আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

একের গেরো

পুরব পাল


‘কাশীতে মন্দিরের সংখ্যা কতো ফেলুবাবু?’

‘তেত্রিশ কোটি।’

‘জয় বাব ফেলুনাথ’ সিনেমার উক্ত দৃশ্যে ফেলুদার উত্তরটা ‘তেত্রিশ কোটি’-র জায়গায় ‘এক’ কল্পনা করতে পারেন? না পারলে বিপদ আছে আপনার কপালে। ইদানিং, হিন্দুধর্ম এবং দেশের বড়োকর্তারা সবকিছুই একসুতোয় বেঁধে ফেলতে বড়োই উদগ্রীব। ‘এক দেশ’ তাতে ‘এক ধর্ম’ তার ‘এক ভাষা’, ‘এক বিধান’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবখানা এমন, যে এই সমস্ত বিষয়গুলো এক হয়ে গেলেই দেশের মানুষের মনে ও মননে ঐক্যের ভাবরসের তীব্র সঞ্চার ঘটবে। আর তাতেই নাকি দেশের , দশের মঙ্গল।

তা কর্তারা ভাবছেন, ভাবুন, তাতে তেমন প্রবল সমস্যা নেই। সমস্যা হল, এঁদের এই আজগুবি চিন্তাভাবনাগুলো বাস্তবায়িত করবার পথে প্রধান পাথেয় হল আমার-আপনার মতো হাজার-হাজার সাধারণ মানুষের সম্মিলিত সামাজিক অনুভূতি ও ভাবাবেগ। এখন আপনিও যদি ‘সমস্ত কিছু এক হলেই সামগ্রিক ঐক্য - এই থিয়োরিতে বিশ্বাস করে বসে থাকেন, তাহলে সমূহ বিপদ। আরেকটু বেশি বিপদ, যদি আপনি নিজেকে হিন্দু মনে করেন এবং বিশ্বাস করে থাকেন বিজেপি আরএসএস দ্বারা প্রণয়িত হিন্দুরাষ্ট্রের তত্ত্বে।

ভেবে দেখুন, এত কাল (অধুনা বিজেপি আরএসএসের বারফাট্টাইয়ের আগে) বাংলায় কস্মিনকালেও আপনি রামনবমী দেখেননি। জন্মাষ্টমীতে বাড়ি বসে ফাটিয়ে তালের বড়া সাঁটিয়েছেন বটে, কিন্তু তার আগে বা পরে একটা অতিকায় নীল শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে ধেই ধেই করে নৃত্য করা মিছিল দেখেননি সেটা কেন? বিজেপি তো আর বঙ্গদেশে হিন্দুত্বের ভগীরথ নয়। জনসঙ্ঘ দলটির (পরবর্তীকালে নামান্তরে বিজেপি) পত্তন হয় ১৯৫১ সালে। বাংলায় হিন্দুধর্মের ঐতিহ্য তার তুলনায় অন্তত হাজার বছর প্রাচীন। তাহলে এত দিনের প্রচলিত আচার বিচারে বাংলায় রাম-কৃষ্ণ-গণেশ ইত্যাদি হিন্দু দেবতাদের তেমন দাপট দেখা যায় না কেন? এক কথায় উত্তর দিতে হ’লে বলতে হয় একটা বিশাল অংশের বাঙালি হিন্দুর সংস্কৃতিগতভাবে ‘শাক্ত’ হবার কথা। শাক্ত অর্থাৎ শক্তির উপাসক। বাঙালি হিন্দুরা বরং বেশি আরাধনা করেন দুর্গা-কালী-লক্ষ্মী-সরস্বতীর অর্থাৎ, মূলত আদ্যাশক্তির। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের হিন্দু দেবতাদের গনগনে পৌরুষের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ভক্তি দেখানো নয়, বাঙালি হিন্দুদের পুজো আদ্যাশক্তিকে, ঘরের মা কিংবা মেয়ের রূপে অনেকটা ঘরের মেয়েকে আদর-যত্ন করার কায়দায়। এই গনগনে পৌরুষকে পুজো না করার স্বতন্ত্র ঐতিহ্যটুকুর কারণেই কিন্তু রাম কিংবা গণেশ বাঙালি হিন্দু মানসে খুব সামনের সারির পৌরাণিক আঙ্গিকটি অর্থাৎ, রামচন্দ্রের রাবণরাজাকে যুদ্ধে হারানোর জন্য করা অকালবোধন-এ আমাদের জনসংস্কৃতিতে বরাবর সযত্নে উপেক্ষিত। প্রসঙ্গত, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের একই উৎসবের কাউন্টারপার্ট যে ‘নবরাত্রি’, তার সমাপিকা রচিত হয় ‘দশেরা’ উপলক্ষে রাবণরাজার কুশপুতুলে আগুন লাগিয়ে। অথচ, বাঙালির ‘বিজয়া দশমী’-তে এসবের নামগন্ধও নেই। দুর্গাপুজোর বোধন থেকে বিসর্জন অবধি মূল আলোকিত বিষয় হল, ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরের মেয়ে বাপের বাড়ি আসছে, সেই নিয়ে আনন্দ, উৎসব, ফুর্তি। রামপ্রসাদী গানে কালীকে মা-মেয়ে ইত্যাদি বলে ডাকা - মঙ্গলকাব্যের পরতে পরতে শিবের প্রতি ‘সংসারের প্রতি উদাসীন জামাই’ ব’লে তাকে করা মিঠে তিরস্কার-সর্বোপরি, রবীন্দ্রনাথের গানে কোনটা যে প্রেম আর কোনটা যে পুজো পর্যায়ের গান সেটা আলাদাই করতে না পারা এই সবকিছুর মধ্যে যে ঘরোয়া, মৃদু, আদুরে ভাবের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে, এটাই বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি। আপনি যদি বিজেপি-আর এস এস প্রবর্তিত হিন্দুধর্মের ফর্ম্যাটে উৎসাহী হয়ে থাকেন, তাহলে এটাও ভাবুন, উত্তর ভারতীয় হিন্দুধর্মের এই গনগনে পৌরুষ-উদযাপন করার ধারাটি কিন্তু আপনার বাঙালিগত যাবতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এখন নিজের ঐতিহ্যের সাথে আপোস করবেন কি না, সে দায় আপনার।

দ্বিতীয় কথা। ধর্ম হিসেবে হিন্দুধর্ম কোনোদিনই ‘এক’-এর কথা বলেনি। এতজন দেবতা, তাদের এতরকম গল্প, এতগুলো গ্রন্থ (পুরাণ আছে আঠারোখানা, চারখানা বেদ, তারপরে বেদান্ত বা উপনিষদ , তাছাড়া সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, মীমাংসা ইত্যাদি, অন্যদিকে মনুস্মৃতি, ভগবৎগীতা) এর মধ্যে কোথায় রাখবেন আপনার ‘এক’-কে? কোন ‘এক’-কে বেছে নিয়ে বাকিদের ফেলে দেবেন? এই বিবিধের মাঝখানে দাউদাউ করে ছড়িয়ে থাকাটাই আপনার ধর্মের আদত চরিত্র। এই ধর্মকে যারা একটিমাত্র সুতোয় বাঁধতে চায়, তাদের মননে কতোটা আপনার হাজার হাজার বছর পুরোনো হিন্দুধর্মের ঐতিহ্য বিরাজ করছে, সেটা ভেবে দেখবেন আশা করি। যে ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী বিধবাদের একঘরে করে রাখা হয়েছিলো যুগ যুগ ধরে, সেই ধর্মেরই ‘পরাশর সংহিতা’ ঘেঁটে বিদ্যাসাগর তুলে এনেছিলেন একখানা শ্লোক, যা বিধবা বিবাহ আইন পাশ করানোর পক্ষে হয়ে দাঁড়ায় তাঁর অন্যতম হাতিয়ার। বলার কথা হল এই যে, ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যেও কোথাও কোনো ‘এক’ কথা বলা নেই, যেটা আছে সেটা হল একটা বিশাল ব্যাপ্তি, অনেক, অনেক কিছুর একটা বিশাল সমারোহ। যারা এই ধর্মের বেসাতি করে ‘এক’-এর পতাকা উড়িয়ে, তারা এই ধর্মের কতটুকু বোঝে, সেটাও আশা করি ভেবে দেখবেন।

তিন নম্বর কথা। ইদানিং নানান ব্যাপার-স্যাপারে, সে বিজ্ঞানের আলোচনা হোক, বা নারী-পুরুষের মেলামেশা সংক্রান্ত কথা হোক, অথবা খাদ্যাভাস নিয়ে তর্ক হোক সব ব্যাপারেই এই বিজেপি-আরএসএস-এর প্রবক্তাদের প্রচন্ড ‘প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যের’ দোহাই দিতে দেখা যায়। এবং মোটামুটি যা যা এঁদের মতের সাথে মেলে না, তাই যে পাশ্চাত্যের আমদানি, অর্থাৎ সোজা কথায় বিদেশী, তা হয় মুখের কথায় অথবা ঠ্যাঙার ঘায়ে বুঝিয়ে দিতে এঁরা বদ্ধপরিকর। এখন গোলমালটা হল এই, যে ধর্মের ক্ষেত্রে এই আব্রাহামিক ধাঁচের ‘এক’ বিষয়টা তুলনামূলকভাবে নতুন এবং সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমী আমদানি। শুধুমাত্র সনাতন হিন্দুধর্মই না, এশিয়ার অন্যান্য পুরোনো ধর্মবিশ্বাস যেমন জাপানের শিন্তো ধর্ম, অথবা চীনের প্রাচীন ধর্মাচার সমস্তই বহু দেবতা, বহু বিশ্বাসের কথা বলে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে যদি প্রাচীন সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে কেউ আপনার বহুত্ববাদকে নস্যাৎ করে কোনো ‘এক’-এর বোঝা আপনার ঘাড়ে চাপাতে আসে সে কথায় ভুলবেন কি না, দায়িত্বটা আপনারই।

ভুলে যেতে চাইলে, ভুলে যান। শুধু দয়া ক’রে মাথায় রাখবেন, আগামীকাল আপনি ভুলে গেলে কিন্তু পরশু থেকে মিথ্যে হয়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের গান, মিথ্যে হয়ে যাবে রামপ্রসাদের ভক্তিরস, মিথ্যে হয়ে যাবে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা শ্যামাসঙ্গীত, মিথ্যে হয়ে যাবে আপনার জাতিগত ধর্মীয় পরিচয়, মিথ্যে হয়ে যাবে এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করা লালমোহনবাবুর প্রশ্নের পিঠে ফেলুদার উত্তর, আর মিথ্যে হয়ে যাবে একটা বিশাল, বিশাল সামাজিক ঐতিহ্যের উত্তরসূরিতা।