাকে ওরা নিয়েছিল এই কারণে যে ব্যাটারা নিজেরা কেউ পাল তুলতে জানতো না। ‘কোলো’ ফেকিতোয়া একাত্তর বছর বয়সে মারা গিয়েছেন ২০১৭’তে। তাদের কাহিনী যে আলোড়ন তুলেছে তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। ‘স্টিফেন’ টেভিটা ফাতাই লাটু, যিনি প্রথম সাঁতরে পিটারের বোটে চলে আসেন, তিনিও বেঁচে নেই আর। এই অতিমারিকালে জুম কলে মিটিং সেরে ব্রেগম্যান, পিটার এবং জীবিত চারজন হলিউডের রিজেন্সি স্টুডিওকে তাদের কাহিনীর চলচ্চিত্রস্বত্ব বিক্রির কাজ সম্পন্ন করেছে।

এই ঘটনা এবং আরো কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ব্রেগম্যান মনে করিয়ে দিতে চাইছেন পুরনো একটি আপ্তবাক্য - মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। অতিমারি-পরবর্তীকালে মানুষ আরো ‘কাইণ্ড’ হবে এমন ভাবনা ভাবার কোনো ভিত্তি আছে বলে অবশ্য মনে হচ্ছে না এখনও, তবে মানুষ প্রকৃতির প্রতি আর একটু কাইন্ড হলে এই গ্রহে সে বাড়তি কিছুদিন টিকে থাকতে পারবে এমন ভাবাটা অমূলক হবে না। তার ভালোত্ব জেগে উঠবেই এমন বলতে পারাটা মুশকিল, কিন্তু পশুত্বকে যে বিসর্জন দিতেই হবে তা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। সে হিসেবে লর্ড অফ দি ফ্লাইজের প্রতি-সমান্তরাল এই ঘটনার বর্ণনা মানুষে আস্থা কিছুটা ফেরালেও ফেরাতে পারে। আর কিছু না হোক, সময়ের প্রায় অতল থেকে এমন একটা কাহিনী তুলে আনার জন্য ব্রেগম্যান বাহবা নিশ্চয়ই পেতে পারেন। তবে, এখানেও একটা কথা আছে। এই বালকেরা তো ব্রিটিশ ছিলনা। টোঙ্গার সাদাসিধে গরীব চাষি পরিবারের ছেলেরা যে সহমর্মিতা দেখিয়েছে তা যে সত্যিকারের ব্রিটিশ ছেলেরা দেখাতেই পারত তা হলফ করে বলা যায় না। ব্রেগম্যানের হিউম্যানকাইন্ড ৭০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গেছে, বলা হচ্ছে ইউভাল নোয়া হারিরি’র পরে ‘নেক্সট বিগ থিং’ এই রুটগার ব্রেগম্যান। কিন্তু টোঙ্গার অধিবাসীরা ব্রেগম্যানের উপর খুব যে সন্তুষ্ট তা বলা যায় না। তাদের মতে লেখক কাহিনী এনেছেন, কিন্তু টোঙ্গাকে আড়ালে রেখেছেন। সহমর্মিতা, বন্ধুতা, একে অন্যের সুখে দুঃখে পাশে থাকা এগুলো টোঙ্গার সমুদ্রসঙ্গী মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এটাকে ব্রেগম্যান এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে দেখেছেন বটে, তবে এই টোঙ্গাবাসীদের প্রতিক্রিয়া জানলে মনে হয়, যে কোনোদিনই এই এক্সপেরিমেন্টের একটাই ফলাফল হতে পারতো এবং তা হত গোল্ডিং-এর 'লর্ড অফ দি ফ্লাইজ'-এর বিপ্রতীপে।

 

তথ্যসুত্রঃ

১। Humankind: A Hopeful History; Rutger Bregman; Bloomsbury
২। Golding, William. Lord of the Flies. New York: Coward-McCann, 1962. Print
৩। https://vocal.media/authors/sam-bridge
৪। https://people.com/human-interest/inside-real-life-lord-of-the-flies-survival-of-6-tongan-boys-54-years-ago/