আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ দ্বাদশ সংখ্যা ● ১-১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ● ১৬-৩০ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

প্রবেশিকায় জট, ধন্দে পড়ুয়ারা

শুভময় মৈত্র


এই পর্যালোচনা যখন শেষ করছি (আগস্ট ২৭, ২০২০), সেদিন আবার কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে। এই অবস্থায় দেশের বিভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়ে তুমুল অনিশ্চয়তা। ২০০৪ সালে ষাটের বেশি বাম সাংসদের সমর্থনে প্রথম ইউপিএ সরকার গঠনের পর কিছুদিন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার বাজেট কিছুটা বেড়েছিল। এছাড়া গোটা সহস্রাব্দই মোটের ওপর প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল উন্নয়ন দেখেছে। ঠিক সেই জায়গায় কোভিড অতিমারী পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিয়ে গোলমাল যে বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। প্রগতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ভাবনার প্রেক্ষিতে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের উন্নয়ন আজকের দিনে ভারতবর্ষে অলীক। তাই বাম ভাবনাকে বালিশের তলায় সমাধিস্থ করে এই লেখা।

বিভিন্ন সময় আমরা আলোচনা করে থাকি শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিযোগিতা নিয়ে। বিশেষ করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ভালো প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং বা সায়েন্স পড়ার যে অসম্ভব চাহিদা তার ফলেই এই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একেবারে সহজ হিসেবে দেশের সবথেকে আকর্ষণীয় প্রায় লাখখানেক আসনের জন্যে প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয় পঁচিশ লক্ষেরও বেশি অত্যন্ত মেধাবী পড়ুয়া। এবার কোভিড পরিস্থিতিতে মুশকিল তাদের প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়েই। আমরা এখানে বেসরকারি ক্ষেত্রের কথা বলছি না। সেখানকার প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধা অনেক সময় ভালো হলেও পড়াশোনার মান নিয়ে আমাদের দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। বাংলার যে কোনো ছেলেমেয়ে যদি মেডিকেল কলেজ, যাদবপুর বা আইআইটি খড়্গপুরে পড়ার সুযোগ পায়, তাহলে সে সাধারণভাবে কোনো প্রাইভেট কলেজে পড়তে যাবে না সেকথা সকলেই জানেন। তাদের সর্বভারতীয় তিনটি প্রবেশিকা পরীক্ষা নিয়েই এবার মূল গণ্ডগোল। একটি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্যে জেইই মেইনসের দ্বিতীয় পর্ব (এবং তারপর বাছাইদের জন্যে আইআইটি) আর অন্যটি ডাক্তারির নিট। এ প্রসঙ্গে একটি বিষয়ের কথায় ফিরে যেতেই হয়। এবার পশ্চিমবঙ্গের প্রযুক্তি প্রবেশিকা পরীক্ষা অনেকটা এগিয়ে আনা হয়েছিল। ফলে কোভিড জমানা শুরু হওয়ার আগেই পরীক্ষা সম্পূর্ণ। কয়েকদিন আগে ফলপ্রকাশও হয়ে গেছে। ফলে আমাদের রাজ্য যে কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় আছে তা মেনে নিতেই হবে।

পশ্চিমবঙ্গে আগেভাগে প্রযুক্তির পরীক্ষা হওয়ার পেছনে অনেক যুক্তিই থাকতে পারে। তার মধ্যে বেসরকারি কলেজের মুনাফার প্রেক্ষিতে বিষয়টি দেখা যাক। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই মতামত যে আগে রাজ্য জয়েন্টের ফল বেরোলে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি কলেজগুলি অন্যান্য রাজ্যের বেসরকারি কলেজের তুলনায় ছাত্র ভর্তিতে কিছুটা সুবিধে পেত। এই বিষয়টা একটু গভীরে গিয়ে বোঝার প্রয়োজন আছে। আর এই কথা শুধু আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেই সত্যি নয়, গোটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একই সঙ্গে শুরুতেই এটা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে এই আলোচনা গড় ভিত্তিতে। অর্থাৎ কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকবেই। ফের মনে করিয়ে দেওয়া যাক যে প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতকস্তরের পড়াশোনায় সরকারি জায়গায় খরচ কম, কিন্তু শিক্ষার মান বেশি। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অঙ্কটা ঠিক উলটো। আমাদের দেশের ভালো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানের গবেষকরা সুযোগ পেলে প্রথমে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও সেকথা সত্যি। যিনি সরকার বা সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পড়ান, তাঁর মাইনে আসে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে। ফলে সে চাকরি যে তুলনায় স্থায়ী তা বলাই বাহুল্য। অর্থাৎ সরকারি স্কুলেও শিক্ষক শিক্ষিকাদের মান গড়ে বেসরকারি ক্ষেত্রের তুলনায় ভালো। যেমনটা আগেই বলেছি, ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র বাদ দিয়ে এটাই সাধারণ ধারণা। তবে স্কুলের বিষয়টি পড়ুয়াদের বিন্যাসে কলেজের থেকে একেবারে আলাদা। বাম আমলে ইংরিজি তুলে দেওয়া এবং লটারির প্রবর্তনের পর থেকে স্বচ্ছল বাঙালি অভিভাবকেরা সরকারি বাংলা স্কুলে ছেলেমেয়েদের আর পাঠান না। বলতেই হয় বামফ্রন্ট সরকারের জনদরদী নীতিতে কোনো ভুল ছিল না। কিন্তু সুবিধাভোগী বাঙালি নিজের সন্তানকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিম্নবিত্ত সহপাঠীদের কাছ থেকে। দেশের অন্যান্য রাজ্যেও নানা কারণে সরকারি স্কুলগুলিতে মধ্যবিত্ত মানুষ আর ছেলেমেয়েদের পাঠান না। সেই ধারা কিন্তু স্নাতকস্তরে একেবারে উলটো। বেসরকারি কলেজ এখনও আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীদের কাছে সরকারি ক্ষেত্রের নিরিখে তুলনীয় নয়।

এই প্রেক্ষিতে পড়াশোনা ভুলে বেসরকারি কলেজের রোজগারের কথায় আসা যাক। ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট দিয়ে এ রাজ্যের বেসরকারি কলেজে যারা ভর্তি হবে, তারা একই সঙ্গে খোঁজ নেবে অন্য রাজ্যের বেসরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার। এবার পশ্চিমবঙ্গে যদি আগে ফল প্রকাশিত হয় সেক্ষেত্রে পড়ুয়াদের এখানকার কোনো কলেজে আগে থেকে নাম লেখানোর তাগিদ থাকবে। ধরা যাক শুরুতে ভর্তি হতে লাগল কুড়ি হাজার টাকা, আর তার মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা ফেরতযোগ্য নয়। এই টাকার অঙ্কগুলি অভিভাবকেরা সকলেই জানেন, ফলে আসল তথ্য বসিয়ে সঠিক মান সহজেই কষে নিতে পারবেন। পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলি তুলনায় ছোট। তবে যেগুলি কিছুটা নামকরা তাতে খুব সহজেই হাজারখানেক আসন ধরা যায়। সেক্ষেত্রে হাজার গুণ পাঁচ হাজার হল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। এই টাকা ফেরতযোগ্য নয়। অর্থাৎ এ রাজ্যের কলেজে ভর্তি হয়ে পরে যদি কেউ অন্য রাজ্যে যায় সেক্ষেত্রে এই টাকার অংশ কলেজের ভাঁড়ারে থেকে যাবে। এটাও জানা আছে যে অন্য কলেজে চলে গেলে বাকি অ্যাডমিশন ফি ফেরত পাওয়াটা কত কঠিন। তবে দেশের আইনে কিছু পরিবর্তন হওয়ায় এখন দেরিতে হলেও বেসরকারি জায়গা থেকে অভিভাবকেরা টাকা ফেরত পাচ্ছেন মাঝে মধ্যে। এই নিরিখে আমাদের রাজ্যের জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা এগিয়ে আনার পেছনে একটা যুক্তি হতে পারে এখানকার বেসরকারি কলেজগুলোকে কিছুটা অক্সিজেন জোগানো। এতে দোষের কিছু নেই। বেসরকারি কলেজও জীবিকার ক্ষেত্র তৈরি করে। তবে কোনো এক অজানা কারণে পরীক্ষা অনেক আগে হলেও আমাদের রাজ্য ফল প্রকাশে তুলনায় দেরি করল। আর এর মধ্যেই দেশের সবথেকে বড় বড় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে প্রবেশিকা পরীক্ষা সেরে ফেলল। ফলে রাজ্যের বেসরকারি কলেজগুলো যে খুব একটা অতিরিক্ত সুবিধে এবার পেল এমনটা নয়। এবার রাজ্যের বাইরের টাকার পরিমাণটা একটু দেখে নেওয়া যাক। দক্ষিণের এক একটি বড় প্রতিষ্ঠানে প্রায় কুড়ি হাজার পড়ুয়ার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। ধরা যাক তাদের প্রত্যেককে শুরুতেই জমা রাখতে হচ্ছে দশ হাজার টাকা করে, এবং তা ফেরতযোগ্য নয়। আরও একবার গুণটা করেই ফেলা যাক, কুড়ি কোটি। এবার সর্বশেষ অনুমান। গত কয়েকদিনে ভারতজুড়ে মোটের ওপর দশ লক্ষ পড়ুয়া গড়ে দশ হাজার করে টাকা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। মোট একহাজার কোটি ভারতীয় মুদ্রা হাতবদল হয়েছে শুধু প্রবেশিকার খরচ হিসেবে। যাকে পোশাকি ভাষায় রেজিস্ট্রেশন বলা হয়। এই প্রত্যেকটি জায়গায় থাকা খাওয়া নিয়ে পড়ার খরচ বছরে এক লক্ষ টাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। বেসরকারি ক্ষেত্রে ডাক্তারি পড়ার খরচ আরও বেশি। অনেক সময়েই তা বছরে পাঁচ লক্ষ থেকে কুড়ি লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

অর্থাৎ সরকারি জায়গায় পরীক্ষা দেরি হওয়ার একটা অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে বেসরকারি ক্ষেত্রের রোজগার শুরুতেই কিছুটা বেড়ে যাওয়া। আর এই পরীক্ষা যদি একেবারেই না হয়, তাহলে সকলকেই বেসরকারি কলেজে পড়তে হবে। সে অঙ্কে মুনাফার কথা থাকবেই। তবে তার থেকেও সাংঘাতিক ব্যাপার হল পঁচিশ লক্ষ পড়ুয়া আর তাদের অভিভাবকদের মানসিক যন্ত্রণা। দেশের অসম্ভব মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা (যার সংখ্যা অবশ্যই কমপক্ষে এক লক্ষ) আইআইটি, আইআইএসইআর, এনআইটি, এআইএমএস এই সব জায়গায় ভর্তি হতে না পারলে গোলমাল ভয়ঙ্কর। সেক্ষেত্রে পরের বছর তারা আবার সরকারি জায়গায় ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করবে। প্রতিযোগিতা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার কোনো সীমা পরিসীমা থাকবে না। ফলে এই প্রবেশিকা যে করতেই হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটি শিক্ষাবর্ষ আমাদের মতো দেশে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ততটা অসুবিধে নেই, কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষা বন্ধ থাকলে যে আঘাত মেধাবী পড়ুয়াদের ওপর আসবে তা অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। কারণ তাদের তখন সরকারি জায়গা ছেড়ে পড়তেই হবে বেসরকারি কলেজে। ঝুঁকি নিয়ে কোনো বেসরকারি কলেজে ভর্তি হলাম না এমন সাহস খুব কম পরিবারই দেখাতে পারবেন। মেধাবী পড়ুয়াদের শিক্ষার উৎকর্ষতায় সেক্ষেত্রে ভাঁটা পড়তে বাধ্য।

অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জী নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের বক্তব্যও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাঁরা বলছেন যে পরীক্ষা নেওয়ার মতো উপযুক্ত পরিস্থিতি নেই। সত্যিই তো অনলাইনে পরীক্ষা হওয়ার কারণে এমনিতেই শহর থেকে দূরে থাকা পরীক্ষার্থীদের বিপুল মুশকিল। যে কোনো স্কুলে এই ধরনের পরীক্ষা নেওয়ার পরিকাঠামো নেই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই অনেকে দূর থেকে আগের রাতে এসে কলকাতায় থাকেন। কোভিড পরিস্থিতিতে তাদের পরীক্ষা দেওয়া ভীষণ মুশকিল। ঠিক এই জায়গাতেই সরকারের দায়িত্ব বেড়ে যায় অনেকটা। পরীক্ষা একবার নেওয়া গেলে তারপর ক্লাস শুরু হতে দেরি হলে সমস্যা তেমন নেই। পরে কোনোভাবে ছুটি কমিয়ে পড়াশোনা সামলে নেওয়া যাবে। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্নাতকস্তরে যারা পড়াশোনা করে তাদের ক্ষেত্রে অনলাইনে কোনক্রমে কিছুটা কাজ এগিয়ে রাখাও সম্ভব। অর্থাৎ সঠিক ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা নেওয়া গেলে একটা বড় সমস্যা মিটবে। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই জুলাই মাসের শেষ দুদিনে কর্নাটকের প্রযুক্তি প্রবেশিকা পরীক্ষা হয়েছে। কয়েকদিন আগে ফলপ্রকাশও সম্পূর্ণ। সেই পরীক্ষা সংক্রান্ত কারণে সে রাজ্যে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে এমন খবরও বিশেষ নেই। সুতরাং যারা পরীক্ষা হওয়ার কথা বলছেন তাদের পক্ষেও উদাহরণ আছে। তবে যে বাংলায় কোভিড রুগীকে অ্যাম্বুলেন্সে চড়াতে গেলে কিলোমিটার প্রতি হাজার টাকা দিতে হয়, সেখানে রাজ্য সরকার বিশেষ ব্যবস্থা না নিলে পরীক্ষার দিন ছাত্রছাত্রীদের হয়রানি যে কম হবে না তা বলাই বাহুল্য। তবে এটা পরিষ্কার যে কর্নাটকের মতো রাজ্য কেন্দ্রীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে নিয়ে নিতে পারবে এবং বর্তমানে সেখানে বিজেপি ক্ষমতায় থাকায় তারা খুব সহজে পরীক্ষা বন্ধের দাবী তুলবে না। অন্যদিকে ছাব্বিশে আগস্ট বিরোধী নেতৃবৃন্দের অন্তর্জাল সম্মেলনের পর এটাও পরিষ্কার যে প্রবেশিকা পেছোনোর দাবী নিয়ে উচ্চতম ন্যায়ালয়ে পৌঁছবে বেশ কয়েকটি বিজেপি বিরোধী রাজ্য। মুশকিলটা ঠিক এই জায়গাতেই। দ্বন্দ্বটা পড়াশোনার সীমানা ছাড়িয়ে সোজা পাড়ি দিল রাজনীতির মহাকাশে। আর এইসময় বিজেপির দিকে ঝুঁকে থাকা অরবিন্দ কেজরিওয়াল টুঁ শব্দটি করছেন না। তিনি তো বলতেই পারতেন যে নিজে পড়াশোনায় ভালো হওয়ার সুবাদে মেধাবী পড়ুয়াদের মনস্তত্ব তিনি বোঝেন। সেই অনুযায়ী সঠিক মতামত পেশ করতে পারতেন বিরোধীদের আলোচনায়। কিন্তু রাজনীতির দায় অনেক বেশি। তাই ভুগতে হবে পড়ুয়াদেরই।

তবে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্যে একটা অঙ্ক পরিষ্কার। একেবারেই পরীক্ষা হবে না এমনটা নয়। ফলে রাত জেগে এবং দাঁত চেপে পড়াশোনা চালিয়ে যেতেই হবে। ফিজিক্সের অঙ্ক কষতে কষতে রাত ভোর হয়ে গেলে চোখে দিতেই হবে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা। মনে রাখতে হবে যে সকলের ক্ষেত্রেই সমস্যা একই। পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে সবার কমবেশি অসুবিধে হবে। পরীক্ষাসূচী বদল হবে বারবার। সেটাও সকলেরই সমস্যা। অর্থাৎ এইসময় প্রত্যেককে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে দেশের রাজনীতি এবং আইনব্যবস্থার দিকে। পড়াশোনার অঙ্ক কষে তো আর পরীক্ষার দিন ঠিক হবে না, সেটা যারা নির্ধারণ করবেন তাঁদের বেশিরভাগই ছাত্রজীবনে খুব বেশি পড়াশোনার সময় পান নি। তবে ঠিক যেমন মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়া খুব শক্ত হলেও আমাদের দেশে সেই পদ সবসময়েই কেউ না কেউ আলো করে থাকেন, তেমনই যখন যেভাবেই পরীক্ষা হোক না কেন, কেউ না কেউ অমূল্য এক লক্ষ সরকারি আসনে ভর্তির সুযোগ পাবেই। সেই বিচারেও প্রত্যকেবারের মতই এবারও কিছুটা ঠিক আর কিছুটা ভুল থাকবে। যারা সুযোগ পাবে না, শেষমেশ তাদের ঝুঁকতেই হবে বেসরকারি ব্যবস্থার দিকে। সেখান থেকে পাশ করেও অনেকে ভবিষ্যতে যথেষ্ট সফল হয়। যারা বেসরকারি জায়গায় ভর্তি হয়ে পরে সরকারি আসনে সুযোগ পাবে তাদের গচ্চা যাবে বেশ কিছুটা টাকা। সে ক্ষতিও একেবারেই মামুলি। সব মিলিয়ে উচ্চতম ন্যায়ালয়ের একটি যুক্তি প্রণিধানযোগ্য যে মহামারীর জন্যে জীবন থেমে থাকতে পারে না। ফলে আজ না হোক কাল পরীক্ষা হতেই হবে সেই দাবিটা কিন্তু জারি থাকা প্রয়োজন। তা না হলে একটা বছরে নষ্ট হবে এক লক্ষ অতি মূল্যবান মানব সম্পদ, আমাদের সরকারি ব্যবস্থায় সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আরাধ্য ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং আর বিজ্ঞানের আসন। রাজনীতির গোলমালে তিন ছক্কায় আসন না পচে যায় সেই দিকে নজর রাখছেন সবথেকে নামী সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তারাও। উচ্চতম ন্যায়ালয়ের সম্মানীয় বিচারকেরা নিশ্চয় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি তাঁদের কথাও শুনবেন। আর সবশেষে আবার মনে করিয়ে দিতে হবে শিক্ষার বাজেটের কথা। বেসরকারি মুনাফা অর্জনের পণ্য আজকের ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর আসন। বন্ধুত্বপূর্ণ ধনতন্ত্রে সেটাই দস্তুর।