আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

শতাব্দী শেষ হয়ে এলো

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার


একটি পথচলার একশো বছর পূর্ণ হল। যেদিন একশোয় পা দিল, সেদিন ফেসবুকে কিছু লিখি নি। সারাদিন সকলের পোস্ট দেখেছি, ভেবেছি। নানা উচ্ছ্বাস, নানা ভাবনা, নানা প্রত্যয়, নানা দীর্ঘশ্বাস - জেগেছে, মিলিয়েছে। লিখব লিখব করে দিনটা চলে গেল। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির একশো বছর পূর্ণ হল। এই তথ্য কেউ কেউ মানেন না। সাংগঠনিকভাবে সেই পক্ষে রয়েছে সিপিআই। উলটো পক্ষে শুধু সিপিআই(এম) নয়, আরো বামপন্থী দলও আছে। ফেসবুকেই দেখলাম, সিপিআই(এমএল) রেড স্টার একশো বছর পূর্তি নিয়ে সামাজিক গণমাধ্যমে আলোচনা চক্র করছে। আসল কথা হল, ১৯২০ সালে তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের উদ্যোগে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠনকে মান্যতা দেওয়া না-দেওয়া। অবিভক্ত দলে কোনো একটা পর্যায়ে ১৯২৫ সালের কানপুরে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় সম্মেলনকে যাত্রারম্ভ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওটাই সবকিছু নয়। ইতিহাসের পুনঃপাঠে যদি যাত্রারম্ভের বিন্দুটা পালটে যায়, তাতে যাত্রাপথটা খাটো হয় না। তবু এ নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে, কিন্তু বিতণ্ডা চলে না।

একশো বছরকে কীভাবে দেখবো? এই দেখারও নানা ধরন আছে। কেউ দেখবেন দলীয় উচ্চারণের সমবেত পুনরাবৃত্তিতে কন্ঠ মিলিয়ে। কেউ নিজের অনুভবকে সমবেত চলার সাথে মিলিয়ে আশা নিরাশার অকপট বয়ানে নিজের দেখাকে ব্যক্ত করবেন। এভাবে ব্যক্ত করার মধ্যে কিন্তু নিজেকে আলাদা করে নেওয়ার কোনো অভিপ্রায় থাকে না। বরং সকলের সাথে পা মেলাতে মেলাতে প্রতিনিয়ত নিজেকে দেখা এবং নিজের দেখা দিয়ে সহপথিকদের সম্মিলিত চলমানতাকে বোঝা।

গতকাল (অক্টোবর ১৭, ২০২০) সকাল থেকে নানা পোস্টার ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো কোনো পোস্টারে অন্য বামপন্থী ধারার নেতাদের ছবিও রয়েছে। কেউ একে ভালো চোখে দেখছেন। কেউ মন্দ চোখে। আমার কাছে এটা ভালো মন্দের বিষয় নয়। এটার মধ্যে আমি একটা বদল দেখতে পাই। এতদিন যেভাবে পেছন ফিরে দেখেছি পেছনে ফেলে আসা পথকে, তা থেকে স্বতন্ত্র এই দেখার চোখটি। আমার কাছে এভাবে দেখাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঙ্ক্ষিত বদল। কতগুলি চিরস্থায়ী তকমা দিয়ে অতীতকে চিহ্নিত করে চিরদিনের জন্যে একটা গ্রহণ বর্জনের অপরিবর্তনীয় তালিকা নির্মাণ, আর যাই হোক বিজ্ঞান নয়। এগিয়ে যেতে যেতে বারবারই পেছনে তাকাতে হয়। গ্রহণ বর্জনের নিরিখটা প্রয়োজনে বদলে নিতেও হয়।

গত শতকের আটের দশকের শেষ থেকে আমাদের বিশ্বাসের পৃথিবীতে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়েছিল। কারো কারো প্রত্যয়ের ডিঙি নৌকো ওতে ভেসে গেছে, ডুবে গেছে। আমরা এক বুক চোখের জলে ডুবেও তীর খুঁজেছি অসহায় হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে। যে ঝড় উথাল পাথাল করে দিচ্ছিল আমাদের, সেই 'ঝড়কে আমি করব মিতে'র বোধে 'ঝড়কে পেলেম সাথি' করে আজো তীর খুঁজেই ফিরি। মনে পড়ে ছাত্র আন্দোলনের সহপথিক সেই বন্ধুর কথা, যে ওয়ার্ল্ড দিস উইকের সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে লেনিনের মূর্তি ভেঙে পড়া আর চেচেস্কুকে ট্যাঙ্কের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনা দেখে আর পার্টি সভ্যপদ নবীকরণ করল না। কাতর মুখে বলল, নিতে পারছি না। আমার ওই বন্ধু সমাধান খুঁজছিল ব্যক্তিগত নিষ্কৃতিতে। আমরা প্রশ্ন-সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েছিলাম। তখন কলকাতার রাজপথে নেমে এসেছিলেন অনেকে প্রতিবাদে। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ঝোলানো পোস্টারে লেখা ছিল, হাজার নদী যেখানে লীন, তিনি সমুদ্র, তিনি লেনিন। শিলচরে আমরা বন্ধুরা, একেকজন একেকটি বামপন্থী ধারার সাথে যুক্ত, ওই শিরোনামেই অনুষ্ঠান করলাম। আলোচনা সভায় ডেকে আনলাম সব বামপন্থী দলের নেতাদের। বিষয়, এখনও কেন লেনিন। আমাদের একবগ্গা জীবনে বহুত্বের সাথে সেই প্রথম বোঝাপড়া। বক্তারা নানা কথা বললেন, কখনো ঐক্যমতে, কখনো বিরুদ্ধতায়। লীন হলেন শেষে সেই লেনিন-সমুদ্রেই। আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল ১৯৮৬/৮৭ থেকেই যখন পোল্যান্ডের খনি আর বন্দর শহরের শ্রমিকরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ধর্মঘটে নেমেছে। মার্ক্সবাদী পথ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে জেনেছিলাম পোল্যান্ডের কৃষিজমির প্রায় অর্ধেক চার্চের মালিকানাধীন। এর আগে চেকোস্লোভাকিয়া বা হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত সৈন্যের হস্তক্ষেপকে বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের দ্বিপদে মেনে নিয়েছিলাম। পরে একই যুক্তিতে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য ও কাম্পুচিয়ায় (তখন তাই বলা হত) ভিয়েতনামী সৈন্যের ভূমিকাকেও। খটকার শুরু পোল্যান্ড থেকে। দূরদর্শনে অনেক রাতে বিদেশি চলচ্চিত্র দেখানো হত। 'কোয়াক' নামে এক পোলিশ ছবি দেখে হতবাক। সমাজতান্ত্রিক দেশে তৈরি ছবির শেষ দৃশ্যে দেখানো হচ্ছে, ত্রাণকর্তা ডাক্তারটি আসলে ভগবান যীশু। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে মার্ক্সবাদী পথ পত্রিকায় একটি অবিস্মরণীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল বিটি রণদিভের। সোভিয়েত ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত অগণতন্ত্রের বীজগুলিকে চিহ্নিত করে ব্যক্তি নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতার বোধের উৎস সন্ধান করেছেন রণদিভে। সেই থেকে প্রশ্নগুলো আরো গভীর ও ব্যাপ্ত হতে শুরু করল। কিন্তু প্রত্যয়ে কোথাও দুর্বলতা এলো না।

তখন পিপলস্ ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার একটি নিবন্ধে বলা হল, কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোটা ইতিহাসকেই আবার নতুন করে পড়তে হবে। নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে যা কিছু গৃহীত ও বর্জিত হয়ে এসেছে এতদিন। সাংগঠনিক স্তরে ও ব্যক্তির স্তরে সেই একটা বাঁকবদল।

বাঁক তবু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিল কি? বোধহয় না। ট্রটস্কির নাম উচ্চারণ এখনও নিষিদ্ধ। বুখারিন, রোজা লুক্সেমবুর্গকে নিয়ে আলোচনা হয়? ১৯৩৬-১৯৩৮ সময়পর্বে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সংঘটিত গ্রেট পার্জ বিষয়ে এখনও সোচ্চার সমালোচনামুখর হতে পারিনি। সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপ কেন ভেঙে পড়ল, এই প্রশ্নের উত্তর এখনও খুবই অতিসরলীকৃত, সহজ উত্তর 'বিচ্যুতি'। অনেকেরই বক্তব্য, এই 'বিচ্যুতি'র হিসেব নিকেশ বর্ধমান প্লেনামেই সমাধা হয়ে গেছে। একটু যা বাকি ছিল তা ১৯৯১ এর 'কয়েকটি মতাদর্শগত প্রশ্নে' শীর্ষক দলিল বা পরবর্তীতে পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত 'মতাদর্শগত প্রস্তাব' এ সমাধা হয়ে গেছে। ফলে অভ্যাসগত বা কাঠামোগত বা মতাদর্শগত আর কোনো প্রশ্নের পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন নেই। এই ধারণাগুলি প্রায় সংখ্যাধিক্য সহপথিক ধারণ করেন। ঠিক এখানেই বুকে ব্যথা বাজে। এতটা আত্মসন্তুষ্ট, এতটা যন্ত্রণাবোধহীন হয়ে কি সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা যায়! চে গুয়েভারার চোখে বিপ্লবী সে-ই যে নিজের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সমাজ জীবন অবধি ব্যাপ্ত হয়ে বিপ্লবকে অনুভব করে।

প্রশ্ন অনেক। পথচলা মানে প্রশ্নের সাথে সহবাস করেই চলা। প্রশ্নকে কোণঠাসা না করে তাকে নিরন্তর জল হাওয়া দিয়েই পথচলা। প্রশ্ন মানেই প্রশ্ন করা নয় শুধু প্রশ্ন করতে দেওয়াও। সমাজে বা রাষ্ট্রে যে এমন উভয়মুখী গণতান্ত্রিকতার স্বপ্ন দেখবে সে নিজের ব্যক্তিজীবনে বা সাংগঠনিক কাঠামোয় অবিরত প্রশ্নের সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচরণ কেন করবে? সোভিয়েত বা পূর্ব ইউরোপে এই ব্যাধিই কি অতিমারীর রূপ নিয়েছিল? নয় কি? এই ব্যাধিই ৩৪ বছরের হাজারো সাফল্যের মধ্যেও কতগুলি গভীর ক্ষতচিহ্ন রেখে যায়নি কি? যে সাংগঠনিক নীতিমালা লেনিনের সোভিয়েত বা পার্টিকে ধ্বংসের পথ থেকে রক্ষা করতে পারল না, আজও তাকেই প্রশ্নহীন ঈশ্বরত্বে অপরিবর্তিত রেখে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত। কিউবা বা লাতিন আমেরিকায় যে নতুন বামপন্থার চর্চা আশার আলো জাগিয়েছে, তাকে নিজেদের বৃত্তে যাচাই করে নেওয়ায় এত অনাগ্রহ কেন? এখনও কেন শুনতে হবে চে গুয়েভারা বামপন্থী ছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট ছিলেন না। কেন কবেকার সেই দাড়িপাল্লাই এখনও বিপ্লবের ওজন মাপায় ব্যবহৃত হয়ে যাবে? কেন মতাদর্শগত পুনর্বিবেচনাগুলি অবাধ ও সর্বব্যাপী হবে না? বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শোভনলাল দত্তগুপ্ত একটি নিবন্ধে বলেছিলেন, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে ক্ষমতা দখলের পন্থা নিয়ে নানা ধরনের তাত্ত্বিক চর্চা হয়েছে। সোভিয়েত থেকে চীন, ভিয়েতনাম থেকে কিউবা, তাছাড়া পূর্ব ইউরোপের নানা দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করেছেন নানা পন্থায়। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর কী করে জনগনের সাথে রক্তমাংসের যোগাযোগকে অক্ষুণ্ন রেখে পার্টির ‌সর্বস্তরের কর্মী সমর্থকদের গণতান্ত্রিক অভিমতকে বিবেচনাধীন রেখে ক্ষমতা ধরে রাখবে তা নিয়ে তুলনায় তাত্ত্বিক চর্চা অনেকটাই কম। সে জন্যেই বারবার, সোভিয়েত থেকে চীন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে ত্রিপুরা কিংবা আসামে, এমনকী কার্বি আংলঙের লিবারেশনপন্থীদের ক্ষেত্রেও, রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজ্য সরকারি ক্ষমতা এমনকী স্বশাসিত জেলা পরিষদের ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণের সাথে অলঙ্ঘ্য দূরত্ব হয়ে যায় বামপন্থীদের। একটি বিকেন্দ্রীকৃত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার রাজনীতি এবং সেই সমাজকে রূপায়িত করার জন্যে দায়িত্ব নেওয়া একটি অতিকেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক সংগঠন প্রকৃতপক্ষে কি বিপরীতমুখী সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির জন্ম দেয়? এর জন্যেই কি দেশে দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার পর জনগণ থেকে দূরত্ব রচিত হয়ে যায় বারবার? সেই প্রশ্নেরও উত্তর নেই। আমি ভেবে পাই না, বিপ্লবকালীন বলশেভিক নেতৃত্বের অধিকাংশের কি সত্যিই এতটাই অধঃপতন হয়েছিল যে তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া আর কোনো শাস্তি সম্ভব ছিল না?

প্রশ্ন থাকবেই। এই প্রশ্নগুলিকে সঙ্গী করেই মিছিলে হাঁটব। শত্রুর আক্রমণ বরণ করে নেবো কুন্ঠাহীনভাবে। যেহেতু রূপের টানে নয়, উন্নত ভালোবাসাবোধের দীক্ষায় আমাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। তাই 'চাঁদের মত অলখ টানে' লড়াইয়ের 'জোয়ারে ঢেউ তোলাবো'।

গভীরভাবে বিশ্বাস করি সব প্রশ্নের উত্তরকে সঙ্গী করে, আরো হাজার প্রশ্নকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সূর্যের ভোর আসবেই।