আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ পঞ্চদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ অক্টোবর, ২০২০ ● ১-১৫ কার্ত্তিক, ১৪২৭

সম্পাদকীয়

রাষ্ট্র সঙ্ঘঃ ৭৫ বছর


সন-তারিখের হিসেবে ২৪ অক্টোবর, ২০২০ রাষ্ট্র সঙ্ঘের ৭৫ বছরের পূর্তি উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে এই আন্তঃরাষ্ট্রীয় শীর্ষ সংগঠনের ক্রিয়াকর্মাদির বিস্তারিত খবরাখবর পাওয়া যেতে পারত। বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের দাপটে বোধ হয় সেই উদ্যোগ আপাতত মুলতবি রাখতে হয়েছে।

১৯২০-র ১০ জানুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শান্তি এবং নিরাপত্তা’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৫৮টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে ‘লীগ অব নেশনস’ বা ‘সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শুরুতে লীগ অব নেশনসের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালিত হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের শান্তি রক্ষার প্রধান লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ। লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার অভিজ্ঞতার ফসল রাষ্ট্র সঙ্ঘ। ১৯৪৫-এর ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন সানফ্রানসিস্কোতে আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে ‘জাতিসমূহের সম্মেলনে’ ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র সঙ্ঘ সনদ রচনা করেন। ১৯৪৪-এর আগস্ট-অক্টোবরে ওয়াশিংটনের ডাম্বার্টন ওকসের বৈঠকে চিন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে এই সনদ গড়ে ওঠে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ৫০টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি ১৯৪৫-এর ২৬ জুন সনদটি অনুমোদন ও স্বাক্ষর করেন। পোল্যান্ড সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলেও পরে এতে স্বাক্ষর প্রদান করে প্রথম স্বাক্ষরকারী ৫১টি রাষ্ট্রের একটি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর চিন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও স্বাক্ষরকারী অধিকাংশ দেশের সনদ অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্র সঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৪৮ থেকে প্রতি বছর ২৪ অক্টোবর রাষ্ট্র সঙ্ঘ দিবস পালনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বর্তমানে রাষ্ট্র সঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩। সদর দপ্তর ১৯৫২ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে অবস্থিত।

রাষ্ট্র সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচার নীতির ওপর ভিত্তি করে শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সব মানুষের কল্যাণের জন্য পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক সংকট মুহূর্তে এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি করে ভারসাম্য বজায় রাখবে বলে স্থির হয়েছিল। শান্তিরক্ষা, শান্তি সৃষ্টি, সংকট প্রতিরোধ এবং মানবিক সাহায্যের জন্য রাষ্ট্র সঙ্ঘ বেশি পরিচিত। তবে এই দিকগুলোর বাইরেও বিভিন্ন উপায়ে রাষ্ট্র সঙ্ঘ এবং এর অঙ্গসংস্থাগুলো (বিভিন্ন বিশেষায়িত সংস্থা, ফান্ড এবং কর্মসূচি) বিশ্বকে প্রভাবিত করে চলেছে। রাষ্ট্র সঙ্ঘ বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন মৌলিক ইস্যু, যেমন সংরক্ষণযোগ্য উন্নয়নের ধারণা থেকে শুরু করে পরিবেশ এবং শরণার্থীদের রক্ষা, দুর্যোগ সহায়তা, সন্ত্রাসবাদ দমন, নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার, শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য, ভূমি মাইন অপসারণ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ার লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

সাংগঠনিকভাবে রাষ্ট্র সঙ্ঘের প্রধান অঙ্গসংস্থাগুলো হল, - সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ, সচিবালয়, ট্রাস্টিশিপ কাউন্সিল এবং আন্তর্জাতিক আদালত। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নানারকম সমস্যার সমাধান, সুবিধা বৃদ্ধি, উন্নত জীবনমান গঠন এবং নিরাপত্তা দানে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে। রাষ্ট্র সঙ্ঘের প্রধান নির্বাহী হলেন সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব। রাষ্ট্র সঙ্ঘের আরও কিছু স্বয়ংশাসিত অঙ্গসংগঠন আছে যা বিশ্বের অনেক দেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও এসব প্রতিষ্ঠান অন্যান্য দেশে নিজেদের সেবামূলক ও অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যায়। যেমন ১৯৫টি দেশে কাজ করছে ইউনেস্কো। ১৯৪টি দেশে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা UNCTAD, ১৯৪ দেশে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা WTO, ১৯৪ দেশে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন ITU, ১৯৭ দেশে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা FAO ও ১৯২ দেশে বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন UPU কাজ করে যাচ্ছে। ICAO কাজ করছে ১৯১টি দেশে, IBRD কাজ করছে ১৮৮টি দেশে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে রাষ্ট্র সঙ্ঘের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল IMF ও উইমেন ইন পার্লামেন্ট WIPO। ১৮৬টি দেশে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কাজ করছে ILO; MIGA আছে ১৮০টি দেশে; ১৭৬টি দেশে IFAD আছে; UNIDO কাজ করছে ১৭০টি দেশে; IMO আছে ১৭১টি দেশে IAEA ১৬৪টি দেশে সক্রিয়। এর বাইরেও কাজ করছে UNCHR, UNICEF, UNIFA নামের রাষ্ট্র সঙ্ঘের অঙ্গসংগঠন। আর আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক। স্বয়ংশাসিত এই সংস্থার এমন দাপট যে অনেক সময়ই খেয়াল থাকে না এটি রাষ্ট্র সঙ্ঘের অধিভুক্ত একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। রাষ্ট্র সঙ্ঘের সদস্য দেশগুলির অর্থনৈতিক বিকাশকে উন্নত করার জন্য বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রকল্পভিত্তিক ঋণ দেওয়ার জন্য সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বাস্তবে দেখা গেছে আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রাষ্ট্র সঙ্ঘের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দেশে ঋণ দেওয়ার জন্য এমন সব শর্ত আরোপ করে যার থেকে দেশগুলি অর্থনৈতিক মুক্তির সুযোগ পায় না। পুরোনো ঋণ শোধ করার জন্য নতুন করে ঋণ নিতে হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশগুলি ক্রমশ ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। এবং ঋণ মুক্তির বিষয়ে রাষ্ট্র সঙ্ঘ কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।

রাষ্ট্র সঙ্ঘের ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক-মুহূর্তে যে সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নজরে আসছে তার মধ্যে ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭-এর নভেম্বরে প্যালেস্টাইনের একটি অংশের উপর ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাষ্ট্র সঙ্ঘ। আবার ১৯৫০-এর দশকে দুই কোরিয়ার লড়াইয়ে রাষ্ট্র সঙ্ঘ দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৬-য় ইজরায়েল এবং মিশরের বিবাদ নিরসনে রাষ্ট্র সঙ্ঘ আপতকালীন বাহিনী গঠন করে দুই দেশের সীমানায় মোতায়েন করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ১৯৬৭-তে রাষ্ট্র সঙ্ঘ আপতকালীন বাহিনী প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। এবার মিশরের পাশে দাঁড়ায় জর্ডন এবং সিরিয়া। আবার এই রাষ্ট্র সঙ্ঘের নির্দেশে বর্ণবৈষম্যবাদী রোডেশিয়ার (এখনকার জিম্বাবোয়ে) বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাষ্ট্র সঙ্ঘ (১৯৬৬)। বর্ণবৈষম্যবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সঙ্ঘ (১৯৭৭) নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯৯৪-এ সার্বিয়া বনাম বসনিয়া-হার্জগোভিনিয়ার যুদ্ধে সার্বিয়ার সেনাবাহিনীর উপর বিমানহানার দায়িত্ব সরাসরি ন্যাটো-র হাতে তুলে দেয় রাষ্ট্র সঙ্ঘ। ২০০৩-এ ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীর যৌথ অভিযান বন্ধ করার জন্য ফ্রান্স জার্মানি রাশিয়ার আবেদনে কর্ণপাত করেনি রাষ্ট্র সঙ্ঘ।

সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ বিতর্ক নিরসনে রাষ্ট্র সঙ্ঘ সবসময়েই একটা বিচিত্র ভূমিকা পালন করে গেছে। তাইওয়ানের বদলে গণপ্রজাতন্ত্রী চিন-কে প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী পরিষদের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে রাষ্ট্র সঙ্ঘ আপত্তি করেনি (১৯৬৭)। পিএলও-কে স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র সঙ্ঘের দ্বিধা নেই (১৯৭৪)। সমাজসভ্যতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সমুদ্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন (১৯৮২), বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তর রক্ষার চুক্তি (১৯৮৭), জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কিয়েটো চুক্তি (১৯৯৭) তো রাষ্ট্র সঙ্ঘের উদ্যোগেই প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানের ঐতিহ্যমন্ডিত স্থাপত্যের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে রাষ্ট্র সঙ্ঘ এবং তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলি উদাসীন। রাষ্ট্র সঙ্ঘ বাহিনী কার্যকরী ভূমিকা পালন করায় ইস্ট টিমোর-এর রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতার লড়াই খুব অল্প সময়ে একটা পরিণতি পায়। সদ্য স্বাধীন দেশ ইস্ট টিমোর-এর পুনর্গঠনের কাজে রাষ্ট্র সঙ্ঘ বাহিনী প্রশংসনীয় কাজ করে। অথচ কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র সঙ্ঘ যথাযথ পদক্ষেপ করলে গৃহযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারতো কি?

এইরকম হাজারো প্রশ্ন/দৃষ্টান্ত উত্থাপন করে রাষ্ট্র সঙ্ঘের সাড়ে সাত দশকের সফরের সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়। রাষ্ট্র সঙ্ঘের ভূমিকা হয়তো সব ক্ষেত্রেই প্রশ্নের উর্দ্ধে নয়। তবে ৭৫ বছর একটি প্রতিষ্ঠানের সাফল্য প্রমাণের জন্য যথেষ্ট সময়। ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক-মুহূর্তে অবশ্যই বলা যায় যে বিত্তশালী রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ না করে সমস্ত বিষয়ে বৈষম্যবিহীন আচরণ করলে রাষ্ট্র সঙ্ঘের পরিচয় অনেক উজ্জ্বল হতে পারতো।