আরেক রকম ● অষ্টম বর্ষ একাদশ সংখ্যা ● ১৬-৩১ আগস্ট, ২০২০ ● ১-১৫ ভাদ্র, ১৪২৭

সমসাময়িক

যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রা


করোনা-কালে মানুষ নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। রোজ করোনা সংক্রমণ কত বাড়ল, কতজনের মৃত্যু হল, সংক্রমিত হলে হাসপাতালে জায়গা হবে কি না, এইরূপ বিবিধ আতঙ্কে মানুষ যখন ব্যতিব্যস্ত ভারতের সরকার দ্বারা ঘোষিত কিছু গুরুতর পদক্ষেপ আমাদের মোদী পদলেহনকারী মিডিয়ার বদান্যতায় গণপরিসরে স্থান পাচ্ছে না। যেমন, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সচিব শ্রী অজয় ভুষণ পাণ্ডে সংসদীয় কমিটির সভায় বলেছেন ২০২০-২১ সালে জিএসটি সংগ্রহে রাজ্য সরকারগুলির যেই ঘাটতি হবে তা কেন্দ্রীয় সরকার পূরণ করবে না।

কথাটি আপাত যুক্তিগ্রাহ্য বলে অনেকের মনে হতে পারে। দেশে কোভিড ও লকডাউনের ফলে ভয়াবহ মন্দার ছায়া। কর সংগ্রহ কমেছে। ২০১৯ সালে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসে মোট জিএসটি কর সংগ্রহ হয়েছিল ৪১৬১৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে এই একই সময়ে জিএসটি কর সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ২৭২৬৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৪ মাসে ঘাটতির পরিমাণ ১৪৩৫১৩ কোটি টাকা। আগামীদিনে এই ঘাটতির মাত্রা আরও বাড়বে, এমন অনুমান করা অমূলক নয়। এহেন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে রাজ্যের জিএসটি সংগ্রহের ঘাটতি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্যাপারটি এত সোজা হলে এই প্রতিবেদন লেখার কোনো দরকার পড়ত না। আসুন আরেকটু গভীরে গিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করা যাক।

২০১৬ সালের আগস্ট মাসে অনেক বাগাড়ম্বর করে জিএসটি-কে ভারতের রাজস্ব ব্যবস্থার এক নতুন অঙ্গ হিসেবে সংসদে পাস করায় কেন্দ্রীয় সরকার। এক দেশ, এক বাজার, এক কর - এই ছিল স্লোগান। কিন্তু গোড়াতেই সমস্যা ছিল। পণ্যের বিক্রয়ের উপর কর সংগ্রহের এক্তিয়ার ভারতের সংবিধান অনুযায়ী ন্যস্ত ছিল রাজ্য সরকারগুলির হাতে। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য এই ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন রাজ্য সরকার তার রাজনৈতিক মত ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিক্রয় করের হার নির্ণয় করতে পারত। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে গোটা দেশে একই কর ব্যবস্থা চালু করার পরিকল্পনা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরোধী ছিল যেখানে পণ্য বিক্রয়ের উপর কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে রাজ্যের অধিকারকে সরাসরি খর্ব করা হয়। কিন্তু তবু বাম, ডান, মধ্যপন্থী নির্বিশেষে সমস্ত রাজ্য সরকার এই জিএসটি-র প্রবর্তনকে মেনে নেয় কেন?

এর দুটি কারণ এখানে উল্লেখযোগ্য। প্রথম, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছিল যে জিএসটি প্রবর্তিত হলে রাজ্য সরকারগুলির মোট কর সংগ্রহ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলির কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় যে প্রথম পাঁচ বছর যদি ২০১৫-১৬ সালের নিরিখে কর সংগ্রহের বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশের কম হয়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঘাটতি পূরণ করবে। এই বাবদ জিএসটি-র মধ্যেই একটি সেস সংগ্রহ করা শুরু হয়। একদিকে কেন্দ্রে বিজেপি-র প্রবল সংখ্যাধিক্য নিয়ে সরকার গঠন, অন্যদিকে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতির ফলে রাজ্য সরকারগুলি জিএসটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিশেষ প্রতিবাদ না করে তাতে সম্মতি দিল। কিন্তু ৪ বছর কাটতে না কাটতেই দেখা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে দেওয়া ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি মানতে পারবে না বলে সরাসরি ঘোষণা করেছে।

করোনা-র প্রকোপে রাজ্য সরকারগুলির ভাঁড়ার প্রায় শূন্য, অথচ স্বাস্থ্যখাতে অধিকাংশ খরচ করছে রাজ্য সরকার। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার যদি রাজ্যের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে অস্বীকার করে তাহলে সমস্ত রাজ্য সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে, আরো বেশি করে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়বে। ঋণের প্রশ্নে আমরা ফিরব। তার আগে একটি ভুল ধারণাকে খণ্ডন করা জরুরি।

অনেকে বলছেন, করোনা-র এই আপৎকালীন সময়, যেখানে দেশের অর্থব্যবস্থা ধসে পড়েছে সেখানে না হয় এক বছর রাজ্য সরকারগুলি ক্ষতিপূরণ পেল না। আবার যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তখন ক্ষতিপূরণের টাকা রাজ্যগুলি পেয়ে যাবে। কিন্তু কথাটি ঠিক নয় দুটি কারণে। একটি আমরা প্রথমেই বলেছি যে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে, যা স্পষ্টতই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু দ্বিতীয় এবং অধিক গুরুতর একটি কারণ আছে। ২০১৯-২০ সালে, যখন কোনো কোভিড মহামারীর নামও কেউ শোনেনি, তখনও রাজ্য সরকারগুলির মোট ক্ষতিপূরণের পরিমাণ গণনা করা হয়েছিল ১.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতিপূরণ বাবদ সেসের সংগৃহীত পরিমাণ হয় মাত্র ৯৫৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারগুলি ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য টাকা থেকে ৭০০০০ কোটি টাকা কম রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব হয় ক্ষতিপূরণ সেসের মাধ্যমে। কিন্তু ২০১৯-২০ সালের শুরুতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ক্ষতিপূরণ বাবদ সেস সংগ্রহের তহবিলে ৪৫০০০ কোটি টাকা উদ্‌বৃত্ত ছিল। তবু ক্ষতিপূরণের টাকার ঘাটতি ঢাকতে কেন্দ্রীয় সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৩৪১২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ তহবিলে স্থানান্তরিত করে, রাজ্য সরকারগুলিকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে ক্ষতিপূরণ তহবিল শূন্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ ধাক্কা খাওয়ায় ক্ষতিপূরণ তহবিলে কোনো টাকা দেওয়া হবে না বলেই অনুমান। তাই অর্থসচিব বলছেন যে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না।

কিন্তু ২০১৯-২০ সালের হিসেব বলছে জিএসটি রাজস্ব সংগ্রহ এবং ক্ষতিপূরণ তহবিল সংক্রান্ত সমস্যার জন্ম কোভিড অতিমারির আগেই হয়েছে। আমরা যদি জিএসটি কর ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর থেকে রাজস্ব সংগ্রহের তথ্যের দিকে তাকাই তাহলে চিত্রটা পরিষ্কার হবে। জুলাই ২০১৭ সালে জিএসটি ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু এপ্রিল ২০১৮, অর্থাৎ ৯ মাস পরে প্রথমবার মোট রাজস্ব সংগ্রহ ১ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করে। কিন্তু জুলাই ২০১৭ থেকে মার্চ ২০২০, এই ৩৩ মাসের মধ্যে মাত্র ৯টি মাসে জিএসটি বাবদ রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকার মাত্রা অতিক্রম করে। যেখানে রাজ্য সরকারগুলিকে বোঝানো হয়েছিল যে রাজস্ব সংগ্রহের বৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশ হবে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের মধ্যে জিএসটি রাজস্বের বৃদ্ধির হার ছিল মোট ৩.৮ শতাংশ। বোঝাই যাচ্ছে মোদী সরকারের বাকি সমস্ত ঘোষণার মতই জিএসটি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে বর্তমান জিএসটি কর সংগ্রহ। এই ঘাটতির বোঝা অন্যায়ভাবে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলির উপর চাপাতে চাইছে। বিভিন্ন রাজ্য সরকার এখন প্রতিবাদ করছে ঠিকই। কিন্তু জিএসটি কর ব্যবস্থা যে আসলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে এই কথা তারা বছর তিনেক আগে বিস্মৃত হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, কেন্দ্র রাজ্য আর্থিক সম্পর্কের মতন বিষয়গুলি ভারতের রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে হারিয়ে গেছে। মোদী সরকার সেই সুযোগে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিচ্ছে নিজের হাতে, রাজ্যগুলিকে বাধ্য করছে কেন্দ্রীয় সরকারের পছন্দের নীতি গ্রহণ করতে। বিরোধীরা যথারীতি চুপ করে বসে আছে অথবা টুইট করছে। কিন্তু কোনো জোরালো প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না। জিএসটি এই প্রবণতার একটি উদাহরণ, অপর উদাহরণটি রাজ্য সরকারগুলির ঋণ সংক্রান্ত।

২০০৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার একটি আইন প্রনয়ণ করে যেখানে বলা হয় যে মোট বাজেট ঘাটতি বা বাজার থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৩ শতাংশের বেশি করা যাবে না। রাজ্য সরকারগুলিও অনুরূপ আইন লাগু করে। কিন্তু কোভিডের ফলে, জিএসটি রাজস্ব সহ সমস্ত রাজস্বে ঘাটতি, ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়া, মন্দাবস্থার কারণে রাজ্য সরকারগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানায় ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর অনুমতি দিতে। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে রাজ্য সরকারগুলি তাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫ শতাংশ অব্দি ঋণ নিতে পারবে। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা ২ শতাংশ বিন্দু বাড়ানো হয়।

প্রবল ঢক্কানিনাদসহ বিজেপি এই নীতির প্রচার করে কিন্তু আসল কথাটি যথারীতি চেপে যায়। এই ২ শতাংশ বিন্দুর মধ্যে মাত্র ০.৫ শতাংশ বিন্দু বাড়তি ঋণ রাজ্যগুলি নিতে পারবে বিনা শর্তে। বাকি ১.৫ শতাংশ বিন্দু বাড়তি ঋণ নিতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলত চারটি শর্ত মানতে হবে। প্রথমত, এক দেশ এক রেশন কার্ড নীতি রাজ্যে বাস্তবায়িত করতে হবে, ease of doing business এর মাপকাঠিতে রাজ্যের স্থান বাড়াতে হবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণ করতে হবে এবং শহরের পুরসভায় বিভিন্ন কর বসিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য সংকট এবং আর্থিক সংকট সমস্ত রাজ্যকেই বিপদে ফেলেছে। কিন্তু তবু কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে রাজ্যগুলিকে বাধ্য করতে চাইছে বিজেপি-র অর্থনৈতিক এজেন্ডাকে যেনতেনপ্রকারেণ বাস্তবায়িত করতে। আবারও বেশ কিছু রাজ্য সরকার প্রতিবাদ করলেও, কোনো বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ল না।

ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভারতের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আক্রমণ প্রথম নয়। কিন্তু মোদী সরকার এক ধাক্কায় এই কাঠামোকে ধ্বংস করে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করতে চাইছে। অবিলম্বে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে, ভারতের সংবিধানের আরো একটি স্তম্ভ ধ্বংস হবে যার নাম যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো।