আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ’র একশো বছর এবং কিছু অচেনা গোয়েন্দা

বাপ্পাদিত্য চক্রবর্তী


এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ একমাত্র ডিটেক্টিভ যার মৃত্যুর খবর বেরিয়েছিল নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রথম পাতায়, ১৯৭৫ সালে।

জন্ম: ১লা এপ্রিল, ১৮৫০। বাবা জ্যুল-ল্যুই পোয়াখ্‌হ, মা গদালীভ পোয়াখ্‌হ। জন্মস্থান বেলজিয়ামের হাইনো প্রদেশের গন্ডগ্রাম এলারজেল্‌। সেখানেই বার্থ সার্টিফিকেট রয়েছে। মতান্তরে বেলজিয়ামের স্পা শহরের কাছে কোনো এক গ্রামে। তবে মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে ওরকম মতান্তর হয়েই থাকে। প্রসঙ্গত, যেহেতু বেলজিয়াম খুবই ছোট দেশ, স্পা থেকে এলারজেল্‌-এর দূরত্ব বেশি নয়। তবে, আগাথা ক্রিস্টি লিখেছিলেন (দ্য বিগ ফোর, ১৯২৭), “আমরা কিন্তু স্পা শহরে ঢুকিনি। বড় রাস্তা ছেড়ে গাছে ছাওয়া পাহাড়ের গা দিয়ে একটা ছোটো গ্রামে পৌঁছেছিলাম। আরো উঁচুতে একটা ভিলা।“ ক্রিস্টির ভাষা পড়ে মনে হয়, এই ভিলাটাই পোয়াখ্‌হ-দের পৈত্রিক বাড়ি।

নামকরণ: এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ (ফরাসী উচ্চারণটাই দিলাম, ইংরেজরা বলে হারকিউল পয়রো, বাঙালিরা বলে এর্কিউল পয়রো - যস্মিন দেশে যদাচারঃ। এরপরও যদি উচ্চারণ নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকে তাদের জ্ঞাতার্থে একটা উদাহরণ। tres bien (very good) এর উচ্চারণ হচ্ছে ৎখে বিয়ঁ।) নামটা এসেছিল দুজন অন্য ডিটেক্টিভ-সাহিত্যের নায়ক থেকে। মেরী বেলো লওন্ডেস-এর এর্ক্যুল পোপো এবং ফ্রাঙ্ক হোয়েল ইভান্স-এর মঁসিয় পোয়াখ্‌হে, যিনিও একজন অবসরপ্রাপ্ত বেলজিয়ান পুলিস অফিসার, লন্ডনে থাকেন।

পাঠকসমক্ষে আত্মপ্রকাশ: ১৯২০ (দ্য মিস্টিরিয়াস এফেয়ার অ্যাট স্টাইলস্‌ ; যদিও বইটা লেখা হয়েছিল ১৯১৬ সালে)। সেই হিসাবে এবছর শতবর্ষ পূর্ণ হল পাঠকদের সামনে আসার। এখানে বলে রাখা ভালো যে আগাথা ক্রিস্টি নিজেই (অটোবায়োগ্রাফি) বলেছিলেন যে প্রথম লেখার সময় পোয়াখ্‌হকে একটু বেশি বয়স্ক করে ফেলেছিলেন। তখন কি উনি জানতেন, যে আগামী পঞ্চান্ন বছর ধরে ওই ডিটেক্টিভকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে!

লেখা পড়ে যতদূর জানা যায়, পোয়াখ্‌হ ১৮৯৩ সাল পর্য্যন্ত ব্রাসেলস পুলিসে ছিলেন, এবং পুলিস চীফ হয়েছিলেন। শাকরেদ ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে বলেছেন যে জীবনে অনেক অপরাধই উনি সমাধান করতে পারেননি, তবে যেটা ওনাকে সবসময় খোঁচাত সেটা হল দ্য চকোলেট বক্স-এর (১৯২৩) কেস।

নাগরিকত্ব: বেলজিয়ান। অনেক বইতেই পোয়াখ্‌হ এটা বলতে বাধ্য হয়েছেন যে উনি বেলজিয়ান, ফরাসী নন। অনেক পাঠক আগাথা ক্রিস্টিকে প্রশ্ন করেছিলেন যে উনি পোয়াখ্‌হকে বেলজিয়ান কেন করলেন। এর একটা উত্তর এই হতে পারে যে ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম ছিল জার্মানীর অধীনে, এবং সেই কারণে পোয়াখ্‌হ-র মত নামজাদা ডিটেক্টিভেরও কাজের অভাব ঘটেছিল। ইতিহাস চর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের মনে থাকবে যে জার্মানির বেলজিয়াম দখলের পরিপ্রেক্ষিতেই ব্রিটেন প্রথম মহাযুদ্ধে শামিল হয়। তখনকার খবরের কাগজে ‘রেপ্‌ অফ্‌ বেলজিয়াম'স্ প্রায় রোজকার শিরোনাম ছিল। তবে পোয়াখ্‌হ’র যে তখন নামডাক যথেষ্ট ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইন্সপেক্টর জ্যাপ্‌, পোয়াখ্‌হ সম্বন্ধে একজন সহকর্মীকে বলেছেন - "আমার কাছে পোয়াখ্‌হ’র নাম শুনেছ তো? আমরা ১৯০৪-এ অ্যাবারক্রম্‌বী ফর্জারী কেসে একসাথে কাজ করেছিলাম। শেষ পর্য্যন্ত ব্রাসেলসেই তাকে ধরা গেল। সেসব কি দিন ছিল, মঁসিয়। ‘ব্যারন’ অল্টারের কথা মনে আছে? অর্ধেক ইউরোপের পুলিস তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। শেষ অবধি মঁসিয় পোয়াখ্‌হ-র সাহায্যে অ্যান্টোয়ার্পে গিয়ে তাকে ধরতে পারি।" (দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস, ১৯২০)

মৃত্যু: ১৯৪৯ (টেলিভিশনের মতে)। ১৯৭৫ (আগাথা ক্রিস্টির লেখা অনুযায়ী)। তবে কেসটা একই - কার্টেন: পোয়াখ্‌হ’স লাস্ট কেস’। বলা দরকার, যে ষাটের দশকেও পোয়াখ্‌হ-র বই বেরিয়েছে। প্রথম দিকে পোয়াখ্‌হ’র দৃষ্টিভঙ্গিতে শার্লক হোমসের ছায়া পাওয়া যায়। তবে পরে এটা প্রায় পুরোটাই কাটিয়ে উঠেছিলেন ক্রিস্টি। ওনার প্রথম দিকের নভেলগুলোতে আরেকজন গোয়েন্দার বেশ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি হলেন এ.ই.ডব্লিউ মেসনের ফরাসী ডিটেক্টিভ ইন্সপেক্টর হানো। প্রথম বই বেরিয়েছিল ১৯১০ সালে, অ্যাট দ্য ভিলা রোজ্‌।

তবে আমি এখানে এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ-র  গোয়েন্দা চরিত্র-বিশ্লেষণ করতে বসিনি। আগাথা ক্রিস্টি প্রায় সকলেই পড়েছেন, তাঁদের বিরক্তিভাজন হবার কোনো শখ নেই আমার। ২০২০ যে শুধু কোভিড ১৯ ভাইরাসের জন্যই মনে থাকবে তা নয়, এটুকুই শুধু জানিয়ে রাখলাম। আর একটা উদ্দেশ্য আছে আমার, সেটা হল - এই সুযোগে আরও অনেক গোয়েন্দা চরিত্র, যাঁরা শার্লক হোমস্  আর এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ-র জনপ্রিয়তার চাপে হারিয়ে গেছেন তাঁদের কথা বলা। শার্লক হোমসের জনপ্রিয়তা এতই ছিল যে  দ্য ফাইনাল প্রবলেম-এ যখন রাইখেনবাখ জলপ্রপাতে কোনান ডয়েল শার্লক হোমস্-কে মেরে ফেললেন, তখন পাঠক মহলে এত প্রতিবাদ উঠলো যে শার্লক হোমস্-কে আবার ফিরে আসতে হল। (দ্য রিটার্ন অফ শার্লক হোমস,  দ্য এম্পটি হাউস)

।। ২ ।।

একটু আগেই  বলেছি আগাথা ক্রিস্টির প্রথম দিকের লেখায় শার্লক হোমসের স্পষ্ট ছাপ ছিল। তবে কোনান ডয়েল নিজেই কি সম্পূর্ণভাবে ‘অরিজিনাল’? না, তা নয়, আর সে কথাটা কোনান ডয়েল নিজেই স্বীকার করেছেন। উনি মডেল হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন এডগার অ্যালেন পো-কে। পো তখন তাঁর মার্ডার্স ইন দ্য হুই মর্গ  লিখে বিখ্যাত। তবে কোনান ডয়েলের সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির তফাৎ এই যে ক্রিস্টি সমসাময়িক অন্যান্য লেখকদের গোয়েন্দা চরিত্রদের বিভিন্ন ভাবে উল্লেখ করেছেন এবং কাউকেই ছোটো করেননি। অন্যদিকে শার্লক হোমস্ ওয়াটসন-কে  আ স্টাডি ইন স্কারলেট-এ বলছেন -"লেকক ইজ আ মিসারেবল বাঙ্গলার।"

প্রশ্ন হল, এই লেকক (উচ্চারণ লেকো) কে? আর তার ওপর এত রাগই বা কেন?

উত্তরটা খুঁজতে হলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ফিরে  যেতে হবে।  পো-র বছর দশেক পরেই এমিল গ্যাবোরো পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর গোয়েন্দাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন - লেকক, তিরাক্ল ইত্যাদি। অবশ্য ইতিমধ্যে চার্লস ডিকেন্স তাঁর নিজস্ব গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর বাকেটের কীর্তিকাহিনী পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন (ব্লীক হাউস, ১৮৫৩), এবং আরও গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন (হান্টেড ডাউন, দ্য ট্রায়াল ফর মার্ডার, ইত্যাদি)। এরপর এলেন উইলকি কলিন্স, পৃথিবীবিখ্যাত বই দ্য মুনস্টোন নিয়ে,   যেটার সম্বন্ধে টি এস ইলিয়ট বলেছিলেন এর  মতো ভালো ডিটেক্টিভ বই আর লেখা হয়নি। গোয়েন্দার নাম? সার্জেন্ট কাফ। তবে ওনার দ্য উওম্যান ইন  হোয়াইট’ বোধহয় এটার থেকেও জনপ্রিয় বই।

কোনান ডয়েল, এডগার এলেন পো-কে নিজের পূর্বসূরী বলে স্বীকার করেছিলেন, কিন্তু গ্যাবোরোকে করেননি। আর তাছাড়া আরো অনেকে ছিলেন সেই সময় যাঁরা, শার্লক হোমসের মতোই লজিক আর অবজার্ভেশনের ওপর ভিত্তি করে রহস্য সমাধান করতেন। তাহলে, কোনান ডয়েল কৃতজ্ঞতা কেন স্বীকার করলেন না?

আমার ধারণা এর দু-তিনটে  কারণ আছে। প্রথম কারণ হল, ঈর্ষা। কোনান ডয়েল যখন  লেখা শুরু করেছেন তখন গ্যাবোরো  খ্যাতির তুঙ্গে। মেইন কম্পেটিটর বলতে পারেন। স্বভাবতই নিজের ডিটেক্টিভকে প্রতিযোগীর হিরোর ধাঁচে ফেললেও, সেটা স্বীকার করতে নিশ্চই চাইবেন না। পো তো আগেই গত হয়েছেন। সুতরাং সেখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। অবশ্য এটাও স্বীকার্য যে শার্লক হোমস্-এর চরিত্র আর লেককের চরিত্রের মধ্যে অনেক তফাৎ। প্রথমত শার্লক হোমসের অনেক গুণ, একাধারে কেমিস্ট, ফরেনসিক অ্যানালিস্ট, চলমান ক্রাইমের বিশ্বকোষ, সবই আছে। হোমসের ভাই মাইক্রফটকে ছাড়া হোয়াইটহল  চলেনা।  অন্যদিকে লেকক একজন চোর, ভোল পাল্টে পুলিশ হয়েছে। তাকে দেখলে কারো সমীহ হয় না। গ্যাবোরো  লেকককে  এঁকেছিলেন একজন সত্যিকারের চোর থেকে পুলিশ হওয়া লোককে দেখে। তার নাম ইউজিন ফ্রান্সিস ভিডক (১৭৭৫-১৮৫৭)। অবশ্য  চেস্টারটনের ফাদার ব্রাউনের সঙ্গী ফ্ল্যাম্বোও শুরুতে চোরই ছিল।

দ্বিতীয় কারণ, আমার মনে হয়, পদ্ধতি। হোমসের পদ্ধতি এবং তাবারে তিরাক্ল বা লেককের কাজের ধরন প্রায় একই রকম।  লেকক এবং তার গুরু তিরাক্ল এদের দুজনেরই পর্যবেক্ষণ থেকে একটা স্পষ্ট ধারণায় আসা - সেটা যে শার্লক হোমস্ মার্কা - অর্থাৎ শার্লকের বাবা মার্কা - সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণ দিই। লেকক  এবং তিরাক্ল (যার আসল নাম তাবারে)-এর প্রথম বই, দ্য উইডো লেরুজ থেকে  উদ্ধৃতি (অনুবাদ আমার নিজের, আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি) - “আমাকে ক্ষমা করবেন, খুনটার  সম্বন্ধে কোনো কিছুই আমি এখনই জানতে চাই না। এতে আমার মন পরিষ্কার থাকবে। প্রমাণ থেকে পরিষ্কার ধারণা করতে পারবো।” বলতে বলতেই তাবারের চোখদুটো চকচক করতে লাগল, শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল, মনে হল যেন বয়স কমে গেছে, অত্যাধিক উৎসাহিত হলে যেমন হয়। লেকককে সঙ্গে নিয়ে প্রায় দৌড়ে চলে গেলেন অকুস্থলে।  আধ ঘন্টা পরে আবার সেভাবেই দৌড়ে  এসে  সোজা   বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঘন্টাখানেক পরেও যখন ফিরলেন  না, তখন ম্যাজিস্ট্রেট মঁসিয় দুবেরঁ কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করলেন তাবারে কোথায়। উত্তর হল - “রাস্তায়, মাটিতে শুয়ে প্লাস্টার অফ প্যারিসের সাথে জল মিশিয়ে কিসব করছে। আমায় বললে এখুনি আসবে।” হলোও তাই, কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাবারে আর লেকক দুজনেই হুজুরে হাজির। লেখকের হাতে একটা ঝুড়ি, তাতে প্লাস্টার অফ প্যারিসের ছাঁচে পায়ের ছাপ।

- “ধাঁধা সমাধান করেছি।” উৎফুল্ল ভাবে বললেন তাবারে।

“কি পেলেন?” ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্ন।

“খুনি একজন যুবা, মাঝারি হাইটের থেকে একটু লম্বা, খুব ফ্যাশনেবল ড্রেস পরা, মাথায় টপ হ্যাট ছিল। ছাতা ছিল হাতে, আর ট্রাবুকস সিগার খেয়েছে, হোল্ডারে লাগান।”

কি প্রমাণ  থেকে তাবারে এই সুস্পষ্ট ধারণায় এলেন  সেটা এখানে বলার দরকার নেই। পাঠক-পাঠিকারা বইটা পড়তে পারেন। কিন্তু আসল কথা, পুরো ব্যাপারটা কেমন চেনা চেনা লাগছে না? আরও একটা উদাহরণ দিই।

এই বইটার নাম মঁসিয়ে লেকক, যে বইতে লেককের সঙ্গে পাঠকের প্রথম  পরিচয়। গল্পটার শুরু এইরকম। ...প্যারিসে এক জায়গায় দুটো খুন  হয়েছে। প্রায় মধ্যরাত। বরফ পড়া বন্ধ হয়েছে ঘন্টাখানেক আগে । লেকক এবং তার সহকর্মী, পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে করতে এক জায়গায় পৌঁছল যেখানে ইঁট পাথর ইত্যাদি ফেলা রয়েছে, বোধহয় কোনো বাড়ি তৈরির কাজ চলছে।

“আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি,” লেকক  বললে - “খুনি যখন দুজন মহিলার সঙ্গে পাবটাতে গিয়েছিল, তখন খুনির সাথে যে এসেছিল, সে এখানে অপেক্ষা করেছে। আমি বলবো সে লোকটা লম্বা ছিল, মধ্যবয়সী, মাথায় ছিল একটা সফ্ট  টুপি, খয়েরি রঙের উলের ওভারকোট ছিল গায়ে। বিবাহিত, বা কোনো সময় বিবাহিত ছিল, অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিল, এমন সময় হঠাৎ মহিলাদের চিৎকার শুনতে পেয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, একজন মহিলা প্রায় অজ্ঞানই হয়ে যাওয়াতে অন্যজন তাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসছিল...।” বিদগ্ধ পাঠক শার্লক হোমসের আ স্টাডি ইন স্কারলেট আর ক্রুকেড ম্যান-এর সঙ্গে তুলনা করে দেখবেন।

এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শার্লক হোমস্ আর তাবারের কাজের ধরনের মধ্যে সামঞ্জস্য পরিষ্কার।

ঈর্ষা এবং পদ্ধতি দুটোর  ব্যাপারই  তো বোঝা গেল। আর কি কারণ থাকতে পারে গ্যাবোরো সম্বন্ধে কোনান ডয়েলের অনীহার?

আমার নিজের যা মনে হয়, সেটা হল অ্যাপ্রোচ। দুজন দুভাবে  গল্পটাকে দেখতেন। দুজনের লেখার বিন্যাস আলাদা। অবশ্য সেটা তো হবারই কথা। ইংরেজিতে যা কয়েকটা শব্দে বলা যায়, ফরাসিতে সেটা বোঝাতে বেশি শব্দ ক্ষয় হয়। কিন্তু এছাড়াও, কোনান ডয়েল অ্যাটমোস্ফিয়ার, অর্থাৎ ঘটনার পারিপার্শ্বিকের  ওপর খুব বেশি জোর দিতেন না। একমাত্র ভ্যালি অফ ফিয়ার আর হাউন্ড অফ ব্যাসকারভিলস্ এই দুটিতে কিছুটা পাওয়া যায়। এছাড়াও, শার্লক হোমস্-কে প্রায়ই বলতে শোনা গেছে, “ওয়াটসন, তুমি রহস্যের লজিকাল প্রগ্রেস ভুলে গিয়ে  চরিত্রের ওপর বেশি জোর দিচ্ছ। এটা ভুল। একটা খুনের  রহস্য উন্মোচন হবে একটা বৈজ্ঞানিক লেখার মতো।” অবশ্যই ওয়াটসন একথা মানেননি। তবে কোনান ডয়েল যে কিছু অংশে অন্তত মেনেছিলেন সেটা বোঝা যায়।

গ্যাবোরোর ব্যাপারটা অন্যরকম। ওনার গল্প নিজের তালে চলে, আর রহস্য উন্মোচন নিজের তালে। ডিটেকটিভ প্রধান চরিত্র হলেও, অন্যান্য চরিত্রও মনে ছায়া ফেলে যায়। রহস্য  উন্মোচনের  সময় জীবনকে যে বাদ দেওয়া যায় না, এটা উনি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

গ্যাবোরো ছাড়া আর কারা হারিয়ে গেছেন? অনেক নাম আছে, স্বল্প পরিসরে সব এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হবে না। অবশ্য, গোয়েন্দা-কাহিনীর পাঠকের কাছে এডগার ওয়ালেস এবং জি. কে. চেস্টারটন চিরকালই প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

তবে আরও একটা ঘটনা ইতিমধ্যে  ঘটেছে। সেক্সটন ব্লেক রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। গোয়েন্দা চরিত্রের মধ্যে যদি কোন চরিত্রকে শার্লক হোমসের পুরো প্রতিচ্ছবি বলা যায় তাহলে তিনি হলেন সেক্সটন ব্লেক। লেখক হ্যারি ব্লিথ (আসল নাম হাল মেরিডিথ) প্রথম গল্পটা বিক্রি করেছিলেন নয় গিনিতে  (দ্য মিসিং মিলিওনেয়ার, ১৮৯৩)। তবে কন্ট্রাক্টটা ভালো করে দেখেননি বিক্রি করার সময় -  গল্পের সঙ্গে সেক্সটন ব্লেকের নামের কপিরাইটও বিক্রি করে দিয়েছিলেন, পয়সার এতটাই টানাটানি ছিল। ফলে যা হবার তাই হল। রাম, শ্যাম, যদু, মধু, সবাই সেক্সটন ব্লেকের নাম দিয়ে গল্প লিখতে লাগল।

আরো একজনের কথা এখানে উল্লেখ করছি। তিনি হলেন আর্থার. বি. রীভ। ইনি সৃষ্টি করেছিলেন গোয়েন্দা ক্রেগ কেনেডি-কে (দ্য ব্ল্যাক ডায়মন্ড, ইনভিসিবল রে)। লিখেছিলেন ১৯০০ থেকে ১৯২০ অবধি। এই ক্রেগ কেনেডি চরিত্র একসময় এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে লোকেরা বলত ‘আমেরিকান শার্লক হোমস্’। তবে পরে রেমন্ড চ্যান্ডলার প্রমুখ  লেখকেরা আসার পর রীভ-এর জনপ্রীতি কমে যায়।

ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া নামের মধ্যে থেকে দুটো নাম না করে পারছিনা - এক, ডক্টর থর্নডাইক (লেখক আর. অস্টিন   ফ্রীম্যান),  আর দুই, এ. ই. ডব্লিউ মেসনের ইন্সপেক্টর হানো। ডক্টর থর্নডাইকের নভেল আর গল্প বেরিয়েছিল ১৯০৭-১৯৪১ অবধি। গোয়েন্দাদের মধ্যে উনিই বোধহয় প্রথম ফরেন্সিক (মেদিকো-লিগ্যাল)  ডিটেক্টিভ। লেখক হিসাবে ফ্রীম্যানের বিশেষত্ব ছিল যে উনি গল্পে যা লিখতেন, বাস্তবে সে জায়গা নিজে আগে ঘুরে আসতেন, এবং যে সমস্ত ফরেনসিক এক্সপেরিমেন্ট ওনার লেখায় স্থান পেত, সেগুলো নিজে হাতেনাতে করে দেখতেন। আর ছিল ফ্রীম্যানের লেখার স্টাইল। তবে উনি শুরু করতেন উল্টোদিক দিয়ে, মানে, অপরাধী কীভাবে পুরো অপরাধটা প্ল্যান করল, কীভাবে অপরাধটা করল, সেটা দেখাতেন, তারপর ডক্টর থর্নডাইক রঙ্গমঞ্চে আসতেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিমায় প্রত্যেকটা সূত্র ধরে অপরাধীকে ধরতেন। গল্পগুলোতে রহস্য-উন্মোচনের অংশ সবই প্রায় ডক্টর জার্ভিসের (থর্নডাইকের সহকর্মী) জবানিতে। পরে অবশ্য ডক্টর থর্নডাইকের গল্পগুলোর ওপরে টেলিভিশন সিরিজও হয়েছে। তবুও, আজ কতজনই বা ওই নাম জানে?

ইন্সপেক্টর হানোকেও লোকে ভুলে গেছে। আগে বলেছি যে আগাথা ক্রিস্টির লেখায় ইন্সপেক্টর হানোর প্রভাব লক্ষণীয়।  ১৯১০ সালে মেজর এ. ই. ডব্লিউ মেসন ইন্সপেক্টর হানো-র  চরিত্র সৃষ্টি করেন। উদ্দেশ্য - শার্লক হোমসের থেকে যতখানি পারা যায়, অন্যরকম এক গোয়েন্দাকে পাঠকের সামনে আনা। ইন্সপেক্টর হানো হোমসের মত দীর্ঘাঙ্গ নন, অপেক্ষাকৃত বেঁটে এবং স্থূল। হানো পেশাদার পুলিসম্যান, অ্যামেচার ‘ভদ্রলোক’ ডিটেকটিভ নন। তিনি ফরাসী সুরেটে চাকরি করেন, ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডের লোক নন। ওনার ‘ওয়াটসন’ হলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাঙ্কার - জুলিয়াস রিকার্ডো। সবথেকে বড়ো  কথা, হানো মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণে বিশ্বাস করেন, চাক্ষুষ প্রমাণের থেকেও অনেক বেশি।

দুজন ব্যতিক্রমী লেখকদের কথা  বলে এই প্রসঙ্গে দাঁড়ি টানব। তাঁরা হলেন ক্লিনটন স্ট্যাগ আর আর্নেস্ট ব্রামাঃ। এঁদের দুজনের ডিটেক্টিভই অন্ধ। ক্লিনটন স্ট্যাগ সৃষ্টি করেছিলেন থর্নলি কোল্টন চরিত্রকে, আর ব্রামাঃ লোকসমক্ষে এনেছিলেন ম্যাক্স ক্যারাডোসকে।

এই দুজন অন্ধ ডিটেক্টিভই তাঁদের একটি ইন্দ্রিয় খুইয়ে বাকিগুলোকে এত জাগ্রত করেছিলেন যে, এক জায়গায় ক্যারাডোস বলছেন - “আমি  স্পিরিট গামের গন্ধ পাঁচ ফুট দূর থেকে টের  পাই, বুঝতে অসুবিধা হয়না যে লোকটার গোঁফটা আসল নয়।” কোল্টনেরও প্রায় একই রকম। কোল্টন আবার একটা ঘড়ি পরেন  যার কাচ নেই, হাত দিয়ে বুঝে নেন ঘড়ির কাঁটা কোথায়, আর খবরের কাগজের ওপর হাত বুলিয়ে লেখা পরে নিতে পারেন, ওনার আঙ্গুল এতই সেনসিটিভ। এটা অবশ্য ক্যারাডোসও পারেন। সহযোগী দুজনেরই আছে।

ক্যারাডোস-এর সহযোগীর নাম পার্কিনসন - সে আবার ক্যারাডোস-এর ভ্যালেও বটে। কোল্টনের সহযোগী তার সেক্রেটারি, ডাকনাম ‘থিনগামিবব’, অর্থাৎ, কোনো ইম্পর্টেন্স নেই। বলে রাখা ভাল, কোল্টন আমেরিকান, আর ক্যারাডোস আধা-ইংরেজ।  স্টাইলের ব্যাপারে কোল্টন এবং ক্যারাডোস সমগোত্রীয়। অ্যাপ্রোচের  ব্যাপারেও অনেকটা তাই।

।। ৩ ।।

উনিশ শতকের গোয়েন্দা গল্পের বিশেষত্ব হলো যে, গোয়েন্দা মূল চরিত্র, এবং পুলিশ অপেক্ষাকৃত বোকা এবং অকর্মণ্য। তারা পুরোনো হিন্দি সিনেমার মতো শেষ দৃশ্যে এসে উপস্থিত হয় শুধু অ্যারেস্ট করার জন্য। এটা চললো প্রায় উনিশশো চল্লিশ-পঞ্চাশ অবধি।  আগাথা ক্রিস্টি, ডরোথি সেয়ার্স, জন ডিকসন কার, এঁরা সবাই চুটিয়ে লিখেছেন  উনিশশো বিশ  থেকে উনিশশো পঞ্চাশ অবধি গোয়েন্দাকে প্রধান চরিত্র করে। এই যে ধারা, এর প্রধান একটা অঙ্গ হল, যে গোয়েন্দারা সবাই, যাকে বলে 'ক্যারেক্টার', অর্থাৎ, সবারই কিছু না কিছু বিশেষত্ব আছে, কেউ ভুলো মন, কেউ নেশা করে (শার্লক হোমসের কোকেন নেওয়া)। কারোরই কোনো পরিবার নেই, সবাই একলা - ‘লোন  উল্ফ’। এদের প্রাগৈতিহাসিক বলা যায়।  ডাইনোসোর। প্রায়ই পুলিশকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এবং এদের কাজের নিয়ম কোনো পুলিশ প্রসিডিওরের ধার ধারেনা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে থেকেই পুলিশের কাজকর্ম এবং ধরনধারণ অনেক উন্নত হল সব ক্ষেত্রে। ফিঙ্গার প্রিন্ট, ফরেনসিকস, আরও নানারকম টেকনিক্যাল উন্নতি হল। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গোয়েন্দা কাহিনীকেও এগিয়ে যেতে হলো। তবে সেটা ত্রিশের দশকের পরে বেশি। পুলিশের কাজে একটা গ্ল্যামার এল। এটারই প্রতিফলন দেখা যায় জন ক্রেসে (ইন্সপেক্টর ওয়েস্ট), জে জে মারি (গিডিয়ন), এবং আরও পরে ষাটের দশকে কলিন  ডেক্সটার (ইন্সপেক্টর  মরিস), ইয়ান র‍্যাঙ্কিন, এবং আরো অনেকে, যাঁরা বাজার মাতিয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমেরিকান এবং কন্টিনেন্টাল (প্রধানত ফরাসি) ডিটেক্টিভ সাহিত্য এবং গল্প দুইই অনেক এগিয়েছে। সেটা নিয়ে বিশদে পরে  আলোচনা করা যাবে। তবে দু'একটা নাম এখানে না বললে, এই পর্ব অসমাপ্ত  থেকে যাবে। এঁদের  মধ্যে অবশ্যই জর্জস সিমেনঁ (ইন্সপেক্টর মেগরে), আদতে বেলজিয়ান, যিনি ডিটেকটিভ জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন, এবং যাঁর উত্তরসূরি ফরাসি লেখিকা  ফ্রেড ভার্গাস (কমিশনার এডামবে্যার) গত কুড়ি  বছরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছেন। ইতিমধ্যে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান গোয়েন্দা সাহিত্য অনেক এগিয়েছে। তবে তাদের গল্পগুলি সবই প্রায় "নোয়া',  অর্থাৎ 'ডার্ক'। এর মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করা আমার কাজ না। আর আমেরিকান লেখকদের মধ্যে এত নাম আছে যে শুধুমাত্র রেমন্ড চ্যান্ডলার বা এলারী ক্যুইন  বললে অন্য লেখকদের পাঠকরা আমাকে জুতো মারতে বাকি রাখবেন।

এটাও জেনে রাখা দরকার যে বাকি পৃথিবী পেছিয়ে থাকেনি। স্প্যানিশ, জার্মান, জাপানি, এবং রাশিয়ান লেখকরাও বহু গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন। এই আলোচনাও পরে করা যেতে পারে।

ইদানিং অবশ্য গোয়েন্দা কাহিনীতে আর একটা ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে। লেখকরা অনেকেই ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ইত্যাদির  যুগ  ছেড়ে পুরোনো দিনে ফিরে যাচ্ছেন, যেখানে গোয়েন্দার নিজের মাথাটাই প্রধান সম্বল ছিল। আরও অনেকে একেবারে মধ্যযুগে, অর্থাৎ মিডিয়াভাল যুগে ফিরে গেছেন, যেমন এডিথ পারগেটার (ছদ্মনাম এলিস পিটার্স), পল ডোহার্টি, মাইকেল জেক্স ইত্যাদি। (চুপিচুপি বলে রাখি, আমার নিজেরও  একটা লিখতে ইচ্ছা হয়- চুপিচুপিই বললাম, নইলে বলবেন বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। ভয় নেই, মাত্র কুড়ি পাতা লিখে উঠতে পেরেছি, আশা করি শেষ হবে না।)

বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীর কথা কেন বললাম না? খুব সহজ। এতজনে এতকিছু লিখেছেন যে আর কিছু লেখার আবশ্যকতা যদি থেকেও থাকে, আমার অন্তত ইচ্ছা নেই।

।। ৪ ।।

এর্ক্যুল পোয়াখ্‌হ’র শতবর্ষে গোয়েন্দা-সাহিত্যকে যাঁরা বহুলভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁদের কয়েকজনের কথা বললাম। সবার কথা এখানে বলা সম্ভব নয়।  তবে একজনের কথা, ভারতীয় হিসাবে, না বললেই নয়। ইংরেজী গোয়েন্দা-সাহিত্যে, ইংরেজের সৃষ্টি করা একটাই ভারতীয় চরিত্র আছে - ইন্সপেক্টর ঘোটে, মুম্বাই পুলিস। সৃষ্টি করেছিলেন এইচ. আর. এফ. কীটিং, ১৯৬৪ সালে। প্রথম বই - দ্য পারফেক্ট মার্ডার । মোট ছাব্বিশটা বই বেরিয়েছিল। অবাক কান্ড, ১৯৭৪-এর আগে কীটিং কখনো ভারতে পা দেননি।

অনেক কথাই বলা হল না, তবে, দরকার কি? অনেকগুলো ক্লু তো দিলাম। বুঝ লোক যে জান সন্ধান।