আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

সুশাসনের উৎকন্ঠা আদালতের রায়েও

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস


যে কোনো দেশের বিচার ব্যবস্থা সেদেশের গণতন্ত্রের পরিসরকে চিনতে সাহায্য করে। সেই নিরিখে আদালতের এক একটি রায়ের সময়কালের প্রেক্ষিত তুলে আনে সমাজের সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্রের খুঁটিনাটি। কালের নিরিখে আদালতের এমন অনেক রায় সমকালীন সমাজে চালিকা হিসেবে শক্তি জুগিয়েছে আবার কখনও কখনও অনেক রায়েই ধাক্কা খেয়েছে মানুষের প্রত্যাশা। আদালতের রায় তৈরি হয় প্রামাণ্য নথি, যুক্তি ও ঐতিহাসিক সত্যের বিন্যাসে। ফলে আদালতে তৈরি রায়ের সিংহভাগই নির্ভর করে বস্তু নির্ভর তথ্যের উপস্থাপনার ওপর। বলাই বাহুল্য এমন তথ্য এবং বস্তু নির্ভর  উপস্থাপনার প্রক্রিয়া অনেকটাই রাষ্ট্রের ব্যাবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে।  সত্য অন্বেষণের লক্ষ্যে তদন্তে রাষ্ট্রের ভুমিকা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিরপেক্ষতার ওপরও বিষয়টি নির্ভরশীল। দেশের বিচার ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রের সক্রিয় উপাদান হিসাবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রের এমন নিরপেক্ষতার প্রশ্নটি বহু মূল্যবান।  রাষ্ট্রের সেই নিরপেক্ষতায় যেমন প্রয়োজন  ধর্মের নিরপেক্ষতা, বর্ণের নিরপেক্ষতা তেমনই প্রয়োজন আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক দাপট নিরপেক্ষ এক পরিচ্ছন্ন প্রশাসন। আদর্শ অর্থে এমন নিরপেক্ষতার ত্রুটি-বিচ্যুতি সহনসীমার মধ্যে রেখেই গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে পৃথিবীর বহু দেশ, ব্যতিক্রম নয় এদেশও। কিন্তু তেমন বিচ্যুতিরেখা যদি নিত্যদিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন অনুজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাড়িকাঠে পড়ে দেশের মানুষ, সামগ্রিক অর্থে দেশের গোটা সমাজ। সাম্প্রতিককালে এদেশের সর্বোচ্চ আদালতের তিন তিনটে  মূল্যবান পর্যবেক্ষণের  নিরিখে সময়কে ধরার চেষ্টায় বেরিয়ে পড়ছে এদেশের সমাজের গভীরে তৈরি হওয়া কিছু ক্ষত।

 

২০১১ ৮ই নভেম্বর ২০১৯

বাবরি ধ্বংস আইনের শাসনের গুরুতর লঙ্ঘন: সুপ্রিম কোর্ট

এবছরের ৩০ সেপ্টেম্বর।  উত্তরের অপেক্ষায় থাকা উত্তরপ্রদেশে আঠাশ বছর ধরে চলা বাবরি ধ্বংসের অপরাধ অন্বেষণের রায় ঘোষণা ছিল সেদিনই। দেশের সুপ্রিম কোর্টের চোখে বাবরি মসজিদ ভাঙার মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনাকে উত্তরপ্রদেশের সিবিআই আদালত কিছু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে মনে করেছে। মসজিদ এদেশের সংখ্যালঘু মানুষের উপাসনা গৃহ হলেও মসজিদ কাঠামো ধ্বংস বাস্তবে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামোকেই ধ্বংস করেছে বলেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চোখে সেটি ছিল এক ভয়ঙ্কর অপরাধের ঘটনা। সিবিআই আদালতের রায়ে জানা গেল যে তদন্তকারী সংস্থা, অভিযুক্ত গেরুয়া বাহিনীর নেতানেত্রীদের সংগঠিত অপরাধের প্রামাণ্য কোনো নথি পেশ করতে পারেনি বলেই ‘দোষ কারও নয় গো  মা’-এর মতো রায়ের কপি বেরিয়েছে আদালত থেকে। আঠাশ বছর আগের বাবরি ভাঙার সময় সংগঠিত অপরাধের ধারাবিবরণী থেকে সংবাদ মাধ্যমের অডিও-ভিডিও ফুটেজ দেশের কোটি কোটি মানুষ দেখতে পেলেও সেটি অধরা থেকে গেছে তদন্তকারি সংস্থার ঝুলিতে। ফলে উত্তর প্রদেশের মসজিদে আঘাত আসমুদ্রহিমাচল  দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনায় যে আঘাত হেনেছিল তারই অন্তিম পরিণতি দেখল দেশের মানুষ এমন রায়ে। 'Justice delayed - Justice denied' -  শতাব্দী প্রাচীন এমন প্রবাদের  বাস্তব রূপ দেখল দেশের মানুষ একুশ  শতকেও। এমন রায় দেশের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার দক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই তুলে দিয়েছে প্রশ্ন। পাক্কা আঠাশ বছর সময় পেয়েও অভিযুক্তদের বাবরি মসজিদের সামনে দেওয়া বক্তৃতার সপক্ষে বৈধ প্রমাণ   পেশ করতে না পারা এমন জরুরি মামলায় মামুলি ব্যর্থতা নয় বরং এই ব্যর্থতা অপরাধের তুল্য বলেই হয়তো ইতিহাসের মানদণ্ডে স্বীকৃতি পাবে। পাশাপাশি তদন্তকারী সংস্থাকে এক দশক আগে যেভাবে 'খাঁচা বন্দি তোতা পাখি'-র সাথে তুলনা করেছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে হালের গেরুয়া শাসনেও। কারণ সাম্প্রতিককালে গেরুয়া শাসকদলের প্রধান কেরলে শবরীমালা মন্দির বিতর্কের প্রেক্ষিতে তাঁর মুল্যবান ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন যে রায়দানের সময় বিচার বিভাগকে বিবেচনায় রাখতে হবে দেশের মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগের প্রশ্নটিকেও।  ফলে গেরুয়া সরকারের আমলে অভিযুক্ত গেরুয়া নেতানেত্রীদের অভিযোগের পক্ষে প্রমাণ তদন্তকারি সংস্থার হেপাজত থেকে হাপিস হওয়া এবং তাদের বেকসুর খালাস পাওয়ার ঘটনা এদেশে নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হয়ে রইল।

 

৭ই অক্টোবর ২০২০

হাথরাসের ধর্ষণের ঘটনা -  সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ 'বিরল,  ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক ঘটনা'।

লখনউ-এর  সিবিআই আদালতের বাবরি ধ্বংসের সাজা ঘোষণার  দিনেই  দ্বিতীয় আঘাত এলো মানুষের চিন্তার জগতে, ভাবনার বৃত্তে, আবেগের আঙিনায়, বিচারের বোধে। সেই  উত্তরপ্রদেশেই  বছর আঠাশ বছর আগে গেরুয়া শাসনকালেই যেমনভাবে ভেঙেছিল মসজিদ ঠিক সেভাবেই ভেঙে পড়লো মানুষের ভরসা দেশের সরকারের প্রতি, উত্তরপ্রদেশের সরকারের প্রতি হাথরাসের ঘটনায়। রাত তিনটের সময় চেলাকাঠের নিচে কেরোসিন/ডিজেল ঢেলে সেই রাজ্যের পুলিশ পুড়িয়ে দিল এক তরুণীর মৃতদেহ। না, করোনায় মারা যায় নি সে! দিনের পর দিন তিলে তিলে কষ্ট পাওয়া এই তরুণী ছিল  যোগী রাজ্যে ধর্ষণের শিকার। রামায়ণের বাল্মীকির রামকে ভোট ময়দানে নামিয়ে ভোটে জেতা যোগীর রাজত্বে আরও একবার বর্বরদের হাতে ধর্ষণের শিকার হতে  হল দলিত বাল্মীকি পরিবারের উনিশ বছরের সন্তানকে। পরিবার থেকে ছিনিয়ে পুলিশ দিয়ে ছিনিয়ে  নেওয়া এই কন্যা আজ মোদী - যোগী রাজত্বে হয়ে উঠলো 'বেটি বাঁচাও বেটি পোড়াও' কর্মসূচীর মূর্ত প্রতীক। ভোর রাতের ওই তরুণীর চিতার আগুনে এখন জ্বলে উঠেছে দেশ আর তার সাথে তুলে দিয়েছে অনেকগুলো সামাজিক রাজনৈতিক প্রশ্নকে। ধর্ষণের পর সেই হিংস্র জন্তুর দল সেই দলিত তরুণীর শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিলো, কেটে নিয়েছিল তাঁর জিভ। আর আজ তাঁর জ্বলন্ত মৃতদেহের ছবি দেখে লজ্জায় জিভ কাটছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। তরুণীর ভেঙে পড়া শিরদাঁড়া আসলে কোথাও ভাঙতে চাইছে মানুষের ন্যায় বিচারের প্রত্যাশাকে এমন আশঙ্কায় আতঙ্কিত সমাজের আমজনতাও। কারণ, নিত্যদিন মানুষ দেখে চলেছে যে  ক্ষমতার অলিন্দের চারপাশে থাকা মানুষদের সাত খুন মাফ হয়ে যাচ্ছে আর সমাজের অর্থ, ক্ষমতার মাপে  প্রান্তিক হওয়া  মানুষজনের  কাছে ন্যায় বিচার ক্রমশ প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। আজকের 'হাথরাস' তেমনই এক অধ্যায়ের সাক্ষী।

হাথরাসে  তরুণীর মৃত্যু ঘিরে তোলপাড় দেশে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্নের মুখে পড়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকারের পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা। তরুণীর মৃত্যুর পর থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজ্যের পুলিশ সেই হাথরাসে বিরোধী রাজনৈতিক  দল থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল।   প্রকাশ্য দিবালোকে এমন দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা  পরিবারের চোখের  সামনে ঘটলেও  রাজ্যের পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেনি। নির্যাতিতার মৃত্যুকালীন জবানবন্দীতেও উল্লেখিত ছিল ধর্ষণের কথা।  কিন্তু রাতের অন্ধকারে তরুণীর দেহ পরিবারের বিনা অনুমতিতে পুড়িয়ে ফেলে দেহের যাবতীয় ক্ষতের প্রমাণ লোপাট করে 'ধর্ষণ হয়নি' এমন তত্ত্বকেই মান্যতা দিতে চাইছে প্রশাসন। সে রাজ্যের শাসক দলের মনুবাদী আদর্শকে অক্ষুণ্ণ রাখতে এখন মরিয়া সে রাজ্যের পুলিস প্রশাসন। সে রাজ্যের শাসক দলের কেষ্টবিষ্টুরা ইতিমধ্যে ধর্ষিতা তরুণীর নির্যাতনকে লঘু করতে বাড়ির মেয়েদের বাইরে  বেরনোর উপযুক্ত শিক্ষার তালিম দিতে বলেছে সব মেয়েদের মা-বাপকে! সরকারের ধর্ষণ বিরোধী ভাষ্যের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে এখন অভিযুক্তদের গলায়। সে রাজ্যের গেরুয়া সমাজ সংস্কারকদের মদতে অভিযুক্তদের পরিবার থেকে ধ্বনি উঠছে দলিত পরিবারের ওই তরুণী ভিন্ন বর্ণের তরুণের সাথে মেলামেশার অপরাধে পরিবারের সদস্যদের হাতেই নাকি খুন হয়েছে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যে এমন ঘটনাকে ভয়াবহ এবং বিরল হিসাবে  চিহ্নিত করলেও সে রাজ্যের সরকার 'হাথরাস'  কাণ্ডে দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্রের গন্ধ আবিষ্কার করেছে। রাতারাতি বেরিয়ে এসেছে রাজ্যের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ধ্বংসের লক্ষ্যেই নাকি আন্তর্জাতিক অনুদানে পরিচালিত হয়েছে 'হাথরাস'-এর আন্দোলন! ফলে প্রত্যাশিত পথেই ভুরিভুরি পুলিশি অভিযোগ দায়ের হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন থানায়। সরকারের এমন  অভিযুক্তদের তালিকায় সমাজকর্মী থেকে রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক কেউ বাদ যায়নি। ফলে গণতন্ত্রে  ভিন্নমতের পরিসর যে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে দেশ জুড়ে তার একপ্রস্থ মহড়া চলছে 'হাথরাস' কাণ্ডে সরকারের এই বিচিত্র  ভুমিকা নিয়ে। সে রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এই বছরের শুরুতে পড়শি রাজ্য দিল্লির বিধানসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে সিএএ এবং এনআরসি বিরোধীদের উদ্দেশ্যে  তাঁর হুমকির ভাষণে বলেছিলেন 'বোলি কা ভাষা নহি সমঝা তো - গোলী কা ভাষা সমঝায়েগা'। যার অর্থ যদি কথায় কাজ না হয় তবে বন্দুকের গুলিতে নিশ্চয়ই কাজ হবে! আর এমন বিশ্বাসে ভর করে গোটা উত্তরপ্রদেশ জুড়ে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক মোকাবিলার পথ ছেড়ে 'এনকাউন্টারের' তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে গোটা রাজ্যেই।

দেশ জোড়া এমন নাড়া খাওয়া ঘটনায় নীরব দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রত্যেকেই। যারা মার্কিন রাষ্ট্রপতির করোনা সংক্রমণের খবরেও দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তাঁদের এমন নীরবতা আশ্চর্যের এবং উৎকণ্ঠারও।

এবিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর 'মন কি বাত' এখনও শুনতে পায়নি দেশের মানুষ। মোদী সরকারের প্রথম ইনিংসে এই উত্তরপ্রদেশের 'দাদরি'-তে প্রকাশ্যে দিবালোকে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে  খুন হতে হয়েছিল  নির্বিবাদী এক মানুষ মহম্মদ আখলাক-কে, তার ঘরের ফ্রিজে মাংস রাখার 'অপরাধে'। কিন্তু তখনও দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নীরব। আর কখনও তাঁর মুখ থেকে সেই হত্যার প্রতিবাদে একটি শব্দ শোনেনি দেশের মানুষ! ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার এমন অঙ্কে প্ৰমাণিত হচ্ছে যে এখন  'মোদী-শাহের' পরের সংস্করণ হিসাবে হিন্দুত্বের নতুন   'পোস্টার বয়' যোগী আদিত্যনাথের পথকেই মান্যতা দিচ্ছে শাসক দল। বিপদের ভয়াবহতা এখানেই। উত্তরের এই প্রদেশের ব্যাধি গোটা দেশ জুড়ে গেরুয়া শাসনে সংক্রামিত হলে সে হবে আরেক অতিমারি।

 

শাহিনবাগের অবস্থান সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট -

'Democracy and dissent go hand in hand but the demonstration expressing dissent have to be in a designated place.' 

গণতন্ত্রে ভিন্নমতকে স্বীকার আর ধারণ করার মধ্যেই নিহিত সেই ব্যবস্থার শক্তি আর সামর্থ্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক পথে ভোটে জেতার পর সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রতি শাসকের সমীহ নিয়ে এদেশে বরাবরই সন্দেহ উঁকি মেরেছে। সেই নিরিখে সাম্প্রতিক কালে শাহিনবাগ মামলার কার্যকারণ সম্পর্কে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের  পর্যবেক্ষণ  দেশের বর্তমান  রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বহুমাত্রিক গুরুত্বের।

প্রথমত এই পর্যবেক্ষণে যেমন স্বীকৃত হয়েছে গণতন্ত্রে সরকারের গৃহীত নীতির বিরুদ্ধে নাগরিকদের পথে নামার অধিকার। এমনকি তেমন নীতি আদালতের বিচারাধীন হলেও মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলনে বাধ সাধেনি আদালত। কিন্তু আন্দোলনে মানুষের পথে নামার অধিকার স্বীকৃত হলেও সুদীর্ঘকাল জুড়ে পথ আটকানোর আন্দোলনের পথ পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সেক্ষেত্রে শাহিনবাগে সিএএ-এনআরসি-র প্রতিবাদ অবস্থান হোক অথবা জাতীয় সড়ক আটকে রেখে সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনই হোক সবই সমদোষে দুষ্ট হতে পারে। কিন্তু দিল্লির শাহিনবাগে মহিলাদের দীর্ঘ শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ কোনো অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের দাবি তুলে ধরেনি। সেই বিক্ষোভ আন্দোলন ছিল দেশের সরকারের নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সমাজের কোটি কোটি মানুষের  উৎকণ্ঠার প্রতিফলন। সেই আন্দোলন দিল্লির শাহিনবাগের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল জুড়ে সংগঠিত হলেও দিল্লির পুলিস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নির্দেশে ওই অঞ্চলের আশেপাশের রাস্তায় তালা ঝুলিয়ে দেয় নাগরিক নিরাপত্তার অজুহাতে। ফলে আন্দোলনস্থলের চেয়ে ঢের বেশি অঞ্চল অবরুদ্ধ হতে থাকে দিনের পর দিন সরকারি সিদ্ধান্তেই। আর কৌশলে এমন অচলাবস্থার দায় চেপে যায় সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। এমন অচলাবস্থার প্রশমনে যখন দেশের সরকারের প্রাথমিক দায় আলাপ আলোচনার শুরুর উদ্যোগ, সেটা না করে কার্যত আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী বানানোর প্রয়াসে কেন্দ্রের শাসক দলের মদতে শুরু হয় ঘৃণার প্রচার। সে প্রচারের লক্ষ্য ছিল দিল্লির বিধানসভা ভোটে মেরুকরণের কৌশল। ফলে নির্বাচনের প্রতিটি সভা থেকে গেরুয়া শাসকের মন্ত্রীসান্ত্রীরা নিয়ম করে প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহী বানানোর উস্কানিমুলক প্রচার চালিয়েছে। সেসব প্রচারে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যেমন এসেছে সিএএ  বিরোধী আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে চেনার ভাষ্য তেমনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণে এসেছিল ইভিএমের বোতাম টিপে প্রতিবাদীদের বিদ্যুতের শক লাগানোর পরামর্শ। যাতে দিল্লির ভোটে ফল ঘোষণার পর শাহিনবাগ চত্বর ফাঁকা হয়ে যায়। স্পষ্টত কেন্দ্রের শাসক দলের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আলোচনার পথ বন্ধ করে বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতিকে কীভাবে উসকে দেওয়া যায়। এটাই কি গণতন্ত্রে ভিন্নমত পোষণের পরিণতি? সেই সময় সংবিধান হাতে শপথ নেওয়া  দেশের কনিষ্ঠ অর্থমন্ত্রী হুমকি দিয়ে বলেছিলেন 'দেশ কে গদ্দারও কো, গোলী মারো শালো কো'। আর এমন ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করার অনিবার্য পরিণতি হয়ে উঠলো দিল্লির ভয়াবহ দাঙ্গা যেখানে দিনে দুপুরে লাশ গোনার রাজনীতি শুরু হয়েছিল। এই বিষয়ে দিল্লির আদালতে বিচার্য এক মামলায় বিচারপতি দিল্লি পুলিশকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন দিল্লির গেরুয়া শাসকের নেতা-মন্ত্রীদের উত্তেজক ভাষণের টেপ আদালতে পেশ করতে। জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে থাকা দিল্লি পুলিশ জানিয়েছিল তেমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। কিন্তু এমন সওয়াল জবাবের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই অজ্ঞাত কারণে সেই বিচারপতিকে ওই মামলা থেকে সরিয়ে অন্যত্র বদলি হতে হয়। ফলে এখান থেকেই দিনের আলোর মতই স্পষ্ট যে এই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের দিল্লির রাজপথে দেওয়া নেতা-মন্ত্রীদের  ভাষণের বক্তৃতার টেপ যদি তদন্তকারি সংস্থার ঝুলি থেকে হারিয়ে যায় সেক্ষেত্রে পাটিগণিতের নিয়মে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আঠাশ বছর আগের বাবরি ধ্বংসের টেপ কোন জাদুতে বিকৃত  হয়ে ওঠে। আর তাই প্রত্যাশিতভাবেই দিল্লি দাঙ্গার চার্জশিটে নাম যুক্ত হতে থাকে প্রতিবাদী সমাজকর্মী, সংস্কৃতি কর্মী, ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা কর্মী  প্রত্যেকেরই। ফলে গণতন্ত্রে ভিন্নমত প্রকাশের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার এক নতুন অধ্যায়ের সাক্ষী হতে চলেছে দেশ আর দেশের মানুষ।