আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

প্রবন্ধ

ভারত-চিন-ইরানঃ নতুন সমীকরণ

পলাশ বরন পাল


সম্প্রতি চাবাহার-জাবেদিন রেলপ্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ইরান। ২০১৬ সালে তেহরান সফরে গিয়ে ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এই রেলপথ নির্মাণের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ঘটনাটি সামনে এল ইরান সরকার কর্তৃক সিনো-ইরানিয়ান কম্প্রিহেনসিভ স্ট্রাটেজিক পার্টনারশিপ চুক্তি অনুমোদনের পরপরই। চুক্তিতে বলা হয়েছে, আগামী পঁচিশ বছরের মেয়াদে ইরানের পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র, ব্যাঙ্কিং, টেলিকম, রেল, বন্দর ও বিমানবন্দর সহ প্রায় শতাধিক প্রকল্পে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে বেইজিং। স্বাভাবিক ভাবেই, এই ঘটনায় চোখে সর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছেন সাউথ ব্লকের কর্মকর্তরা।

ভারত মহাসাগরের ওমান সাগরের তীরে অবস্থিত চাবাহার বন্দরটি পাকিস্তানের গ্বদর বন্দরের প্রতিস্পর্ধী। ইসলামাবাদ বন্দরটিকে কার্যত চিনের হাতে তুলে দিয়েছে। তাই চাবাহারের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে থাকার অর্থ, কৌশলগত লড়াইয়ে বেইজিং-এর গতিবিধিকে নজেরে রাখা। এই বন্দরের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানকে এড়িয়ে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করার সুবিধা রয়েছে। এই বহুমুখী উদ্দেশকে সামনে রেখেই গত কয়েক বছরে চাবাহার প্রকল্পটির পিছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বন্দর ও রেলে চিনের বিরাট অঙ্কের বিনিয়োগের ফলে বাণিজ্য ও কৌশলগত লড়াইয়ে ভারতের তুলনায় এখন এ্যাডভান্টেজ পাবে চিন। তেহরানে বেইজিং-এর সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনাও সাউথ ব্লকের মাথা ব্যাথার আর একটি কারণ। কেননা, চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া, যৌথ গবেষণা ও অস্ত্র উন্নয়ন, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ছাড়াও ইরানের সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে।

ইরান শি চিনফিং এর উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বিআরআই-এর অংশীদার। তেহরান-বেইজিং অংশীদারি চুক্তিটিও সম্পন্ন হয়েছে বিআরআই-এর অধীনে। তাই তেহরান ও চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত সড়ক পথ যুক্ত হবে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে। এই করিডোরটি আবার নতুন সিল্ক রোডের অংশ, যা কাজাকস্তান, কিরগিস্তান, উজবেকিস্তান তুরস্ক হয়ে শেষ পর্যন্ত যুক্ত করবে ইউরোপকে। ফলে চাবাহার বন্দরকে ঘিরে ভারতের যাবতীয় বাণিজ্যিক উদ্যোগ, বিশেষত ইউরোপে পৌঁছানোর সুদূরপ্রয়াসী পরিকল্পনাও ধাক্কা তে খাবেই। সেই সঙ্গে বেইজিং-এর মধ্যস্থতায় বদলে যেতে পারে তেহরান ও ইসলামাবাদের সম্পর্কের সমীকরণ। ইসলামিক গোষ্ঠীর দেশ হলেও বহুদিন ধরেই দেশ দুটির সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। এটা নয়াদিল্লির পক্ষে প্রকৃত অর্থেই বাড়তি উদ্বেগের কারণ হবে।

আবার, ইরানের অবস্থান হরমুজ প্রণালীর উত্তর উপকূলে, এবং এই পথ দিয়েই পৃথিবীর সিংহ ভাগ তেল আমদানি হয়। অঞ্চলটির ওপর তেহরানের অল্প হলেও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিনের আগমনের ফলে এখানে আঞ্চলিক ভারসাম্যের বদল ঘটবে। চিন-ভারত দ্বৈরথ যেহেতু একটি বাস্তব ঘটনা, ভারতকে বিপাকে ফেলতে বেইজিং মাঝে মধ্যেই নানা জটিলতা তৈরি করে। কূটনীতিকদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে চিন-ভারত দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে এখানেও ভারতের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে বেইজিং। অন্যদিকে চিন কিন্তু এই চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তার ‘মালাক্কা ডিলেমা’ অনেকটাই কাটিয়ে উঠবে। জ্বালানীর জন্য মালাক্কা প্রণালীর ওপর বেইজিং-এর যে নির্ভরতা, সেটাই মালাক্কা ডিলেমা নামে পরিচিত।

ইসলামি বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত ইরানের পররাষ্ট্র নীতির মূলমন্ত্র ছিল ‘পূর্ব নয়, পশ্চিমও না’। অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম, উভয়ের সঙ্গে সম-দূরত্বের নীতি এবং উভয়কে সম-গুরুত্বের নীতি। এখন প্রশ্ন হল, ইরান এতদিনের ঐতিহ্য ভেঙে হঠাৎ করে চিনের সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ হল কেন? কেনই বা চাবাহার প্রকল্পকে ঘিরে বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও সেখানে ভারতের ভূমিকাকে এত লঘু করে তুলল?

এর উত্তরে অনেকেই ইরানের শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলেছেন। ঠিকই। ২০১৫ সালে, বারাক ওবামার উদ্যোগে, ইরান ও ছয় জাতির (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চিন ও রাশিয়া) মধ্যে সম্পাদিত পরমানু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের একতরফাভাবে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার ও তেহরানের ওপরে চাপানো আর্থিক অবরোধের কারণে দেশটির অর্থব্যবস্থা এই মুহূর্তে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা মেনে ভারত-সহ বেশির ভাগ রাষ্ট্রই ইরান থেকে তেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছে বা পুরোপুরি বন্ধ করেছে। তাই এই সঙ্কট থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ইরানের প্রয়োজন ছিল একটি বড়সড় আর্থিক বিনিয়োগ। চিন সে প্রত্যাশা পূর্ণ করেছে। তবে এটাই সব নয়, চিন-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ এবং চিন ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সহযোগিতার ইতিহাসও চুক্তির পক্ষে অনুঘটকের কাজ করেছে।

অতীতে পশ্চিমা দুনিয়া, বিশেষত আমেরিকা যখনই ইরানের ওপর খড়্গহস্ত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই চিন ছিল প্রধান পরিত্রাতা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮, দীর্ঘ আট বছরের (প্রথম) উপসাগরীয় যুদ্ধের (ইরাক-ইরান যুদ্ধ) সময় ইরানের সামরিক সরঞ্জামের অন্যতম উৎস ছিল চিন। একই ভাবে, ২০০৬ সালে, পরমানু কর্মসূচীর প্রশ্নে জাতিপুঞ্জ যখন ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে, ভারত, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পৃক্ততা কমালেও চিন কিন্তু তেহরানে উপস্থিত জোরদার করেছিল। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ঘুর পথে তেল আমদানি করে তেহরানের অর্থব্যবস্থাকে সচল রাখে বেইজিং। বর্তমানে ইরানের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশীদার হল চিন।

শুরুর দিকে অবশ্য বিআরআই প্রকল্প নিয়ে ইরান কিছুটা সন্দিহান ছিল। ইরানকে কেন্দ্র করে চিনের মধ্য এশিয়াকে দক্ষিণ ককেশাস ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনাকে ভালো চোখে দেখেনি। এতে করে মধ্য এশিয়ায় ইরানের প্রভাব খর্ব হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বেইজিং-এর ঋণের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত ছিল তেহরান। তবে শেষ পর্যন্ত দেশের অর্থনীতির কথা ভেবেই ইরানকে কিছুটা আপোষ করতে হয়। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল, কয়েকদফা আলোচনার পরেই উভয়ের মধ্যে চুক্তির শর্তগুলি স্থির হয়।

ভারত ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্কও বহু প্রাচীন, এবছরই তা ৭০ বছর পূর্ণ করেছে। ইসলামিক গোষ্ঠীর (ওআইসি) মধ্যে এই দেশটিকে কখনও পাকিস্তানপন্থী অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। কাশ্মীর প্রসঙ্গেও ভারত-বিরোধী বক্তব্য থেকে দূরে সচরাচর। যদিও বা কখনও করেছে, তা ওপর ওপর, অন্য ইসলামিক দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার তাগিদে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠতা এবং ঘরোয়া রাজনীতিতে মোদীর হিন্দুত্ববাদী নীতি ইরানকে ক্ষুব্ধ করে। বিশেষত, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘মুসলমানদের প্রধান শত্রু’ হিসাবে বিবেচনা করার রাজনীতি, তেহরান ও নয়াদিল্লির সম্পর্কে বড়সড় ফাঁটল ধরায়।

চলতি বছরের মার্চ মাসে, ট্রাম্পের ভারত সফরের পরপরই, দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসাকে ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হিংসা’ বলে বিবৃতি দেন ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভেজ জাফরি। দিন কয়েকের ব্যবধানে প্রায় একই ভাবে টুইটারে তোপ দাগেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতোল্লা খামেনি - ‘ভারত সরকারের উচিত চরমপন্থী হিন্দুদের মোকাবিলা করা। ইসলামি দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না চাইলে ভারত এই অত্যাচার বন্ধ করুক’। জম্বু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের পরে, নয়াদিল্লিকে সতর্ক করে একই ভাবে ক্ষোভ জানিয়েছিলেন, ভারতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত। বলেছিলেন, কাশ্মীরের মানুষ যাতে ন্যায়বিচার পায়, সেটা ভারতকে নিশ্চিত করতে হবে।

একথা ঠিকই যে, ভারতের কথা ভেবেই চাবাহার বন্দরকে নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখে ট্রাম্প প্রশাসন। ভারতও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মেনে ইরান থেকে তেল আমদানি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনে। কিন্তু চাবাহার বন্দরকে নিষেধাজ্ঞা থেকে ছাড় দিলেও ওয়াশিংটন তেহরানকে এমনভাবে অবরোধের জালে জড়িয়ে ফেলে যে, তা ভেদ করে চাবাহার প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়া ভারত ও ইরান উভয়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ইরান রেলপথ নির্মাণের বরাত দিয়েছিল সামরিক বাহিনীর শাখা ইসলামি রেভুলিউশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি)-এর একটি সংস্থা খাতাম আল-আনবিয়াকে। কিন্তু ২০১৮ সালে সংস্থাটিকে (আইআরজিসি) ফরেন টেরোরিস্ট অর্গানাইজেশন (এফটিও)-এর তালিকাভূক্ত করে এবং তার ওপর ‘সেকেন্ডারি স্যাংশন’ জারি করে হোয়াইট হাউস। অর্থাৎ, এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হলেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে আসত ভারতের ওপর।

চিন ভারতের অন্যতম প্রতিপক্ষ সন্দেহ নেই। কৌশলগত লড়াই হোক বা বাণিজ্যিক, ভারতকে কোণঠাসা করতে এখন সে বেপরোয়া। তাই নয়াদিল্লির এখন প্রয়োজন বহুপক্ষীয় জোটের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু তার পরিবর্তে, শুধুমাত্র চিনকে প্রতিরোধের তাড়নায়, নরেন্দ্র মোদী যেভাবে ট্রাম্পের কাঁধে ভর করেছেন, এবং ভারতের স্বার্থকে আমেরিকার স্বার্থের সঙ্গে এক আসনে স্থান দিয়েছেন, তাতে ভারতের মঙ্গলের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।

পাশাপাশি, বিভাজনের রাজনীতি শুধুমাত্র দেশের গণতন্ত্রের ভিতকে দুর্বল করে তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও মুখ পোড়াতে হয়। পূর্বে এনআরসি নিয়ে অমিত শাহের একের পর এক বাংলাদেশ-বিরোধী বিবৃতি, ঢাকাকে ক্ষুব্ধ করেছে। ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এখন ঝুলছে সরু সূতোর ওপর। এবারে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্য এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু ইরান। মোদী-অমিত শাহের শাসনে ভারতের আর কী কী হারাতে হবে, এখন সেটাই দেখার অপেক্ষা।