আরেক রকম ● নবম বর্ষ দ্বাবিংশ সংখ্যা ● ১৬-৩০ নভেম্বর, ২০২১ ● ১-১৫ অগ্রহায়ণ, ১৪২৮

পুনঃপাঠ

মার্কসবাদের কাছাকাছিও আমরা পৌঁছইনি

অশোক মিত্র


প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ডঃ অশোক মিত্রের বিষয়ে নতুন করে কোনো পরিচিতি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। মূল চর্চার বিষয় অর্থনীতি হলেও তাঁর মেধা ও মননের দীপ্তি ছড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক ও সমাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমানভাবে। পাশাপাশি, এ কথা না বললেও চলে তিনি একজন আপাদমস্তক কবিতামনস্ক মানুষ এবহং প্রবন্ধকার হিসেবে যে অনন্য গদ্যশিল্পের তার সাধনা, তার মধ্যে কবিতার বিভা ছড়িয়ে থাকে অনেকটা জুড়ে। কবিতার পাঠক হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র্য যেমন তিনি জানান দেন তাঁর গদ্যভাষায়, ঠিক তেমনই সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি বিষয়ে বিবেকী গদ্য তাঁকে চিনিয়ে দেয়। যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির অঙ্গনে তাঁকে আমরা দেখছি তখনও এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তাঁর অবস্থান, দলের ছত্রছায়া তাঁর ব্যক্তিত্বকে অন্তত নিষ্প্রভ করে দিতে পারেনি কখনও। বর্তমানে দলীয় পদ বা অন্যান্য সমস্ত ধরনের পদ থেকে তিনি অবসৃত কিন্তু চিন্তা ও চেতনার ক্ষেত্রে আপোসহীন তাঁর মানসিকতা, মূল্যবোধের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান দৃষ্টান্তস্বরূপ।

তবে কবিতা নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাইনি, কারণ ইদানীং সময়ের কবিতা নিয়ে তাঁর অবস্থান আমার অজানা ছিল না। আর এটাও আমি জানতাম রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ের আলোচনা-কথাবার্তায় তিনি স্বচ্ছন্দতর বোধ করেন, তাই নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া নানান জিজ্ঞাসা, যা হয়তো আরো অনেকেরও হতে পারে, জড়ো করে হাজির হয়েছিলাম তাঁর কাছে। নানা ধরনের লেখালেখির চাপে ব্যস্ত শ্রী মিত্র-র কাছে আবদার করে দু-ঘন্টা সময় পাওয়া গিয়েছিল। দু-ঘন্টা নেহাত কম সময় নয় অবশ্যই। কিন্তু বিধি বাম। মহালয়ার আগের দিনের দুপুরে গোটা কলকাতা জুড়ে পুজোবাজারের জ্যাম-জট ছাড়িয়ে ওঁর বাড়ি পৌঁছানো গেল নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক ঘন্টা পর। হাতে থাকা অবশিষ্ট সময়ে কথাবার্তা চলল নানা বিষয়ে। বলা বাহুল্য, এমন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপচারিতা হতে পারে প্রায় অন্তহীন, কিন্তু সে এক অবাস্তব প্রকল্প। সুতরাং যতটুকু আলোচনার পরিসর হতে পারে তারই মধ্যে নানা বিষয় ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে এই সাক্ষাৎকারে।

প্রবুদ্ধ বাগচী



• আচ্ছা, পশ্চিমবাংলায় উন্নয়ন শব্দটির অনুষঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রসঙ্গটি প্রায় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু উন্নয়ন ও পঞ্চায়েত কাঠামোর যে যুগলবন্দি, এর মধ্যে কি কোথাও একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছে না?

অ.মিঃ আমি অন্তত কোনো দ্বন্দ্ব দেখি না। কারণ, মুখ্য লক্ষ্য হচ্ছে উন্নয়ন, গ্রামের চেহারা পাল্টানো, গ্রামের মানুষগুলিকে নতুন জীবনের স্বাদ দেওয়া। এবং যেটা বলা হচ্ছে যে পঞ্চায়েতের মধ্যবর্তিতায় যদি প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকৃত করা যায় সাধারণ, গাঁয়ের মানুষকে যদি প্রশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নেওয়া যায় তাহলে উন্নয়ন দ্রুততর হবে। সুতরাং আমার উন্নয়নের চরিতার্থতার জন্যই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন।

• কিন্তু উন্নয়ন মানে তো বৈষম্যের অবসানও বটে। এই বৈষম্যের অবসান ঠিক কতটা হচ্ছে?

অ.মিঃ যে মুহূর্তে আমরা বলছি গ্রামের সাধারণ মানুষকে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করাবো তখন আমরা, পরোক্ষে কেন প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই, বলছি যে সামাজিক অসাম্য আছে তা দূর হবে এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে।

• কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের হাতে উন্নয়নের দায় তুলে দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে অনেক জায়গায় দলীয় স্বার্থ ও সংকীর্ণতার বাইরে তারা যেতে পারছেন না। যে পাড়ায় আমার ভোট বেশী সেখানে পিচ রাস্তা বা জলের কল বসছে আর যেখানে আমার ভোট কম সেখানে কাঁচা রাস্তাই থেকে যাচ্ছে, পানীয় জলের সুব্যবস্থা হচ্ছে না - এ যেন উন্নয়নের রাজনীতিকরণ! কী বলবেন?

অ.মিঃ জ্যোতিবাবু একটি কথা বারবার বলতেন যে, যাঁরা আমার সঙ্গে নেই আমার তো উদ্দেশ্য হবে তাঁদের আমার পাশে এনে জড়ো করা। সুতরাং উন্নয়নের একটা বড়ো লক্ষ্য তো হবে এতদিন যাঁরা আমাদের পছন্দ করেননি তাঁদের কাছে গিয়ে প্রমাণ করিয়ে দেওয়া যে আমরা তাঁদেরও মঙ্গল চাই, তাঁদের শুভ চাই। এখন যারা পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্বে আছেন তাঁরা বারবার এই কথাটা বলেছেন যে, গ্রামীণ উন্নয়ন কেন, যে কোনো উন্নয়নের লক্ষ্য হবে ঔচিত্য সমতা। এবং সেই ঔচিত্যের যে নিক্তি তাতে একদা যাঁরা আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁরা কিছুতেই বাদ পড়তে পারেন না বরং আমি তাঁদের আমার সঙ্গে একত্রিত করবার চেষ্টা করব।

• এটা হয়তো বাঞ্ছিত লক্ষ্য, কিন্তু সে লক্ষ্যের কতটা কাছাকাছি বাস্তবে আমরা রয়েছি?

অ.মিঃ দেখুন, গত দশ-পনেরো বছর আমি গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াই না কারণ আমার সে সুযোগ হয় না। তবে বিভিন্ন সূত্রে যা খবরাখবর পাই তাতে মনে হয় এখানে এলোমেলো কিছু অপূর্ণতা আছে, ওখানে কিছু অনৌচিত্য আছে, ইতস্তত এমনকী কিছু দুর্নীতিও বাসা বেঁধেছে। তবু সব মিলিয়ে মনে হয় মস্ত একটা পরিবর্তনের জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। এখন যেসব অসম্পূর্ণতা ও গ্লানি চোখে পড়ছে আমার ধারণা সাধারণ মানুষের চেতনার মান যত উন্নত হবে তত তাঁরা নিজেরাই দেখবেন তাঁদের জন্য বরাদ্দ যে টাকাপয়সা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলো যেন আঁকাবাঁকা পথে উধাও হয়ে না যায়। আমাকে অনেকে এটাও বলেন যে গ্রামে একটা নতুন মোড়লসমাজ তৈরি হচ্ছে হয়তো খানিকটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই হচ্ছে। এটা হতে পারে। যে ধরনের সমাজব্যবস্থার মধ্যে আছি তাতে এমনটা হতে পারে।

তবে এখানে দু'দিকেই একটা দায়িত্ব থেকে যায়। প্রথম কথা হল, রাজনৈতিক নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাদের সতর্ক থাকা, প্রয়োজনে নির্দয় হওয়া। আর দ্বিতীয়ত যারা একেবারে নীচের তলায় প্রত্যক্ষভাবে রয়েছেন তাঁদেরও এটা দেখা। অনেক সময় এটা তো হয়ই, কোথাও হয়তো একটা টিউবওয়েল বসাতে হবে, পঞ্চায়েত প্রধান সেটা হয়তো নিজের বাড়ির উঠোনে বসিয়ে দিলেন - কিন্তু তার পাশাপাশি এটাও হয়েছে যে, এসব জিনিস চাপা থাকে না। ছ-মাস হোক, আট মাস হোক দু-বছর হোক পাড়াপড়শিরা জড়ো হয়েই এসব অনাচার বন্ধে এগিয়ে আসেন। সুতরাং আমি হাল ছেড়ে দিইনি। একটা পরীক্ষা চলছে, তারই মধ্যে দিয়ে কিছু অশুভ প্রবণতা দেখা দিয়েছে। যদি ওপর ও নীচের দুই তরফেই নজর থাকে তবে এসব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে। আর যদি ওপরের দিকেও শ্লথতা থাকে আর নীচের দিকেও গা-ছেড়ে-দেওয়া ব্যাপার থাকে তাহলে অবিশ্যি অন্য কথা।

• আমার তো মনে হয়, জনপ্রতিনিধিদের ঘাড়ে যে বিপুল পরিমাণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, তাঁরা তার প্রতি সুবিচার করতে পারছেন না - আপনি কী বলেন?

অ.মিঃ আসলে সেই পুরোনো কথাটাই পুনরায় বলতে হয়। ওপরের তলায় ও নীচের তলায় যাঁরা আছেন তাদের সতর্ক হতে হবে, নির্দয় হতে হবে এবং প্রয়োজনে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদ ছাড়া কোনো সমাজের চেহারা পরিবর্তন হতে পারে না।

• গত পঁচিশ বছরে কেন্দ্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলির রূপায়ণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলার পঞ্চায়েত অনেকটাই সফল। কিন্তু তৃণমূলস্তর থেকে পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে (যা কেরালাতে হয়েছে) এখানকার পঞ্চায়েতগুলি তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি - কেন এমন হল?

অ.মিঃ কেরালাতেও সম্প্রতি একটা রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, ফলে সেখানেও পরিস্থিতি খুব অনিশ্চয় হয়ে পড়েছে। আর এখানে, হতে পারে একধরনের গা-ছাড়া ভাব এসেছে - এক্ষেত্রে সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে। আসলে, আমরা বলি, এটা একটা সংকট, এটা হয়তো গ্রামোন্নয়নের এক ধরনের সংকট। এটাও ঘটনা, আমরা স্থানীয় ভিত্তিতে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদ সংগ্রহ করতে পারছি না, তা যে-কারণেই হোক। এবং সেটা পারছি না বলেই তৃণমূলস্তরে নতুন নতুন প্রকল্প উদ্ভাবন করা যাচ্ছে না - কারণ এ দুটোর পারস্পরিক সম্বন্ধ রয়েছে। এখন আমরা সংকট নিয়ে যখন সবাই মিলে বসে আলোচনা করব তখন তো এগুলো নিয়েই আলোচনা করব। যদি এ ব্যাপারে আমরা আগ্রহ না দেখাই তবে আমরা ধাক্কা খাব। একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ যদি উন্নয়নের সুফল না পান তাহলে সাধারণ মানুষই ধাক্কা দেবেন। সেই ধাক্কা থেকে আবার পরবর্তী পথ খোঁজা আরম্ভ হবে। কিন্তু তা বলে পঞ্চায়েত যথেষ্ট ভালো কাজ করছে না বলে তাকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিতে হবে এটা কোনো নীতি হতে পারে না। সমস্যাটা হল কী ভাবে তাকে শুদ্ধতর ও সংহত করা যায়।

• তবে কি পঞ্চায়েত ব্যবস্থার একটা নিবিড় পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন?

অ.মিঃ হ্যাঁ, দরকার। কিন্তু এখন যারা রাজনৈতিক নায়কত্বে আছেন এসব বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলাই শ্রেয়। আমরা বৃদ্ধ মানুষ, এখন সব বাইরে থেকেই দেখি।

• 'শিল্পায়ন' এই মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় একটি সংবেদনশীল বিষয়। কিন্তু আপনি বারেবারেই বিভিন্ন জায়গায় লিখছেন যে রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি যদি বিনিয়োগ না হয় তাহলে বেসরকারি পুঁজি একা এসে বিনিয়োগ করে রাজ্যের হাল ফেরাতে পারবে না। বিষয়টা যদি আরেকবার ব্যাখ্যা করে দেন...

অ.মিঃ আমার মত এ ব্যাপারে খুব স্পষ্ট। যাঁরা আমাদের বেসরকারি মালিক-টালিক আছেন, স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর তো দেখলাম, সাদা বাংলা কথায় এদের মুরোদ কম। এঁরা যত কথা বলেন কাজ তেমন বেশি করতে পারেন না, কারণ এঁরা বড়ো বেশি পরস্ব নির্ভর। ১৯৮০-৮৫ পর্যন্ত এঁরা সরকারের উপর নির্ভর করেছিলেন। সরকার আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন, ফলে এঁরা দেশের বাজারে তাঁদের জিনিস বিক্রি করতেন। বাইরের থেকে জিনিসপত্র আসার কোনো ব্যাপার ছিল না, প্রতিযোগিতারও কোনো বালাই ছিল না। শুধু তাই নয় এরা বিনিয়োগ করতেনও সরকারের ওপর নির্ভর করে। এরা একটা নতুন কারখানা খুলতে নিজেদের পকেট থেকে যদি শতকরা দশভাগ টাকা দিতেন তো বাকি নব্বইভাগ আসত সরকারি আর্থিক সংস্থা ব্যাঙ্ক বা বীমা করপোরেশন থেকে। সুতরাং এরা কিছু বিনিয়োগ করবে, যেখানে রাষ্ট্র পিছিয়ে যাচ্ছে, বিনিয়োগ করছে না, এটা একরকম দুরাশা। এখন কী বলা হচ্ছে, না বিদেশিরা এসে বিনিয়োগ করবেন - কই বিদেশিরা তো আসছে না। বিদেশিদের কাছে যত দাসখত লিখে দেওয়া হচ্ছে সেরকম জোর গতিতে তো বিদেশিরা আসছে না। সুতরাং আমার মনে হয় না, এই যে বিকল্প কাঠামো যেটাকে বলা হচ্ছে, অর্থাৎ বিদেশিদের টাকায় দেশি বেসরকারি মালিকরা পুঁজি বিনিয়োগ করবে, এর উপর খুব বেশি ভরসা রাখা যায়।

আসলে এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলা অবান্তর। কারণ দেশের মূল আর্থিক সিদ্ধান্তগুলি নেন কেন্দ্রীয় সরকার। আর কেন্দ্রীয় সরকারের চরিত্র নির্ভর করে দেশের অধিকাংশ মানুষ ভোট দিয়ে কাদের সরকারে পাঠাচ্ছেন তার ওপর। এখন আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছেন পিছিয়ে পড়়া মানুষ। তার মধ্যে আবার একটা বড় অংশ পুরাণের রাজ্যে বিচরণ করছেন। এখন এঁরা যদি ঠিক করে থাকেন আমরা যাদের নির্বাচিত করেছি তারা আমাদের পুরাণের রাজ্যে নিয়ে যাবেন, এরা বিদেশিদের সঙ্গে খাতির করে আমাদের অবস্থার মোড় ফেরাবেন তাহলে আপাতত আমাদের কিছুই করার নেই; শুধু আঙুলচোষা ছাড়া যতদিন না পর্যন্ত সাধারণ মানুষের চেতনার মান পাঁচ হাজার বা দশ হাজার বছর এগিয়ে না আসে।

• তাহলে যে এখন বলা হচ্ছে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারগুলির পক্ষে পুঁজি আকর্ষণ করে শিল্প গড়ার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে?

অ.মিঃ যাঁরা এসব বলেন তাঁদেরকেই গিয়ে বরং জিজ্ঞেস করুন। আমি তো আর এখন সক্রিয় যোদ্ধা নই যে তরবারি নিয়ে লড়তে যাব। আমি আমার মতো যতটা পারি প্রচার করার চেষ্টা করব, আমার ক্ষীণকন্ঠ যতদুর পৌঁছাবে পৌঁছে দেবো - এর বেশি কিছু নয়। এরপর দেশ যদি ডুববার হয় ডুববে! আমার আর কী করার আছে?

• আচ্ছা মার্কসবাদের তাত্ত্বিক দিক নিয়ে যত বিতর্ক ও চর্চা আমাদের দেশে হয়েছে, প্রায়োগিত মার্কসবাদ নিয়ে ঠিক সেই রকম নিবিড় চর্চা হয়নি। মার্কসবাদের প্রায়োগিক দিক নিয়ে চর্চা বিকশিত হল না কেন?

অ.মিঃ সেটা হবে। কারণ তার সমস্যাগুলো দেখা দিলেই সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। আপাতত আমরা তো মার্কসবাদ থেকে বহু যোজন দুরে আছি সুতরাং প্রয়োগিক দিক নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার হয়নি। এখনো, এই পঁটিশ বছর একটা রাজ্যে তথাকথিত বামফ্রন্ট সরকার আছে কিন্তু আর যাই হোক এটা তো মার্কসবাদ নয়। একটা ধনতান্ত্রিক-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে একটা বামচেতনা সমন্বিত সরকার আছে এই পর্যন্ত, কিন্তু এই সরকারের মার্কসবাদ প্রয়োগ করার কোনো অধিকারও নেই, ক্ষমতাও নেই। বরং মার্কসবাদ প্রয়োগ করার চেষ্টা করলেই তাকে উৎখাত করে দেওয়া হবে। সুতরাং সমস্যাটা যখন মাথাচাড়া দেবে তখনই চিন্তাভাবনা শুরু হবে এবং সমাধানের সূত্রগুলোও তখনই বেরিয়ে আসবে। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লবের আগে, একটি রাষ্ট্রে কীভাবে সমাজতান্ত্রিক সরকার পরিচালনা হবে, মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তিতে, তার বিশেষ কোনো আলোচনাই হয়নি কিন্তু লোকেরা দেখে শেখে বা ঠেকে শেখে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর সেই দেশে যেমন বিতর্কের ঢেউ এসেছে, বিতর্কের পর বিতর্ক - কৃষিতে কীরকমভাবে পরিবর্তন আসবে, শিল্প কোন ধরনের চেহারা নেবে, দেশটা কোন পথে চলবে, বৈদেশিক বাণিজ্য করবেন কিনা, প্রশাসন কীরকম হবে এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার থেকে তাঁরা কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বেশ কিছুদিন পর্যন্ত তাঁরা সেসব সিদ্ধান্তের সুফল পেয়েছেন শেষের দিকে অবশ্য তেমন সুফল পাননি। এখন তার কারণগুলো নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। অন্যদিকে চিনে আবার নতুন একটা বিকল্প পথের চেষ্টা চলছে। কিউবাতে, সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশে আরেকরকমভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। সুতরাং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এখন এসব প্রচেষ্টা মার্কসবাদকে কতখানি নিখাদ রেখেছে বা কতটা সাময়িক পরিস্থিতির সঙ্গে আপোস করেছে সেগুলো বিশদ গবেষণার বিষয়। সুতরাং সংকট দেখা দিলেও, এমনকী মার্কসবাদেও যদি সংকট দেখা দেয় তবে প্রশ্নগুলো লোকেরা করতে আরম্ভ করবে। আমাদের দেশে আমরা এখনো সংকটের মধ্যে পড়িনি, কেননা মার্কসবাদের কাছাকাছিও আমরা পৌঁছইনি!

• আচ্ছা, বামপন্থীরা আজও পর্যন্ত ধর্ম, ধর্মচর্চা ইত্যাদি নিয়ে কোনো সঠিক অবস্থানে আসতে পারলেন না বলেই কি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এই রমরমা? এর জন্য কি বামপন্থীরা দায় অস্বীকার করতে পারবেন?

অ.মিঃ আমি তো আগেই বললাম দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি পুরাণের অন্ধকারে ফিরে যেতে চান তাহলে একা পশ্চিমবঙ্গে লড়াই করে খুব বেশিদূর এগোনো যাবে না। যদি ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্যবর্তিতায় এমন সব নেতাদের ক্ষমতায় পৌঁছে দেন যারা উগ্র হিন্দুত্বে বিশ্বাসবান এবং একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে দু-হাতে আলিঙ্গন করতে দৃঢ়কল্প তাহলে অনেকরকম সমস্যা দেখা দেয়। এখন আমরা একেবারে সরাসরি সেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। আমার যা চিন্তা, তাতে মনে হয়, এই অবস্থায় বামপন্থীদের কোনো উগ্র ধর্মান্ধতার সঙ্গে বোঝাপড়া করা ঘোর অনুচিত হবে।

অবশ্য আমার দুঃখটা অন্য জায়গায়। পশ্চিমবাংলায় কিছু অকারণ ধর্মীয় রীতিনীতি সংস্কারের বোঝা থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত করতে পারিনি আজও। আমি বহু জায়গায় এসব নিয়ে লিখেছি। কেন সরকারি দফতরে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি দেখা যাবে? সরকারি অফিসের লিফটে কেন কালীমূর্তিতে ধূপধুনো দেওয়া হবে? সরকারি গাড়িতে চলেছি, কেন সেখানে একটা শিবের বা কালীর মূর্তিতে আলো দেওয়া হবে? কেন চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হলে সরকারি দফতরে হাফ ছুটি বা পুরো ছুটি দেওয়া হবে? বা এই যে দুগ্গাপুজো, রাস্তা আটকে ম্যারাপ বেঁধে কেন দুগ্গাপুজোর সমারোহ হবে? এখন সমস্যা হচ্ছে আমরা প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রের মধ্যে বাস করছি, মধ্যবিত্ত মানুষকে আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে - আমাদের চেতনা যতদূর এগিয়েছে সাধারণ মধ্যবিত্তের চেতনা ততদূর এগোয়নি। এখন যদি তাঁদের বলি, রাস্তা আটকে দুর্গাপুজো করতে দেব না কিংবা দুর্গাপুজোর প্রতিমা বিজয়া দশমীর রাত বারোটার মধ্যে বিসর্জন দিতে হবে তাতে তাঁরা চটে যাবেন। এটা করতে আমরা ভয় পাই। কারণ আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যদি বলে, আমরা রাস্তা আটকে দুর্গাপুজো করতে দেব, আমরা সাত দিন কেন দশ দিন ধরে দুগ্গাপ্রতিমা টিকিয়ে রাখতে দেব। ফলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা বামপন্থী, তাদের মধ্যে কিছুটা অস্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে, তারা ভাবছেন, কী দরকার এদের চটিয়ে বরং এদের আপাতত খুশি রাখা যাক। এই খুশি রাখার প্রক্রিয়াতে যে খুব একটা লাভ হচ্ছে এমন আমার মনে হয় না। আমার এক যুগোস্লাভ বন্ধু, বহু পুরোনো বন্ধু, প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর সস্ত্রীক কলকাতায় এসেছিলেন। ওরা ভীষণ উচ্ছ্বসিত যে একটা যুক্তফ্রন্ট সরকার, একটা লাল সরকার পশ্চিমবাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তো, এরা সেবার কলকাতায় এসে সারা দিন খুব ঘুরে বেড়ালো - সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে এসে আমাকে বলছে, এটা কেমন ব্যাপার? তোমাদের এত দেবদেবী, এত পুজোর ধূম? মানে ওরা ঘাবড়ে গেছে আর কি?

সুতরাং গুজরাট নিয়ে আমাদের খুব বেশি নামতা পড়ার অবকাশ নেই যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা নিজেরাও আচরিক ক্ষেত্রে সংস্কৃতিমনস্ক হতে পারছি।

• কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বামপন্থীদের অবস্থান...

অ.মিঃ আসলে বামপন্থী আন্দোলন একটু বেশি সরকার নির্ভর হয়ে গেছে। বামপন্থী আন্দোলনটা তো সরকারের পাশাপাশি চলবে! সরকারের কিছু ক্ষমতা আছে, কিছুটা সংগতি আছে আবার কিছুটা সীমাবদ্ধতাও আছে কিন্তু সামাজিক সংস্কারের বিষয়টা রাজনৈতিক নেতৃত্বের আওতায় পড়ে। খুব জোর, সরকার সেখানে কোথাও কোথাও সমর্থন জোগাতে পারে।

আমি বলি, এগুলো কতগুলো সাধারণ কুশলতার ব্যাপার। নির্বাচনে জেতার পরবর্তী এক বছর-দু'বছর কিছু আপাত-অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিলাম। বাকি দু-তিন বছর সেগুলোর ভিত্তিতে এগোলাম, মানুষকে বোঝালাম কেন এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপর আবার নির্বাচনে জিতলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। এই গণতান্ত্রিক কাঠামো ও নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে কীভাবে এগোনো যায় আমি সেটাই ভাবছি। এই যেমন অনেকে বলছেন সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে দুনীর্তি রয়েছে, তো আমি বলি নির্বাচনে জেতার পরপরই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে কারণ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে তত আবার হিসেবটা অন্যরকম হয়ে যাবে। যাই হোক, এসব ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কুশলতাই শেষ কথা বলবে।

• কিন্তু এ রাজ্যের বামপন্থীরা সেটা পারছেন কই?

অ.মিঃ ওই তো বললাম, এখন সব ভয় খায়। প্রতি পদে পদে ভয় খেতে হয়। প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্র তো! কিন্তু এই ভয়টা না কাটালে গোটা দেশের চেহারা পাল্টানো সম্ভব হবে না। আমরাই যদি ভয় পাই তাহলে কী হবে? আমরা কেন ভয় পাব, ওরা আমাদের ভয় পাবে - এরকম একটা চেতনা নিয়ে এগোতে না পারলে মুশকিল আছে।

• কিছুদিন আগে পর্যন্তও বামপন্থী কালচার বলে একটা কিছু বোঝাত যা অন্যদের থেকে আলাদা - এই সীমারেখাটা কি আজকাল মুছে গেছে বলে মনে হচ্ছে না?

অ.মিঃ আমি অন্য কিছু বলছি না, কিন্তু অসবর্ণ বিবাহের ব্যাপারটা এখন মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে গেছে কিন্তু আন্তধর্ম বিবাহে এখনো প্রচুর জড়তা, প্রচুর আপত্তি, শতকরা একভাগও এমন ঘটনা ঘটছে কিনা সন্দেহ - কিন্তু এটা হওয়া উচিত নয়, আরো ব্যাপকভাবে এটা ঘটা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু হচ্ছে না।

• এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। বাংলা গানের বিষয়ে আপনি তো আগ্রহী শ্রোতা। এখনকার বাংলা গানের বিষয়ে কী বুঝছেন?

অ.মিঃ গান আমি শুনি, শুনতে ভালো লাগে। আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগে বাংলা আধুনিক গানের যে সূত্রপাত তা খুবই চমৎকার হয়েছিল। এখনকার গানে যেন হট্টগোল বড়ো বেশি। জানি না, হয়তো মানুষের রুচি বদলাচ্ছে, আমার রুচি দিয়ে তো আর সবটা বিচার করলে হবে না। আগেকার গানগুলি লিখতেন মূলত কবিরা। এখানেও আমার তত্ত্ব আছে। বেকার ছেলেরা চাকরি-বাকরি পেত না, কেউ সাহিত্যচর্চা করত, পাশাপাশি গানও লিখত। কেউ হয়তো সুর ভাঁজত। অজয় ভটাচার্য, প্রণব রায় এসব গীতিকাররা মূলত কবি ছিলেন, সে সময় 'কবিতা' পত্রিকায় এদের লেখা ছাপা হত। এখন এ জিনিসটা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় নিরক্ষর মানুষ গান লিখছেন এখন, যিনি মুগুর ভাঁজছেন তিনিও এখন গান লিখছেন। তবে সবকিছুই যে খারাপ এ কথা বলব না। এই যে সুমন, এর গান আমি শুনেছি, লেখাও কিছু পড়েছি, খুব স্মার্ট লেখা এবং কিছুটা সমাজচেতনা আছে। উনি খুব শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি গানে সেটা বোঝা যায়। আবার, আমার স্ত্রী সেদিন বললেন যে, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত গান লিখছেন। আমি বললাম, ভালোই তো, ও গান লিখলে তো খারাপ হবে না। সম্প্রতি 'বিভাব'-এর প্রাক্ শারদীয় সংখ্যায় অরুণকুমার বসু-র একটা লেখা পড়লাম এসব বিষয় নিয়ে, খুব ভালো লেখা।

• এবারে কবিতা নিয়ে কিছু বলুন...

অ.মিঃ কবিতা পড়া আমি ছেড়ে দিয়েছি অনেককাল।

• কবে থেকে ছাড়লেন? কেনই বা ছাড়লেন?

অ.মিঃ দশ-বারো বছর আগে থেকে। কারণ এখন যারা কবিতা লিখছেন তাঁরা সব চেনা মানুষজন। কবিতা পড়লেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করবেন তাঁদের লেখা কেমন লাগে। মুখের ওপর তো বলতে পারি না যে তোমার কবিতা আমার বিতিকিচ্ছিরি লাগে। আর যে-কটা দিন বাঁচব সন্ধি করেই বাঁচতে হবে তাই কবিতা পড়ি না।

• কিন্তু আপনি 'দেশ'-এ প্রকাশিত 'আপিলা চাপিলা' রচনায় তারাপদ রায়ের 'দারিদ্ররেখা' বইটির দারুন প্রশংসা করেছেন...

অ.মিঃ হ্যাঁ, ঠিকই। কিন্তু সেটা কবিতার জন্য ঠিক ততটা নয়। বিষয়ের জন্য। তারাপদ রায় এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের নাকে ঝামা ঘষে দিয়েছেন। ওটাই আমার ভালো লেগেছে।

• এবার বাংলাভাষা প্রসঙ্গে আসি। আপনি তো দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন এবং এই রাজ্যের ক্ষমতাসীন সরকারের ভাষানীতি নিয়ে সমালোচনাও করছেন। বাংলাভাষা নিয়ে সত্যি সত্যি আপনার আশঙ্কাটা কোথায়?

অ.মিঃ বাংলাভাষা আর থাকবে না। আমি ভেবেছিলাম যে বোধহয় ওপার বাংলায় কিছুটা বাংলাভাষার কদর থাকবে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশের এক বন্ধু আমার বাড়িতে দু-দিন অতিথি হয়ে কাটিয়ে গেলেন, তাঁর মুখে যা শুনলাম তাতে বুঝেছি বাংলাদেশেও বাংলাভাষার আর তেমন ভবিষ্যৎ নেই। সুতরাং আর কী হবে?

আসলে আমি এই কথাটাই বহুবার বলেছি যে, এখনো আমাদের সমাজে দিকনির্দেশ করেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলাভাষা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। এই ভাষার প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা হারিয়েছেন, আগ্রহ হারিয়েছেন, বরং একটা বিদ্বিষ্টভাব পোষণ করছেন।

• কিন্তু এই যে বাংলাভাষায় এত পত্র-পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে বা প্রকাশকরা বই প্রকাশ করছেন, মানুষ কিনছেন সেসব বই, এগুলোকে তাহলে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

অ.মিঃ যারা লিখছেন এসব, তারাই কিনছেন বা পড়ছেন। আর বাংলা বই কত বিক্রি হয়? কোন ধরনের বই বিক্রি হচ্ছে একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন। আমি তো মনে করি নিরক্ষরদের লেখা বই, নিরক্ষররা কিনছেন।

আমি কোথায় যেন একটা লিখেছিলাম, যে, কয়েকজন তরুণ-তরুণী যদি রাস্তা দিয়ে গল্প করতে করতে যান তবে লক্ষ করে দেখা যাবে যে তাঁরা বেশির ভাগ কথা ইংরেজিতে বলছেন, একটানা বেশিক্ষণ বাংলায় কথা বলতেও তাঁরা অক্ষম। আসলে ভাষাকে ভালো না বাসলে সেই ভাষাচর্চায় আগ্রহ হয় না। সেই ভালোবাসাটাই নেই। সুতরাং আর কী, আপাতত ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি।

• ঠিক এই মুহূর্তে আপনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে নেই বা সেই অর্থে কোনো পদেও নেই, আবার পুরোনো দলের সঙ্গেও আপনার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে (অন্তত কিছু কিছু ব্যাপারে) তাহলে আপনার এখনকার অবস্থানটা কীরকম? মৃণাল সেন যেমন নিজেকে বলেছিলেন, 'প্রাইভেট মার্কসিস্ট' আপনিও কি নিজেকে প্রাইভেট মার্কসিস্ট বলবেন?

অ.মিঃ না, আমি প্রাইভেট মার্কসিস্ট-টিস্ট নই। ও সব কথার আমি মানেই জানি না। যে অঞ্চলে আমি থাকি, যে ভূখন্ডে আমার অবস্থান তাতে যে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের সাধারণ মানুষের সবচাইতে ঘন যোগাযোগ সেই রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষগুলির সঙ্গে আমি সবসময় থাকব। কোনো দল নয়, দল মানে তো শুধু কতগুলো নেতা নন, দল মানে সাধারণ মানুষ, সহমর্মী মানুষ - সেই মানুষগুলোর সঙ্গে আমি থাকতে চাই।

______________________________
'কবিতা পাক্ষিক' পত্রিকা, ২৫ জানুয়ারি ২০০৩ সংখ্যায়, অশোক মিত্রের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন প্রবুদ্ধ বাগচী। তাঁর সৌজন্যে আমরা 'আরেক রকম'-এর তরফে এটি পুনর্মুদ্রিত করলাম।