আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সমসাময়িক

এগিয়ে বাংলাদেশ?


আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার বা আইএমএফ বিশ্ব অর্থব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা এবং আগামী কয়েক বছরের পূ্র্বাভাস সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে কোভিড-১৯ এবং লকডাউন বিশ্ব অর্থব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় মোট উৎপাদন ৪.৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই সংকোচনের পরিমাণ হবে ৪.৩ শতাংশ, ইউরোপে ৮.৩ শতাংশ এবং উদীয়মান অর্থব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই সংকোচনের পরিমাণ হবে ৩.৩ শতাংশ। আইএমএফ-এর এই পূর্বাভাসকে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এই বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আইএমএফ সম্পূর্ণ অন্য তথ্য পেশ করেছিল। কিন্তু কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে তা বিগত সাত মাসে কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে, তাই বলা যেতে পারে যে আইএমএফ-এর এই পূর্বাভাস বাস্তব পরিস্থিতিকে ধরতে বেশি সক্ষম হবে। যদিও, ইউরোপে বাড়তে থাকা সংক্রমণের ফলে আবারো যদি কিছু দেশ লকডাউনের পথে হাঁটে তবে আইএমএফ-এর পূর্বাভাসের থেকেও বেশি হারে অর্থব্যবস্থার সংকোচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এপ্রিল মাসে প্রকাশিত আইএমএফ-এর পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল যে ২০২০ সালে ভারতের অর্থব্যবস্থা ১.৯ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বিগত ছয় মাসে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, ভারতের অর্থব্যবস্থা ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে ২৩.৯ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। অতএব, আইএমএফ-কেও এই বাস্তব মেনে নিয়ে তাদের এপ্রিল মাসের পূর্বাভাসের সম্পূর্ণ পরিমার্জন করতে হয়েছে। অক্টোবরের পূর্বাভাসে আইএমএফ জানাচ্ছে যে ভারতের অর্থব্যবস্থা ২০২০ সালে ১০.৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। ছয় মাস আগে যেখানে আইএমএফ বৃদ্ধির গল্প শোনাচ্ছিল এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত পূর্বাভাস দিচ্ছে। সেই সময়েই অনেক অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন যে ভারত সংক্রান্ত আইএমএফ-এর পূর্বাভাস সম্পূর্ণ ভুল। এখন আইএমএফ নিজেই সেই কথা মেনে নিয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের তুলনায় ভারতের অর্থব্যবস্থার সংকট বেশি গভীর, সংকোচনের পূর্বাভাস ভারতের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

এই নিরিখে শুধু আমাদের পড়শি দেশগুলির সঙ্গে তুলনা করা যাক। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২০ সালে চিনের আর্থিক বৃদ্ধি হবে ১.৯ শতাংশ, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হবে ৩.৮ শতাংশ, মায়ানমারের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ, নেপাল ০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা-র ক্ষেত্রে -৪.৬ শতাংশ, ভূটান ০.৬ শতাংশ। পাকিস্তানের তথ্য আইএমএফ প্রকাশ করেনি। এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন হতে চলেছে। মাত্র কিছু বছর আগেই ভারতের অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক নীতিপ্রণয়নকারীরা চিৎকার করে বলছিলেন যে ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। আপাতত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল আমাদের থেকে আর্থিক বৃদ্ধির নিরিখে এগিয়ে রয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার আগে এবং পরে মোদী সরকার ভারতের অর্থব্যবস্থার হাল ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

আপাতত, সংবাদমাধ্যমে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির এই ভয়াবহ পতন নিয়ে আলোচনা কম চোখে পড়ছে। বরং ভারতের মাথা পিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় কমে যাবে বলে আইএমএফ-এর পূর্বাভাস নিয়ে রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন, সংবাদমাধ্যমেও এই নিয়ে আলোচনা চলছে। আইএমএফ-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু আয় হবে ১৮৭৬ ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় ১৮৮৭ ডলার হবে বলে আইএমএফ-এর অনুমান। এই তথ্যকে কেন্দ্র করে ভারতের সরকারকে বিপুল সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। তথ্যটি অসম্পূর্ণ, এবং এই তুলনা খুব বেশি কাজের নয়, দুটি কারণে। প্রথমত, আইএমএফ-এর পূর্বাভাস থেকেই পরিষ্কার যে ২০২১ সালে ভারতের মাথা পিছু আয় (২০৩০ ডলার) বাংলাদেশের (১৯৮৯) তুলনায় বেশি হয়ে যাবে। তাই এক বছর বাংলাদেশের থেকে আমরা পিছিয়ে এসেছি বলে খুব বেশি হতাশ হওয়ার কারণ নেই। আবার, দুটি দেশের মধ্যে পণ্যের দামের তফাৎ থাকে। আপনি ভারতে দশ টাকা দিয়ে যত পণ্য কিনতে পারবেন, আমেরিকায় তার প্রায় কিছুই কিনতে পারবেন না। এই তফাৎকে মাথায় রেখে মাথা পিছু আয় নির্ধারণ করা হয় Purchasing Power Parity বা ক্রয় ক্ষমতার হিসেবে। এই নিরিখে দেখলে দেখা যাবে যে ২০২০ সালে ভারতের মাথা পিছু আয় হবে ৬২৮৩ ডলার যেখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হবে ৫১৩৮ ডলার। তাই শুধুমাত্র এক বছরের হিসেবের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ বা ভারতের মধ্যে তুলনা টানা ঠিক নয়।

কিন্তু আমরা যদি বিগত কয়েক বছরে ভারত এবং বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় এবং বৃদ্ধির হারের তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে যে বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে ভারতের মাথা পিছু আয়কে প্রায় ধরে ফেলেছে। যেমন ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৩২৮ ডলার, যা ২০১০ সালে বেড়ে হয় ৭৬২ ডলার এবং ২০২০ সালে যা বেড়ে ১৮৮৭ ডলার হবে বলে আইএমএফ-এর অনুমান। একই সময়কালে ভারতের মাথা পিছু আয় ছিল যথাক্রমে ৩০৮ ডলার, ১০১৯ ডলার এবং ১৮৭৬ ডলার। অর্থাৎ, ২০১০ সালে ভারত বাংলাদেশের থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্রমে ভারতের মাথা পিছু আয়ের কাছাকাছি পৌঁছিয়ে যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ভারতের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি থেকেছে। যেমন, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭.৩ শতাংশ, ৭.৯ শতাংশ এবং ৮.২ শতাংশ। একই বছরগুলিতে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৭ শতাংশ, ৬.১ শতাংশ এবং ৪.২ শতাংশ। বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার শেষ কয়েক বছরে ভারতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল।

বাংলাদেশ অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হারের এই উন্নতির নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে তাদের রপ্তানি নির্ভর অর্থব্যবস্থা বহু চর্চিত বিষয়। কিন্তু যেই বিষয়টি সহজে লোকের নজরে আসে না তা হল, বাংলাদেশ এই সময় মানব উন্নয়নের নিরিখেও ভারতের তুলনায় কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। যেমন, বাংলাদেশে জন্মের সময় মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা ৭২.৩ বছর, ভারতের ক্ষেত্রে যা ৬৯.৪ বছর। আবার, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কা (১৫ বছরের ঊর্ধ্বে) মহিলাদের স্বাক্ষরতার হার ৭২ শতাংশ, ভারতের ক্ষেত্রে যা ৬৬ শতাংশ। মোট স্বাক্ষরতার হারের নিরিখেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারী কতজন সন্তানের জন্ম দেয়, এই হিসেবের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশে এই সংখ্যা ১৯৯৫ সাল অবধি ভারতের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশে প্রতি নারী ২ সন্তান জন্ম দেন, ভারতের ক্ষেত্রে যা ২.২। অর্থাৎ, জন্মনিয়ন্ত্রণের দিক থেকেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে। ভারতে প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে ২৮ জন এক বছর বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২৬। এমনকি দারিদ্রের নিরিখেও বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে ১৯.৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্ররেখার নিচে ছিলেন, ভারতে ২০১১ সালে ২২.৫ শতাংশ মানুষ এই দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থিত ছিলেন।

আরেকটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। শ্রম বাজারে মহিলাদের অংশগ্রহণের নিরিখে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে প্রতি ১০০ জন মহিলার মধ্যে ভারতে মাত্র ২০.৩ জন শ্রম বাজারে অংশগ্রহণ করছেন (অর্থাৎ কর্মরত রয়েছেন অথবা কাজ খুঁজছেন)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৩৬.৪ শতাংশ। মহিলাদের অর্থব্যবস্থায় অংশগ্রহণের নিরিখে বাংলাদেশ ভারতের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। রপ্তানি নির্ভর বস্ত্রশিল্পে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এই প্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ।

এমন নয় যে, বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হয়ে গেছে বা বাংলাদেশের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ভারতের মতই একটি গরিব দেশ। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ দেশ এবং এক সময় উন্নয়নের নিরিখে ভারত সমস্ত সূচকেই এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলির থেকে এগিয়ে থাকলেও এখন পিছিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের তুলনা করতে হলে শুধুমাত্র মাথাপিছু আয় বা আর্থিক বৃদ্ধির হারের দিকে তাকালে ছবিটি অসমাপ্ত থাকবে। উন্নয়নের বহু গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিতে ভারতের থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। ভারতের প্রধান দুর্বলতা এখানেই নিহিত রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যও মানব উন্নয়নের কিছু সূচকের উন্নয়নের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে।