আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সমসাময়িক

বাবরি রায় প্রহসন


বিচারকের অবসর নেওয়ার কথা ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯। তিনি অবসরও নেন। লক্ষ্ণৌ জেলা আদালতের বিচারক হিসেবে। জেলা জজ হিসেবে অবসর নিলেও সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের প্রধান ও একমাত্র বিচারক হিসেবে রয়ে গেলেন তিনি। একইসঙ্গে একজায়গায় অবসরপ্রাপ্ত ও অন্য জায়গায় কর্মরত? কীভাবে হলো? গত বছর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বনামখ্যাত রঞ্জন গগৈয়ের কাছে আবেদন করেন সিবিআই আদালতের বিচারক সুরেন্দ্রকুমার যাদব। আর্জি আমার অবসরের বয়সসীমা এক বছর বাড়িয়ে দেওয়া হোক। আমি চার বছর ৩৬ দিন মামলা শুনেছি। আমিই রায় দিয়ে যেতে চাই। রঞ্জন গগৈ অনুমতি দেন। সেই হিসেবে ২০২০ এর ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর অবসর।‌অবসরের দিন বা আগে সাধারণত বিচারক বা বিচারপতিরা গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেন না। কিন্তু নতুন ভারতে সব উলটপুরাণ। গুরু রঞ্জন গগৈ ২০১৯ এর নয় নভেম্বর অবসর গ্রহণের অতি অল্প ক’দিন আগে বাবরি মসজিদ মামলার আশ্চর্যজনক রায় দেন। গোটা জমিটাই তুলে দেন হিন্দু পক্ষের হাতে।

আর একই সঙ্গে বাবরি মসজিদ ধ্বংস অন্যায় বলেও অন্যায়ভাবে এক বিচারকের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন। আর সেই বিচারক শেষ কাজের দিনে রায় দিলেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস পূর্ব পরিকল্পিত নয় বলে বেকসুর খালাস দিলেন ৩২ জন অভিযুক্তকে। ওঁরা অবশ্য কেউই এই কারণে জেলে যান নি।

বিচারক তাঁর রায়ে ছয়টি পয়েন্ট উল্লেখ করেন। প্রথমত, পরিকল্পিতভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়নি। দ্বিতীয়ত, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ নেই। তৃতীয়ত, সিবিআই যে ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড পেশ করেছে, তা প্রামাণ্য কিনা জানা যাচ্ছে না। চতুর্থত, সমাজবিরোধীরা মসজিদ ভাঙার চেষ্টা করেছিল। অভিযুক্তরা তাদের থামাতে চেষ্টা করেছিলেন। পঞ্চমত, অডিও ক্যাসেটে কয়েকজনের ভাষণ শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু কী বলা হয়েছে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ষষ্ঠত, অপরাধীরা ধর্মে বিশ্বাস করেন । মসজিদের নীচে রামলালার গর্ভগৃহ ছিল - সেটা তাঁরা ভাঙবেন কেন?

আদালত থেকে বেরিয়েই এক অপরাধী বলেন, আমরাই বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছি। ফাঁসি দিলেও একথা বলবো। আরেকজন উমা ভারতী লিব্রেহান কমিশনে বলেন, বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছি।‌ বেশ করেছি। অভিযুক্তরা বলছেন, ভেঙ্গেছি। বিচারক বলছেন, না ওঁরা ভাঙ্গে নি‌। এটা পূর্ব পরিকল্পিতও নয়। ভারতে ফ্যাসিবাদ যে প্রায় কায়েম হয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৮ বছর পরে দেওয়া রায় তার প্রমাণ। বিচার নয়, এটা বিচারের প্রহসন। দেখা যাক, প্রহসন কবে বন্ধ হয়।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের এক নয়া ইতিহাস। শীর্ষক শিরোনাম করে ‘কোবরা পোস্ট’ একটা খবর ছেপেছিল। তাতে বলা হয়েছিলঃ পরিকল্পনা করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেছিল সংঙ্ঘ পরিবার। কোবরা পোস্টের স্টিং অপরেশনে উঠেছে এমন বিস্ফোরক তথ্য। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় ওই দিনটিতে রাম জন্মভূমির আন্দোলনের নামে ষোড়শ শতকের স্থাপত্য বাবরি মসজিদকে ধ্বংসাবশেষে রূপ দিয়েছিল কিছু ধর্মান্ধ মানুষ।

এতদিন পর্যন্ত দাবি করা হত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া কিছু জনতা এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য ধ্বংসের কারণ। কিন্তু কোবরা পোস্টের ২৩ জনের উপর করা একটি স্টিং অপরেশন বদলে দিল ওই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রচলিত ধারণা। এই স্টিং অপারেশনে দাবি করা হয়েছে। সংঙ্ঘপরিবার এই ধ্বংসের গোপনীয় ছক কষেছিল অনেক আগেই। উন্মত্ত সেই জনতা হয় সেই ছকের রূপ দিয়েছিল, নয় তারা ওই পরিবারের স্বেচ্ছাসেবক ছিল।

কোবরা পোস্টের তদন্তের ফলাফল অনুযায়ী রাম জন্মভূমি আন্দোলনের মুখ্য চরিত্র সাক্ষী মহারাজ, আচার্য্য ধর্মেন্দ্র, উমা ভারতী, মহান্ত বেদান্তী, বিনয় কাটিয়ার সঙ্গে শীর্ষ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানি, উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং এমনকী তদানীন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও সঙ্ঘপরিবারের এই পরিকল্পনার কথা আগে থেকেই জানতেন। কোবরা পোস্টের সহকারী সম্পাদক কে আশিস উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা, ফৈজাবাদ, তান্ডা, লখনউ, গোরখপুর, মথুরা, মোরাদাবাদ সহ জয়পুর, ঔরাঙ্গাবাদ, মুম্বাই, গোয়ালিয়র ঘুরে ঘুরে এমন ২৩ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যাঁরা এই ধ্বংসকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কে আশিস এই ২৩ জনের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন রেকর্ডও করেছেন।

যদি এই ২৩ জনের দাবি সত্যি হয় তাহলে বোঝা যাচ্ছে রাম জন্মভূমি আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা মাসের পর মাস ধরে গোপনে এই ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের রীতিমতো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। পরিকল্পনা করে ঘটনাটিকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে মনে হয় কিছু ধর্মান্ধ জনতাই এই ধ্বংসের জন্য দায়ী। রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় সমগ্র পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। (সূত্রঃ শীর্ষ নিউজ ডটকম)।

ইতিহাস এখনও জানাচ্ছে, বাবরের সেনাপতি বাঁকি খাঁ ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশে ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায় একটি মসজিদ তৈরি করেন। বাবরের নামে বলে বাবরি মসজিদ। ঐতিহাসিক দুর্গাপ্রসাদ ভট্টাচার্য তাঁর লেখায় দেখিয়েছিলেন, ওখানে আগেই একটি মসজিদ ছিল। বাঁকি খাঁ তাঁর সংস্কার করেন। এই মসজিদটি স্থাপত্য কলা ও বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশলের জন্য অভিনব ছিল। লর্ড বেন্টিঙ্কের (১৮২৫-৩৩) প্রধান স্থপতি গ্রাহাম পিকফোর্ড তাঁর ‘হিস্টরিক স্ট্রাকচার্স অফ অউধ’ গ্রন্থে লেখেন, বাবরি মসজিদের শব্দপ্রক্ষেপণ ব্যবস্থা ছিল অসামান্য। ষোড়শ শতকে দাঁড়িয়ে শ্রুতি ও স্থাপত্যবিজ্ঞানের অসাধারণ প্রয়োগ তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি লেখেন, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অর্থাৎ ২০০ ফুট (৬০ মিটার) দূর থেকেও ফিসফিস করে বলা কথা পরিষ্কার শোনা যেত। শোনা যেত বক্তার কন্ঠস্বর। মসজিদের দেওয়াল তৈরিতে ব্যবহৃত হয় বেলেপাথর যা শব্দকে প্রতিধ্বনিত করতে পারত। গ্রাহাম পিকফোর্ড লিখছেন, শ্রোতা বিস্মিত হতেন এই অভিনব শব্দ প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা দেখে। এখানে ছিল অনুরণন দ্বারা ধ্বনিবর্ধক যন্ত্রের আধুনিক ব্যবহার। খিলান, ধনুকাকৃতি খিলান আর গম্বুজগুলি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে ভিতরটা ঠান্ডা থাকে এবং সহজেই আলো প্রবেশ করতে পারে। পাঠক খেয়াল করে দেখবেন মধ্যযুগের মুঘল স্থাপত্যগুলিতে দিনের বেলায় আলো জ্বালিয়ে রাখতে হয় না। বাবরি মসজিদে ছিল উঁচু সিলিং, গম্বুজ এবং ছয়টি বড় ঘেরা জানালা। বলার কথা একটাই, বাবরি মসজিদ ধ্বংস শুধু মসজিদ ধ্বংস নয়, ধ্বনি, আলো ও স্থাপত্য শিল্পের এক অভিনব নিদর্শন দেখা থেকে ভাবী প্রজন্মকে বঞ্চিত করা।

ভবিষ্যতে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হবে। তাতে প্রহসনকেই আসল বলে মনে হবে। আসল দাবিকে প্রহসন।

নাকি অন্য কিছু দেখবে আগামী প্রজন্ম?