আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭
সমসাময়িক
নিম্নগামী বৃদ্ধি, ঊর্ধ্বগামী মূল্য
অনর্গল অসত্য বা অর্ধসত্য বলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় বাকি সমস্ত মন্ত্রী-সান্ত্রী অভ্যাসে পরিণত করেছেন। সম্প্রতি দেশের অর্থমন্ত্রী বলেছেন ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের বৃদ্ধির হার শূন্য শতাংশের আশেপাশে থাকবে। এই বক্তব্য পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী বোধহয় ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রতিবেদন পড়তে ভুলে গিয়েছিলেন। অক্টোবর মাসের ৭ থেকে ৯ তারিখে মুম্বই শহরে অনুষ্ঠিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতি সংক্রান্ত কমিটির (Monetary Policy Committee) সভায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে বলা হয় যে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি ৯.৫ শতাংশ সংকুচিত হবে। ১৩ অক্টোবর তারিখে, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের পূর্বাভাস প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয়েছে যে ভারতের জিডিপি সংকুচিত হবে ১০.৩ শতাংশ। এই সমস্ত প্রতিবেদন গণপরিসরে প্রকাশিত হওয়ার পরেও ২৮ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী উপরোক্ত দাবি করেন, যদিও তাঁর এহেন দাবির নেপথ্যে কোন তথ্য বা তত্ত্ব আছে তা তিনি খোলসা করে বলেননি। বোঝাই যাচ্ছে মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
উপরোক্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সভায় ডেপুটি গভর্নর মাইকেল পাত্র অত্যন্ত গভীর চিন্তা ব্যক্ত করেন অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য নিয়ে। তিনি বলেন যে ২০২০-২১ সালে কোভিড পূর্ববর্তী জিডিপি-র তুলনায় ৬ শতাংশ পতন ঘটবে এবং তা পুনরুদ্ধার করতে বহু বছর সময় লেগে যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী যেই আশার বাণী শোনাতে চাইছেন, তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নরের কথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, স্বয়ং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর বলেছেন যে কিছু সূচকের ভিত্তিতে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরছে বলে মনে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখনও অর্থব্যবস্থায় যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়েছে। বিশেষ করে কোভিড সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা অর্থব্যবস্থার আরো ক্ষতি করবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নরের বক্তব্যেও অর্থমন্ত্রীর অবাস্তব আশাবাদের প্রতিধ্বনী শোনা যায়নি।
এই যে বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমে অর্থব্যবস্থা গতিপ্রাপ্ত হয়েছে বলে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন তা নিয়েও সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত, দীর্ঘদিন লকডাউনের পরে মানুষ বাইরে বেরোচ্ছেন পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করছেন। অতএব, স্বাভাভিকভাবেই অর্থব্যবস্থা আগের তুলনায় গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আগের তুলনায় বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সংবাদমাধ্যমে এই তুলনা করা হচ্ছে এপ্রিল-মে মাসের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই এপ্রিল-মে মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে অর্থব্যবস্থা বেশি সচল থেকেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আগের বছরের তুলনায় ছবিটি কেমন? এই ক্ষেত্রে কিছু সূচক আশার কথা বললেও ২০২০-২১ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের তথ্য সামনে না আসা অবধি সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবু, বলা যেতে পারে যে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় বেশি হবে, কারণ লকডাউনের প্রকোপ কমেছে, দ্বিতীয়ত যে সমস্ত পণ্য মানুষ আগে কিনতে পারেননি, এখন তারা তা কিনেছেন, এবং তৃতীয়ত উৎসবের প্রাক্কালে কেনাকাটা অর্থব্যবস্থায় বাড়তি রক্তসঞ্চালন করবে। কিন্তু, যদি সরকারী খরচ বাড়িয়ে ফিসক্যাল স্টিমিউলাস না দেওয়া হয়, তবে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এই বৃদ্ধির হার আবার কমে আসতে পারে, যেই আশঙ্কার কথা অর্থনীতিবিদ প্রণব সেন আরেক রকম-এ (গত সংখ্যা) প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন। বিশেষত, আপাতত দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়তে পারে বলে যা বলা হচ্ছে, তা মূলত ভোগ্যপণ্য ব্যয়ের বৃদ্ধির কারণেই হবে। কিন্তু অর্থব্যবস্থাকে গতিশীল রাখতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। এখনও অর্থব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডেপুটি গভর্নর মাইকেল পাত্র এই কথাটি আর্থিক কমিটির সভাতেও বলেছেন।
বৃদ্ধির হারের পরিণতি বর্ষশেষে কী হবে তা সময় বলবে। আপাতত সাধারণ মানুষের জীবন জেরবার করে তুলেছে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা। ভারতে সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার (খুচরো মূল্যের হিসেবে) হয়েছে ৭.৩৪ শতাংশ, যার মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ১০.৬৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ দেশে খাদ্যের দাম ১০ শতাংশের বেশি হারে বাড়ছে। বিশ্বের সমস্ত উদীয়মান অর্থব্যবস্থার মধ্যে ভারতের মূল্যবৃদ্ধি প্রায় সর্বাধিক। বাকি দেশে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ কোভিড-পূর্ব মানের থেকে খুব বেশি বাড়েনি। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে তা লাগাতার বাড়ছে। এই মূল্যবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি অবশ্যই খাওয়ারের বাড়তে থাকা দাম।
কিন্তু খাদ্যের মধ্যেও, কোন পণ্যের দাম বাড়ছে? দেখা যাচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে শাকসবজির মূল্যবৃদ্ধির হার ২০ শতাংশের বেশি, মাছ-মাংসের মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ, ডিমের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ, ডাল ১৫ শতাংশ, খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৫ শতাংশ। এই হিসেব কষা হচ্ছে ২০১৯ ও ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের বিভিন্ন পণ্যের দামের নিরিখে। কিন্তু অক্টোবর মাস থেকে বাড়তে শুরু করেছে আলু-পেঁয়াজের দাম। কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪০ টাকায়, যা এই সময় গত বছর বিক্রি হত ১৬ টাকা প্রতি কেজি দরে। পেঁয়াজ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৮০-১০০ প্রতি কেজি দরে, যা গত বছর অক্টোবর মাসে বিক্রি হত কেজি প্রতি ৫৭ টাকায়। টমেটোর ক্ষেত্রেও অনুরূপ ছবি চোখে পড়ছে। একদিকে, লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ, অনেক মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। তার মধ্যে দুইবেলা যা খেয়ে বেঁচে থাকা তার দামও যদি হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়, মানুষ তবে বাঁচবে কী নিয়ে?
কোভিড পরবর্তী আর্থিক মন্দার আবহে এহেন মূল্যবৃদ্ধি অর্থনৈতিক তত্ত্বের নিরিখে ব্যাখ্যা করা কঠিন। একদিকে, মানুষের হাতে টাকা নেই, বহু মানুষ বেকার। ফলত, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে বলেই মনে করা যেতে পারে। অতএব, অতিরিক্ত চাহিদার জন্য এই মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে এমন কথা বলা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, প্রথম ত্রৈমাসিকের তথ্য সাক্ষ্য দিচ্ছে যে কোভিডের আবহেও কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে। অতএব, এমন মনে করা অসংগত হবে না, যে জোগানের সমস্যাও থাকার কথা নয়। তবু মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে তার কারণ খুঁজতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে যেতে হবে।
আগেই বলা হয়েছে যে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ শাকসবজির ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি। শাকসবজি বহু প্রকারের হয়, যা একেকটি ফসলের ক্ষেত্রে একেক সময় বাজারে আসে। যেমন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে কর্নাটকে অসময়ের বৃষ্টি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। কর্নাটকের পেঁয়াজ এই সময় বাজারে মূল জোগান নিশ্চিত করে। সেখানে কর্নাটকের অসময়ের বৃষ্টি পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কাজ করছে না। কোভিড জনিত লকডাউনের পরে এখনো পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে এখনও লোকাল ট্রেন চলছে না যার মাধ্যমে শাকসবজির এক বৃহদাংশ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সবজির জোগান দেয়। তদুপরি, খুচরো বিক্রেতারা কোভিড জনিত লকডাউনের ফলে কিছু অধিক মুনাফা কামানোর আশায় পণ্যের দাম বাড়িয়ে রেখেছেন। তৃতীয়ত কোভিড জনিত সাবধানতা অবলম্বনের উদ্দেশ্যে স্যানিটাইজার বা মাস্কের খরচ বহন করার জন্যও পণ্যের দাম বাড়ছে এমনটাও হতে পারে। এর সঙ্গে অসাধু ব্যাবসায়ীদের নেতৃত্বে মজুতদারী বাড়িয়ে কৃত্রিম উপায়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ কমিয়ে তার দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুঠের চেষ্টা হচ্ছে কী না, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
কেন্দ্রীয় সরকার দিন কয়েক আগে কৃষি আইন গায়ের জোরে পাশ করায় যার মধ্যে অত্যাবশ্যক পণ্যের মজুতদারি করার উপরে কোনো ঊর্ধ্বসীমা রাখা হয়নি। এই আইনে সরকার এই কথাও জোর গলায় ঘোষণা করে যে পণ্যের দাম যদি খুব বেশি না বাড়ে তবে সরকার বাজারে হস্তক্ষেপ করবে না। এই আইন পাশ করার কয়েক দিনের মধ্যে পেঁয়াজের বাড়তে থাকা দামকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। পেঁয়াজের রপ্তানিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং পেঁয়াজের মজুতের উপরেও ঊর্ধ্বসীমা চাপানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে বিহারের নির্বাচনের মরসুমে সরকার পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নতুন করে কোনো বিতর্ক হোক তা চায়নি। তবু দাম কিন্তু বেড়েই চলেছে। কিন্তু সরকারের এহেন পদক্ষেপ আবারো প্রমাণ করল যে কৃষি আইনের মাধ্যমে মজুতদারির ঊর্ধ্বসীমা বিলোপের নীতি আসলে ভ্রান্ত। এই বিতর্কের দুই পক্ষের মাঝখানে আপাতত পড়ে রয়েছে ভারতের দীনদরিদ্র জনগণ যারা লকডাউনের ঠেলা সামলিয়ে আপাতত মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন।