আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

উৎসব উন্মাদনা এবং স্বেচ্ছা সংযম


হেমন্তের সাঁঝবেলায় পঞ্জিকার তিথি মেনে সমাপ্ত হল এবারের শারদোৎসব। সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সমাপ্তিক্ষণ প্রলম্বিত। সংক্রমণের আশঙ্কায় এবারের শারদোৎসব নিয়ে জনজীবন যখন উদ্বেগে আচ্ছন্ন সেই পরম লগ্নে সরকারের আর্থিক ও নৈতিক অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে শুরু হয় বাৎসরিক উন্মাদনার প্রস্তুতি।

অনেকের মতে শারদোৎসব তো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকার বিষয়। জামা কাপড় জুতো থেকে শুরু করে ঘরগেরস্তালির যাবতীয় কেনাকাটার এটাই আদর্শ সময় ধরে নিয়ে সকলেই হাসি-আহ্লাদে উৎসব উদযাপন করতে চায়। ব্যাপারীদের মুখেও হাসি ফোটে। যথার্থ যুক্তি। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাও বলে চলেছেন কেনাকাটার ঝোঁক না বাড়লে অর্থাৎ বাজারে অর্থের বিনিয়োগ না বাড়াতে পারলে বর্তমান সঙ্কট নিরসনে অন্য কোনো সমাধানসূত্র নেই। তাঁরা তো অনেকদিন ধরেই পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন যে কাজছাড়া কাজহারা নিরন্ন মানুষের কাছে নগদ অর্থ অনুদান হিসেবে পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। তর্কের খাতিরে বলা যায় মানুষের হাতে যখন পয়সা নেই তখন বাজারের কেনাকাটা কীভাবে হবে। উত্তরে অনেক যুক্তি দেওয়া যায়। পালটা যুক্তিরও অভাব নেই। এই বিতর্ক-আলোচনা আসলে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া।

জীবন এবং জীবিকা একে অপরের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। জীবিকা না থাকলে জীবন কীভাবে চলবে? আবার জীবন হারিয়ে গেলে জীবিকার প্রয়োজন কোথায়? এও এক চিরায়ত বিতর্কের বিষয়। সেই আবহে রাজ্য প্রশাসনের উদ্যোগ এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অন্যান্য দেশেও বিভিন্ন ধরনের উৎসব উদযাপিত হয়। এই বছর প্রায় সব দেশেই উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান পরিহার করা হয়। ইস্টার থেকে ঈদ ঘরে বসেই উদযাপন করতে কেউ আপত্তি করেননি। পুরীর রথযাত্রার উৎসব সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে সামান্য এবং অপরিহার্য মানুষের উপস্থিতিতে পালন করা হয়েছে। গণেশ চতুর্থীর মতো জমজমাট উৎসব নীরবে পালিত হয়েছে। নবরাত্রির গঢ়বা উৎসব কখন শুরু হয়ে কখন যে শেষ হয়ে গেল কেউ টেরও পেল না। সকলের মনে হয়েছে উৎসব উপলক্ষে জনসমাগম এই বছর বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত কেরালার ওনাম উৎসব উদযাপনের ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা যখন স্মৃতিতে নয় রীতিমতো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, তখন উৎসব উদযাপন নিয়ে সকলেই চিন্তিত নয় শঙ্কিত ছিলেন।

শারোদৎসবের সলতে পাকানোর সময় অর্থাৎ এই বছরের জুন-জুলাইয়ের দিনগুলোতেও বোঝা যাচ্ছিল না, এবার কী হবে? আদৌ হবে তো? হলে কেমন ভাবে হবে? শেষ লগ্নে এসে ঢাকে কাঠি পড়ল। রাজ্য প্রশাসনও রাজনীতি এবং অর্থনীতির অঙ্ক কষে শারোদৎসবকে ‘সফল’ করার আয়োজন করে ফেলল। আন্দাজ করা যাচ্ছিল যে সংক্রমণ সংক্রান্ত বিধি নিষেধ শিকেয় তুলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনকে আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা শুরু হতে চলেছে। চিকিৎসক গবেষক বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন বলতে শুরু করলেন কী বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চলেছে।

প্রশাসন নিরুত্তর। একবার যখন ঘোষণা করা হয়েছে তখন আর পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই। সম্মানহানির সম্ভাবনা আছে। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকার পথ পরিক্রমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত/প্রচারিত হচ্ছিল তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক গবেষকদের আশঙ্কা অমূলক নয়। কোনো কোনো জায়গায় অসংখ্য মানুষ সংক্রমণ সংক্রান্ত বিধিমালা অগ্রাহ্য করে মনের খুশিতে বাজার করেছেন। মণ্ডপের আকার আয়তন কিছুটা ছোটো হলেও আনুষঙ্গিক আয়োজনে কোনো ঘাটতি নেই। আলোকসজ্জা ত্রুটিহীন। বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত অস্থায়ী পরিকাঠামোর উপর বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন বিরাজমান।  বাঁশের বেড়া দিয়ে জনজোয়ারের তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের বন্দোবস্তও বাদ যায়নি।

চূড়ান্ত পর্যায়ে আদালত পথ আগলে না দাঁড়ালে জনস্রোত আরও কত দূর ফুলেফেঁপে উঠতে পারত, সেটা অনুমান করা কঠিন নয়। শেষ মুহূর্তে আদালতের নির্দেশে মণ্ডপে দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যের স্টেডিয়ামে দর্শকশূন্য মাঠে যেমন ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন হয়েছে অনেকটা সেইরকম আর কী!

প্রাথমিক পর্যায়ে জনসাধারণের সংযম যথেষ্ট প্রশংসনীয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সংযমে অন্য মাত্রা সংযোজন করেছিল। কাজেই সাধারণভাবে আদালতের হুকুমনামা যথাযথ ভাবে পালিত হয়েছে। কিন্তু উৎসবের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই যেন সকলের মনে পড়ে গেল,- "তুমি যতো বলো, / 'চিরদিন চিরদিন'/ আমি জানি শুধু / 'আজকেই আজকেই'!" (নবনীতা দেব সেন)। অথবা মনে পড়ে গেল উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের নাটক 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস' নাটকের সেই বিখ্যাত রায়। "হৃৎপিণ্ড থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে পারেন তবে এক ফোঁটা রক্ত যেন চুঁইয়ে না পড়ে"। মণ্ডপের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ কিন্তু রাস্তায় চলাফেরা তো নিষিদ্ধ নয়। ফল, সর্বত্র না হলেও কিছু কিছু জাকজমকপূর্ণ মণ্ডপের আশপাশের রাস্তায় সৃষ্টি হয় অসংযত দর্শনার্থীদের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে বিপুল সমাগম। কোথাও কোথাও নাকি মণ্ডপের নিষিদ্ধ এলাকায় আদালত নির্ধারিত দর্শকের থেকেও বেশি দর্শনার্থীদের জমায়েত হয়েছে। প্রশাসন নির্বিকার অথবা ক্ষেত্রবিশেষে উদাসীন। এর ফলে সংক্রমণের তীব্রতা কত বাড়ল তা অদূর ভবিষ্যতে জানা যাবে। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে যে রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় সংক্রমণজনিত মৃত-আক্রান্তের সংখ্যা উর্দ্ধমুখী। এবং উৎসবের আবহে দৈনিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার হার কমেছে। সংযম সর্বব্যাপী হলে সংক্রমণ সম্প্রসারণ ও তার প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার যুদ্ধের আয়োজন সর্বাত্মক হতে পারত। বিগত কয়েক মাসের কষ্টকর কর্মহীন উপার্জনবিহীন অবরুদ্ধ জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত/বিধ্বস্ত মানুষের পক্ষে উৎসবের বন্যায় ভেসে যাওয়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু আর একটু ধৈর্য আর একটু সংযম পালন করতে পারলে কেউ কোনো অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ পেতেন না।

উৎসবের সমাপ্তিলগ্ন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সতর্কতার আগল ভাঙতে শুরু করে। প্রতিমা নিরঞ্জনের আগের রাত থেকে সংযমরহিত জন-অসচেতনতার ছবিই দেখল রাজ্য। কলকাতা-সহ রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই জনস্রোত দেখা গেছে। বহু জায়গায় আদালতের নির্দেশিকা উপেক্ষা করেই মণ্ডপের আগল খুলে দেওয়া হয়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার বহু মণ্ডপে ‘নো-এন্ট্রি জ়োন’-এর বাইরে ভিড়ের চেনা ছবি দেখা গিয়েছে। বহু এলাকায় ক্রমাগত পথ হেঁটেছেন মানুষজন। প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় শোভাযাত্রার অনুমতি কলকাতা পুলিশ দেয়নি। ফলে বিসর্জনের শোভাযাত্রা ছিল না। তবে কলকাতা-সহ বিভিন্ন জেলায় বিসর্জন ঘাটে ভিড় দেখা গেছে। মণ্ডপের ভিতরে সিঁদুর খেলার মতো লৌকিক আচার নিষিদ্ধ করেছিল আদালত। কিন্তু বাইরে সেই খেলা বন্ধ থাকবে কি না, তা মানুষের সদিচ্ছার উপরে নির্ভরশীল ছিল। এবং অনেক জায়গাতেই ছিল সদিচ্ছার অভাব। আদালতের নির্দেশিকা, প্রশাসনের আর্জি, চিকিৎসক গবেষক বিশেষজ্ঞদের আবেদন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না-করে উৎসবে শামিল হলেন বহু বঙ্গবাসী। সংক্রমণের আবহে এই উন্মাদনা কোন বিপদের দিকে রাজ্যবাসীকে নিয়ে যায়, সেই আশঙ্কা নিয়েই এ বছরের শারদোৎসবের যবনিকা পতন হয়েছে। যদিও কলকাতার বিভিন্ন সর্বজনীন পুজো কমিটির দাবি, লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকায় ভিড় অনেক কম হয়েছে। সমাজের একাংশ সতর্কতা মাথায় রেখে ঘরে বসেই পুজো কাটিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ দু’ দিনে যা ভিড় হয়েছে, তা যথেষ্ট আশঙ্কাজনক বলেই মনে করছেন চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, গঙ্গার ঘাটে বিসর্জনের সময় ভিড় করা যাবে না। দূরত্ববিধি মেনে পুলিশ-প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বিসর্জন হয়েছে। তবুও কয়েকটি ঘাটে ভিড় চোখে পড়েছে। মূলত ছোট ঘাটগুলিতে বাড়ির প্রতিমা বিসর্জনে তুলনায় বেশি লোক এসেছিলেন বলে ভিড় হটানোর চেষ্টাও করতে দেখা গিয়েছে পুলিশকে।

কলকাতার মতো উত্তরবঙ্গ থেকে শুরু করে মুর্শিদাবাদ নদীয়া বর্ধমান মেদিনীপুর পুরুলিয়াসহ সমস্ত জেলাতেই একই চিত্র। বিভিন্ন জেলায় উৎসবের শেষ রাতে পথে উপচে পড়া ভিড় হয়েছে। নিরঞ্জনের প্রাক-মুহূর্তে বহু জায়গায় পারস্পরিক দূরত্বের সতর্কবার্তা অবজ্ঞা করে মাস্ক ছাড়াই সিঁদুর খেলায় মাততে দেখা গিয়েছে। প্রশাসনের উদাসীনতা অথবা আপাত নিষ্ক্রিয়তায় জনগণের একাংশ এই ধরনের আচরণ করেছে। পারস্পরিক দূরত্বকে অবহেলা করে উৎসবের উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয়ে গেলে কী হতে পারে তা অদূর ভবিষ্যতে জানা যাবে।

শারোদৎসবের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত। এখনও দেওয়ালি ছটপূজা ইত্যাদি বাকি আছে। দুর্গাপূজার ধারাবাহিকতায় সরকারের অনুপ্রেরণা এবং প্রশাসনের উদাসীনতায় জনজীবনে আবার উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়লে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। শীতকাল আসন্ন। শীতের আবহে সংক্রমণ কীভাবে প্রতিহত করা যাবে তা নিয়ে এখন উত্তর গোলার্ধের সমস্ত দেশে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো মজবুত করার কাজ চলছে। এই রাজ্যে সেসব বাদ দিয়ে খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে ছটপূজার জন্য জলাশয়। এবং সঙ্গে শুরু হয়েছে জলাশয়ের ঘাট শক্তপোক্ত করার কাজ। তালি-থালি-দিওয়ালির মধ্যে দিয়ে সাত মাস আগে শুরু হয়েছিল এদেশের সংক্রমণ প্রতিহত করার কাজ। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সংক্রমিত মানুষ ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। মৃত্যুর পর মরদেহ পরিবার পরিজন হাতে পায়নি। শুধুমাত্র আরও একটি মৃত্যু সংক্রান্ত খবর সরকারের নথিতে যুক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা নেই। উৎসবের আয়োজন উদ্বোধন ইত্যাদি নিয়ে নীতি নির্ধারকদের যত ব্যস্ততা। এই পরিস্থিতিতে নিজের এবং সমাজের স্বার্থে স্বেচ্ছা সংযম এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন।