আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

প্রবন্ধ

প্রসঙ্গঃ ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত মোদী সরকারের 'শ্বেতপত্র'

প্রসেনজিৎ বসু, সমীরণ সেনগুপ্ত ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস


কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন গত ৮ই ফেব্রুয়ারী সংসদে দেশের অর্থনীতির ওপরে একটি 'হোয়াইট পেপার' বা 'শ্বেতপত্র' প্রকাশ করেছেন। এই শ্বেতপত্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় সরকার তার আর্থিক দায়িত্বপালন কতটা দক্ষতার সাথে করতে পারলো, দেশের জনগণের স্বার্থেই তা বিবেচনা করা দরকার। সেই কারণেই দেশের অর্থব্যবস্থার উপর আলোচনা হওয়া উচিৎ বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে না উঠতে পারলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অন্তঃসারশূন্য হয়ে দাঁড়ায়।

ঠিক সেটাই ঘটেছে মোদী সরকারের এই শ্বেতপত্রের ক্ষেত্রে। অর্থবর্ষ ২০০৪-০৫ থেকে ২০১৩-২০১৪ পর্যন্ত ইউপিএ সরকারের শাসনকালের একতরফা সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে সেই আমলের পরিকল্পনাহীনতা এবং অদূরদর্শীতার বোঝা মোদী সরকারকেও বহন করতে হয়েছে। শ্বেতপত্রের দাবি, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২৩-২৪, অর্থাৎ বর্তমান সরকারের শাসনকালেই নাকি ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতির ভিত মেরামত করে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন সুনিশ্চিত করা গেছে।

ভারতের সরকারি ঋণ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান কিন্তু শ্বেতপত্রের এই আখ্যানকে সমর্থন করছে না। কেন্দ্রীয় বাজেট, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং পরিসংখ্যান মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালের মে মাসে যখন ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ ছিল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি-র ৬৭ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারসমূহের সম্মিলিত ঋণ ছিল জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে যখন ইউপিএ জমানা শেষ হয়, তখন সামগ্রিক ঋণের বোঝা কমে দাঁড়ায় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে জিডিপি-র ৫৩ শতাংশে এবং কেন্দ্র-রাজ্য সরকারসমূহের সম্মিলিত ক্ষেত্রে জিডিপি-র ৬৭ শতাংশে।অথচ, বিগত দশ বছরে মোদী সরকারের সময়কালে সরকারি ঋণের বোঝা পুনরায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের পরিমাণ জিডিপি-র ৫৮ শতাংশে এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্মিলিত ঋণ জিডিপির ৮২ শতাংশে এসে ঠেকেছে।

ইউপিএ সরকারের দশ বছরে জিডিপি-তে ঋণের অনুপাত কমে যাওয়ার পেছনে মূলতঃ দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, ওই সময়কালে দেশের জিডিপি পূর্ববর্তী বাজপেয়ী সরকারের তুলনায় অনেক বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সাথে সরকারি রাজস্ব ঘাটতির মাত্রা কমে আসে।

মোদী সরকারের শাসনকালে জিডিপি-তে ঋণের অনুপাত বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ অদূরদর্শী ও পরিকল্পনাহীনভাবে গৃহীত বিভিন্ন আর্থিক নীতি। নোটবন্দী এবং তাড়াহুড়ো করে জিএসটি চালু করার মতন একের পর এক বড় ধাক্কার কারণে জিডিপি বৃদ্ধির হার একেই কমে গিয়েছিল, সবশেষে কোভিড অতিমারি ও লকডাউনের ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হার আরও কমে যায়। তাছাড়া, অতিমারিজনিত মন্দার পর থেকে বিগত চার বছরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অনেকাংশেই ফিস্কাল স্টিমুল্যাস, অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল থেকেছে।

মোদী জমানায় অর্থনীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ভোগজনিত ব্যয় বৃদ্ধির হার ইউপিএ আমলের তুলনায় কমে গেছে। সরকারি পরিসংখ্যান থেকে এই সত্যগুলি সহজেই দেখা যায়। অথচ নিজেদের আমলের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে ধামাচাপা দিতে এখন মোদী সরকার দশ বছর আগে ক্ষমতা হারানো ইউপিএ সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছে।

শ্বেতপত্রে ইউপিএ শাসনকালের সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, তৎকালীন সরকার উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় এবং সেই সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে বিপুল পরিমাণে অনুৎপাদক সম্পদ (NPA) বৃদ্ধি পায়। সেই সমালোচনা সবটা অন্যায্য না হলেও, বাস্তবে জনগণ দশ বছর আগেই সেইসব ইস্যুতে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে সরকার পরিবর্তন করেছে। এখন বেশি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো মোদী সরকার গত দশ বছরে এই ভুলত্রুটি সংশোধন করতে পেরেছে কি?

সরকারি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে আমদানি এবং রপ্তানি, দুই ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার বিগত দশকের তুলনায় অনেকটা কমেছে। তদুপরি, ২০১৪ সালে প্রতি মার্কিন ডলারের ভারতীয় মুদ্রায় মূল্য ছিল ৬০ টাকা, এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ টাকায়, অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থেকেছে। অতিমারিজনিত মন্দার পরবর্তী সময়ে মূল্যবৃদ্ধির হার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির হার বর্তমানে ৮-৯ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে।

সবচেয়ে উল্লেযোগ্য, মোদী জমানায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি ঋণখেলাপি বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির ঋণের বৃহদংশই মকুব করে দিয়েছে, যেই মকুব হওয়া অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ২০২৩ সালের মার্চ মাসে দাঁড়িয়েছিল ১০.৬ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এই কর্পোরেট ঋণ মকুবের ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি বেশ কয়েক বছর লোকসান করে। সেই লোকসান সামলাতে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের কোষাগার ঘাটতি বাড়িয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির পুনঃপুঁজিকরণ (recapitalisation) করে। এই ধারের পরিমাণ এখন পৌঁছেছে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকায়, যার ফলে প্রতি বছর ১৯ হাজার কোটি টাকা কোষাগার থেকে সুদের খাতে খরচা হচ্ছে। অর্থাৎ, জনগণের করের টাকাতেই বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির ঋণ মকুব করা হয়েছে।

মোদী সরকার যেভাবে কর্পোরেট করের হার কমিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। ২০১৮-১৯ সালে কার্যকরী কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ছিল ৩০ শতাংশের কাছাকাছি, দুই বছরে এটা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২২ শতাংশে। এর ফলে একদিকে রাজস্ব আদায় কমে যায়, অন্যদিকে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা কর্পোরেট মুনাফা বেড়ে যায়। সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে গেলেও এই কর্পোরেট কর ছাড়ের ফলে কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি।

দেশের কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই মোদী সরকারের শ্বেতপত্রে নেই। ৫৫ পাতার ওই শ্বেতপত্রে মূল্যবৃদ্ধি (inflation) কথাটা ৩৪ বার উল্লিখিত হলেও বেকারত্ব (unemployment) শব্দটারই কোন উল্লেখ নেই। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোদী জমানায় বেকারত্বের হার ২০১৭-১৮ সালে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছিল। ২০২২-২৩ সালে বেকারত্বের গড় হার একটু কমে ৩.২ শতাংশ হলেও, শহরাঞ্চলে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। ইউপিএ জমানায়, ২০১১-১২ সালে গড় বেকারত্বের হার ছিল ২.৩ শতাংশ, শহরাঞ্চলে যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৯ শতাংশ। অর্থাৎ মোদী জমানায় বেকারত্ব বেড়েছে।

২০২২-২৩ সালে কর্মরতদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ ছিল স্বরোজগারি বা স্বনিযুক্ত পেশায় কর্মরত (self-employed)। এই স্বরোজগারিদের মাসিক আয় ২০১৮-তে ছিল ১২,৩০৪ টাকা, ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ১৩,৩৪৭ টাকা। এই পাঁচ বছরে বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির গড় হার যেখানে ছিল ৬ শতাংশ, দেশের ৬৩ শতাংশ শ্রমজীবীর মাসিক আয় বেড়েছে বছরে মাত্র ২ শতাংশ হারে। অর্থাৎ তাদের প্রকৃত আয় কমে গেছে।

দেশের কোটি কোটি কর্মহীন যুবক-যুবতীদের দুর্দশার দায় মোদী সরকার একদিকে চাপিয়ে দিতে চাইছে ইউপিএ সরকারের উপর। অন্যদিকে, ভোটের মুখে মসজিদ ভেঙে মন্দির গড়ার সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে শাসকদল এই কর্মহীন যুবসমাজকে বিপথগামী করছে।

মোদী সরকার ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের নানারকম সুযোগ সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। গত দশ বছরে আদানি গোষ্ঠীর মালিকের ব্যক্তিগত সম্পদ বেড়েছে উল্কাগতিতে। হিন্ডেনবার্গ এবং ওসিসিআরপি (OCCRP) রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায় যে আদানি গোষ্ঠী বিদেশে বিনোদ আদানির একগাদা ভুয়ো কোম্পানির মাধ্যমে নিজেদের কোম্পানির শেয়ারে বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা ঢেলে, শেয়ারের দাম বাড়িয়েছে। এই সমস্ত কার্যকলাপ সরকারের বদান্যতা ব্যতীত চালানো সম্ভব হতো না।

আদানি-সহ বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি এর প্রতিদানে 'ইলেক্টোরাল বন্ড'-এর মতন অস্বচ্ছ পথে বিজেপির পার্টি তহবিলে বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান দিয়ে গেছে গত কয়েক বছর ধরে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিকতম রায়ে 'ইলেক্টোরাল বন্ড'-এর পিছনে লুকোনো কর্পোরেট 'লাভার্থী'-দের মুখোশ খসে পড়বে কিনা তা সময়ই বলবে।

অতীতের সরকারগুলোর ব্যর্থতা খুঁজে তাদের একতরফা গালিগালাজ করার পরিবর্তে গত দশ বছরের এই ধান্দার ধনতন্ত্রের উপর একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারলে বরং গণতন্ত্রের উপকার হতো।