আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ ষোড়শ সংখ্যা ● ১-১৫ নভেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

এভাবেও ফিরে আসা যায়!


নভেম্বর ২০১৯। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি তথা মুভমেন্ট ফর সোস্যালিজম (এমএএস) পার্টির নেতা ইভো মোরালেসকে সামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে গদিচ্যুত করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এই সামরিক অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল বলিভিয়ার উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহ এবং অবশ্যই গোটা বিশ্বের দক্ষিণপন্থার পাহারাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসের নির্বাচনের প্রাক্কালে ইভো মোরালেসকে নিয়ে মানুষের মনে নিশ্চিতভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠেছিল। বিশেষ করে বলিভিয়ার সংবিধানে যেখানে সর্বোচ্চ তিন বার কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন, ইভো মোরালেস চেয়েছিলেন মেয়াদের এই ঊর্ধ্বসীমাকে সরিয়ে দিতে। তদুপরি, খনিজ পদার্থের রপ্তানি নির্ভর অর্থব্যবস্থার প্রতি মোরালেস বেশি মনোযোগী ছিলেন, যা কিছু ক্ষেত্রে তাঁর দেশের আদিবাসী সমাজের মানুষদের ক্ষতি করছিল। তাঁর রাজনীতিতে কিছুটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরাচার দানা বাঁধছিল বলেও অনেকে মনে করছিলেন। কিন্তু তবু, সত্য এই যে অক্টোবর ২০১৯-এর নির্বাচনে ইভো মোরালেস জয়ী হলেও তাঁকে অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়।

ইভো মোরালেসকে বিতাড়িত করে সেই দেশের মসনদে আসীন হন জেনিন আনেজ, যাঁকে অভিষিক্ত করে বলিভিয়ার সামরিক বাহিনী। ক্ষমতায় আসার পরে জেনিন তাঁর উগ্র দক্ষিণপন্থী মতাদর্শের ভিত্তিতে একদিকে বলিভিয়ার আদিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে শুরু করেন। হাতে মোটা বাইবেল নিয়ে ঘোষণা করেন যে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে আবার বাইবেল ফিরে এসেছে, অর্থাৎ আদিবাসী মানুষরা সাবধান। অন্যদিকে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে নিপীড়ন শুরু করেন মোরালেসের সংগঠন এমএএস-এর কর্মী সমর্থকদের উপর। বেশ কিছু এমএএস সমর্থককে হত্যা করা হয়। বলিভিয়ার গরীব মানুষ, আদিবাসী মানুষ বুঝতে পারেন যে বিষয়টি শুধুমাত্র মোরালেসকে অপসারণ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং মোরালেসকে সরিয়ে একদিকে তাঁর তথা বলিভিয়ার গরীব আদিবাসী সমাজের রাজনৈতিক শক্তি এমএএস-কে ধ্বংস করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। অন্যদিকে, মোরালেসের তথা বামপন্থী শক্তির নেতৃত্বে বলিভিয়ার অর্থব্যবস্থা এবং সমাজে যে প্রগতিশীল পরিবর্তন ঘটেছে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির মাধ্যমে খতম করাই জেনিন আনেজ এবং তাঁর সরকারের মূল উদ্দেশ্য।

মোরালেসের সরকার বলিভিয়ার অর্থব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করেছে। বলিভিয়ার খনিজ সম্পদের জাতীয়করণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দারিদ্র উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে মোরালেস সরকার। ২০০৬ সালে যখন মোরালেস ক্ষমতায় আসেন বলিভিয়ার ৫৯.৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে ছিলেন, ২০১৭ সালে যা কমে হয় ৩৪.৬ শতাংশ। ২০০২ সালে বলিভিয়ার আর্থিক বৈষম্য লাতিন আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল, যা ২০১৮ সালে অনেক কমে এসেছে। অন্যদিকে, খনিজ পদার্থের রপ্তানির মাধ্যমে দেশের মাথাপিছু আয় বাড়াতেও সক্ষম হয় বলিভিয়া। এই নীতি সমূহের মধ্যে গরীব মানুষ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। জেনিন আনেজ বা তাঁর মতন উগ্র দক্ষিণপন্থী শিবিরের সদস্যদের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি - প্রথমত, বলিভিয়ার বিপুল খনিজ সম্পদের বেসরকারীকরণ এবং গরীব তথা আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে লাগাতার আক্রমণ। যেহেতু এমএএস এই অংশের মানুষের সর্ববৃহৎ সংগঠন, তাই স্বাভাবিকভাবেই আনেজের আক্রমণের অভিমুখ নির্দিষ্টভাবে মোরালেসের সংগঠনের দিকেই ছিল।

বলিভিয়ার গরীব তথা আদিবাসী মানুষ বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁদের যাবতীয় অধিকারকে হরণ করার খেলায় নেমেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতপুষ্ট শাসকেরা। তাই এমএএস-এর প্রতি বেড়েছে তাদের দায়বদ্ধতা। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলিভিয়ার শ্রমজীবি মানুষ এক বছর ধরে লড়াই করেছেন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। রাস্তা কখনও ছাড়েননি। একের পর আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তারা। যেখানে সরকার ভাবছিল মোরালেসকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে এমএএস-কে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে, সেখানে বলিভিয়ার শ্রমজীবি মানুষ সরকারের সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে দেননি। প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। বরং তাকে শক্তিশালী করে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে গেছেন।

ফলাফল মিলল এক বছর পর। বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এমএএস পার্টি মনোনীত প্রার্থী, মোরালেসের অর্থমন্ত্রী লুই আর্সে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন লুই আর্সে। প্রমাণ করেছেন বামপন্থী চিন্তা নিয়ে মানুষের কাজে, মানুষের মধ্যে আন্দোলনের শিকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করতে পারলে শত ষড়যন্ত্রের পরেও প্রগতিশীল মানুষের জয় নিশ্চিত। লুই আর্সে দেশের সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন, যার ফলে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে মানুষের মনে কোনো প্রশ্ন ছিল না। আবার তিনি মোরালেসের অঙ্গুলিহেলনে চলেন এমন প্রচারও হালে পানি পায়নি, কারণ তিনি নিজের স্বতন্ত্র চিন্তার প্রমাণ রেখেছেন। তাই বলিভিয়া ভরসা রেখেছে তাঁর নেতৃত্বে। মোরালেসের মতন তিনি দরিদ্র কৃষকের সন্তান না হয়েও শ্রেণি রাজনীতিতে হতদরিদ্র মানুষের পাশে থেকেছেন, তাদের ভরসা দিয়েছেন, তাদের বিশ্বাস জিতেছেন। ব্যক্তি মোরালেস নয়, এমএএস ভরসা রেখেছে তাদের ২০০৬-২০১৯ সালের কাজের উপর এবং তাদের সংগঠনের উপর। তাই মোরালেস নির্বাসনে থাকলেও বলিভিয়ার মানুষ এই জয় ছিনিয়ে এনেছেন।

লুই আর্সের সামনে আপাতত বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, কোভিডের প্রকোপ বলিভিয়াতে খুব বেশি, আর্থিক সংকোচন ঘটছে তীব্রভাবে। অন্যদিকে, মোরালেসের খনিজ সম্পদ নির্ভর অর্থব্যবস্থার উন্নয়নের মডেল আপাতত সমস্যার সম্মুখীন, কারণ খনিজ সম্পদের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে লাগাতার কমছে। তদুপরি, দূষণ এবং আদিবাসী মানুষের জমির সঙ্গে এই খনিজ সম্পদের উৎপাদনের বিরোধ রয়েছে। অতএব, লুই আর্সেকে নতুন অর্থনৈতিক প্রগতির পথ বেছে নিতে হবে। ব্যাপক ভূমি বন্টনের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষির উন্নয়ন, সমবায়কৃত চাষের প্রচলন, ছোট ও মাঝারি শিল্প নির্ভর উন্নয়ন তথা খনিজ সম্পদের বাইরে বেড়িয়ে অর্থব্যবস্থার বহুমুখীনতা বাড়ানো লুই আর্সের সামনে আশু কাজ। এই অবশ্যকরণীয় কাজগুলি সম্পন্ন হওয়া এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে আদিবাসী ও গরীব মানুষদের পাশে থাকার উপরে নির্ভর করছে বলিভিয়ার বিপ্লবের স্থায়িত্ব।

নিকট অতীতে, লাতিন আমেরিকার বুকে দ্বিতীয়বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে তৈরি হওয়া সামরিক অভ্যুত্থানকে আটকে দেওয়া গেল। প্রথমটা হয়েছিল ভেনেজুয়েলায় যখন রাষ্ট্রপতি সাভেজকে অপসারিত করার পরে জনগণের প্লাবন সেই দেশের সামরিকবাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল সাভেজকে রাষ্ট্রপতি পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। ১৯৯৮ সালের এই ঘটনার পরে ২০২০ সালে আবারো ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান, এবার বলিভিয়ায়। কিন্তু বলিভিয়ার এই প্রত্যাবর্তন অনন্য কারণ সর্বোচ্চ নেতৃত্ব নির্বাসনে থাকলেও এক বছর ধরে মানুষের লড়াই দক্ষিণপন্থী সরকারের পতন সুনিশ্চিত করেছে। বিশ্বের সমস্ত প্রগতিশীল এবং গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ বলিভিয়ার এই প্রত্যাবর্তনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

বহুবার লাতিন আমেরিকার মানুষকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাড়া করা একনায়কদের হাতে পরাভূত হতে হয়েছে। তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ চিলি, যেখানে ১৯৭৩ সালে সমাজতান্ত্রীক সালভাদর আলেন্দে সরকারের পতন ঘটিয়ে তাঁকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল পিনোচেত। পিনোচেতের নেতৃত্বে এবং চিকাগো ইউনিভার্সিটির তরুণ অর্থনীতিবিদদের হাত ধরে চিলিতে শুরু হয় বিশ্বের প্রথম নবউদারনীতির পরীক্ষা। চিলির সমস্ত খনিজ সম্পদের বেসরকারীকরণ, শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেওয়া, খোলা বাজার অর্থনীতির জাঁতাকলে মানুষকে অবিরাম বেঁধে রাখাই ছিল এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য, যা পাকাপোক্তভাবে স্থান নেয় পিনোচেত দ্বারা স্থাপিত ১৯৮০ সালের সংবিধানে। পিনোচেতের একনায়কতন্ত্র খতম হয়ে যাওয়ার পরেও, তার ভূতের মতন এই সংবিধান তার প্রবর্তিত নীতিকে চিলিতে বছরের পর বছর বজায় রেখেছে। কিন্তু আর নয়।

২০২০ সালের অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে চিলির জনগণের ৭৮ শতাংশ রায় দিয়েছেন যে পিনোচেতের সংবিধান বাতিল করে নতুন জনমুখী সংবিধান দেশে প্রবর্তন করার পক্ষে। এই সংবিধান বাতিল ও নতুন সংবিধান গড়ার লড়াই শুরু হয়েছিল ১ বছর আগে যখন চিলির রাস্তা চাক্ষুষ করেছিল এক গণবিদ্রোহ। চিলির ১ শতাংশ ধনীতম ব্যক্তিদের হাতে দেশের ২৬.৫ শতাংশ সম্পদ। আর্থিক বৃদ্ধির হার তলানিতে। এর মধ্যে নিয়ে আসা হল মেট্রো রেলের ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। বারুদে স্ফূলিঙ্গ পড়ল। গর্জে উঠল চিলি। ব্যাপক গণবিক্ষোভের মধ্যে চিলির সরকার বাধ্য হল ভাড়া বৃদ্ধি প্রত্যাহার করতে। কিন্তু জনগণ ততদিনে বুঝে গেছে পিনোচেতের সংবিধানের মধ্যেই রয়ে গিয়েছে জনবিরোধী নীতির প্রাণভ্রমরা। অতএব, সংবিধান পরিবর্তনের দাবি উত্থাপিত হল। চিলির সরকার মানুষের ক্ষোভের সামনে বাধ্য হল গণভোট সংঘটিত করতে। এই গণভোটে পরাজিত পিনোচেতের সংবিধান। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে চিলিতে যেই দক্ষিণপন্থী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নবউদারবাদ চিলির সমাজে ঢোকানো হয়েছিল, তাকে নির্মূল করার ডাক দিলেন চিলির জনগণ। আগামীদিনে লড়াই এখনও বাকি রয়েছে। নতুন গণপরিষদ কেমন হবে, কারা তাতে নির্বাচিত হবেন, জনমুখী সংবিধান বানানো হবে কি না, তা নির্ভর করবে চিলির জনগণের আন্দোলনের ধারাবাহিকতার উপর। আপাতত, পিনোচেতকে কবরে ঢোকানো গেছে। কিন্তু তার ভূত যাতে না ফিরতে পারে, সেই লড়াই জারি রাখতে হবে।

লাতিন আমেরিকার এই দুই দেশের নির্বাচনের পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রায় এসে গেছে। একদিকে জনমত সমীক্ষা বলছে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প, যিনি বর্ণবিদ্বেষ এবং ফ্যাসিবাদের মিশ্রণে মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করেছেন, হারতে চলেছেন। কিন্তু ট্রাম্প গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। তাই বলে রেখেছেন তিনি হেরে গেলেও গদি ছাড়বেন কি না, তা নির্ভর করবে পোস্টাল ব্যালটের ফলাফলের উপর। লাগাতার প্রচার করছেন যে পোস্টাল ব্যালটে ভুয়ো ভোট দেওয়া হচ্ছে। যদি শেষ অবধি দেখা যায় যে পোস্টাল ব্যালটের জন্যই তিনি হারছেন, তবে সুপ্রিম কোর্টে তিনি যাবেন, যেখানে তাঁর বশংবদ বিচারপতিরা বসে রয়েছেন। ট্রাম্প যদি বিপুল ব্যবধানে না হারেন, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আমরা ক্যু দেখতে পাব, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট তথা রাস্তায় বর্ণবিদ্বেষী সাদা চামড়ার গুণ্ডাদের হাঙ্গামা ট্রাম্পকে জোর করে গদিতে আসীন রাখতে চাইবে। এভাবেই কি ইতিহাসের নতুন একটি পর্ব নির্মাণ হবে? যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিয়েছে, সেভাবেই খোদ সেই দেশের রাষ্ট্রপতি গণতান্ত্রিক জনাদেশ না মেনে জোর করে গদিতে টিকে থাকতে চাইবেন? পরবর্তী ক্যু কি এবারে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্রে ঘটবে? আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। তারপরেই জানা যাবে এই অশ্রুত প্রশ্নের উত্তর।