আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ অষ্টম সংখ্যা ● ১৬-৩০ এপ্রিল, ২০২৪ ● ১-১৫ বৈশাখ, ১৪৩১

প্রবন্ধ

আমার দুই স্বপ্ন

অমিয় দেব


।। ১ ।।

ন-দশ বছর বয়েসে নেতাজির “Give me blood, I promise you freedom” লেখা ছবি দেখেছি। ওই সময়েই বড়দের সঙ্গে থেকে এক গোপন রেডিয়োতে তাঁর গলাও একটু শুনেছি। বোধকরি ব্রহ্মদেশ থেকে তাঁর দেশবাসীদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন। আর আজ, আমার নব্বই পূর্তির দিনকয় আগে হঠাৎ তাঁকে স্বপ্নে দেখলাম। ঠিক নেতাজির চেহারায় নয়, সুভাষচন্দ্র বসুর চেহারায়। আমার জেল খাটা, জেলে-লাঠি-খাওয়া কমিউনিস্ট দাদা (বারো বছর প্রয়াত) এক রাজনৈতিক সভায় যাচ্ছেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে। আমি বললাম, দাঁড়াও ওঁকে জিজ্ঞেস করে আসি, উনিও হয়তো যাবেন। সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি স্মিতভাবে বললেন, হ্যাঁ যাবেন। - স্বপ্ন ভেঙে গেল।

স্বপ্ন ভেঙে যায়, তবে স্বপ্ন যে দেখি তার একটা হেতু থাকে। স্বপ্ন বানায় আমারই অচেতন মন। অর্থাৎ আমার চেতন মন না জানলেও আমার স্বপ্নের কর্তা আমিই। মনে আছে একবার মনোচিকিৎসক মৃণাল বড়ুয়ার কাছে স্বপ্ন নিয়ে জানতে গিয়েছিলাম। আমি তখন হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর প্রতিবেশী। প্রসঙ্গ ছিল আমার এক দাদার দেখা একটি স্বপ্ন যা তিনি আমাকে লিখে পাঠিয়েছিলেন। মৃণাল বড়ুয়া তখন লুম্বিনীতে - সেই ‘লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল’ যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত মনঃসমীক্ষক গিরীন্দ্রশেখর বসু। আর যার জমি দান করেছিলেন গিরীন্দ্রশেখর বসুর দাদা ‘পরশুরাম’ রাজশেখর বসু। ঠিক কী বলেছিলেন মৃণাল বড়ুয়া তা এখন পুরো মনে পড়ছে না। তবে ফ্রয়েডের ইচ্ছাপূরণ তত্ত্বের কথা তুলেছিলেন। অবদমিত বা রুদ্ধ ইচ্ছা কী করে স্বপ্নে প্রতীক মারফত পরিতৃপ্ত হয়ে ওঠে, সেই তত্ত্ব। এই ইচ্ছা ফ্রয়েডে মুখ্যত কামজ। কিন্তু মৃণাল বড়ুয়া কি তাঁর মনোবিদ্যার গুরু বা গুরুপ্রতিম গিরীন্দ্রশেখর বসুর যুগ্ম তথা বিপরীত ইচ্ছা-তত্ত্বের কথা তোলেননি, যিনি ফ্রয়েডীয় হয়েও ফ্রয়েড থেকে কোথাও কোথাও আলাদা, আর যাঁর গ্রন্থ ‘স্বপ্ন’ এখন ক্লাসিক?

সম্প্রতি সেই ক্লাসিককে আড়াল থেকে বের করে এনেছেন কলেজ রো-র প্রকাশক 'পত্রলেখা'। তাঁদের বদান্যতায় তা পড়বারও আমার সুযোগ হয়েছে। তবে গিরীন্দ্রশেখরের মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির অনুকরণ আমার মতো অবিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয়। আমার এই স্বপ্ন আমি যেভাবে বুঝেছি তা বলবার চেষ্টা করছি। ব্রিটিশ-রাজের কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করার যে-পন্থা সুভাষচন্দ্র শেষ পর্যন্ত নিয়েছিলেন তা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেনি। কারণ আগ্রাসী জাপানের হাত থেকে ভারতকে বাঁচানো সেই মুহূর্তে পার্টির কাছে বেশি জরুরি মনে হয়েছিল। ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকার সঙ্গে ‘বজ্রকন্ঠে তোলো আওয়াজ,/ রুখবো দস্যুদলকে আজ/ দেবে না জাপানী উড়োজাহাজ/ ভারত ছুঁড়ে স্বরাজ’-এর যোগ বোধ করি মানতেই হয়। কিন্তু “Give me blood, I promise you freedom”-এর টান কি সেই বাল্যেই মিলিয়ে গিয়েছিল, নাকি এক ‘রুদ্ধ’ ভক্তির চেহারায় আত্মগোপন করে ছিল? তবে একসময়, বাল্য থেকে কৈশোরে পা দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত ছাত্র ফেডারেশনে ঝুঁকি। আর ততদিনে আমার সেজদা পার্টিতে। ইতিমধ্যে, তাইহোকুতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সত্যিই মৃত্যু হয়েছিল কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। বোধকরি তাঁকে যে আমরা মরতে দিতে চাই না, তারই প্রমাণ হিসেবে এক পুরাণ গড়ে ওঠে তাঁকে নিয়ে। তাঁকে কেউ রুশদেশে খুঁজে পান, কেউ তাঁকে দেখেন সাধুবাবার চেহারায়। অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর পুণরুদয়ের অপেক্ষা চলে জনমানসে। সেই সঙ্গে তাঁর ‘জয় হিন্দ’ মন্ত্র হতে থাকে উদ্দীপিত ও তাঁর দেশনায়ক মূর্তি হয় প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি প্রদীপ ঘোষের এক প্রবন্ধে একই বাক্যে জন্মস্থান হিসেবে কটকের এক ঘর ও পোরবন্দরের এক একতলার উল্লেখ পেলাম। গান্ধী নিয়ে একটু-আধটু লিখে থাকলেও সুভাষচন্দ্র নিয়ে কিছু লিখিনি, তাই হয়তো সেই বাল্যের ‘রুদ্ধ’ ভক্তি স্বপ্ন দেখাল। ইচ্ছাপূরণ? তবে এক অনুষঙ্গও কি তাতে দেখছি? আমার কমিউনিস্ট দাদার মনে সুভাষচন্দ্র অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামীপ্য ঘটিয়ে কি এক অন্য ইচ্ছা আমি পূরণ করছি? উপায় নিরপেক্ষ উদ্দেশ্যের গুরুত্ব বুঝতে চাইছি? ব্রিটিশ বিতাড়নই যে সুভাষচন্দ্রের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তা নিয়ে কি সন্দেহের কোনো অবকাশ আছে? মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিন বুকে নিয়ে, ব্রিটিশের রেখে যাওয়া জেলে পুলিশের লাঠিতে মেরুদণ্ডের ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর দীর্ঘ ও নিদারুণ প্রক্রিয়া পেরিয়ে এসে, মতবাদের রূঢ়তায় ততটা নয় যতটা মতবাদের অন্তরতম মনুষত্বে বিশ্বাসী, আমার দাদা কি সুভাষচন্দ্রে প্রত্যয়ী হয়ে উঠবেন না?

।। ২ ।।

আজ ১৯ মার্চ, ২০২৪, ভোরে স্বপ্নে দেখলাম সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। কী একটা কোথাও যেন হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তাঁর বন্ধু সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে। তাঁকে কি আমি কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম?

সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আমি কখনও সুধীন্দ্রনাথের রাসেল স্ট্রিটে দেখিনি। অথচ তাঁরা যে একসময় খুব নিকট ছিলেন তা জানতাম। তাঁকে সুধীন্দ্রনাথ তাঁর দ্বিতীয় ও প্রথম মুখ্য কাব্যগ্রন্থ ‘অর্কেস্ট্রা’ উৎসর্গ করেছিলেন। আর তিনি যখন বিশ্বভারতীতে উপাচার্য এবং সুধীন ঘোষ-রামকিংকর ব্যাপারটা সেখানে ঘটে, ও তা নিয়ে হইচই হয়, তখন মনে আছে সুধীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আমি যদি সত্যেন হতুম তাহলে সুধীন ঘোষকে আনতুম না। (বিলেতপ্রবাসী ইঙ্গ-ভারতীয় লেখক সুধীন্দ্রনাথ, তথা সুধীন, ঘোষকে বিশ্বভারতীতে ইংরেজির অধ্যাপক করে এনেছিলেন সত্যন্দ্রনাথ বসুই।) কথাটা কানে লেগে আছে। আর তারপর যখন ১৯৬০-এর ২৫ জুন সুধীন্দ্রনাথের মরদেহ নিয়ে শোকমিছিল কেওড়াতলা যাচ্ছে তখন, যদুবাবুর বাজারের কাছে, এক অস্টিন এসে দাঁড়াল ও গাড়ি থেকে নেমে সত্যন্দ্রনাথ বললেন, তোমরা একটু সুধীনকে নামাও, আমি একবার ওকে দেখি।

সম্প্রতি ২০২৩-এর শারদীয় ‘অনুষ্টুপ’-এ বন্ধু রেবা সরকারকে লেখা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের আটান্নখানা চিঠি ছাপা হয়েছে। এই পত্রগুচ্ছের কথা একেবারেই জানতাম না। খুবই ব্যক্তিগত ও স্বীকারোক্তি সংবলিত। তাদের কালক্রম ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৪। প্রথম দিকের কয়েকটি চিঠিতে ‘সত্যেন’-এর কথা এসেছে বারবার, বন্ধুবৎসল। শেষদিকে আর নেই (অন্য এক বন্ধু ‘ধূর্জটি’-র কথা অবশ্য আছে অনেক)। একটা দূরত্ব কি ঘনিয়ে আসছিল? আর দূরত্বের কারণ কি স্ত্রী ছবির (সত্যেন্দ্রনাথের আত্মীয়াও) সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান মানসিক দূরত্ব? এবং স্বপ্নে কি আমি সুধীন্দ্রজীবনের যে-তথ্যাবলি একদা সংগ্রহ করেছিলাম, তার ভিত্তিতে সত্যেন্দ্রনাথকে এই মানসিক কারণ বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম? বলছিলেম যে ছবি-সুধীন্দ্রর এই (ঈর্ষাজনিত?) দাম্পত্যসংকট বুঝি-বা ঘোচবার ছিল না; যে, তাঁর সঙ্গে শেষপর্যন্ত বসবাস না করলেও ছবি যে তাঁর স্ত্রী তা সুধীন্দ্রনাথ কখনও অস্বীকার করেননি; যে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শৌরীন্দ্রনাথকে - যাঁকে তাঁর ‘পাওয়ার অব এ্যাটর্নি’ দেওয়া ছিল - একটা শিলমোহর করা খাম দিয়ে সুধীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর যদি ছবি কোনো ব্যবহারিক সমস্যা করেন তাহলে যেন খামটা খুলে তাঁকে দেখানো হয় (খামে কী লেখা তাঁর ছিল তা ছবি জানতেন, এবং জানতেন কি আর কেউ?), তবে খামটা খোলার কোনো দরকার হয়নি এবং ছবির মৃত্যুর কিছুদিন পর তা নষ্ট করেও ফেলা হয়? বলছিলাম যে সুধীন্দ্রনাথ - রাজেশ্বরীর প্রেম ও বিবাহ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, এবং উল্লিখিত দাম্পত্য সংকটের সঙ্গে তার কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক ছিল না? বলছিলাম সেই স্নেহের আকর মানুষটিকে যিনি একবার তাঁর ঢাকার রাণু ও ঢাকার বুদ্ধদেবের ১০২, রাসবিহারী এভিনিউ-এর বাড়িতে এসে এক অনর্থকারী মামলা থেকে নিবৃত্ত করেন তাঁর ওই ভ্রাতৃপ্রতিম লেখকটি ও তাঁকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচিয়ে দেন? রবীন্দ্রশতবর্ষের শেষের কথা। সাক্ষী আমি।