আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

আমার শিক্ষকতার শুরু

অমিয় দেব


।। ১ ।।

শিক্ষকতা কী? চাকরি, না পেশা, না বৃত্তি, না আরো কিছু? চাকরি তো বটেই, কেননা মাসান্তে মাইনে মেলে। সে-মাইনের আবার স্কেলও আছে, এত থেকে অত। এবং তাতে বার্ষিক বৃদ্ধির পরিমাণও নির্দিষ্ট - তাতে একাধিক ধাপও থাকতে পারে। শিক্ষক-পদেরও প্রকারভেদ আছে। কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ছিল লেকচারার (কোথাও কোথাও বা কখনো কখনো জুনিয়ার লেকচারার - সিনিয়ার লেকচারার - রীডার - প্রফেসার)। এখন এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসার - এ্যাসোসিয়েট প্রফেসার - প্রফেসার। যেমন অন্য চাকরিতে, তেমনি এখানেও ছুটির বিধিনিষেধ বাঁধা। কিন্তু এই শিক্ষকতা কি শুধু চাকরিই? কোনো অবকাশ নেই পেশার? যখন, ধরা যাক, কোনো এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসার পদে প্রার্থীদের ইন্টারভিউ হয়, তখন কী দেখা হয়? অর্থাৎ, কে কতটা যোগ্য তা কীভাবে বিবেচিত হয়? নেহাতই কে কতটা ভালো ছাত্র ছিল এবং কেমন মার্কস পেয়ে এসেছে, তার দ্বারা? কিংবা সাম্প্রতিক লেখাপড়ায় কে কতটা এগিয়ে, কোনো গবেষণা করে থাকলে তার মান কেমন, তার দ্বারাও? নাকি এও দেখে নেওয়া হবে কোনো বিষয় কে কতটা প্রাঞ্জলভাবে কোনো সম্ভাব্য শ্রোতৃমণ্ডলীকে বুঝিয়ে বলতে পারে? কারণ বিদ্বানমাত্রেই ভালো ব্যাখ্যাতা নাও হতে পারে। বা, সব বিদ্বান তার বিদ্যাদানে সমান সমর্থ নাও হতে পারে।অথচ গুরুমাত্রেই কি শিষ্যসম্ভব নয়! মানে, ছাত্র আছে বলেই তো শিক্ষক। বিদ্যালয় হোক, মহাবিদ্যালয় হোক, বিশ্ববিদ্যালয় হোক, সর্বত্রই তো কথাটা তা-ই। শিক্ষণের এই মুখ্য কথাটা কি কোনো এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসার নির্বাচকেরা ভুলে থাকতে পারেন? ছাত্রমনস্কতার সম্ভাবনা প্রার্থীদের কার কতটা তা তাঁরা নিশ্চয়ই দেখবেন। তবে শিক্ষকতা পেশা, এই অভিধাতে এ-আপত্তি উঠতে পারে যে শিক্ষকমাত্রেই টিউটর নয়। টিউটর তিনি যিনি ছাত্রকে হাতে-নাতে শেখাবেন। কিন্তু বিদ্যা ছাড়া তো সেই শিক্ষা শূন্যকুম্ভ। এবং যিনি বিদ্যা দেন বিদ্যাদান কি তাঁরও পেশা নয়? পেশাদারী না হলে তিনি ছাত্রকে বিদ্যার অভিমুখে আনবেন কী করে? ঠিক আছে, শিক্ষকতা না হয় পেশা হল, কিন্তু শিক্ষকতা কি বৃত্তিও নয়? কারণ সকলেই তো শিক্ষক নয়, কেউ কেউই শিক্ষক। বা একটু ঘুরিয়ে বললে, সকল শিক্ষকই শিক্ষক নয়, কোনো কোনো শিক্ষকই শিক্ষক। বৃত্তিধারী। অর্থাৎ শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কোনো বৃত্তিতেই তাঁকে মানাত না। উল্টোদিক থেকে দেখলে, বিদ্বান বা পণ্ডিত মাত্রেই শিক্ষক নন, শিক্ষকতা বৃত্তিতে তাঁর অধিষ্ঠিত থাকা চাই।

কিন্তু বৃত্তিও বোধহয় শেষকথা নয়। শিক্ষকতাতে, এক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষকের - না, না, অভিভাবকত্ব নয়, আত্মীয়তাপ্রতিম এক সম্পর্ক যার রেশ থেকে যায় অনেকদিন। ছাত্র বুঝি-বা এক সম্ভাব্য ঠাঁই যেখানে শিক্ষক খানিক আরাম পেতে পারেন। এই সম্ভাবনা সর্বত্র দৃশ্যমান না-ও হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু যেখানে হয় সেখানে শিক্ষকের পেশা ও বৃত্তিজনিত অভিমান ঘোচে - তিনি মানুষ হয়ে ওঠেন। সেই যে যুগপৎ বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রপ্রিয় সুবীর রায়চৌধুরী একবার মজা করে বলেছিলেন, আমার কোনো ছাত্র নেই, সবাই স্বাধীন নাগরিক, যার ওপিঠে সৌরীন ভট্টাচার্য উক্তি করেছিলেন, আপনার ওই স্বাধীন নাগরিক ছাত্র... - তার কথা কি সহজে ভুলে যাবার! শিক্ষক ছাড়া যেমন ছাত্র নেই, তেমনি ছাত্র ছাড়া শিক্ষকও নেই। আবার, ছাত্র যেমন তাঁর বর্তমান তেমনি কিয়দংশে তাঁর ভবিষ্যৎও। নিবন্ধপাঠক যদি দৈবাৎ শিক্ষক হন, তিনি যেন এই নিবন্ধকারের মতো এক দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষকের এতাদৃশ অভিজ্ঞতা কিঞ্চিৎ গোচরে রাখেন। 

।। ২ ।।

বস্তুত, আমার কর্মজীবনে আর কিছু করিনি। শুধুই পড়িয়েছি। এক একদাবন্ধু ডাকতেন মাস্টার। মাস্টারি কি আমার ধরণধারণে প্রকট ছিল? জানি না। (তবে ছাত্রাবস্থা থেকেই আমি একটু গম্ভীর গম্ভীর, যা দেখে বন্ধু সত্রাজিৎ দত্ত ছড়া কেটেছিলেন, ‘শুনতে পাচ্ছ হে অমিয়/ হতে চাও যদি রোমিও/ গাম্ভীর্যটা কমিও’।) কিন্তু মাস্টার না হলে আর কী হতাম? আপার ডিভিশন ক্লার্ক? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ. পাশ করে মফস্বলে মা-বাবা-দাদাদের কাছে গেছি। এরপরে কী করব ঠিক জানি না। এক শুভানুধ্যায়ী আত্মীয় এসে অসম সরকারের এক বিজ্ঞপ্তির উল্লেখ করল। হোক না কেরানিগিরি, করে দাও আবেদন, মাইনে খারাপ নয়। ভাগ্যিস দু-এক দিনের মধ্যেই এক চিঠি এল এম.এ.-র সহপাঠী নবনীতার (তখনো দেব) কাছ থেকে, এক্ষুনি ফিরে এসে দরখাস্ত করো, আজই যাদবপুর বিভাগে লেকচারার চেয়ে এক বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। বন্ধু আর কাকে বলে! এই ঋণ ভুলবার নয়।

সব নবীন শিক্ষকের গোড়াকার গল্প এক হয় কিনা জানি না, কিন্তু গোড়ায় একটা বড়ো ক্লাস সামলাতে আমাকে বেশ নাজেহাল হতে হয়েছিল। সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে গ্যালারিবোঝাই ক্লাস। বুঝি-বা এই বেঁটে রোগাপাতলা মাস্টারকে একটু বাজিয়ে নেবার বাসনা হয়েছিল ছাত্রদের কারো কারো। রেজিস্টার খুলে রোলকল শুরু করতেই আরম্ভ হল নানা আওয়াজঃ খুকখুক, খকখক, ঘসঘস। থেমে থেমে। রোলকল বিঘ্নিত হতে লাগল। শেষ করে আর সেদিন পাঠ্যে পৌঁছনো গেল না। এক ধরণের ধর্ষকামই কি নয় এ? অনেকে মিলে একের হেনস্থা? দ্বিতীয় দিনও যখন এই চলল তখন একটা উপায় ঠাওরালাম। শঠে শাঠ্যং। ক্রমিক রোলকল না করে এলোপাথাড়ি রোলকল শুরু করলাম। ক্লাসে হাজিরার ‘পার্সেন্টেজ’ জরুরি; অতএব এক সন্ধি বোধকরি হল। পাঠ্য চালু করা গেল। কিঞ্চিৎ মনোযোগও আদায় হল। মনোযোগ যাতে বাড়ে তার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার কাজ যে আমি করবই, তা প্রমাণ হতে আর বিঘ্নের বুঝি অবকাশ রইল না। আমি পরীক্ষায় উতরোলাম।

যাদবপুরের আর্ট্‌স ফ্যাকাল্টির যে-বিভাগে আমার নিয়োগ হয়েছে, অর্থাৎ যে-বিভাগ থেকে এই কিছুদিন আগে এম.এ. পাশ করেছি, সেখানে আমি তখন এক অন্য পরীক্ষা দিচ্ছি। শিক্ষকতায় যোগ্য হয়ে উঠবার চেষ্টা করছি। আন্ডার গ্র্যাজুয়েটে আমাদের ছাত্র কম, খুবই কম, কিন্তু পাঠক্রম তিন বছরের। তাই আলাদা আলাদা তিনটে ক্লাস পড়াতে হয়। তাছাড়া ছাত্র কম বলে তাদের ব্যক্তিগত মনোযোগ দিতে হয়। খুব সহজ নয় কাজটা। কারণ ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্নতা থাকে এবং এক আদর্শ ছাত্রকে কল্পনা করে পড়িয়ে যাওয়া যায় না। এই তো গেল অনার্স। তার উপর আছে এক দু-বছরের ‘সাবসিডিয়ারি’ (অন্যত্র যাকে ‘পাস’ বলা হয়) যা আর্ট্‌সের অন্য বিভাগের ছেলেমেয়েরা নিতে পারে। যে-কজনই তারা আসুক - ইতিহাস বা দর্শন থেকে এলেও তারা সাহিত্যে আগ্রহী। তারাও মনোযোগ দাবি করে। এখানেও পরীক্ষা। আর এই বিভাগে যেহেতু সকলকেই গোড়া থেকে এম.এ. ক্লাসে পড়াতে হয়, তাই নবীন শিক্ষককে সমবয়সীদের পড়ানোর যোগ্যতাও অর্জন করতে হয়। ভাবুন অমিয় দেব পড়াচ্ছে দীপক মজুমদারকে। সহজ কথা? (বাদল সরকার তো অনেক পরের গল্প। অমিয় দেব তো প্রায় প্রবীণ তখন। তখন অপেক্ষাকৃত নবীন শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, যে বাদল সরকারের প্রিয় মাস্টারমশাই হয়ে উঠেছিল।)

আমার শিক্ষকতার শেষ, প্রকৃতপক্ষে, ছিয়ানব্বইতে (যখন মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব পেলাম), যদিও চার বছর তিন মাস পরে ফিরে এসে কয়েকদিন পড়িয়েছিলাম। শুরু ঊনষাটে। মাঝখানে চার বছর বিদেশে বৃত্তি নিয়ে, যদিও বৃত্তি ফুরোলে সেখানেও কিছুদিন শিক্ষকতা। অবসরের পর অনেকদিন কেটে গেছে। পড়ানোর স্মৃতি ধূসর হয়ে এসেছে। পড়িয়েছিলাম-এর প্রমাণ পাই যখন প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা দেখা দেয়। তাদের কারো কারো সঙ্গে এখন বন্ধুতা। নির্ভরতার সম্পর্ক।প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের টেলিফোন করি। সময়ের ভারও খানিক লাঘব হয়। আত্মগ্লানি ও আত্মতুষ্টির মধ্যবর্তী যে-শূন্যতায় মাঝে মাঝে ঝুলি তার কথাও তো বলতে হয়! দান্তের লিম্বোকে যে মাথার বালিশ করে রেখেছি। ‘ত্যাজি স্পৃহা’ যে-প্রবেশতার দাম দেব না? এসো অক্ষর, এসো অক্ষর, আমায় মুক্তি দাও।

বলছিলাম শিক্ষকতার শুরুর কথা, এসে গেল শিক্ষকতার শেষের কথা। এই বর্তুলতারই অন্য নাম কি জীবন?