আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সমসাময়িক

বিহার কা বাহার


বহুকাল পর বিহার সম্ভবত ভারতীয় রাজনীতিকে দিশা দেখাচ্ছে। ১৯৭৫-এ জয়প্রকাশের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল কার্যত বিহার। ১৯৯০, ১৯৯৫-এ মণ্ডল কমিশন ছিল ইস্যু। ২০০৫-এ বিহারে লালু প্রসাদ যাদব দুর্নীতিগ্রস্ত এই প্রচার করে ক্ষমতায় আসেন নীতীশকুমার। ২০১৪-এ জোট ভঙ্গ। লালুপ্রসাদ যাদবের দলের হাত ধরে ক্ষমতায় এলেন। তারপর নীতীশের বিরুদ্ধে সিবিআই লেলিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাতেই জোট ভেঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই সরকার গড়লেন বিজেপির সঙ্গে।

এবং এবারও গোদি মিডিয়া সমীক্ষা প্রকাশ করে জানাচ্ছে, বিজেপি জোট ক্ষমতায় ফিরছে। ফিরছে কিনা বোঝা যাবে ১০ নভেম্বর। তবে ছোটো ছোটো প্রচার মাধ্যম এবং মোদী নীতীশ জুটি বনাম তেজস্বী যাদবের জনসভায় ভিড় ও উচ্ছ্বাসের তফাৎ অন্য কথা বলছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ভিড়ে উচ্ছ্বাসে শ্লোগানে ভরিয়ে দিচ্ছে তেজস্বী যাদবের সভা। ২৮ অক্টোবর মোদীর দুটি সভা ছিল। চেয়ার ভরেনি। ঘুমোচ্ছে লোকে। দেখা গেছে। আর ওইদিন তেজস্বী যাদবের সভা ছিল ১৬টি। মেরেকেটে মাত্র ৫-৬ মিনিট করে বলছেন। তাতেও হাজার হাজার জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ছেন। যেন ভোটের ফল বেরিয়ে গেছে। কেন?

আগে নির্বাচন এলে জিনিসপত্রের দাম আর চাকরি একটা বড় বিষয় হতো। বিজেপির নতুন ভারতে ধর্মই প্রধান হাতিয়ার হয়েছে। ২০১৪-এর নির্বাচনে আচ্ছে দিন বা সুদিনের প্রতীক্ষায় ৩১% ভোটার ভোট দিয়েছিলেন বিজেপিকে। কিন্তু সুদিন আসেনি। অর্থনীতির চরম দুর্দিন। ৪৫ বছরে রেকর্ড বেকারত্ব। রেকর্ড মন্দা। ২৩.৯% হ্রাস জিডিপিতে। ক্ষুধা অপুষ্টি দুর্নীতি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাধীনতা নারী সুরক্ষা সবেতেই ভারত পিছিয়ে। এমনকী পাকিস্তানের চেয়েও পিছিয়ে।

এইসময় বিহারে নির্বাচনী রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু কর্মসংস্থান। বিহারে, সিএমআইই সমীক্ষা অনুযায়ী ৪৬.৬% বেকার। দেশে লক ডাউনের সময় বাইরের রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের সিংহভাগ উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের। বিহার দ্বিতীয় স্থানে। ২৩ লাখের বেশি মানুষ হেঁটে শত শত কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরেছেন। ১২০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ঘরে ফেরা মেয়ে জ্যোতি কুমারী যাদব বিহারের। আট দিন ধরে ট্রেনে ঘুরে জল খাবার না পেয়ে মুজফফরপুর স্টেশনে মৃত মায়ের গায়ের চাদর ধরে টানা ছেলেটি বিহারের। গত বছর রেলে কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে সমস্তিপুর রেল স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তরুণরাও বিহারের।

বিহারে লালুপ্রসাদ যাদবের সময় শিল্প থেকে অর্থ যা আসতো এখন তার অর্ধেক। বিহারকে এখন বাহার ছুটতে হচ্ছে। মদ নিষিদ্ধ নামেই। সর্বত্র বেশি দামে মদ মিলছে। বিজলি সড়ক পানির শ্লোগান দিয়ে একবার ক্ষমতায় এসেছিলেন নীতীশ। এবার ভাঙাচোরা রাস্তা তার সচিবালয় গমনের পথ বন্ধুর করে তুলেছে।

উল্টোদিকে তেজস্বী যাদব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষমতা এলেই মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই ১০ লাখ চাকরি। নীতীশ কুমার বলছেন, এতো পয়সা নেই। আর তাঁর শরিক বিজেপি বলছে, ১৯ লাখ চাকরি দেবো। সঙ্গে উঠেছে বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। বিরোধীরা বলছেন এ-সব মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। নীতীশ কুমার গত ১৫ বছর সরকারি চাকরি দেন নি। এবার দিতে হবে। দুই, বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন জুমলা। আগে ১৫ লাখ টাকা দাও। ভ্যাকসিন কিনে নেবো।

বিহারে এবার তিনটি জোট ভোটে লড়ছে। একটি নীতীশ কুমারের দলের সঙ্গে বিজেপির জোট। সেই জোটও টুটাফুটা। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রয়াত মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানের দল তথা দলপ্রধান চিরাগ পাসোয়ান নীতীশ কুমারের দলের ১২২ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছে। যদিও বিজেপির বিরুদ্ধে দেয়নি। এটা বিজেপির কৌশল নীতীশের প্রাধান্য কমানোর। ভোটের পর তেমন বুঝলে নীতীশের সঙ্গে জোট ভেঙ্গে চিরাগকে নিয়ে সরকার গড়ার ধান্দা।

কিন্তু সে-ই ধান্দা কি পূরণ হবে? সন্দেহ জাগছে। মুসলিম যাদব সমীকরণ এবার আবার কাজ করছে। তার চেয়ে বেশি কাজ করছে বেকারদের বিক্ষোভ। এরসঙ্গে আছে জিনিসপত্রের লাগামহীন দাম। তেজস্বী যাদব বুকে পেঁয়াজের মালা নিয়ে ঘুরেছেন। ৮০-১০০ টাকা দাম পেঁয়াজের। এর সঙ্গে আলু চাল ডাল তেল নুনের দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে।

বিহার ভোটের বহুদিন পর মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যা ইস্যু হয়েছে। হার জিত পরে হবে জনতার ইস্যু আপাতত জিতছে। এটাই দেখার। মোদী সাম্প্রদায়িক হিন্দু-মুসলমান তাস আবার খেললেও, প্রচারমাধ্যম লিখতে বাধ্য হচ্ছে, শ্রমিকরা মোদীর নাম উচ্চারণে নারাজ।