আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম রাজনীতি (দ্বিতীয় পর্ব)

সৈয়দ আসিফ আলী


২০১১ পরবর্তী রাজনীতিতে মুসলমান সমাজ

মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় এসে ধর্মের আবরণে মুসলিম সমাজকে কাছে টানতে উদ্যোগী হন। এই কাছে টানার বিবিধ প্রকার ব্যবস্থা করা হয়। একদিকে যেমন ছিল সংসদ বা বিধানসভায় মুসলিম প্রতিনিধি বৃদ্ধির নীতি তেমনি ছিল ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগানোর নীতি। ২০১৬ সালে মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৭ জন। ২০১৪ ও ২০১৯-এ তৃণমূল কংগ্রেসের মোট মুসলিম সাংসদ হল যথাক্রমে ৪ ও ৫ । রাজ্যসভাতেও স্থান দেওয়া হল। ১৯৫০ ও ৬০র দশকে কংগ্রেসের টিকিটে লড়ে মুসলিমদের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা যেমন প্রবল ছিল, বর্তমানে তা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। অবশ্যই এই দুই ভিন্ন সময়ের মুসলিম বিধায়ক বা সাংসদের কেন্দ্রগুলি দেখলে বোঝা যায় মূলত মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলি থেকেই জিতেছেন। ২০১৬ সালে জেতা মোট ৫৭ মুসলিম বিধায়কের মধ্যে মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা এই চার জেলা থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন ৩০ জন। সময়ের সাথে সাথে ‘ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি’র নীতির যে পরিবর্তন হয় নি তা বুঝতে কষ্ট হয় না, যার মূল বক্তব্যঃ মুসলিম অধ্যুষিত জেলা, কেন্দ্র বা অঞ্চলে মুসলিমদেরই টিকিট দাও, অন্যত্র দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ মুসলিমরা ‘নিজেদের প্রার্থী’কেই ভোট দেবে। বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী দলগুলি মুসলিম আশা- আকাঙ্খাকে পাত্তাই দেয় না। ২০১৬ সালে মোট ৭ জন মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে প্রায় সবাই ‘ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি’র মতই মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকেই নির্বাচনে দাঁড়ান।

মুসলিম সমাজকে কাছে টানতে মমতা ব্যানার্জী বিধায়ক বৃদ্ধি করা ছাড়াও আরো অনেক চমকপ্রদ পন্থা অবলম্বন করেন। এই নীতিগুলোর প্রভাব বিধায়ক সংখ্যা বাড়ানোর থেকে অনেক বেশি। খেটে খাওয়া, দিনমজুর, কৃষক বা সাধারণ মুসলমান, যারা রাজনৈতিক মতাদর্শ, চর্চা, প্রতিবাদসভা প্রভৃতি থেকে শতহস্ত দূরে, টিভিতে যখন নেত্রীকে নিজের চারপাশের মানুষের মত মাথায় ঘোমটা টেনে উপরে হাত তুলে মোনাজাত করতে দেখে নিশ্চই সেই ছবি তার মনে গভীর ছাপ ফেলে। ২০১১ সালে ইমাম ও মোয়াজ্জিন ভাতা দেওয়ার ঘোষণা হয়। ইফতার পার্টিতে নেতাদের উপস্থিতি, প্রকাশ্য ভাষণে ‘খোদা হাফিস’, ‘আল্লা’, ‘দোয়া’ প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার, ঈদের জমায়েতে শুভেচ্ছা - এসবই ভাষা, শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতপাত নির্বিশেষে মুসলমান সমাজে আবেদন সৃষ্টি করেছে তা স্বীকার করতেই হবে। ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলায় কোনো দলই এভাবে মুসলিম প্রীতি দেখানোর সাহস করেনি। বঙ্গ রাজনীতিতে কয়েকটি শব্দবন্ধের - মুসলিম তোষণ, অনুপ্রবেশকারী, দেশবিরোধী প্রভৃতির ব্যবহার, দেশভাগের পর যে তকমা মুসলিমদের গায়ে সাঁটিয়ে দেওয়া হত, আবার ফিরে এল।

২০১৪-র পরে একদিকে ছিল মোদী ও হিন্দুত্ব, অন্যদিকে বাংলায় শাসকগোষ্ঠীর ভুল নীতি। এই দুইয়ের সাঁড়াশি চাপে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সমাজকে সামনে রেখে হিন্দুত্বের রাজনীতি পাকাপোক্ত জায়গা করে নিল ও মুসলিম রাজনীতি আরো জটিল থেকে জটিলতর হল। ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংখ্যালঘু দপ্তরের কবরস্থান ঘেরাও, মসজিদ, ইদ্গাহ, মাজার ঘেরার জন্য অর্থপ্রদানের একটি হিসাব - ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই খাতে ৩০০ কোটির বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আলিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের মতে এর উদ্দেশ্য মুসলমান ভাবাবেগে নাড়া দিয়ে ভোট নেওয়া। যেকোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহনের দায়িত্ব সেই সম্প্রদায়ের, সরকার এই দায়িত্ব কেন নিজে থেকে নেবে। এই অধ্যাপকের মত শিক্ষিত মুসলমানের দাবি মসজিদ, ইদ্গাহ, মাজার ঘেরার জন্য অর্থসংস্থান বা ইমাম-মোয়াজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা নয়। এই শ্রেণিটি চায় পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপকের সংখ্যা কত, রাজ্য সরকারের মোট মুসলিম কর্মচারীর সংখ্যা বৃদ্ধি হল কিনা প্রভৃতি জানতে। আত্মমর্যাদার সঙ্গে উন্নয়ন এটাই- ক্ষমতার সুষম বন্টন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমান অধিকার। সহজভাবে বললে সরকার, রাজনৈতিক দল মুসলিম ধর্মাচরণ ও ধার্মিক প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে থেকে শিক্ষা, চাকরির মাধ্যমে ভিতর থেকে মুসলমান সমাজকে শক্তিশালী করা উচিৎ। কিন্তু আমরা দেখি রাজনৈতিক দলগুলির মুসলমান প্রীতি দেখানোর ও উন্নয়ন করছি বোঝানোর সবথেকে বড় হাতিয়ার সরাসরি ইসলামি ধর্মাচরণে অংশ নেওয়া। কয়েক মাস আগে আলিয়া ইউনিভার্সিটির নিউটাউন ক্যাম্পাসে দরকারি কাজে গিয়েছিলাম। বিকেলবেলা ক্যাম্পাস ছেড়ে আসার সময় চার-পাঁচজন আমার কাছে এসে ইউনিভার্সিটি লাগোয়া হজ হাউসে ইসলামিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে বললেন। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বেরিয়ে আসা প্রত্যেক ছাত্রকেই তারা এভাবেই অনুরোধ করছিলেন। মসজিদের আলোচনায় খারিজি মাদ্রাসার অনুকরণে দেখলাম ইসলামিক আলোচনায় কমপক্ষে একশ ছাত্রের উপস্থিতি। অবাক হলাম। সরকার মুসলমানদের দাবি মেনে ইউনিভার্সিটির উন্নতি করেছে। ইউনিভার্সিটির অন্দরে এভাবে ধর্মাচরণের প্রবেশ আদতে হিন্দত্ববাদীদের হাত শক্ত করা। ধর্মনিরপেক্ষ আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সীমারেখা না টানতে পারলে পুরো মুসলমান সমাজেরই ক্ষতি হবে।

যদিও এমন নয় যে শাসকগোষ্ঠীর সব নীতিই মুসলিম সমাজকে কেবল একটি ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে রাজনীতির ঘুঁটি সাজিয়েছে। মুসলিম সমাজের ভিতরে শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি, ধর্মাচরণের বিবিধতা আছে যা ভারতের কোনো অংশের মুসলিম রাজনীতি কখনই প্রকট হতে দেয় না। মুসলিম সমাজ নিজেও বাংলায় এমন কোনো রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করতে পারেনি যা ভেতরের বিবিধতা ও দ্বন্দগুলোকে প্রকাশ্যে আনবে। এই সমাজেও যে জাত পাত আছে, সৈয়দ, খানরা উচ্চবংশ আর মোল্লা, সেখরা যে নীচু বংশ সেসব বিষয়ে আলোচনা ও রাজনীতি হয়নি। যদিও পাশের রাজ্য বিহারে দলিত, আতরফ শ্রেণি উচ্চবর্ণের মুসলমানদের রাজনীতিতে আধিপত্যের বিরোধিতা করে যথেষ্ট ক্ষমতাশীল। বিহারের পাসমান্দা মুসলিম আন্দোলনের মত কোনো সমগোত্রিয় আন্দোলন বাংলায় গড়ে ওঠেনি। এমনকি অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা, চাকরির দাবি বা প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যের বিরোধিতা হয়নি। ২০১১ পরবর্তী সময়ে ওবিসি সংরক্ষণের দাবি তোলার সময় অনেক মুসলিম সংগঠন সমগ্র মুসলিম সমাজকে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পথে নামে। মুসলিম সংরক্ষণের দাবি স্বাধীনতার পরে উঠেছিল। ১৯৯০-এর দশকে সংরক্ষণের রাজনীতির মাধ্যমে আবার ফিরে আসে। আসোসিয়েশন ফর প্রোমোটিং এডুকেশন এন্ড এমপ্লয়মেন্ট অফ মুসলিমস (APEEM) নামে সংগঠনটি সমগ্র মুসলিম সমাজের জন্য সংরক্ষণের দাবি জানায়। বিহারের সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের মত নেতারাও একই দাবি তোলেন। এরা প্রত্যেকেই উচ্চবর্ণের মুসলিম সমাজের অংশ। বিহারের অল ইন্ডিয়া পাসমান্দা মুসলিম মাহাজ সংগঠনের থেকে তাই অনেক কিছু শেখার আছে। ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার আশরাফ শ্রেণি যেভাবে নীচুতলার মুসলমান প্রান্তিক সমাজকে দূরে রেখে রাজনীতি করেছিল, বর্তমানে সেই ধারাই লক্ষ্য হচ্ছে।

আমির আলী, আব্দুল লতিফ ইংরেজি শিক্ষা, সরকারী চাকরি প্রভৃতির দাবি তুললেও জমি, জাত-পাত ও শ্রেণি বৈষম্য দূর করার ও সেসময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়া ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রশ্নগুলিকে এড়িয়ে যান। ৯০-এর দশকে জাত-পাতের রাজনীতি পুনরুজ্জীবত হলে দু-একটি সংগঠন ছাড়া বাংলায় মুসলমানদের ক্ষমতায়নের জন্য কোনো মুসলিম সংগঠন, রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিত্বকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। উত্তরবঙ্গ অনগ্রসর মুসলিম সংগ্রাম সমিতি নামে সংগঠনটি বেশ কয়েকটি (খোট্টা, নিকারী, সর্দার প্রভৃতি) মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসার যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করে। উত্তরবঙ্গের এই মুসলিম জনগোষ্ঠীগুলি স্বাধীনতার পর বিহার থেকে এসে জনবসতি স্থাপন করে। তাই জাত-পাতের বৈষম্য সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সচেতন। এই অঞ্চল বাদ দিলে বাংলার বাকি মুসলমানদের মধ্যে জাত-পাতের সামাজিক সচেতনতা নেই বললেই চলে। সেজন্যই মুসলিম রাজনীতির এই ধারাটির জনপ্রিয়তা সীমিত। হিন্দুত্বের বিরোধীতা করতে গিয়ে শিক্ষা, চাকরি, অন্দরের বৈষম্য আর বোঝা হয়ে ওঠেনি।

আজ সমাজে, সংবাদপত্রে, সিনেমায়, জনমানসে মুসলমানদের যে একরৈখিক পরিচিতি গড়ে উঠেছে, তার জন্য নিজেরাও সমানভাবে দোষী। মালদহ, মুর্শিদাবাদ এই দুই জেলায় স্বাধীনতার পর থেকেই সাংসদ, বিধায়ক মুসলিম সম্প্রদায়ের থেকে উঠে এসেছেন। কই, এই দুই জেলায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাটের তো উন্নতি হয়নি। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা ভারতের পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির মধ্যে এদের নাম আসে। খুব স্পষ্ট, জনপ্রতিনিধি বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনযাত্রার উন্নতি হয়নি। ২০১১-র পরবর্তীকালেও একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর কিছু নীতি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। আলিয়া ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় ক্যাম্পাস, ওবিসি সংরক্ষণ বৃদ্ধি, সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট বৃদ্ধি, মাইনরিটি স্কলারশিপ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সরকারের ২০১৬ সালের একটি রিপোর্টে দাবি করা হচ্ছে সংখ্যালঘু স্ক্লারশিপ ও ঋণ প্রদানে পশ্চিমবঙ্গ দেশে প্রথম, যেখানে ২০১০-১১ সালে সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট ছিল ৪৭২ কোটি, ২০১৫-১৬ তে বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৮৩ কোটি, জেলায় জেলায় সংখ্যালঘু ভবন নির্মাণ, হজ হাউস তৈরি, ঊর্দু ভাষাকে ক্ষেত্রবিশেষে সরকারী ভাষার যোগ্যতা, কবরস্থান ঘেরাও প্রভৃতি। বর্তমানে ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় থাকা ১৭৮টি গোষ্ঠীর মধ্যে ১১৭ টি মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। যদি সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেটের দিকে তাকাই দেখতে পাব অর্থ-সংস্থান অন্যান্য জনগোষ্ঠী কেন্দ্রিক দপ্তরের থেকে অনেক বেশি। বাম আমলে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দপ্তর ও সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট যেখানে প্রায় সমান ছিল, তৃণমূল জামানায় সেই ব্যবধান অনেকখানি বেড়ে যায়। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে উচ্চশিক্ষা দপ্তর ও সংখ্যালঘু দপ্তরের বাজেট প্রস্তাবের আর্থিক বরাদ্দ প্রায় সমান (যথাক্রমে ৩৯৬৪ ও ৪০১৬ কোটি)। সরকারের এই পরিবর্তন চমকপ্রদ। সূক্ষ্ণভাবে দেখলে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি অনেকটা হলেও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা নতুন সরকার করেছে। মুসলিম সমাজের একটি অংশের ক্ষোভ রয়েছে সরকারী পাঠ্যবুস্তকগুলিতে তাদের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মের অনুপস্থিতি নিয়ে। ক্ষমতায় আসার পর নতুন পাঠ্য বইতে সেই ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা হয়েছে। ধরা যাক আপনি ষষ্ঠ শ্রেণির ‘গণিত প্রভা’ বইটি উলটেপালটে দেখলেন, বিভাস, প্রীতম, পর্ণা, জেঠুর পাশাপাশি রহমান, রাজিয়া, সামসুর, মহিদুর, রাফিকা বেগম, আজমা খাতুন, রহিম চাচারাও উপস্থিত।

বাম শাসনকালে ভূমি সংস্কারের নীতি অবশ্যই বাংলার গ্রামীণ মুসলমানদের জন্য ফলপ্রসূ হয়েছিল। একটি হিসেব অনুযায়ী এই রাজ্যে ভূমি সংস্কারের ফলে ১৯৭৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মোট পাট্টা জমির ১৮% মুসলিম পরিবারগুলি পেয়েছে। এই রাজ্যের মোট গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩০.৯ শতাংশ মুসলিম, মোট চাষজমির ২৫.৬% আছে মুসলমানের আওতায়। বাম রাজনীতি কখনই উন্নয়নের নীতি তৈরিতে ধর্মগোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয় নি। সংখ্যালঘুরা যে সংখ্যাগুরুর থেকে উন্নয়নের বিভিন্ন মাপকাঠিতে পিছিয়ে থাকতে পারে, সেটা ভদ্রলোক শ্রেণি কখনই স্বীকার করেনি। এমনকি মন্ডল রাজনীতির যুগে ওবিসি সংরক্ষণের লিস্ট থেকে স্পষ্ট অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী যাদের সংরক্ষণ পাওয়া উচিত ছিল, তাদের বঞ্চনা করা হয়েছে। রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে “ওবিসি সংরক্ষণের সুবিধা এই রাজ্যগুলিতে মুসলিমদের দেওয়া হয়নি।“ সাচার রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন যখন রাস্তায় নামল, একমাত্র তখনই সরকার ও পার্টিতে মনোভাবের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তবে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ঢেলে আধুনিকিকরণ করার কৃতিত্ব বামেদেরই। বাম আমলের পর নতুন করে আর খারিজি মাদ্রাসাগুলি সরকারের অধীনে আনার ব্যবস্থা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারী সিনিয়র মাদ্রাসার শিক্ষক বলছিলেন, মাদ্রাসা আধুনিকিকরণের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম সমাজের গোঁড়া অংশকে নিরস্ত করা। পরবর্তীকালে মাদ্রাসার নামে রাজনীতি অনেক হয়েছে। তবে অতীতে হলেও বাম আমলে মুসলিম এলিট ক্যাপচার বিশেষ হতে দেখা যায়নি। তৃণমূল কংগ্রেস মৌলবিদের ভাতা দিয়ে ধর্মান্ধ মুসলমানদের কাছে টেনেছে। ঠিক সেভাবেই বাংলার মুসলিম এলিট সমাজকে বিভিন্ন সংগঠন স্তর, পার্টি পদাধিকারী করেছে। বিভিন্ন ডেভলপমেন্ট বোর্ডের নামে (ফুরফুরা শরীফ, পাথরচাপড়ি দাতাবাবা মাজার) স্থানীয় মুসলিম ব্যক্তিবর্গকে ক্ষমতা দিয়ে জেলায় জেলায় মুসলিম এলিট তৈরি করা ও তাদের লালন পালনের ব্যবস্থা দুই হয়েছে। মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক কলমের সম্পাদক, ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান বা জামায়েত উলেমা-ই-হিন্দের সম্পাদক ও বাংলা জুড়ে ১০০০টি মাদ্রাসা পরিচালনকারি ‘পশ্চিমবঙ্গ রাবেতায়ে মাদারিসে ইসলামিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী এই এলিট ক্যাপচারের অংশ।

মুসলমান সমাজের ধর্মীয় অনুভূতিকে নিয়ে খেলার শাসকদলের নীতিকে মুসলমান সমাজ আর ভালো চোখে দেখে না। এতে যে তাদেরই বেশি ক্ষতি! হিন্দুত্ববাদীরা মমতা ব্যানার্জীর ঈদের নামাজের সকালে উপস্থিত থাকার মত ঘটনাকে নিজেদের পালে হাওয়া লাগায়। দুটি রাজনৈতিক দল, মীম ও ওয়েলফেয়ার পার্টি তাই আজ তৃণমূল মুখাপেক্ষি না হয়ে মুসলমান ভোট চাইছে। হায়দারাবাদ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার হয়ে মীম বাংলায় এসেছে। বিহারে এই বছরের নির্বাচনে মীমের ঘাঁটি মুসলিম অধ্যুষিত সীমাঞ্চল, বিহারের পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। ২০১৯-এ কিষাণগঞ্জ কেন্দ্রে তৃতীয় হওয়ার পর ওয়েইসি বলেছিলেন, “সীমাঞ্চলকে ভয়াবহভাবে বঞ্চনা করা হয়েছে, এখন সময় সীমাঞ্চলের হয়ে তার নিজের কেউ বলুক”। বাংলায় একইভাবে মুসলিম অধ্যুষিত মালদহ, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগণাতে বঞ্চনা ও ন্যায়ের দাবিতে মুসলিম ভোট নিজেদের দিকে টানতে চাইছে। আর মমতা ব্যানার্জী বলেই ফেলেছেন ‘‘ওরা কিন্তু বিজেপির বি-টিম। ওরা বিজেপির টাকা নেয়। সংখ্যালঘুরা ভুল করবেন না। ওদের বাড়ি হায়দরাবাদে। এখানে নয়।’’। প্রয়াত সোমেন মিত্রের মতে ‘‘এই রাজ্যের মানুষকে মিম-এর থেকে সাবধান থাকতে অনুরোধ করছি। এরা মুসলিমদের স্বঘোষিত নেতা বলে জাহির করে। কিন্তু আসলে ওরা বিজেপির সহযোগী। দেশের প্রায় সব নির্বাচনেই কিছু ভোট নষ্ট করে বিজেপির সুবিধা করে দেয়!’’ মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকেই আর একটি নতুন ধারার রাজনীতির জন্ম হয়েছে। শিক্ষিত তরুণ মুসলমান নাগরিক সমাজের মাধ্যমে ‘ন্যায়’ এর কল্পনা রচনা। বেঙ্গল একাডেমিয়া ফর সোশাল এমপাওয়ারমেন্ট, বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ ও মুসলিম মিশন ও মুসলমান সমাজ দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন সংবাদপত্র, পত্রপত্রিকা এই ধারার ধ্বজাধারী। সরকার ও রাজনৈতিক দলের মুখাপেক্ষি না হয়ে এই প্রত্যেকটি উদ্যোগ এমন একটি মঞ্চ মুসলমানদের দিয়েছে যার মাধ্যমে নিজেদের মনের কথা তারা বলতে পারে। মুসলমান সমাজ নাগরিক সমাজের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায়ের এই দিক অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে সরকার পরিচালিত শিক্ষাব্যবস্থার কদর্য অবস্থা দেখে মুসলমান সমাজ নিজে ইসলামিক মিশন স্কুলের মাধ্যমে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, অধ্যাপক তৈরি করেছে যারা আজ মধ্যবিত্ত বাঙালির অংশ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সভাপতি সামিরুল ইসলামের মতে সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ না করে মুসলমান, আদিবাসী প্রান্তিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করলে সমাজ ও ক্ষমতার প্রতি স্তরে ভদ্রলোকের প্রতিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ দেওয়া যায়।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি মুসলিম রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিন্দুত্বের রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের রাজনীতির ইতিহাসের দিকে না গিয়ে বরঞ্চ সাম্প্রতিক কালের কাজকর্মের দিকে আলোকপাত করা ভাল। ২০১৭ সালে প্রকাশিত "পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব রক্ষায় নতুন করে ভাবতে হবে’’ ৩০ পাতার শীর্ষক বইতে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের সংকট ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুসলমান সমাজকেই মূলত দায়ি করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ থেকে মুসলমান অনুপ্রবেশ, হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ (‘হিন্দু জনপদ আক্রমণ, জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাট’; ‘হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ শ্লীলতাহানী’; ‘হিন্দু ধর্মস্থানে আক্রমণ, পূজায় বাধা’; ‘মুসলিম দুষ্কৃতিদের অবাধ সন্ত্রাস ও নির্লিপ্ত প্রশাসন’; ‘পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের ভার তুলে দেওয়া হছে ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে’) প্রভৃতিকে মূল অস্তিত্বের সংকট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এদের মতে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বের দুটি ভিত্তি - জনসংখ্যার হিসেবে হিন্দুদের সংখ্যাগুরুত্ব বজায় থাকা ও হিন্দু সংস্কৃতির চর্চা, হিন্দু নারীদের সুরক্ষা ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের প্রসার। মুসলমান সমাজের জন্য বাংলার অস্তিত্ব নাকি বিপন্ন। বইটিতে মুসলমান জনসংখ্যার বৃদ্ধির জুজু দেখিয়ে লেখা হয়েছে যে - ‘এই ভয়ংকর মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পশ্চিমবঙ্গের ভিত্তিটাকেই নষ্ট করে দিল’। বইটিতে লেখা হচ্ছেঃ ‘পশ্চিমবঙ্গ মুসলমান প্রধান হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গ-র ভারতে থাকার আর প্রয়োজন থাকে না। পশ্চিমবঙ্গটাই থাকার প্রয়োজন থাকে না। কারণ আগেই যেটা বলা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হয়েছিল যথেষ্ট হিন্দুপ্রধান অঞ্চল নিয়ে, সুতরাং হিন্দু জনসংখ্যার যথেষ্ট প্রাধান্য না থাকলে তার বাংলাদেশ হওয়া ছাড়া গতি নেই।‘ খুব স্পষ্ট কীভাবে সাধারণ হিন্দুসমাজকে মুসলমান জুজু দেখিয়ে ভীত করা হচ্ছে। ইসলামিক মৌলবাদে নাকি বাংলা ছেয়ে গেছে (‘…গত কয়েক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি মৌলবাদের দিনে দিনে দাপট বাড়াতে পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব সংকটের মুখে।‘)।

মুসলিম রাজনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ‘মুসলিম নেতা’। যেকোনো আদর্শেই বিশ্বাস করুন না কেন, আপনি যদি মুসলমান হন আর রাজনীতি করেন, আপনার একটি অন্যতম পরিচয় হবে মুসলমানদের নেতা হিসেবে। বাংলায় মুসলিম লীগের প্রতিপত্তি থাকায় ‘মুসলমান নেতা’র ব্যবহার জনমানসে প্রবল। কিন্তু সারা ভারতে মুসলিম নেতার নামের মধ্যে বাংলার কারো নাম আসে না। আমাদের রাজ্যে সলমন খুরশিদ, সৈয়দ সাহাবুদ্দিনের মত কেউ নেই। অঞ্চলভিত্তিক বা জেলাভিত্তিক মুসলিম নেতা আছে অবশ্যই। সব থেকে মজার মুসলিম নেতা এই শ্রেণিটিতে কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই নয়, মাদ্রাসার, মসজিদের ইমাম, প্রভৃতি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গকেও ধরা হয়, আর এই ধারণা জনপ্রিয় করার পিছনে গণমাধ্যম ও হিন্দুত্ববাদীদের অপরিসীম অবদান। মুসলিম নেতা বলতে বোঝায় সেই সমাজের নেতা যারা অনেকগুলি বিয়ে করে, অনেক বাচ্চা নিয়ে যারা দেশের জনসংখ্যা বাড়ায়, মহিলাদের শোষণ করে, মাদ্রাসায় শুধু কোরান মুখস্থ করে। ভদ্রলোক বাবুরা কোনোদিন এরকম নেতাদের উঠতেই দেবে না। একবার সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীকে দেখে আমাকে এক বয়োজ্যেষ্ঠ আক্ষেপের সুরে বলেছিলন (আমি যে সেই দাড়িওয়ালা সমাজের অংশ সেটা না জেনে যদিও) “এই দাড়িওয়ালাকে গ্রন্থাগার মন্ত্রী করেছে!” আবার ফিরহাদ হাকিম কলকাতার পৌরপ্রধান হলে এক বন্ধু বলেছিল “আর কাউকে পেল না!”

 

উপসংহার

এনআরসি, সিএএ নীতি আজ মুসলমান সমাজের অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষটিকেও হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনা আসলে কী। যে মানুষগুলো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমসিম খেত, তারাও আজ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কলকাতা বা শাহীনবাগের মত ছোট জমায়েতের মাধ্যমে রাস্তায় নেমেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজ যথার্থই এই সংকটের সময় নিজের ভূমিকাও পালন করছে। স্বাধীনতার পর প্রথম তিন দশক জনমানসে, সরকারী স্তরে এমনকি মুসলমান সমাজের ভিতর থেকেও মুসলমান কেন্দ্রিক আলোচনা হয়নি। ৮০-র দশকের শুরুতে বিভিন্ন বাংলা পত্রপত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশ শুরু হয়, যেগুলি মুসলমান পরিচালিত ও মুসলমান কেন্দ্রিক। এরপর আসে বিভিন্ন মুসলিম মিশন স্কুল। এই প্রতিষ্ঠানগুলি মুসলিম রাজনৈতিক, সামাজিক আকাঙ্খা ও স্বপ্নকে তুলে ধরে নিজের কথা বলার জায়গা করে দিয়েছে। বাংলার মুসলমানের কাছে আজ আত্মপরিচয় ও আত্মসম্মান দুটি বড় প্রশ্ন, দেশভাগের পর মুসলিম মানসে দুই ক্ষেত্রেই সংকট দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে বাংলার শাসকদলের গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক, রাজ্য স্তরেও বিভিন্ন পদ ও ক্ষমতা আজ মুসলমানের হাতে। মুসলমান সমাজের চতুর্মুখি চ্যালেঞ্জের ফলে (মিশনের মাধ্যমে মুসলিম মধ্যবিত্তের বিকাশ, মুসলমানের নিজস্ব পত্রপত্রিকা, নাগরিক সমাজে মুসলমানের অংশগ্রহণ আর সরাসরি রাজনীতিতে মুসলমানের সক্রিয়তা) ভদ্রলোক শ্রেণির শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, জনসংস্কৃতি, গণমাধ্যম সবেতেই প্রতিপত্তি তাই আজ কিছুটা হলেও টালমাটাল । বাংলায় হিন্দুত্ববাদীদের প্রসারের অন্যতম কারণ এই মুসলমান সমাজের ভিতরের এই পরিবর্তন। ২০২১-এ দেখার বিষয় তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি মুসলমানদের প্রতি কতটা দরদি, মুসলিমকেন্দ্রিক মীম বা ওয়েলফেয়ার পার্টি আর হিন্দুত্ববাদীরা কতটা প্রভাবশালী। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে মুসলমানের অবস্থানের চতুর্থ পর্ব রচনার অপেক্ষায়।