আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

সাধারণের গীতাপাঠ - অর্জুনই আমাদের প্রতিনিধি

দীপাঞ্জন গুহ


ভারতের সংবিধানের এবং সেই সূত্রে আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি প্রধান ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান শর্ত ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা, কোনো ধর্মীয় ব্যাপারে রাষ্ট্রের মাথা না ঘামানো। কিন্তু গভীর আশঙ্কার কথা এই যে এই শর্ত গত কয়েক বছরে দেশ ও রাজ্যে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, রাম মন্দির, গঙ্গা-আরতি, ইমামভাতা, দুর্গাপুজোর কার্নিভাল ইত্যাদি বিভিন্ন নামে। এর একটি সাম্প্রতিক নিদর্শন ভারতের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটিকে একটি পুরোদস্তুর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পরিণত করা। বর্তমানে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের উদ্বোধনের অনুষ্ঠান ঘিরে দেশজুড়ে সরকারি উদ্যোগে যে উন্মাদনা তৈরি করা হল, সেটি এই প্রকল্পের সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

সরাসরি সরকারি উদ্যোগে না হলেও এই দক্ষিণপন্থী প্রকল্পের অংশ হিসাবে সম্প্রতি কলকাতা শহরে একটি বড় 'সমবেত গীতাপাঠ'-এর অনুষ্ঠান হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গে এরকম একটি অনুষ্ঠান যথেষ্ট অভিনব, কারণ যারা গীতাকে ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মানে, তাদের মধ্যে একটা মাঠে বিশাল সংখ্যায় জড়ো হয়ে গীতাপাঠের চল খুব একটা নেই। যাঁরা এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা, তাঁরা সম্ভবত এরকম একটা চল তৈরি করতে চাইছেন, তাঁদের ধর্মাবলম্বীদের একত্র করার উদ্দেশ্যে। ধর্মের নামে মানুষকে সমবেত করে তাদের মধ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ আবেগ তৈরি করা এবং তারপর সেই আবেগকে বিভিন্নভাবে - সামাজিক, রাজনৈতিক, সহিংস, অহিংস - ব্যবহার করার অনেক নিদর্শন আছে। পৃথিবীর কিছু প্রধান ধর্মে সমবেত প্রার্থনার বড় একটা জায়গা আছে, তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা সম্ভবত তাঁদের অনুসারীদের একত্র করতে চাইছেন।

যাইহোক, এই গীতাপাঠের অনুষ্ঠানটি নিয়ে সামাজিক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো ভাষ্য এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, যদিও এর প্ৰত্যেকটিই বিস্তারে লেখা সম্ভব। এই লেখার উদ্দেশ্য 'ভগবদ্গীতা' নামক গ্রন্থটিকে আরেকটু কাছ থেকে দেখা, এই গ্রন্থ ও এই ভূমির একজন সাধারণ উত্তরাধিকারী হিসাবে।

গীতা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি মহাভারতের অন্তর্গত, এবং তাই, ধর্মগ্রন্থ হিসাবে অভিহিত হলেও, এটি নিজেও প্রথমত একটি সাহিত্যকীর্তি। সাহিত্যের উত্তরাধিকার দেশ-কাল-ধর্ম-রাজনীতি নির্বিশেষে প্রত্যেকের। কিন্তু ধর্ম যেহেতু প্রশ্নহীন আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল, তাই ধর্মগুরুরা সবসময় চেয়েছেন ধর্মগ্রন্থকে কুক্ষিগত করে রাখতে এবং নিজের মতো করে তার ব্যাখ্যা দিতে। যে লেখা আপনি নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, পড়তে পারছেন, তাকে নিজের মতো বুঝতে গেলেই আপনাকে বলা হবে যে বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই, তাই তার ব্যাখ্যা আপনাকে ধর্মগুরুদের কাছ থেকেই শুনতে হবে। এই শৃঙ্খলকে আমাদের প্রথমেই ছিন্ন করতে হবে, আমাদের নিজেদের ক্ষমতা ও অধিকারে গীতাকে বুঝতে হবে, কারণ গীতা ধর্মগ্রন্থের থেকেও বেশি করে একটি সাহিত্যকীর্তি যাকে পড়া বোঝা অনুভব করার অধিকার একজন সাধারণ পাঠকের আছে।

গীতার প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি প্রথমেই গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা উচিত, তা হলো গীতার কেন্দ্রীয় চরিত্র কে - কৃষ্ণ না অর্জুন? আর একধাপ এগিয়ে বলা যায় যে গীতায় কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অর্জুনের প্রশ্নগুলি না কৃষ্ণের উত্তরগুলি। এ-কথা জিগেস করলে বেশিরভাগ মানুষই সম্ভবত উত্তর দেবেন যে কৃষ্ণের উত্তরগুলিই গীতার মূল কথা, সেগুলিই ভগবানের বাণী। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন যে অর্জুনের প্রশ্নগুলি এবং তাঁর মানবিক অবস্থানই গীতার মূল শক্তি, তাহলে সেই মতামতও কিন্তু ভেবে দেখতে হয়।

গীতার তর্কের শুরু অর্জুনের একটি শক্তিশালী মানবিক আবেগ থেকে - আমার ভাই, আত্মীয় বন্ধুদের হত্যা করে আমি কোনো রাজত্ব ও সুখ চাই না। ভীষ্ম দ্রোণের মতো পূজনীয়দের আমি কী করে হত্যা করবো? এই কথা বলে যখন অর্জুন গাণ্ডীব নামিয়ে রেখে রথের ওপর বসে পড়েন, তখন কুরুক্ষেত্রে যুযুধান দু-পক্ষ দুইপাশে সমবেত হয়েছে এবং দু-পক্ষের মহাবীরদের মহাশঙ্খগুলি বেজে গেছে, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরু হতে আর দেরি নেই।

এই অবস্থা থেকে অর্জুনকে যুদ্ধ করায় আবার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কৃষ্ণ অনেকগুলি যুক্তি দেখান, যেগুলি ভারতের মননে চিরস্থায়ী হয়ে গেছে। কৃষ্ণ যা বলেন তার সারাংশ প্রধান দুটি তত্ত্বে এসে দাঁড়ায় - প্রথমটি একটি তথ্য - আত্মা অবিনশ্বর - ও দ্বিতীয়টি উপদেশ - নিষ্কাম কর্মের।

প্রথমত কৃষ্ণ বলেন অর্জুন যে প্রিয়জনদের হত্যা করতে চাইছেন না, সেই চিন্তাটি অমূলক কারণ মানুষটির দেহকে হত্যা করলেও তার আত্মার কোনো বিনাশ নেই। বিজ্ঞান বা যুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে শুধু যদি কাব্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, তাহলে এই পর্যায়ে আমাদের সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কতগুলি শ্লোক পরপর রচিত হয়েছে। তিনি জাত নন, তিনি মৃত নন, তিনি শাশ্বত, শরীরে হত হলেও তিনি হত হন না। কোনও অস্ত্র তাঁকে ছিন্ন করতে পারে না, আগুন তাঁকে পোড়াতে পারে না, জল তাঁকে ভেজাতে পারে না, হাওয়া তাঁকে শুষ্ক করতে পারে না ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত কৃষ্ণ বলেন যে, অর্জুনকে তাঁর কর্ম করতে হবে এবং সেই কর্ম হতে হবে নিষ্কাম, অর্থাৎ ফলের কথা না ভেবে, সরল জাগতিক বিচার ও চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে। সব মানুষেরই এই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে যে কার কী কর্ম সেটা ঠিক হবে কী করে। যেমন অর্জুন প্রিয়জনদের হত্যা করে রাজ্য ও সুখ লাভ করাটাকে তাঁর কর্ম মনে করছেন না, অথচ কৃষ্ণ তাঁকে বোঝাতে চাইছেন যে এটাই তাঁর কর্ম। এক্ষেত্রে গীতার উত্তর হচ্ছে যে স্বধর্ম পালনই হচ্ছে কর্ম এবং স্বধর্ম হচ্ছে চতুর্বর্ণ-নির্দেশিত কাজ। অর্জুন ক্ষত্রিয় এবং তাঁর কাজ যুদ্ধ করা। এক্ষেত্রে পরিষ্কার যে ব্যক্তিগত মানবিক বিচার নয়, জন্মসূত্রে পাওয়া চতুর্বর্ণ প্রথা-নির্দেশিত কাজই মানুষের কর্তব্য। এর থেকে ভাবা যায় যে বর্ণাশ্রমকে প্রতিষ্ঠিত করা গীতার আরেকটি প্রধান লক্ষ্য। এক্ষেত্রে আরেকটা ব্যাপারও ভেবে দেখার। নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দেওয়া হলেও গীতার এই কথোপকথনটি অন্তত কৃষ্ণের দিক থেকে ঠিক নিষ্কাম বলা যায় না। অর্থাৎ এই তর্কটিকে ফলাফলের দিকে না তাকিয়ে খোলামনে যুক্তি ও মতের বিনিময় বলা যায় না। তখন যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধারা সমবেত, যুদ্ধের ভেরি বেজে গেছে, যেকোনো সময় প্রথম বাণটি উড়ে আসবে, এই অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অর্জুনকে বুঝিয়ে যুদ্ধ করানোটাই এই কথোপকথনের স্পষ্ট উদ্দেশ্য।

কিন্তু যেটা এখানে দেখার সেটা হচ্ছে যে কৃষ্ণের এই দীর্ঘ ও সুভাষিত বক্তব্য কিন্তু অর্জুন সহজে মানেন না। তিনি দীর্ঘক্ষণ তাঁর সরল মানবিক ভাবনাটিকে ধরে রাখেন এবং কৃষ্ণকে প্রশ্ন করতে থাকেন। এবং শেষ পর্যন্ত অর্জুনকে মানানোর জন্য যুক্তি ছেড়ে কৃষ্ণকে একটি অতিপ্রাকৃতের আশ্রয় নিতে হয়, তাঁকে বিশ্বরূপ দেখাতে হয়। এক্ষেত্রে ভাবা যায় যে এই কথোপকথনে একজন মানবিক বিচারবুদ্ধিচালিত মানুষের প্রতিনিধি অর্জুন। তাঁর অবস্থানে সাধারণ মানবিক মূল্যবোধ প্রতিফলিত, যেখানে আত্মীয় বন্ধু প্রিয়জনদের সহাবস্থানে, হিংসাকে পরিত্যাগ করে, একটি সুস্থ শান্তিপূর্ণ জীবন কাটানোই মানুষের উদ্দেশ্য। এবং তার জন্য অনেকটা ত্যাগস্বীকারও করা যায়। অর্জুনের এই সরল অবস্থানটিই কিন্তু দেশকাল অতিক্রম করে আজ সারা পৃথিবীর স্বীকৃত আদর্শ মানবিক মূল্যবোধ (যদিও বিভিন্ন স্বার্থে ও লোভে, ভ্রান্ত প্ররোচনায়, তা হামেশাই লঙ্ঘিত হয়)। সেদিক থেকে দেখলে গীতার অর্জুন অনেকাংশে আমাদেরই প্রতিনিধি।

আশা করা যায় যে গীতা প্রসঙ্গে এই নতুন জেগে ওঠা গণ-উদ্দীপনায় মানুষ কৃষ্ণের উত্তরগুলির পাশাপাশি অর্জুনের প্রশ্নগুলিও গুরুত্ব দিয়ে পড়বেন ও স্বাধীনভাবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, মানবিক আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করবেন, এবং ধর্মের শৃঙ্খল পেরিয়ে এই কালজয়ী গ্রন্থটি পাঠের বহুমাত্রিক আনন্দ লাভ করবেন।