আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সমসাময়িক

সংযম-সতর্কতা-সচেতনতার শপথ


একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের প্রথম বর্ষের সমাপ্তিলগ্ন আসন্ন। এই বছরের বেশিরভাগ সময় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংক্রমণের দাপটে জনজীবন পর্যুদস্ত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কোনো দেশে জাতীয় স্তরে কোথাও আবার স্থানীয় ভাবে জনজীবন অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ইংরেজি ভাষার 'লক ডাউন' এখন সব ভাষারই নিজস্ব শব্দবন্ধ।

লক-ডাউনের ফলে প্রচলিত জীবনযাপন প্রক্রিয়া পালটে গিয়ে এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছে। পছন্দ না হলেও সংক্রমণ প্রতিহত করার তাগিদে পৃথিবীর বেশিরভাগ সমাজ তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আরোপিত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘিত হয়েছে সেইসব দেশে আবার সংক্রমণ সম্প্রসারিত হচ্ছে। ফলে নতুন করে জাতীয় স্তরে লক ডাউন ঘোষণা করতে হয়েছে। ফ্রান্স আবার অবরুদ্ধ। জার্মানি আবার অবরুদ্ধ হতে পারে বলে সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা করেছেন যে আবার নতুন করে লক ডাউন শুরু করতে হতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশই বাৎসরিক উৎসব উদযাপন করতে পারেনি। ইস্টার থেকে ঈদ সকলেই ঘরে বসেই নিজের মতো করে উদযাপন করেছেন। মহরমের মিছিল হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পঁচাত্তর বছর উদযাপনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবসের (৪ জুলাই) সমারোহ স্থগিত। ফ্রান্সের বাস্তিল দিবস (১৪ জুলাই) উদযাপনের ধারাবাহিকতায় এবার ছেদ পড়েছে। বার্লিনের দেওয়াল ভাঙার চল্লিশ বছর পূর্তির (৯ অক্টোবর) অনুষ্ঠান বাতিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার (২৪ অক্টোবর) পঁচাত্তর বছর উদযাপিত হয়নি। যে সব দেশে লোকাচার মেনে হলউইন উৎসবের (৩১ অক্টোবর) আয়োজন করা হয় তা এবারের মতো স্থগিত। 'গাই ফক্স' (৫ নভেম্বর) গ্রেট ব্রিটেনের জাতীয় ছুটির দিন। আগের রাত থেকেই আতশবাজি জ্বালিয়ে শুরু হয় উৎসব উদযাপন। এই বছরও ছুটি থাকবে। কিন্তু জনজীবন আতশবাজি ভিত্তিক উৎসব মুখর হবে না।

ভারতবর্ষ সাধারণ ভাবে এবারের মতো উৎসব মুলতুবি রেখেছে। নিয়মরক্ষার খাতিরে আদালতের নির্দেশে পুরীর রথযাত্রার উৎসব সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে একান্তই অপরিহার্য মানুষের উপস্থিতিতে পালন করা হয়েছে। গণেশ চতুর্থীর মতো জমজমাট উৎসব নীরবে পালিত হয়েছে। নবরাত্রির গঢ়বা উৎসব কখন শুরু হয়ে কখন যে শেষ হয়ে গেল কেউ বুঝতেই পারেনি। সকলেই মেনে নিয়েছেন যে উৎসব উপলক্ষে জনসমাগম এই বছর বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত কেরালার ওনাম উৎসব উদযাপনের ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা এখনও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

এইসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শারদীয় দুর্গাপূজার উদ্যোক্তারা নিজেদের মতো করে স্থির করে নিয়েছিলেন যে এবার কোনো উৎসব উদযাপন করা হবে না। নেহাত পরম্পরা রক্ষার জন্য যেটুকু না করলেই নয় তা নীরবে, প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তিবিশেষের বাড়িতে সম্পন্ন করা হবে। এবং বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমনটাই হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের উদ্যোক্তারা যখন উৎসব উদযাপন নিয়ে চিন্তিত নয়, শঙ্কিত ছিলেন সেই লগ্নে রাজ্য সরকারের অনুপ্রেরণায় সকলে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। সরকারি কোষাগার থেকে অর্থ বরাদ্দ হল। আইন আদালত হল। চিকিৎসক, গবেষক, বিশেষজ্ঞদের করুণ আবেদন অগ্রাহ্য করে অতঃপর কোথাও কোথাও আইন মেনে আইন অমান্য করে জনসমাগম হল। প্রশাসনের নির্বিকার আচরণ ও উদাসীনতা অবলোকন করতে করতে সম্পন্ন হয়েছে শারোদৎসবের প্রথম পর্যায়।

দেওয়ালি সমাসন্ন। এই উৎসবের অন্যতম উপাদান আতশবাজি। আদালত, দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষর নির্দেশে শব্দ বাজি নিষিদ্ধ। কিন্তু নিষিদ্ধ বিষয়েই মানুষের বেশি আকর্ষণ। কাজেই কাগজপত্র অনুযায়ী নিষিদ্ধ হলেও শব্দ বাজি ব্যবহার বন্ধ হয়নি। আকাশ জুড়ে স্বপ্নমায়া ছড়ানো দৃশ্য বাজি কোন মাত্রার দূষণ ছড়ায় তা মেপে দেখা হয়েছে কি? উত্তরে থাকো মৌন - এমন এক আপ্তবাক্য স্মরণ করে সকলেই নিরুত্তর।

ইতিমধ্যে আবহাওয়ায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ঠান্ডা এগিয়ে আসছে। ঠান্ডার সঙ্গে বায়ু দূষণ মিলেমিশে জনজীবনকে কীভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে তার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত দিল্লির পরিস্থিতি। দিল্লিতে সবে ঠান্ডার মরসুম শুরু হয়েছে। এরমধ্যেই বায়ু দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দিনদুপুরে রাস্তায় দৃশ্যমানতা অন্তর্হিত। এ এমন এক আবহাওয়া যা জনজীবনে নিয়ে এসেছে শ্বাসরোধকর পরিস্থিতি। দিনের শেষে শ্বাসকষ্টে জর্জরিত নাগরিকদের ডাক্তার-হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না।

পশ্চিমবঙ্গের নীল-সাদা স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ঢিলেঢালা নড়বড়ে চেহারার সঙ্গে সকলেই পরিচিত। পাঁচ তারা তকমা লাগানো হাসপাতালগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবার থেকে বাণিজ্য বিষয়ে বেশি আগ্রহী। এই পরিস্থিতিতে জানা যাচ্ছে যে শ্বাসতন্ত্রের অসুখের সময়ে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সরবরাহ যথেষ্ট নয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন সংক্রমণ আক্রান্তের সংখ্যা গড়ে ৪ হাজারের ঘরে আটকে রয়েছে। গত দু’মাস ধরে চব্বিশ ঘণ্টায় মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবে কম-বেশি ৬০। পরীক্ষা করা হচ্ছে গড়ে প্রতিদিন ৪০ হাজার। কী করে যে এই পরিসংখ্যানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সংক্রমণ সম্প্রসারিত হচ্ছে তা বিশারদদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ মানুষের মনেও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুযায়ী নভেম্বরে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আকস্মিকভাবে বাস্তবিকই বৃদ্ধি পেলে কী হবে তা চিন্তার বিষয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পুজো পরিক্রমার হাত ধরে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যে প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যায় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

দেওয়ালি ছাড়াও আগামী কয়েক মাসের মধ্যে রয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজো, রাস উৎসব, ছট পুজো, ধনতেরাস, কার্তিক পুজো এবং বড়দিন-সহ একাধিক পার্বণ। সেগুলির বেশির ভাগ নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক হলেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। একাধিক জেলা থেকে বহু মানুষ সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে উৎসবে যোগ দেন। জনসমাগমের দিক থেকে দুর্গাপুজোর থেকে সেইসব উৎসব কোনো অংশে কম নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই উৎসবগুলিতে আতশবাজির প্রাচুর্য। শীতের কুয়াশা-শিশির এবং আতশবাজির ধোঁয়া মিলেমিশে এমন এক আবহাওয়া সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে যা মনুষ্যদেহের শ্বাসতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। এবার আবার সঙ্গে থাকছে সংক্রমণের আশঙ্কা। সবমিলিয়ে এক মারাত্মক মরসুম আসতে পারে বলে সকলেই উদ্বিগ্ন।

এই পরিস্থিতিতে উৎসব উদযাপন সম্পর্কে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। তবে সরকারের অনুপ্রেরণায় অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজার পর বিশেষত দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কোন উদ্যোক্তা উৎসব পরিহারের কথা চিন্তা করবেন!

দুর্গাপূজার দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায় যে সরকারের তরফে উৎসব স্থগিত রাখার কোনো উদ্যোগ নেওয়া মুশকিল। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে আতশবাজির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা মোটেও সহজ কাজ নয়। অতএব বায়ুদূষণ অবশ্যম্ভাবী। তার মধ্যেই সুস্থ ভাবে বাঁচতে হবে। বিভিন্ন কারণে মানুষকে বাইরে বেরোতেই হয়। আর বাইরে বেরোলে শ্বাসকষ্ট বাড়ে। আর ঘরের মধ্যে দমবন্ধ করে বসে থাকলে শুরু হয় মানসিক যন্ত্রণা। স্ব-আরোপিত সংযম-সতর্কতা-সচেতনতা ভিন্ন এমন এক বিচিত্র অবস্থায় অন্য কোনো দিশা দেখা যাচ্ছে কি? কাজেই সমাজসভ্যতার এই দুরূহ সংকটের সময় সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে শপথ নিতে হবে নিজেদের সুস্থ রাখার জন্য সংযত হয়ে থাকতে হবে। চলাফেরায় সবসময় সতর্কতা থাকবে। এবং আমাদের মধ্যে সচেতনতা বজায় থাকবে।