আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

সংরক্ষণঃ বর্ণব্যূহে চক্রকূট

সুমন ভট্টাচার্য


শর্তপাতের ছন্দ

আপাতত সংহত থাকা যাক গ্রামবঙ্গ বা গ্রামীণ বঙ্গজনের ইতিবৃত্তে। কতশত কাল, সেই বল্লাল সেন থেকে হরেক রকম বর্গী থেকে খড়্গিদের হামলা সামলাতে সামলাতেও যে গ্রাম আর গ্রামসমাজ ছিল প্রায় অবিচল তার লঘু বিচলন এলো আঠেরো শতকে, কলকাতায় নগরপত্তনে। ইতিকথার এই মুখ্ড়াটুকু না মানলেই নয় - গ্রামসমাজের, বৃহত্তর অধিকারবিচ্যুত, তথাকথিত নিম্ন বা নিম্নাতিনিম্ন, কৌলিক জীবিকায় গজালপোঁতা মানুষ, তা থেকে বেরিয়ে আসবার ফুরসত পান তখন। ভিনদেশি প্রভুর দরকার, কাজের মানুষ। তার জাত-গোত্র-শীল-মেল অবান্তর। সুতরাং প্রথমপর্বের কলকাতায় যাঁরা ধীরে বিত্তবান হলেন, তাঁরা তথাকথিত নিম্নবর্ণ। কিন্তু আর্থিক মাপকাঠিতে বিত্তবান হলেও, সংস্কারকে তাঁরা প্রশ্ন করেননি বা করতে পারেনওনি। তাই যে যে ব্রাহ্মণ্য-নিদান-বিধানে তাঁরা অবদমিত ছিলেন, অন্তত ‘জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ’-র পালনে-লালনে মানতে বাধ্য হলেন সেই ব্রাহ্মণদের!

কলকাতার অন্তত, নব-বিকশিত ধনাঢ্যকুল যে বিশেষ দানশীলতার খ্যাতি অর্জন করেন, সেই দানের পশ্চাদভূমি, তাঁদের কৌলিক জীবিকার, তথাকথিত অসম্মানিত বা অব অবজ্ঞেয়তার পরিচয়। এই সংস্কার কিন্তু এই একুশ শতকেও চমৎকার বহাল।

কিন্তু সামাজিক সচলতা - হিতেশরঞ্জন সন্যালের অমোঘ গবেষণাগ্রন্থ, Social Mobility in Bengal (1981), এ যা বিস্তৃত-বিশ্লেষণে ব্যাখ্যাত - ঘটলেও, তার পিছুটান থেকে কি মুক্ত আমাদের সমাজ? ব্রাহ্মসমাজ-আন্দোলন তাকে একটু ধাক্কাধাক্কি করলেও নড়াতে পারেনি। পারলো না, কমিউনিস্ট আন্দোলন-ও! মাত্রই কয়েকজন, ধরা যাক, হাজার খানেকই - মানুষের সার্থকতায় বা সংস্কার মুক্ত আচরণে কিন্তু আন্দোলনের, আদর্শের ‘পরিপোষণ’ ঘটলেও, তা নড়াতে পারেনা সংস্কারের সেই জম্পেশ বায়বতা। যেন বা ঊনপঞ্চাশ বায়ুর তান্ডব।

যাঁরা চার-পা এগিয়েছিলেন, পিছোলেন চার নং বয়াটে বেয়াল্লিশ পা! তা বাস্তবিক পরের কথা। ১৮৯১-এর আদমসুমারির প্রেক্ষিতে যে প্রথম জাতিবর্ণ গোষ্ঠী, সরব হন, তাঁরা উগ্রক্ষত্রিয়। প্রথমে তাঁদের কৌলিক প্রথাচারের বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনায়, পরে, উগ্রক্ষত্রিয় এই পরিচয়ের পুরাণ-প্রতিষ্ঠার সূত্র-জ্ঞাপনে ব্যস্ত হন তাঁরা। অবশ্য এর আগে কায়স্থরা প্রতিষ্ঠা করতে চান তাঁদের ক্ষত্রিয়-পরিচয়! উনিশ শতকের কায়স্থ-কৌস্তভ পুস্তিকা থেকে, বিশ শতকের কায়স্থ-পত্রিকা প্রভৃতি এই নিয়ে ব্যস্ত থাকলেন না হোক তিন দশকে তো বটেই।

এর মৌলে ছিল স্তরান্তরিত অবস্থানের প্রত্যাশা। রঘুনন্দনী ফতোয়ার বিরুদ্ধে শতাধিক কাল পরে কথা বলবার সাহস পেয়েছেন বাংলার মানুষ! বল্লাল সেনের এক কথায় তাবৎ স্বর্ণবণিক পতিত! একই সূত্রে বৈশ্যকুল হারাচ্ছেন সামাজিক সম্মান! উত্তর লক্ষ্মণসেন পর্বে আর কোনো সার্বভৌম নৃপতির অবস্থান নেই, সুতরাং চতুর্বর্ণ ফিরিস্তির ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র-র বদলে এতদঞ্চলের কথাঃ ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈশ্য-শূদ্র! বাংলায় ক্ষত্রিয় নেই; বৈশ্যবর্গও সোনার বেনের ছোঁয়ান্যাপায় পতিত প্রায়। সুতরাং ব্রাহ্মণাদি ত্রিজাতি যাঁরা উপবীত-সংস্কারের অধিকারী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে রইলেন নকলগড়ের একা কুম্ভ ব্রাহ্মণ! আর শূদ্র - যাঁদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই!

কিন্তু একটি স্তরান্তরিত বিন্যাসের সম্ভাবনা এলো। কেবলমাত্র বঙ্গ নয় অপরাপর প্রদেশেও। দ্রুত স্মর্তব্য সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী ও বিশেষভাবেই ঢোঁড়াইচরিতমানস । ঢোঁড়াই তাঁর গ্রামে এই আন্দোলনের নায়ক। তাৎমা থেকে তিনি গোষ্ঠীনাম বদলানঃ তন্ত্রিমাছত্রী। ছত্রী অর্থাৎ ক্ষত্রিয়! একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, মোহনদাস গান্ধি, এদেশে ফিরবার পর যে সংগঠনের শক্তি পাশে চাইছেন - তার জন্য, তথাকথিত অস্পৃশ্য, অন্ত্যজদের জনবলকে মনে করছেন, গুরুত্বপূর্ণ। ফলত গুজরাতি সাধক কবি নরসিংহদাস মেহতা-র চয়িত - ‘হরিজন’ শব্দবন্ধটিকে চাইলেন প্রসারিত করতে। পারলেনও। কিন্তু তাঁদের সংকট তো থাকলো একই জায়গায়! এখানে, অন্তত, এই আলোচনায়, বিস্তৃত ইতিহাসের পরিসর নেই - আর অন্তর্বতী বিভঙ্গের যে অজস্র অনুপুঙ্খ, তারও না। সুতরাং, সরাসরি, আসা যাক, সংরক্ষণের প্রসঙ্গে। ১৯৩৫-এর আইন অনুযায়ী এলো, তথাকথিত নিম্নবর্ণের জন্য, বিশেষত অনগ্রসর ও অবদমিত জাতিবর্ণের মানুষের জন্য বিশেষ কিছু সামাজিক সুবিধা-র আয়োজন আদতে নির্বাচনের আসন-সংরক্ষণ অবশ্য!

এইবার যে উল্টোরথের পালা, সেখানে বিশেষ সরকারি সুবিধার এক্তিয়ার, তাঁদের, যাঁরা ‘জাতে খাটো’। ফলত, যাঁরা, তিন দশক অন্তত উচ্চবর্ণ-হওয়ার জন্য যুক্তি দাখিল করছিলেন - তাঁদের একাংশ ব্যাকুল হলেন, সেই অবস্থানে ফিরবার জন্য, ঠিক যে অবস্থানে তাঁরা রয়েছেন। এইখানে, সামাজিক সুবিধাভোগে অভ্যস্ত বা সামাজিক অবস্থানে যাঁরা অসম্মানিত নন, তাঁদের বিচার কিন্তু গেল এঁদের বিরুদ্ধেই । কোন শর্তে তাঁরা সামাজিক বিচারের যথাযথ ন্যায়কে ‘প্রত্যক্ষ’ করবেন? বর্ণগত উচ্চতার পরিচয়ে? না বর্ণগত নিম্ন বা নিম্নাতিনিম্নের আদিম পরিসরে?

উভয়স্ত শর্তপাত।

২.

প্রত্যাঘাতের দ্বন্দ্ব

জাতিবর্ণস্তরান্তর, আকাঙ্ক্ষার আন্দোলন, রক্ষণশীল ব্রাহ্মণশাসিত - নিয়ন্ত্রিত সমাজকেও দিয়েছিল এক দ্বিঘাত-সমীকরণের সুবিধা। প্রথমত, যে স্তরান্তরে তাঁরা উন্নীত হতে চান, তার চরম ছাড়পত্র দেবেন অবশ্যই ‘সদাশয় সরকার বাহাদুর’, কিন্তু পুরাণ-সমর্থনের নানা বাণী, নানা বাক-এর বিচার ক’রে, তার সত্যতা যাচাই করবার অধিকারী তো ব্রাহ্মণরাই, সুতরাং, কোনো গোষ্ঠী কিন্তু একেবারেই চটায়নি - না ব্রাহ্মণকে না শ্বেতাঙ্গপ্রবরদের। অবশ্য, একমাত্র, চন্ডাল জনগোষ্ঠী, যাঁরা ১৯১১-য় নমঃশূদ্র অভিধা পেলেন, তাঁরা তোয়াক্কা করেননি বামুনদের। এবং লক্ষণীয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই উত্তুঙ্গ পটে, এক বিপুল জনগোষ্ঠী মগ্ন ছিলেন, নিজেদের জাতিবর্ণ-পরিচয়ের অহমিকার বিতর্কেই। এই পর্যায়ে ফলিত প্রয়োগের কূটকৌশলে আসছে পুরাণসিদ্ধ স্তরান্তরণের, বা স্তরান্তরিত উচ্চবর্ণের পরিচয় প্রতিষ্ঠার বদলে সরকারি ক্ষেত্রে কিছুটা সুযোগের বন্দোবস্ত। কর্তব্য, ১৯১৯-এ প্রথম যে সংরক্ষণের প্রসঙ্গটি ওঠে, তারপর চিত্তরঞ্জন দাশ প্রথম সরকারি ক্ষেত্রে, মুসলমানদের জন্য আনুপাতিক সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন। যা Bengal Pact (১৯২৩) নামে, গৃহীত হয়েও শেষত কার্যকর হয়নি, কিন্তু এবার তা কার্যকর হ’ল হিন্দুবিশ্বে। অতঃপর ‘স্বাধীন স্বদেশে’ তার প্রয়োগ পর্ব।

কিন্তু অভিপ্রায়গতভাবে সংরক্ষণ-কে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা অনুচিত। কারণ, তার মৌল উদ্দেশ্য ছিল সাম্যসন্ধান - যদি সাম্যসাধন, তৎক্ষণাৎ না-ও ঘটে! কিঞ্চিৎ মহাকাব্যিক উপমায়, এ-ও আরেক-চক্রগূহ ভেদ এবং অতঃপর, ব্যূহবদ্ধতা-ও বটে!

সংরক্ষণ ভেদ করতে চেয়েছিল ছ’টি মুখ্যসংকট। পরিবর্তে সংযোজিত হ’ল সপ্তম সংকট। উপস্থাপিত ছকটিকে, ঘড়ির কাঁটায় দেখা যাক, তার ‘আশা-নিরাশার সংলাপ’-এ। যে সামাজিক ক্ষমতা আর সুবিধাভোগের একচেটিয়াবসহ বিশেষ উচ্চবর্ণাভিমান, তার আর ভূমিকা, থাকবার কথা নয় তেমন। আর যে কারণে এই মানসিকতার বিকাশ, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের হীনম্মন্যতা, ইতি ঘটবে তারও।

একই সঙ্গে সরকারি বিধির কারণে, এর পালনগত বাধ্যতায়, লুপ্ত হওয়ারই কথা সমবর্ণ বৈরতা তথা ক্রমোচ্চ বিন্যাসের বিশেষ মানসিকতার। কারণ, বিশ শতকের বঙ্গদেশে এটুকু সংঘটিত যে, কুলীন-শ্রোক্রিয়, বংশজ, ভঙ্গকুলীন এবং মেল বিচার, নিঃশব্দ বিপ্লবে বিলুপ্ত! গ্রহবিপ্র, অগ্রদানী, বর্ণ ব্রাহ্মণ পরিচয় নিয়েও সযত্ন ঘাঁটাঘাঁটি বহুলাংশেই শেষ। সুতরাং, এই বিচারনীতিও গুরুত্ব হারাবে। আর দৃষ্টিকোণের প্রত্যক্ষ জাতক যে সামাজিকতার পরিসরে জেগে থাকা বৃহত্তর অবজ্ঞার পারস্পরিক, নষ্ট হওয়ার কথা তো তারও!

সংরক্ষণের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা জাগে আরেকটি বিশেষ পরম্পরার, তা মেধা - অপচয়। সুদীর্ঘকাল যাঁদেরকে নিরক্ষর ক’রে তাঁদের প্রতিভার, মেধা ও মননশক্তিকে চেপে রাখা হয়েছিল, যার রূপক - শম্বুক, কর্ণ, একলব্য-এর আখ্যানে ইতি ঘটবে তারও।

বিশেষত, কেবলমাত্র যে দৈবায়ত্ত, জন্মের কারণে, সামাজিক সম্মিলনের মধ্যে, তথা সংহতির মধ্যেও, প্রবর্ধিত হয়েছে হরেক চিড়, ফাটলের অলিগলি, তার তো শেষ হবেই।

কিন্তু সংরক্ষণ প্রচলিত হওয়ার পর - যা প্রথম দেখা দিয়েছে, তার নাম - উন্নীতের আত্মাবমাননা এবং উন্নীতের আত্মবিলোপ! এবং এই বিষাক্ত অভিঘাতে, বর্ণাভিমানের সপ্তরথীব্যূহে সংরক্ষণের অভিমন্যু বিকল না-হলেও বিহবল।

উচ্চবর্ণাভিমান অধিকতর বা নিয়ত শক্তিমন্ত। সমবর্ণ-বৈরতা তথা বিদ্বেষ, আরও এক ধাপ শক্তি গড়েছে অপরাপর অনগ্রসর জাতিবর্ণগোষ্ঠীর (OBC)-র ঘোষণায়। এবং যাঁরা সরকারি সুবিধা নিতে পারলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেই চলে তফশিল ভুক্তির যথার্থ্য বিচার। বিশেষত জলচল শূদ্র, যাঁরা তফশিল ভুক্ত নন, আর যাঁরা ছল-অচল এবং প্রায় বর্ণ-কাঠামো বহির্ভূত, যাকে দেবেশ রায় যথাযথভাবে ‘শূদ্রাতিশূদ্র’, পরিচয়ে, সমাজিক অবস্থানে, চেনান, তাঁদের মধ্যেও বিরোধ, বিতর্ক তো নিত্যদিনেরই! ফলত যাঁদের হীনম্মন্যতা অপসৃত হওয়ার কথা, পরিবর্তে ঘটছে তারই বিশেষ ‘নবজাগরণ’!

আর যা সব থেকে ভয়ংকর, তা মেধার অপচয়-রোধ আর নিম্নমেধার উচ্চাসন-প্রাপ্তির বিতর্ক! সংরক্ষণের ভূমিকা যেখানে বিশেষভাবেই সরকারি চাকরি-র সরহদ্দ-সীমিত, আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আসরে তার ফলিত প্রয়োগ তাই জীবিকাসংকট-প্রধান রাষ্ট্রে বিরোধ নিয়ত ঘনীভূত এখানেই এর ফলত করণে, সমকর্মক্ষেত্রে বা ‘বিষম’ কর্মক্ষেত্রে, বৈষম্যই শেষত ‘রাজপথের কথা’ এবং ‘ঘাটের কথা-ও’! প্রত্যেকটি পরিসরেই এঁদের মুখোমুখি হ’তে হয়, শেষ পর্যন্ত উচ্চবর্ণের এবং ক্রমোচ্চবিন্যাসদীর্ণ নিম্নবর্ণেরও!! এর পরিচয় সকলেই জানেন, যদি মেধামানে তিনি/তাঁরা ‘সাধারণ’, এর তালিকায় থাকেন, তখন, বলা হয় কোটা-র পাবলিক আমাদের কুটতে এসেছে!! আর যদি নিজস্ব কোটা-তেই থাকেন, তবে তো কথাই নেইঃ কোটা-র কট্কটি! ফলে, সমাজিক-সাংস্কৃতিক দূরত্ব অধুনা অসেতুবন্ধ্য ব্যবধানের নিশ্চয়তা।

সাম্প্রতিক আস্যপুথি, (Facebook) নামক মাধ্যমে এ-ব্যাপারে তীব্র অসহিষ্ণু মন্তব্য - যা শালীনতার সীমাও ছাড়ায়, তা এখন প্রাত্যহিকের ‘দিনকর’। পদগত পরিচয়ে অনেকেই উচ্চ বা উচ্চতর, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপ ছোপের মোহরে তো শিক্ষিতই! এঁরা যখন অকাতরে বলেন, এস.সি ডাক্তারের কাছে যাইনা!! এস.সি মাস্টারের কাছে ছেলে মেয়েকে পাঠাইনা!! ইত্যাদি ইত্যাদি - এবং তারপরেও যখন, সামাজিক বা সরকারি আইনের বিষয়টিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে এসে বিচার ও মন্তব্য পুষ্পিত হয় - তা আরো ভয়ংকর। যেন - সেই সব ব্যক্তিবর্গ, নিজেরাই নিজেদের সুবিধামতন সেই সমস্ত আইনের প্রণেতা!

আর এই সূত্রে দেখা দেয় উন্নীতের আত্মবিলোপ! এই বিষয়টি দৃষ্টান্তনির্ভর। আপাতত, ‘উল্লেখ থাক’, খবরের কাগজের নাম-পদবি পরিবর্তনের স্তম্ভে, মাঝে মাঝে দেখা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তি, বদলে নিচ্ছেন তাঁদের পদবি - বিশ্বাস, মন্ডল, প্রামাণিক প্রভৃতি পদবির মানুষ বদলে যাচ্ছেন, রায়-সরকার, হালদার-এর মতো পদবিতে! অর্থাৎ তাঁরা নন - তাঁদের সন্তানকুল যেন লোকস্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারেন, তাঁদের বর্ণপরিচয়।

৩.

আত্মঘাতের অন্ধ

কিন্তু এই সবই তো ‘ভদ্রপঞ্চজনের’ জানাই কথা! তারপরেও সদাশয় সরকার বাহাদুর (দি.স.) - অর্থাৎ দিশি সংস্করণ - আর মানুষকে কোনো ‘দাসত্বশৃঙ্খল’-এ বাঁধতেও অনীহ। তাহ’লে আর সংরক্ষণের দরকার কোথায়?

উনিশ-বিশ শতকের স্তরান্তর বিন্যাস আন্দোলন যে সফল হয়নি, তার একটি মহাকাব্যিক সূত্র আছে। অস্ত্রপরীক্ষা-প্রাঙ্গণে উপস্থিত কর্ণকে বাধা দিয়েছিলেন মুরুব্বিরা - তিনি ক্ষত্রিয় নন। সূতপুত্র। কর্ণকে এক লহমায় অঙ্গরাজ্যের রাজত্ব দিয়ে ‘ক্ষত্রিয়’ করেন দুর্যোধন। কিন্তু সে পরিচয়, সেখানে বা দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা, কাজে লাগেনি কোথাও! অথচ দিব্য ক’রে ভেবে দেখলে, পান্ডব-কৌরব, কেউই কিন্তু প্রকৃতার্থে ‘ক্ষত্রিয়’ নন। ব্যাসকূটটি বস্তুত এখানেই! যোগ্যতার অবদমন এবং অনর্জিত অবস্থানের সুবিধাভোগ।

ফলত, ঐতিহ্য-অনুগত রাষ্ট্রে, সুতরাং, পুনরাবর্তনই দেশাচার!! সংরক্ষণ, একেবারেই কথার কথা! দেখা যাক সাম্প্রতিকঃ ‘দলিত তাই মন্দিরে ঢুকতে বাধা’ - পাত্র, হিমাচল প্রদেশের সামাজিক ন্যায় ও উন্নয়ন মন্ত্রী রাজীব সৈজল! তফশিলি জাতি ও জনজাতির জন্য সংরক্ষণ-কাল আরও দশ বছর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব-প্রসঙ্গে, জানান তাঁর অভিজ্ঞতা যা নাচন-এর বিধায়ক বিনোদ কুমার-এরও! (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ জানুয়ারি, ২০২০, পৃ. ৬)।

তার একটু আগের ঘটনা, গ্রেটার নয়ডা-য়, লোকেশ নামক এক বিরিয়ানি-বিক্রেতাকে শারীরিক নিপীড়ন করে একদল। বক্তব্যঃ নিম্নজাতের হয়েও, কেন তিনি খাদ্যদ্রব্য, অর্থাৎ স্বহস্তপ্রস্তুত খাদ্য বিক্রয় করছেন! (‘নিচু জাত, বিরিয়ানি বিক্রেতাকে মারধর’, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, পৃ. ৬)

এবং অতঃপর, ২০২২-এর আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে, উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের জয়ের জন্য, ব্রাহ্মণ-মুখ্যমন্ত্রীর দিকে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ-মুখ্যমন্ত্রী সন্ধানের দিকে মনোযোগী হতে বলেছেন, প্রশান্ত কিশোর। উত্তরপ্রদেশে ২০১৯-২০-র মধ্যে নিহত হয়েছেন ২৮ জন ব্রাহ্মণ। ১৯৮৯-এ নারায়ণ দত্ত তেওয়ারি-র পর এখানে মুখ্যমন্ত্রীর মর্যাদা বা পদ পাননি কোনো ব্রাহ্মণ। আর মায়াবতী তাঁর মন্ত্রীসভায় সতীশ মিশ্রকে এনে লাভবতী হয়েছিলেন! বিশেষত অধুনা যোগী আদিত্যনাথের আমলে, তেমন আমল পাছেন না দ্বিজবর্গ। ফলে এবার দরকার ব্রাহ্মণযোগ। (‘নজরে বিধানসভা, ব্রাহ্মণ তাস খেলছে কংগ্রেস’, ৮ জুলাই, ২০২০, আনন্দবাজার পত্রিকা, পৃ. ৮)

আবার পশ্চিমবঙ্গে টাটকা হালের খবর, রাজ্য প্রশাসন পুরোহিত-ভাতা নিয়ে তৎপর। এও তো সংরক্ষণের আরেক ‘ছায়ার ঘোমটা’!

তবে?

যাঁদের জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন, তাঁদের আর্থিক নিরাপত্তা অথবা সামাজিক ‘সম্মাননা’র আয়োজন নিয়তই ফসকে যায় হরেক চোরাগলির, কানাপাঁচিলে! এরকম সংবাদ কিন্তু সপ্তাহে, পাওয়া যায় গড়ে তিনদিন । কিন্তু ‘কথা শুধু পড়ে থাকে কথার মনেই’ - বার্তাকে বিচারের প্রয়োজন নেই।

সুতরাং, যাঁদের জন্য মূলত সংরক্ষণ প্রয়োজন, আর্থিক এবং সামাজিক উভয়ত অনগ্রসরতা চিহ্নিত মানুষের জন্যই তো - সেক্ষেত্রে প্রশ্ন, এখনও তাঁদের ক’জন তার আওতায় এসেছেন বা সুবিধা পান? আবার যাঁরা ক্ষমতায় বা জীবিকায় উচ্চপদে - হয়তো, নিজ অর্জনে, নিজস্ব বিদ্যাবত্তায় - তাঁরাও তো সামাজিক বৃহত্তর অবজ্ঞার বাইরে নন! মনে রাখুন, ব্রজেন্দ্রনাথ শীলকে আজীবন শুনতে হয়েছে তেলি-পরিচয়ের তকমা!

একটু ভিন্ন-কথায় আপাতত ইতি টানা যাক। বুধন পাশমানের পুত্র রামকিষুণ, স্কুলফাইনালের সময় তার পদবি লেখায় ‘প্রসাদ’। একথা জানাজানিতে গ্রামে-পাড়ায় বিতর্কের চরমঃ ‘প্রসাদ’ হচ্ছে কায়স্তের পদবি। ‘পাশমান’ থেকে তিনি পুরুষে ‘শর্মা’ তপশিল থেকে ব্রাহ্মণ, এর চেয়ে অধঃপতন আর কি হতে পারে? (‘অভিমত’, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী, ১২শ খন্ড)

উত্তর-পঞ্চাশ বিহারের পটভূমিতে এই গল্প। সেখানে এভাবেই চলছিল একই সঙ্গে তপশিলভুক্তির সুযোগ আর এফিডেভিট-এর-সদ্ব্যবহার।

তা’হলে এই নিয়ত ওলটপালটের তালে গোলে, সংরক্ষণের সদভিপ্রায়টুকু তো ব্যূহবন্দিত্বে অসহায়। যাঁরা দীর্ঘকাল অপমানিত হয়েছেন - তাঁরা সেই অপমানের চৌহদ্দিতে চমৎকার ‘সংরক্ষিত’ই!! যে ব্রাহ্মণ-ব্যূহ বিনষ্ট করতে সংরক্ষণ, সে আজ যেন স্বয়ং, আরেক ব্যূহ তৈরি করছে নিজে বা নিজেনিজেই! হয়ে উঠছে, উঠেছে, আরেক হাড্ডাহাড্ডি, শ্রেণিবৈরতার, একাধারে আয়ু এবং আয়ুধ - তা অবশ্য ইতিবাচকতায় ধাবিত!

কারণ একই সঙ্গে উচ্চবর্ণভুক্তিরও সুবিধা! তা নিয়ম যখন আছে, তা মানতে আর অসুবিধা কোথায়? আর এই নিয়ত ওলটপালটের তালে গোলে সংরক্ষণের সদভিপ্রায়টুকু বিবর্ণপ্রায়।

একদিকে তফশিলভুক্তির ‘প্রসাদ’ এবং মাঝে মাঝে, বারংবার যে তার কালসীমা আর সুবিধা-প্রাপ্তের আর্থিকভাবে উন্নত অবস্থানে পৌঁছনোর পর, সংরক্ষণ - প্রত্যাহারের কথা আসে - তা যুক্তিতে যথাযথ। কিন্তু তফশিলভুক্তির ইতিকথার সামাজিক অবজ্ঞার গল্প মোছে না। সামাজিক অপমানটা থেকেই যায়! অপমানের সংরক্ষণ, যেন স্বতঃস্ফূর্ত! স্বয়ংক্রিয়। আর তার সঙ্গে নানারকম উপায়ে, সংরক্ষণ এবং তার প্রতিশ্রুতি, আরেক রাজনীতির খেলা! জাঠ, মিনা, গুজ্জর, মতুয়া, এ যেন শুধুই গোষ্ঠী স্বার্থের অধিবাস-পরবাস!

হিমাচল প্রদেশের মন্ত্রী, বিধায়ক, তাঁরা হয়তো অতঃপর মন্দিরে ঢুকতে পারবেন, কিন্তু তাঁর জনগোষ্ঠীর মানুষ? অথবা সেই বিরিয়ানি ওয়ালা লোকেশন, তাঁর কোনো সুবিচারপ্রাপ্তির আশা আছে? কিন্তু তারপরেও এই অতিমারীর রণাঙ্গনেও কংগ্রেস তার ঘর গোছাতে ব্রাহ্মণ-প্রাধান্যের কথা ভাবে, যে উত্তরপ্রদেশে আগে ছিল কায়স্থপ্রাধান্য! সুতরাং, মানুষের মর্যাদা বা উপযোগ বা জনকল্যাণ নয় - ‘সংরক্ষণ’ আর তার পালটা চালের চাপান-উতোর শেষ কথা। আর সংরক্ষণ - এই সপ্তরথীসংকটের চক্রব্যূহে হয়ে উঠলো এক বাড়াবাড়ি শ্রেণিবৈরতার উপাদান!

তা-ও তো অনুক্তই থাকলো ‘আদিবাসী’দের নিয়ে খেলা আর - এর নানা ফাঁকি, নানা ফাঁদ - নানা অভিনয়ের রকমসকম।