আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

দিল্লি থেকে হাথরসঃ নারী নির্যাতনের ক্রমবিবর্তন

মালিনী ভট্টাচার্য


২০১২-র ডিসেম্বরে দিল্লিতে যে ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, যার পরিণামে অত্যাচারিতা মেয়েটির মৃত্যু হয়, তা জনাবর্তে ‘নির্ভয়াকাণ্ড’ বলে পরিচিত । এই ঘটনা নিয়ে বিপুল গণ-অসন্তোষের সৃষ্টি হয়, আর তারই ফলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার প্রাক্তন বিচারপতি জে এস ভার্মার নেতৃত্বে এক কমিটি তৈরি করে। ২০১৩-র ডিসেম্বরে তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল এবং এই কমিটির আইনি সুপারিশগুলির প্রায় সবই সরকার গ্রহণ করে। তার ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির কিছু ধারার পাশাপাশি ফৌজদারি কার্যক্রমের বিধি এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনেরও বিভিন্ন পরিবর্তন করা হয়েছিল সেসময়ে। সংশোধিত আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞার আরো স্পষ্টীকরণ করা হয়, বিভিন্ন ধরনের যৌন আক্রমণে সাজার মাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাজা কঠোরতর হয়, সাক্ষ্যগ্রহণের পদ্ধতিতেও কিছু পরিবর্তন আনা হয়।

অনেকে ভেবেছিলেন, ‘নির্ভয়া’কে দিয়েই আমাদের দেশে নারীনির্যাতনের বীভৎসতা প্রশমিত হবে। কঠোরতর আইনের সাহায্যে সম্ভাব্য অপরাধীর মনে আতঙ্কসৃষ্টি করে তাকে দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখা যাবে। ভার্মা কমিটি অবশ্য এই সংশোধনীগুলিতে ভারতীয় দণ্ডবিধির কঠোরতম সাজা মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করা থেকে বিরত ছিলেন, তার কারণও ব্যাখ্যা করেছিলেন। এমনিতেই খুনের মামলায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা যে নেই তা নয়। ধর্ষণের পরে খুনের ক্ষেত্রেও চালু আইন প্রয়োগ করাতে বাধা ছিল না, রায়দানের ইতিহাস থেকে তেমন উদাহরণ দেখানোও যায়। কিন্তু এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ‘লবি’ আইনপরিবর্তনের কালে সুপারিশ করতে থাকে ধর্ষণ ও খুনের জন্য শাস্তির ধারাগুলির মধ্যে প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা রাখার। সম্ভাব্য অপরাধীদের সন্ত্রস্ত রাখার সেটাই নাকি একমাত্র পথ। নির্ভয়ার পরিবারের প্রতি যে বিপুল সহানুভূতির ঢেউ তখনও দেশ জুড়ে ছিল তার ফলে ধর্ষণসংক্রান্ত সংশোধিত সেই ধারাগুলির মধ্যে দোষীর প্রাণদণ্ডের ধারা ঢুকেও যায়।

‘নির্ভয়া’র ধর্ষকদের মধ্যে যারা কয়েদ-অবস্থায় মারা যায়নি, অনেক টানাপোড়েনের পর অবশেষে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী হওয়ায় অত্যাচারিতার পরিবার বলতেই পারেন, যে ‘সুবিচার’ তাঁদের দাবি ছিল তা তাঁরা পেয়েছেন। সেই ‘লবি’র সবচেয়ে সোচ্চার প্রবক্তারা পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছেন এবং তাঁদের এই দর্শন অনুযায়ী নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে যেখানেই পারছেন কেবল সাজার মাত্রা বাড়িয়েই ‘অপরাধ’ বন্ধ করার রাস্তা নিয়েছেন এও আমরা রোজ দেখছি। নারী-আন্দোলনের মধ্যে অবশ্য একটি বড়ো অংশ মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, অপরাধীকে কোতল করাটা কোনোদিনই কোথাও অপরাধের জোয়ারে বাঁধ বাঁধতে সাহায্য করেছে বলে জানা যায়নি। বরং দোষীর প্রাণের ভয় থাকলে দুষ্কর্মের প্রধান সাক্ষী নির্যাতিতা মেয়েটির মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবার প্রবণতাও বাড়তে পারে। ভার্মা কমিটির সুপারিশ ছিল ‘যাবজ্জীবন কারাদণ্ড’, ‘যাবজ্জীবন’ কথাটিকে যেখানে তার আক্ষরিক অর্থেই নিতে হবে; এই সুপারিশের সঙ্গে নারী আন্দোলন সহমত ছিল। তবু ‘প্রাণের বদলে প্রাণদণ্ড’ এই আবেগের উচ্ছ্বাসে সেদিন অন্য মতাবলম্বীদের কণ্ঠ ডুবে গিয়েছিল।

তারপরেও প্রতিবাদীদের আশঙ্কাকে সপ্রমাণ করে নারীনির্যাতনের ব্যাপকতা এবং বীভৎসতা গত কয়েকবছরে কমার বদলে সারা দেশে আরো বেড়েই গেছে। ধর্ষণের পরে নৃশংস হত্যা, সামূহিক ধর্ষণ, শিশুধর্ষণ - ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস্‌ ব্যুরোর তথ্যও এধরনের ঘটনার বিপুল বাড়বাড়ন্তই দেখাচ্ছে। পাশাপাশি গার্হস্থ্য নির্যাতনেরও কমতি নেই। বিশেষ করে কালো তালিকায় যে রাজ্যগুলি রয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে যোগী-শাসিত উত্তরপ্রদেশ। আমাদের রাজ্যও খুব একটা পিছিয়ে নেই, কামদুনি মধ্যমগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজকের রায়গঞ্জ বা ডেবরায় যার রক্তাক্ত প্রমাণ। জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়া, তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদের পর উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ের আতঙ্ক মানুষের মনে জারি থাকতে থাকতেই হাথরস আবার এই প্রশ্নটিকেই আমাদের সামনে নতুন করে নিয়ে আসছে যে আইন-পরিবর্তনে তাহলে কী ফল হল? বস্তুত হায়দ্রাবাদে এক তরুণী পশুচিকিৎসককে ধর্ষণের পর খুন করে দেহটি জ্বালিয়ে দেবার চেষ্টার জন্য যে অভিযুক্তদের ধরা হয়েছিল, খোদ পুলিশই তো তাদের এনকাউন্টার কিলিং করে কিছু লোকের বাহবা পায় এবং প্রমাণ করে দেয় আইনের শাসন নয়, বন্দুকের শাসনটাই কার্যকর।

এপর্যন্ত হাথরসের ঘটনা যতোটা আমরা জানতে পেরেছি তাতে এমন একটা তুলনাই মনে আসছে যে ঠিক যেমন বাবরি মসজিদ বিচূর্ণ হবার পর ভাঙচুরের অধ্যায় এখানেই শেষ হল মনে করাটা প্রচণ্ড ভুল ছিল, তেমনই ‘নির্ভয়া’কে দিয়েই নারীঘাতী বীভৎসার শেষ, এই আশার ভিত্তি ছিল নিতান্তই নড়বড়ে। হাথরসে নৃশংসতা যেমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, একই সঙ্গে পুলিশ এবং প্রশাসনেরও প্রতিটি পদক্ষেপে লক্ষ্য করা গেছে আইনকানুন সম্বন্ধে চূড়ান্ত তাচ্ছিল্যের ভাব। মনে রাখতে হবে, উন্নাওতে বিজেপি-র বিধায়কের বিরুদ্ধে মামলায় রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি এবং সাক্ষীকে নিরাপত্তা দেওয়ায় তাদের অক্ষমতা যখন সর্বত্র নিন্দিত হচ্ছে তার মধ্যেই হাথরস-কাণ্ড; তারপরেও উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন বিচলিত নয়। যেমন তারা বিচলিত নয় এনকাউন্টার কিলিং-এর অজস্র অভিযোগেও।

রক্তাক্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা-লড়া মেয়েটির এফআইআর-টিও তারা ঠিকভাবে নেবার চেষ্টা করেনি, মেয়েটির চিকিৎসার দ্রুত উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে দীর্ঘদিন তাকে রেখে দিয়েছে আলিগড়ের হাসপাতালে, যে মেডিকো-লিগ্যাল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে মামলার ধারা ঠিক হয় তাতে অমার্জনীয় দেরি হয়েছে, ফরেন্সিক পরীক্ষার উপাদান এত দেরিতে পাঠানো হয়েছে যাতে পরীক্ষার অর্থই থাকে না, এবং মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দির সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার প্রকাশ্যে বলেছে, এ ধর্ষণের ঘটনা নয়। এর সঙ্গে যদি যোগ করি পরিবারকে ঘরে আটকে রেখে মৃতদেহ রাতের অন্ধকারে দাহ করে ফেলার ঘটনা, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে ভয় দেখানোর অভিযোগ এবং অপরাধীদের সমর্থনে বিনাবাধায় গ্রামের মধ্যে ‘উঁচু’ জাতের লোকেদের পেশী প্রদর্শনী - তাহলে বলতেই হয় পুরো ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের ছিঁটেফোঁটা লক্ষণও নেই।

এই প্রশ্ন আমাদের আরো একবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভার্মা কমিটির প্রতিবেদনের মুখবন্ধের একটি অংশে যেখানে বিচারপতি ভার্মা বলছেন, আসলে আইন যা রয়েছে তার অল্পসল্প পরিবর্তন করলেও সুবিচার সম্ভব। ধারাগুলির কিছু সংশোধন, সেগুলির সঙ্গে কিছু সংযোজনই যথেষ্ট। যেটা জরুরি প্রয়োজন তা হল আইনগুলিকে কার্যকরী করাতে সরকারের দায়বদ্ধতা, এবং আইনের অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা যাতে সবচাইতে অসহায় মেয়েটিরও নাগালের বাইরে থেকে না যায়, তার জন্য রাষ্ট্রের উদ্যোগে সবরকম ব্যবস্থা। তার মধ্যে পড়ে আদালতের পর্যাপ্ত পরিকাঠামো এবং যথেষ্টসংখ্যক উপযুক্ত বিচারকের নিয়োগ যাতে বিচারের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রী না হয়, বিচারপ্রার্থীর প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা (এধরনের মামলায় সরকারই বাদীপক্ষ হলেও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ নিতান্ত কম নয়), সাক্ষীর নিরাপত্তা, নির্দিষ্ট ডাক্তারি এবং ফরেনসিক পরীক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি এর প্রশাসনিক দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের জবাবদিহির দায়।

ভার্মা কমিটির এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষণকে আজ নারীনির্যাতনের প্রসার এবং ভয়াবহতার নিরিখে বিচার করলে একথা স্পষ্ট হয় যে কোনো সরকারই বিচারপতি ভার্মা-কথিত সহায়তার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে তৎপরতা দেখায়নি, বরং অনেক লড়াইয়ের পরে ব্যবস্থার যেটুকু বা উন্নতি হয়েছিল, গত কয়েকবছরে তার ধ্বংসসাধন অতি দ্রুতগতিতে ঘটানো হয়েছে। আইনের প্রধান উদ্দেশ্য যেখানে হয়ে দাঁড়ায় সমাজের ওপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সেখানে এমনটাই ঘটার কথা। আজকের দিনে প্রশাসন এবং আইনি ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাহুবলীদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তীর্ণ হবার ফলেই যে তাদের ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধীদের আইনের শাসনে আনা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে হাথরস তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

আরএসএস-বিজেপির রাজত্বে নারী-নির্যাতনের বাড়বাড়ন্তে তাদের ‘মনুবাদী’ সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাথরসের ঘটনায় গ্রামের মধ্যে ‘উচ্চ’বর্ণের ঠাকুরদের পেশী-আস্ফালন, বাল্মীকি সম্প্রদায়ের নির্যাতিতা মেয়েটির চরিত্রহননের লাগাতার চেষ্টা এবং ‘সংস্কারী’ মেয়েদের কখনো এমন হয় না - জাতীয় মন্তব্য তাদের রাজত্বে দলিতদের ওপর নির্যাতনের সাংঘাতিক অগ্রগতি এবং ‘উচ্চ’বর্ণের জোটগুলির প্রভাববৃদ্ধির সূচক। কিন্তু এইসব আবার আমাদের বহুপরিচিত সমাজ-আঙ্গিকও বটে, যা শুধু মার্কামারা সংঘীদের মুখ থেকেই আমরা শুনি বা বিজেপি-শাসিত রাজ্যেরই একচেটিয়া এমনটা নয়। যে রাজ্যে বিজেপি-রাজ নেই অথচ নারীনির্যাতন তুঙ্গে উঠেছে, যেমন আমাদের রাজ্যে, সেখানে রক্ষণশীল সংস্কারের উচ্চারণ হয়তো আরেকটু অন্যরকম, জাতপাতের রাজনীতির চেহারা কিছুটা ভিন্ন। তাসত্ত্বেও সংবিধান, গণতন্ত্র এবং আইনের প্রতি গদিয়ান শক্তির সম্পূর্ণ ঔদাসীন্যে একটি মৌলিক সাদৃশ্য সূচিত হয় এধরনের শাসকদলগুলির মধ্যে। তাছাড়া সমাজের ভিতরে দীর্ঘদিনের যে নানাবিধ রক্ষণশীলতা রয়ে গেছে তার অপসারণে কোনো সাংবিধানিক দায়বদ্ধতাও তাদের কারো নেই।

কিন্তু ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো এবং আইনকে অগ্রাহ্য করে রাজ্যশাসন চালাতে হলে তার বদলে তার বিপরীত একটি মতাদর্শগত ধাঁচাও অবশ্যই প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ তার জন্মকাল থেকে ‘মনুবাদী’ অসাম্যের সংস্কারকে এব্যাপারে পুরোদস্তুর ব্যবহার করতে পেরেছে তাদের ভয়ংকর অধ্যবসায়ের সাহায্যে। কোনো ধর্মীয় প্রত্যয়ের কারণে বা কোনো কল্পিত প্রাচীন আদর্শ সমাজের প্রতি বিশ্বস্ততার কারণে নয়, আধুনিক কালে সমাজকে সম্পূর্ণভাবে হাতের মুঠোয় রাখার একটি উপায়হিসাবেই ‘হিন্দুত্বে’র পুনর্নির্মাণের চেষ্টায় তারা কোনো ছেদ দেয়নি। ‘মনুসংহিতা’ বলে কোনো শাস্ত্রের যদি অস্তিত্ব নাও থাকত তবু সংঘকে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রয়োজনেই এমন একটি শাস্ত্র আবিষ্কার করতে হত। নয়া উদারবাদের যুগে যখন সংবিধান ও আইনগুলিকে শিথিল করার তাগিদ অর্থনৈতিক রদবদলের কারণেই বেড়ে উঠল এবং কর্পোরেটের সঙ্গে সংঘীদের গাঁঠছড়া বাঁধা শুরু হল তখন ‘রক্ষণশীলতা’র থাকবন্দি বিভাজনের মতাদর্শকেই সংবিধান ও আইনের শাসনের পরিবর্তে আধিপত্যবাদকে কায়েম করার কাজে তারা ব্যবহারযোগ্য করে তুলল। শুধু তাই নয়, অগ্রগামী সামাজিক আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে সমাজের অভ্যন্তরে রক্ষণশীলতার সমর্থনকেও চাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হল।

তৃণমূল কংগ্রেস বা সংবিধানকে তাচ্ছিল্যকারী, আধিপত্যবাদী অনুরূপ কোনো রাজনৈতিক শক্তিরই সংঘীদের মতো সমাজের মধ্যে এতদূর বিস্তৃত শিকড় নেই। বরং বলা চলে আইন-সংবিধানের আওতার বাইরে জুলুমবাজির জমানার প্রতিষ্ঠায় এমন সব রাজনৈতিক দল যতো তৎপরতা দেখিয়েছে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ততোটাই সংঘ-বিজেপি-র মুখাপেক্ষী হয়েছে। সমাজের ভিতরের অসাম্য ও রক্ষণশীলতার সঙ্গে আপস যেখানে যে রাজনৈতিক দল এই সময়ে করেছে, তারাও সংঘীদেরই বাড়বাড়ন্তে সহায়তা করেছে। কংগ্রেস জমানায় বাবরি মসজিদের বিনাশ সম্ভব হয়েছিল এই আপসের কারণেই। ২০০৬ সালে কংগ্রেস-এনসিপি-র রাজত্বে মহারাষ্ট্রের খৈরলাঞ্জিতে স্থানীয় ক্ষমতাশালী ওবিসি-দের হাতে সুরেখা ভোটমাংগে এবং তাঁর কন্যা প্রিয়ংকা ও দুই পুত্রের নৃশংস অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডকে জাতপাত-প্ররোচিত অপরাধ হিসাবে দেখতে সরকার গররাজি ছিল কারণ ক্ষমতায় থেকে এমন কিছু করতে তারা চায়নি যাতে গণ্ডগোল বাড়ে। তার ফলে মূল অপরাধী বিজেপি নেতা বেকসুর খালাস হয়ে যায়। আবার হাথরসের ঘটনা দেখিয়ে দেয় এই আপস করার কারণেই অখিলেশ-মায়াবতীরা আজ কত অপ্রাসঙ্গিক।

লিঙ্গ-অসাম্যের দীর্ঘ ইতিহাস সমাজে মেয়েদের এমনিতেই নানাবিধ আক্রমণের মুখে বিপন্ন করে রেখেছে। অসাম্যে বিভাজিত সমাজে তাছাড়াও বিশেষ বিপন্নতায় ভোগে শিশুরা, দলিতরা, আদিবাসীরা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, এবং অবশ্যই গরিব মানুষ। আবার এইসব বর্গের মধ্যেও যারা মেয়ে তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আরো বেশি। এটা কোনো ব্যতিক্রম নয় যে আমাদের আইনি পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নারীনির্যাতন-সংক্রান্ত যে গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্নগুলি রয়েছে তার অনেকগুলির গোড়াপত্তন হয়েছে এইসব বর্গের মেয়েদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা থেকেই। ১৯৭৯ সালে মথুরা-মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অসাম্যসূচক রায়কে নারী-আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ জানানো থেকেই আশির দশকে ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইনে বেশকিছু পরিবর্তন। ‘সাথিন’-প্রকল্পের দলিত কর্মী ভাঁওরি দেবীর ওপর তথাকথিত ‘উচ্চ’বর্ণের পুরুষদের যৌন-আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটেই কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থাসম্বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায় এবং ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইনেরও আরো পরিবর্তন। ১৯৮৯ সালে প্রণীত তপশীলি জাতি ও জনজাতির উপর অত্যাচার নিবারণে বহুপ্রতীক্ষিত আইনটিও তো এমনই এক দিক্‌চিহ্ন।

তবু যে ভাঁওরি দেবীর মামলার আজও নিষ্পত্তি হয়নি বা খৈরলাঞ্জির বীভৎসায় সেসময়ে সিবিআই তদন্তের দাবি মানা হয়নি, বা হাথরসে আজ সিবিআই তদন্ত করতে নেমেও ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ-সহ এফআইআর-টি গ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে ধন্দ থেকে যাচ্ছে, তার একটি প্রধান কারণেরই উল্লেখ করেছি একটু আগে। বিচারব্যবস্থার অন্তর্গত ত্রুটি ছাড়াও তা হল বিশ শতকের শেষ একুশ শতকের শুরু থেকে দেশের পরিস্থিতির পরিবর্তন, নয়া উদারবাদী জমানায় সংবিধান ও আইন সম্বন্ধে শাসককুলের অনীহাবৃদ্ধি, যা ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই বিজেপি-র রক্ষণশীল ‘মনুবাদী’ আধিপত্যের বার্তাকে ক্রমশ একধরনের সার্বজনীন সামাজিক মান্যতা পেতে সাহায্য করেছে। বিপন্ন বর্গগুলিই এই আধিপত্যের মূল লক্ষ্য, তাদের মধ্যে দলিতদের ও আদিবাসীদের ‘হিন্দুত্বে’র ছাতার তলায় নিয়ে এসে বশ মানানোর চেষ্টা এইসময়ে বিশেষভাবে ব্যাপকতা পায়। অন্যদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিশেষ করে মুসলিমদের বশ্যতাস্বীকার করানোর পন্থা আতঙ্ক; তাদের ‘বহিরাগত’ বলে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে যার শুরু। তাই এই সমস্ত বর্গগুলির মেয়েদের বিপন্নতা আজ চূড়ান্ত।

তদুপরি মোদীর আমলে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাব বাড়ার আরেকটি বড়ো কারণ গরিবি ও বেরোজগারির বৃদ্ধি। যেদেশে মেয়েদের ৯৫% ভাগই অসংগঠিত শ্রমের ক্ষেত্রে কাজ করেন সেখানে প্রতিদিন তাঁদের শ্রমের সাংঘাতিক অবমূল্যায়ন, যা ঘরেই কি বাইরেই কি, বিপদের বাতাবরণেই তাঁদের কাজ খুঁজতে এবং করতে বাধ্য করছে। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষাও তাই আরো বিপর্যস্ত। হাথরসের ঘটনায় জাতপাতের ব্যাপারটি অন্যতম প্রধান মাত্রা তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মেয়েটির পরিবারের অর্থনৈতিক বিপন্নতাও কি আক্রমণকারীদের স্পর্ধাকে আরো বাড়িয়ে দেয়নি? আর সাধারণভাবেও জাতপাতের দিক থেকে যাঁরা সবচাইতে প্রান্তিক তাঁদের বৃহদংশই যে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার তা কি অস্বীকার করা সম্ভব? উত্তরপ্রদেশের উন্নাওতে কিছুদিন আগে যে ঘটনা ঘটে, সেখানে জাতপাতের মাত্রাটি ছিল না, কিন্তু সেখানে নির্যাতিতা মেয়েটি শাসকদলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধায়কের খপ্পরে পড়ে একটি চাকরি চাইতে গিয়ে। জেলে বসেও সেই বাহুবলী নির্যাতিতা এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে চরম প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কাজের অধিকারের স্বীকৃতি এই আমলে ভয়ংকরভাবে ক্ষয় পাওয়ার বিষয়টিও কি মেয়েদের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে অর্থহীন করে তুলছে না?

খ্রিস্টিয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে যখন মনুসংহিতা সংকলিত ও রচিত হয় তখন উত্তরভারতের বড়ো বড়ো রাজবংশে ব্রাহ্মণ্যবাদের দিকে একটা ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। শাস্ত্রটি যাঁরা সংকলন করেছিলেন তাঁরা পূর্ববর্তী যুগের বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি অবৈদিক দর্শনের প্রভাবকে খর্ব করার জন্য এবং শকহূনদের আসন্ন আক্রমণের দিকে চোখ রেখে তাঁদের কল্পিত ‘সত্যযুগে’ যেমনটা ছিল তেমনই ব্রাহ্মণ ও রাজার মধ্যে নিবিড় সংযোগের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এক ‘খাঁটি’ বৈদিক ধর্মাচরণবিধির চালচিত্র রচনা করতে চেয়েছিলেন। ‘ম্লেচ্ছ’ ও ‘যবন’দের রাখা হয়েছিল এই ছকের বাইরে; বাকি সমস্ত জনগোষ্ঠীগুলিকে একটি অনড় থাকবন্দি ব্যবস্থার কোথাও না কোথাও ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের একই রাজনৈতিক-সামাজিক আধিপত্যের ছত্রছায়ায় নিয়ে আসা ছিল তাঁদের পরিকল্পনা। সংকটকালে ‘বর্ণসংকরে’র সম্ভাবনায় তাঁরা তাই এত ভীত ছিলেন; তাই শূদ্র এবং নারীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এত জরুরি ছিল। আম্বেদকরের লেখায় মনু-দর্শনের এই প্রবণতার সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ রয়েছে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আধুনিক ভারতের দিকে আমরা এগোলাম, অধিকারের সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তার দুটি মূল ধারণা। এগুলি বিদেশ থেকে আসেনি, আমাদের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমাদের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে গেছে। তা রক্ষা করার দায়িত্ব ভারতের জনগণ সংবিধানের মধ্য দিয়ে ন্যস্ত করেছে রাষ্ট্রের হাতে। মনুসংহিতাও কিন্তু রাজার বা রাষ্ট্রের স্বৈরাচারের কথা বলে না, একধরনের ন্যায়ের শাসনের কথাই বলে। মুশকিল হল সেই ন্যায়ের ধারণা বিধৃত রয়েছে সম্পূর্ণ সামাজিক বশ্যতার একটি ছকের ভিতর। শূদ্র বা নারীও রাষ্ট্রের সুরক্ষা পাবার উপযুক্ত এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, কিন্তু যতক্ষণ তারা মনুকথিত আচার-আচরণের ছকটিকে মেনে নিচ্ছে ততক্ষণই। এই দৃষ্টিভঙ্গি যে স্বাধীন ভারতে ন্যায়ের ধারণা, মৌলিক অধিকারের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী তার কোনো সন্দেহ নেই। এর প্রয়োগের কোনো দুশ্চেষ্টা আজকের দিনে ন্যায়ের রাজত্ব কায়েম করতে পারবে এমন ভাবা বাতুলতা। তাহলে সংঘীরা তা করতে চাইছে কেন? ন্যায়ের প্রতি একনিষ্ঠ বলে নিশ্চয়ই নয়।

ঔপনিবেশিক সরকার মনুসংহিতার ইংরেজি অনুবাদই করিয়েছিল, হিন্দু প্রজাদের জন্য তার বিধান চালু করতে পারেনি। ভারত স্বাধীন হবার পরেও ভারতীয় দণ্ডবিধি মনুর অনুসরণ করেনি, সংবিধানকেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু মনুর যাঁরা আধুনিক সন্তান, যাঁরা প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় সংবিধানকে মেনে নেননি, তাঁদের আসলে দরকার ঐ পরিপূর্ণ বশ্যতার ছকটি যার শিকড়গুলি আমাদের সমাজের মধ্যে রয়ে গেছে, কিন্তু স্বাধীন ভারতে ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে যার মৌলিক বিরোধ। তাঁদের পক্ষে যেটা উপলব্ধি করা অসম্ভব তা হল এই যে ‘হিন্দুত্বে’র ছত্রছায়ায় এনে বা তা থেকে বহিষ্কার করে রেখে, অনুশাসনের বেড়াজালে ঘিরে বা শাস্তির ব্যবস্থা করে যে বশ্যতা তাঁরা আদায় করতে চাইছেন তা আজকের ভারতে অসম্ভব। তাই আইনের বদলে জবরদস্তির আশ্রয় নিতে তাঁরা বাধ্য। এমনকী, আইনকেই তাঁরা জবরদস্তির রূপ দিচ্ছেন। এই প্রয়াস সর্বক্ষেত্রেই মেয়েদের ওপর নানাবিধ অত্যাচারকে বাড়াচ্ছে শুধু নয়, বশীকরণের একটা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করছে।

তা নাহলে যাঁরা দলিত বা সংখ্যালঘু নন এমন মেয়েদেরও নিজের জীবনসঙ্গী খোঁজার অধিকারকে পারিবারিক সম্মানরক্ষার নামে জোটবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখতে হয় কেন? তথাকথিত ‘লাভ জিহাদে’র ভীতি জনাবর্তে কেন ছড়িয়ে দেওয়া হয়? অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কেন ‘হিন্দুত্বে’র হাতে সংখ্যালঘুর অধিকার হননকারী হাতিয়ার হয়ে ওঠে? নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রতিবাদে মেয়েদের পথে নামা মনুবাদীদের কেন এত বিচলিত করে যে তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনতে হয়? প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা ন্যায়বিচার নয়, বিষয়টা বিজেপি-আরএসএস শাসিত ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার প্রতি প্রশ্নহীন বাধ্যতা, তাদের দুর্গাবাহিনীরও ছাড় নেই তা থেকে। পারিবারিক অনুশাসনের প্রতি বাধ্যতা, ‘উঁচু’জাতের প্রতি বাধ্যতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের আতঙ্ককে মেনে নেওয়ার বাধ্যতা। তাই হাথরস এব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাবে না। হাথরসের কাণ্ড যদি কেবল দলিত মেয়েদের ওপর অজস্র অত্যাচারের একটি উদাহরণ বলেই পরিগণিত হয়, তাহলে হয়তো তার প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণেও এনে ফেলা যাবে। কিন্তু হাথরসের চিতার আলোকে যদি আজকের মনুবাদী সুরক্ষাব্যবস্থার প্রতিফলনকে খোলাচোখে দেখি তবে তার ভাঁওতাকে সেই আগুনে নিক্ষেপ করে সাংবিধানিক সুরক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার সম্মিলিত লড়াই আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারবে।