আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

প্রবন্ধ

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম রাজনীতি (প্রথম পর্ব)

সৈয়দ আসিফ আলী


‘‘I have been here for almost 1,400 years. Yet, I am the ‘Other’.’’
(In ‘Of Saffron Flags and Skullcaps’, by Ziya Us Salam)


২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ১৭তম বিধানসভা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হতে এখনও সময় আছে। কিন্তু আগামী বিধানসভা নির্বাচনে যে মুসলিম রাজনীতি, মুসলিম সম্প্রদায় ও ‘মুসলমান ভোট’কে নিয়ে উত্তেজনা, চর্চা, রাজনৈতিক বাদ-বিবাদ, প্রতিযোগিতা চরমে পৌঁছবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজ্যের ২৭% জনসংখ্যা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। অন্যদিকে বলা হয়ে থাকে ২৯৪ সিটের মধ্যে অন্তত ১৪০টি আসনে ‘মুসলিম ভোট’ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করে। মুসলিম জনসংখ্যার ওজন, হিন্দুত্ব রাজনীতির পাকাপোক্ত স্থান করে নেওয়া, মুসলমানদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রিয়তার রাজনীতি ও ২০১৪ পরবর্তী ভারতবর্ষে ধর্ম রাজনীতিতে অন্যতম নির্ণায়ক হওয়া - এ সবকিছুর মিশেলে মুসলিম রাজনীতির গুরুত্ব বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক।

বর্তমান মুসলিম রাজনীতি বুঝতে হলে অবশ্যই পেছনে ফিরে দেখতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম রাজনীতি বুঝতে গেলে বিচ্ছিন্ন ভাবে কেবল বাংলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রম পর্যাপ্ত নয়, সারা ভারত জুড়ে ঘটনাবলীও প্রতিমুহূর্তে মুসলিম রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। ভোটের রাজনীতির বাইরেও মুসলিম রাজনীতি বেঁচে থাকে। এই রাজনীতি অত্যন্ত জটিল, একদিকে রাজনৈতিক দল যেমন আছে, তেমনি আছে ধর্মানুভূতি, অ-রাজনৈতিক মুসলিম সংগঠন, মন্দির-মসজিদ, মাদ্রাসা, মৌলবি শ্রেণি, হিন্দুত্বের রাজনীতি, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, ইসলামোফোবিয়া, Post-Truth দাঙ্গা, গোঁড়ামি ইত্যাদি। পরিচয়ের রাজনীতির শুরু সেই ব্রিটিশ শাসনকালে। স্বাধীনতার পর উন্নয়নে জোয়ার এনে ভাবা হয়েছিল পরিচয় উবে গিয়ে ধর্ম, জাত-পাত নির্বিশেষে সবাই আত্মসম্মানের সঙ্গে উন্নয়নের সুফল পাবে। ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্টে দেখা গেল ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সমাজের বেহাল অবস্থা। পুনরায় ২০১১ সালে প্রকাশিত স্ন্যাপের রিপোর্টে ‘পরিবর্তন’ হয়ে গেলেও আশানুরূপ ছবি ধরা পড়েনি। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত শুনতে পাই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ও বাংলার শাসক গোষ্ঠী ‘নির্লজ্জ সংখ্যালঘু’ (পড়ুন মুসলমান) তোষণ করতে ব্যস্ত এবং এর ফলে সংখ্যাগুরু হিন্দু সমাজকে বিভিন্ন সু্যোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। সাচার কমিটি ও প্রতীচির রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার ছবি উঠে আসায় বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ওঠে যে মুসলমানদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন হবে না। বাংলা দৈনিকের পাতায় লেখা হয়ঃ

‘‘তাই মুসলমান সমাজের উন্নয়নের কথা বললে যাঁরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জিগির তোলেন, তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক উন্নয়নেরই বিরোধিতা করছেন। যে রাজনীতিকরা সত্যিই মুসলমান সমাজ তথা রাজ্যের উন্নয়ন চান, তাঁরা সস্তা রাজনীতিতে আটকে থাকলে চলবে না। কোন অঙ্কে ভোটে জেতা যাবে, সেই হিসেব ছেড়ে তাঁরা মুসলিম যুবসমাজের শিক্ষার উন্নতির দিকে নজর ফেরান। তাঁদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবুন। মুসলিম সমাজকে বাদ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন সম্ভব হবে না।’’

সামগ্রিকের উন্নয়নের জন্য প্রত্যেকটি সামাজিক গোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্র খেয়াল রাখবে এটাই কাম্য। প্রশ্ন ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কেন ধর্মিভিত্তিক উন্নয়নের নীতি তৈরি হবে এবং রাষ্ট্র যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা নীতি তৈরি করে তাহলে পরিচয়ের রাজনীতিকে বাহবা দেওয়া হয়। যখনই নীতি নির্ধারণে ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক পর্যালোচনা করা হয় তখনই সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে বিরোধিতা করা হয়। রাষ্ট্র যদি একটি অপরিপর্তনশীল প্রতিষ্ঠান হয়ে থেকে যায় ও বাস্তবকে (ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষত মুসলমানদের শিক্ষা, চাকরিতে দৈন্য, হিন্দুত্ববাদীদের দিক থেকে আসা প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনা, অপমান) অগ্রাহ্য করে মুখ ফিরিয়ে থাকলে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সবার উন্নয়ন হবে কীভাবে? অবশ্যই ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য অনেকগুলি প্রতিষ্ঠান রয়েছে (পৃথক মন্ত্রক, মাইনরিটি কমিশন প্রভৃতি), কিন্তু অধিকাংশই নিরাপত্তা ও ধর্মাচরণের অধিকার রক্ষায় ব্যস্ত। সমাজকল্যাণের নীতিতে ধর্মকে একটি আধার কেন বানানো হয় না, যখন আমাদের সবার জানা বেশিরভাগ জাতি-রাষ্ট্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকার অনিশ্চিয়তা থেকেই যায় । এই ঘাটতি পূরণ হবে কীভাবে যদি না ধর্মকে (জাতি, শ্রেণি, লিঙ্গের পাশাপাশি) উন্নয়নের একটি মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়? ‘ট্রিকলডাউন এফেক্টে’র মাধ্যমে যে সব জাতি-সম্প্রদায় আত্মমর্যাদার সঙ্গে উন্নয়নের সুফল পায়নি স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর তা আর নতুন করে বলার কী আছে! ৭৩ বছরের এই সময়ের মধ্যে যদি দেখি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম রাজনীতিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা সঙ্গত, প্রথম পর্যায়ে দেশভাগ ও দাঙ্গার আবহাওয়ার মধ্যে রাজনীতিতে মুসলমানদের মূলস্রোতে আসা, দ্বিতীয় পর্যায়ে বাম সরকারের অধীনে, তৃতীয় পর্যায়ে তৃণমূল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির উত্থান।
 

স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলি

স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর ১৯৫১ সেনসাস অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১ লাখ, মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। যেসব মুসলমানরা নানা কারণে এই বাংলায় থেকে গেল, ঐতিহাসিক জয়া চ্যাটার্জীর মতে তারা ‘‘দুর্বল ও গরীব, তাদের ছিল কিঞ্চিত সম্পদ, যোগাযোগহীন এবং এমন কোনো দক্ষতা ছিল না যার সাহায্যে তারা নতুন কোনো জীবন সীমান্তের ওপারে শুরু করতে পারে…।’’ বোঝাই যাচ্ছে দেশভাগ পূর্ব বাংলার হিন্দু সমাজের মত পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের উপরেও কেমন আঘাত এনেছিল। অদ্ভুতভাবে এই সময়ে মুসলমান সম্প্রদায় রাজনীতি বাদ দিয়ে সমাজের সকল স্তর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল। এই রাজ্যেরই প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ মইনুল হাসান এক জায়গায় লিখছেনঃ ‘‘স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলায় মুসলমানদের কয়েক দশক কেটেছে ভয় ও হতাশার মধ্যে।’’ এই হতাশার একটি কারণ তার মতে ‘‘কোথাও গিয়ে মুসলমানরা নিজেদের ‘একাত্ম’ করতে পারছিলেন না। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত, কাচারী, রাজ দরবার - সব জায়গায় কোনো মুসলমানের দেখা পাওয়া যেত না। অফিস-কোথাও না। কদাচিৎ কোথাও এক আধখানা। নিজেকে যে কারও সঙ্গে মেলাবে তার ক্ষেত্রই ছিল না। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেও তাই ছিল। নেতাদের গাড়ির চালক, অথবা খানসামা, অথবা আর্দালি ছাড়া কোথাও মুসলমানদের দেখা নেই। এযে কত বড় হতাশা, বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। এক চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে চলেছে বাংলার মুসলমান সমাজ কয়েক দশক।’’

এই একই মন্তব্য সমকালীন রাজনীতি সম্পর্কে করা যাবে না। জনবল ক্ষমতা হারিয়ে ও দেশভাগ হওয়াতে নতুন মুসলিম রাজনীতির উদ্ভব হল। মুসলিম সমাজের একটি অংশ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ১৯৪৭-এর অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স, ১৯৫১-এর অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনভেনশন প্রভৃতি সভাতে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে সমর্থনের জন্য দাবি তুলে লীগের ও মুসলিম সংগঠন পরিচালিত রাজনীতির অবসানের আহ্বান করা হয়। বাংলার তাবড় লীগের নেতা হোসেন সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭-এর নভেম্বরে কলকাতায় লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে সভা ডাকেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘স্টার অফ ইন্ডিয়া’র প্রতিবেদন অনুসারে জয়া চ্যাটার্জী লিখেছেনঃ ‘‘Most of them recognised that the League in effect ‘had ceased to exist’ and that Muslims must now independently steer their course in independent India.’’ অন্যদিকে মৌলানা আজাদের মত ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতা ১৯৪৭-এর জামা মসজিদ ভাষণে বললেনঃ ‘‘Now that Indian politics has taken a new direction, there is no place in it for the Muslim League. Now the question is whether or not we are capable of any constructive thinking.’’ অনেক মুসলমান এই দেশটাকে নিজের দেশ বলে ভাবতে পারছিল না। আজাদের মত নেতাকে তাই আশ্বস্ত করতে হয়ঃ ‘‘Come, today let us pledge that this country is ours, we belong to it and any fundamental decision about its destiny will remain incomplete without our consent.’’ মুসলিম রাজনীতির তৎকালীন এই দুটি শক্তিশালী ধারাই সমগ্র মুসলমান সমাজের কাছে একই আবেদন রাখল - ধর্মপরিচয় ঝেড়ে ফেলে মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার। দেশভাগের পর রাজনৈতিক দিক থেকে সক্রিয় মুসলমানদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হত - জাতীয়তাবাদী মুসলমান ও মুসলমান। জাতীয়তাবাদী সমর্থনকারী মুসলমান হল প্রথম গোষ্ঠী আর বাকিরা সকলে নিজেদের জাতি, পেশা, শ্রেণি, লিঙ্গ, সংস্কৃতি সব পরিচয় হারিয়ে কেবল মুসলমান হয়েই থেকে গেল। মুসলমানের আত্ম-পরিচয়ের এই সংকোচন মুসলিম রাজনীতির একটি নির্ণায়ক দিক, যার প্রভাব আজ বেশি করে বোঝা যায়।

বাংলায় বিধানচন্দ্র রায় ও অতুল্য ঘোষের নেতৃত্বে লীগের সদস্যদের কংগ্রেসে অন্তর্ভুক্তি ও ক্ষমতায়ন শুরু হয়। যদিও লীগের সদস্যদের কংগ্রেসে যোগদানের পথ মসৃণ ছিল না। একদিকে ছিল মুসলিমদের উপর সন্দেহের তির, অন্যদিকে কংগ্রেসে নিজের মুসলিম সদস্যদের বিরোধিতা। ১৯৫১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ৮০ জন মুসলিম প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়ায়, যার মধ্যে কংগ্রেসের ২১ জন, বিরোধী দলের ১৪ জন ও ৪৫ জন নির্দলীয়। এর মধ্যে কংগ্রেসের ১৭ জন ও ২জন নির্দলীয় মুসলিম প্রার্থী জিতে যায়, কিন্তু বিরোধী দলের একজন মুসলিম প্রার্থীও বিধানসভায় জায়গা করতে পারেনি। উপরের তথ্য থেকে স্পষ্ট পঞ্চাশের দশকে কংগ্রেসী মুসলিমদের জেতার সম্ভাবনা বেশি ছিল। পরবর্তীকালে ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে সারা ভারত জুড়ে কংগ্রেসের ভাঙন শুরু হয় ও পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলি ক্ষমতা অর্জন করে। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলি ৩০ জন মুসলিমকে টিকিট দেয় যার মধ্যে ১৪ জন জেতে। ১৯৭৭ সালে বামপন্থী সরকারে মোট ৩৪ বিধায়কের মধ্যে ১৮ জন সিপিআইএমের মুসলিম বিধায়ক ছিলেন। প্রমাণ হল বামপন্থায় বাংলার মুসলমানদের ভরসা ও বিশ্বাস। সঙ্গে এও বোঝা যায় স্বাধীনোত্তর কালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, শিল্প-সাহিত্যে মুসলমানদের উপস্থিতি কম থাকলেও, ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। তবে ভোটের রাজনীতির বাইরে মুসলিম সমাজকে ঘিরে অনেকের মনেই ছিল সন্দেহ। বিশেষত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গরা এই সন্দেহের বাতাবরণকে জনপ্রিয় করেছিলেন।মূলস্রোত রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে গেলেই একপ্রকার বাধা আসত, বাংলা কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও সেই বাধা আসে জয়া চ্যাটার্জী যার উল্লেখ করেছেন।

সত্তরের দশকের শেষে মুসলিম রাজনীতির নতুন উল্লেখযোগ্য দিক লক্ষ্য করা যায়। ১৯৬৯-এর নির্বাচনে দ্য মাইরনিটিস লীগ (MIL) ও প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ (PML) নামে দুটি দল রাজনীতিতে আসে। স্বাধীনতার প্রায় ২০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম রাজনীতির এই গোষ্ঠীকেন্দ্রিক ধারার পুনরুত্থান হল। প্রথম নির্বাচনে ৪০টি প্রার্থীর মধ্যে PMLর তিনজন বিধায়ক নওদা, হরিহরপাড়া ও দেগঙ্গা আসন জিতেছিলেন। দ্য মাইরনিটিস লীগের ২ জন প্রার্থীর জামানত জব্দ হয়। ১৯৭১-এর নির্বাচনে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ (PML) ২ টি আসনে লড়লেও কেউ পাত্তা পায়নি। সেই একই অবস্থা হল ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট মুসলিম লীগের (SML)। ১৯৭৭ সালে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ (PML) আরো শক্তি নিয়ে ঝাঁপায়। কিন্তু একটি আসন জেতা ছাড়া বাকি ৩১টিতেই তাদের জামানত জব্দ হয়। পরবর্তী নির্বাচনগুলিতেও একই অবস্থা হয় মুসলিম লীগের (MUL)। এই ধারার মুসলিম রাজনীতিকে বাংলার মুসলমান সমাজ পাত্তাই দেয়নি, বরঞ্চ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির প্রতিই আস্থা রেখেছে। বাংলায় বিভিন্ন ধারার লীগের জনপ্রিয়তা কমানোর প্রয়োজন অনুভব করে কংগ্রেসের নতুন নীতিতে মুসলিম অধ্যুষিত জেলাগুলিতে (মূর্শিদাবাদ, মালদা) গণি খান, আব্দুস সাত্তার প্রভৃতিদের পার্টিতে ও সরকারে ক্ষমতা দেওয়া হয়। অনেকের মতে এই পদক্ষেপ মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা কমানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল। একটি মুসলিম কেন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে ভোটের হিসাব বোঝা যেতে পারে। ১৯৭৭-এ ফারাক্কা কেন্দ্রে ৭ জন ভোটে লড়েন, যার মধ্যে ৬ জনই মুসলিম। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগের (MUL) ভাগ্যে জোটে সর্বসাকুল্যে ১৯০টি ভোট। ১৯৯০-এর দশকের পরও এই দলগুলি বাংলায় কোনো সুবিধা করতে পারেনি। আরো অনেক দল উঠে আসে এই সময়- ইন্ডিয়ন ইউনিয়ন মুসলিম লীগ (IUML), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মুসলিম লীগ (PBRML), মুসলিম লীগ কেরালা স্টেট কমিটি (MUL), জামাত-ই-সেরাতুল মুস্তাকিম (JeSM), ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া (WPOI) ইত্যাদি। এমনকি ২০০৬, ২০১১ ও ২০১৬-র নির্বাচনেও এই দলগুলি অংশগ্রহণ করে। কিন্তু বাংলার মুসলমান সমাজকে এরা আকৃষ্ট করতে পারেনি।

স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবাংলায় মুসলিম রাজনীতি প্রায় ৭০ বছর বাম শাসন শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত অনেক চড়াই-উতরাই দেখেছে। একদিকে মুসলমান সমাজের উপর ছিল সন্দেহের বাতাবরণ, বারবার দেশের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ দেওয়া, অন্যদিকে ছিল মুসলমান সমাজ কতৃক লীগের রাজনীতিকে ছেড়ে ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির প্রতি বিশ্বাস রাখার নজির। কিন্তু মূলস্রোতের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ উন্নয়নের সূচকগুলিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি তাই শুধু আজকের সত্যতা নয়, এর জট সুদূর অতীতে প্রথিত। কংগ্রেসের মত দলগুলি মুসলিম ‘এলিট ক্যাপচার’ এর মাধ্যমে মুসলিম ভোটারদের কাছে টেনেছে। জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে আজকের যে মুসলিম রাজনীতি তার সলতেও দেশভাগের পরেই পাকানো হয়।
 

২০০৬ পরবর্তী মুসলিম রাজনীতি

সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সারা ভারত জুড়ে মুসলমান সমাজের প্রতিক্রিয়া গঠনমূলক ছিল। নিরাপত্তা, ধর্মের অধিকার, সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি মুসলিম ইস্যু ছেড়ে শিক্ষা, চাকরির দাবি মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রে আসে। মূলত তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রিপোর্টটি লেখা হয়ঃ আত্মপরিচয়, নিরাপত্তা ও ন্যায়। রিপোর্টে মুসলমান সমাজে আন্ত-রাজ্য বৈষ্যমের ছবিটি ধরা পড়ে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা যে অনেক পিছিয়ে তা প্রমাণিত হয়। বাংলার মুসলমানরা বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে পথে নামল। এর সঙ্গে যোগ হল জমিকেন্দ্রিক আন্দোলন, রিজওয়ানুর হত্যা মামলা যার ফলে বাম বিরোধিতা আরো জোর পেল। বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এল। জামাত-ই-ইসলামি,অল ইন্ডিয়া মিল্লী কাউন্সিল, ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইনরিটি ইয়ুথ ফেডারেশন, স্টুডেন্ট ইসলামিক অর্গানাইজেশন প্রভৃতি সংগঠন মুসলিম রাজনীতির নতুন ভাষা তৈরি করল। ভোটের রাজনীতি থেকে সরে এসে উন্নয়ন বঞ্চনা, শিক্ষা, চাকরিতে পিছিয়ে থাকা, সংরক্ষণের দাবি ও আন্দোলন শুরু হল। এই সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেন সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী, মহঃ কামরুজ্জামান প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ, এরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের সাথে যুক্ত।

এই পর্বের মুসলিম আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পর বাংলায় শিক্ষা, চাকরির দাবি তুলে এত বিস্তৃত আন্দোলন বাংলার মুসলমান সমাজ তৈরি করতে পারেনি ও বিভিন্ন মুসলিম সংগঠন যারা মূলত ইসলামিক ঐতিহ্য বহনে ব্যস্ত ছিল, তারা প্রথমবার সামাজিক ন্যায়ের দাবি তুলল। মুসলমানের জন্য ওবিসি সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন এই সময়েই জোর পায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এদের ভূমিকা ও রাজনৈতিক অবস্থান ২০১১ পরবর্তী সময়ে ভিন্ন হলেও, সাচার রিপোর্ট প্রকাশের পর আন্দোলনের ভাষা অ-রাজনৈতিক ছিল। এদের মধ্যে কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে ওবিসি আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। ২০১৩ সালে সারা বাংলা সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের আন্দোলনে বেশ কয়েকটি মুসলিম ওবিসি গোষ্ঠী যারা রাজ্য সরকারের তালিকাতে থাকলেও কেন্দ্র সরকারের তালিকাতে ছিলনা, তাদের অন্তর্ভুক্তি হয়। স্টুডেন্ট ইসলামিক অর্গানাইজেশন ২০১৩ সালে মূর্শিদাবাদে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এই উত্থানকে কেনেথ বো নিয়েলসন পার্থ চ্যাটার্জীর ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।

২০১১ প্রাক-নির্বাচন সময়ে তৃণমূল কংগ্রেস এই দাবিগুলির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। কলকাতার নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সংখ্যালঘু সমাজের মধ্যে থেকে কাউকে সুযোগ দেওয়ার কথাও ওঠে, ওবিসি সংরক্ষণের দাবি সমর্থন করা প্রভৃতি কারণে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলমান সমাজের একটি অংশের মন জিতে নেয় তাতে সন্দেহে নেই। ২০১১ সালের নির্বাচনে মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯, যা বাংলার ইতিহাসে সর্বোচ্চ। তবে এমন নয় যে তথাকথিত মুসলিম নেতৃত্ব মমতা বন্ধোপাধ্যায়ের পাশে এসে দাড়াঁয়। ২০১১ নির্বাচনে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর মত নেতৃত্ব, যিনি জমি আন্দোলনে মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে একসাথে লড়েছিলেন, নতুন সমীকরণ তৈরির চেষ্টা করেন। পিডিসিআই নামে নতুন দল গঠন করে ৩৬ টি আসনে প্রতিদ্বন্দিতা করে যার মধ্যে সবকটিতেই জামানত জব্দ হয়। তবে অন্যান্য মুসলিম কেন্দ্রিক দল থেকে পিডিসিআই নীতি কিছুটা আলাদা ছিল। মুসলিমরা ছাড়াও তপশিলী জাতি, তপশিলী উপজাতি ও অ-মুসলিমরাও এই দলে যোগদান করেন। ১৯ জন অ-মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে ৬ জন তপশিলী জাতি ও ১ জন তপশিলী উপজাতিকে পিডিসিআই এর টিকিটে লড়েন। মুসলিম, তপশিলী জাতি ও তপশিলী উপজাতি প্রভৃতি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা সফল হল না। একই নির্বাচনে এসডিপিআই নামে আর একটি মুসলিম কেন্দ্রিক দল আত্মপ্রকাশ করে। ১১টি কেন্দ্রে লড়ে পর্যদুস্ত হয়। অন্যান্য মুসলিম কেন্দ্রিক দলগুলি এই পরিবর্তনের সময়কালে পাত্তা পায় নি। স্পষ্ট যে ১৯৬৯র নির্বাচনের সময় থেকেই মুসলিম কেন্দ্রিক দলগুলি বাংলার মুসলমানদের আশা-আকাঙ্খা বুঝতে পারেনি। মুসলমানরা কেবল একটি সম্প্রদায়ের হয়ে গলা ফাটানোর নীতিতে বিশ্বাস করেনি।

অভিজিৎ গুপ্ত প্রাক-তৃণমূল যুগের মুসলিম রাজনীতি বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে বারবার ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির প্রতি আস্থা আসলে মুসলিম সমাজকে রাজনৈতিকভাবে মূলস্রোতে নিয়ে এসেছে। তার মতে এই রাজনৈতিকভাবে মূলস্রোতে আসার দুটি পর্যায়ঃ স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসে যোগদান, পরবর্তীকালে বামপন্থার প্রতি আস্থা। তার তত্ত্বটিকে একটু এগিয়ে নিয়ে বলা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি ভরসা রাজনৈতিক মূলস্রোতে আসার তৃতীয় পর্যায়। ২০১১ পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম রাজনীতি চরম মোড় নেয় যা বহু চর্চিত। বর্তমানের মুসলিম রাজনীতি বুঝতে গেলে ভোটের অঙ্ক, বিধায়ক সংখ্যা, মুসলিম রাজনৈতিক দল বা মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা প্রভৃতির বাইরে গিয়ে বুঝতে হবে।

১৯৮০ ও ১৯৯০র দশকে সারা ভারত জুড়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি জনপ্রিয় হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্বের রাজনীতি বুঝতে হলে বিধায়ক বা সাংসদ সংখ্যার নিরিখে টের পাওয়া যাবে না। রাজ্যস্তরের নির্বাচন ছেড়ে স্থানীয় নির্বাচনের দিকে তাকালে বিষয়টি বোধগম্য হবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির সদস্য গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ১৯৮৮, ১৯৯৩, ১৯৯৮ সালে মোট আসনের যথাক্রমে ০.০৭%, ৩.৮৯%, ৭.৭৮% হয়, যা ২০০৩ ও ২০০৮-এ হয় যথাক্রমে ৩.৩২%, ২.৮১%। স্থানীয় স্তরে বিজেপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে বোঝাই যাচ্ছে।


______________________________

References:
● শুভজিত বাগচী, ২০১৬, Co-opt and placate: Trinamool’s Muslim formula, দ্য হিন্দু, মার্চ ২২। (https://www.thehindu.com/elections/westbengal2016/2016-west-bengal-assembly-polls-trinamools-muslim-formula/article8381994.ece)
● শুভনীল চৌধুরী ও শাশ্বত ঘোষ, 2016, 17 March, ‘মুসলমানদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন হবে না’, আনন্দবাজার পত্রিকা। (https://www.anandabazar.com/editorial/development-can-not-possible-without-muslims-1.334277)
● Chatterji, J. (2011). The spoils of partition Bengal and India, 1947-1967. Cambridge: Cambridge University Press (p-171).
● মইনুল হাসান, ২০১৯, স্বাধীনোত্তর বাংলায় সংখ্যাঘু উন্নয়নঃ একটি মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ, উদার আকাশ, ঈদ শারদ উৎসব সংখ্যা। (https://eprints.soas.ac.uk/17278/1/2008/586/586_hilal_ahmed.htm)
● Chatterji, J. (2011). The spoils of partition Bengal and India, 1947-1967. Cambridge: Cambridge University Press (p-176).
● Pandey, G. (1999). Can a Muslim Be an Indian? Comparative Studies In Society and History, 41(4), 608-629. doi: 10.1017/s0010417599003072.
● Pandey, G. (1999). Can a Muslim Be an Indian? Comparative Studies In Society And History, 41(4), 608-629. doi: 10.1017/s0010417599003072.
● Statistical Reporton General Election, 1977 To The Legislative Assembly of West Bengal.
● Nielsen, K. (2011). In Search of Development: Muslims and Electoral Politics in an Indian State. Forum for Development Studies, 38(3), 345-370. doi: 10.1080/08039410.2011.596568
● Winds of change may blow in a Mayor from minority community, ২০১০, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১লা জুন। (https://indianexpress.com/article/cities/kolkata/winds-of-change-may-blow-in-a-mayor-from-minority-community)
● Statistical Reporton General Election, 2011 To The Legislative Assembly of West Bengal.
● Dasgupta, Avijit (2009). On The Margins: Muslims In West Bengal. Economic and Political Weekly, 44(16):91-96.