আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

সমসাময়িক

সন্দেশখালিঃ দু চার কথা


পাঠক ইতিমধ্যেই সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত। সংবাদমাধ্যমের পাতায় বিগত কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে উত্তর চব্বিশ পরগনার প্রান্তিক অঞ্চল সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় রোমহর্ষক দিনলিপি মানুষ পড়েছেন খবরের পাতায়। ঘটনার সূত্রপাত প্রায় মাসখানেক আগে। এলাকার দোর্দন্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা শেখ শাহাজানের বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি রেশন দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগে তল্লাশি করতে যায়। এলাকার মুকুটহীন রাজা শাহজাহান ও তাঁর দামাল ছেলের দলের সহ্য না হওয়ায় তারা ইডির অধিকারীকদেরই খানিক সমঝে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে রাজামশাইকে ঘটনার অভিঘাতে নিজের বাড়ি ছেড়ে গোপন ডেরায় যেতে হয়েছে। সেখান থেকে তিনি আদালতে মামলা করছেন, শর্ত দিচ্ছেন গ্রেফতার না হলে আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন। এসবই চলছে, কিন্তু রাজ্য পুলিশ প্রশাসন তাকে কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। তৃণমূলের নেতারা যে হুডিনির থেকেও বড় জাদুকর তা বোধহয় রাজ্য পুলিশ না থাকলে বোঝা যেত না।

এমত অবস্থায় রাজার শারীরিক অনুপস্থিতিতে প্রজারা ঈষৎ বিদ্রোহ শুরু করে। রাজামশাই-এর লেঠেল বাহিনী যাঁদের জমি, ভেড়ি দখল করেছে তাঁরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা বিবরণ দিয়েছেন কীভাবে স্বল্পমূল্যে গায়ের জোরে তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। রাজি না হলে চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে ভেড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর সেই দখল করা সম্পত্তির জোরে এলাকার প্রশাসনকে কব্জা করেছে তৃণমূলের এই গুণধর নেতা ওরফে মাফিয়া। এই ঘটনা নতুন নয়। রাজ্যের বুকে এরকম বহু তাজা নেতার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কেউ শিক্ষিকার মুখে জলের জগ ছুঁড়ে মেরে বিখ্যাত, কেউ উপাচার্য বা অধ্যক্ষকে ঠেঙিয়ে বিখ্যাত আবার কেউ বা পুলিশকে বোমা মারতে বলে আপাতত তিহার জেলে বিশ্রাম নিচ্ছে।

রাজনৈতিক মাফিয়া ও তৃণমূল দলটির যোগাযোগ বহু পুরাতন এবং সর্বজনবিদিত। এমন কোনো মানুষ পাওয়া মুশকিল যিনি বিশ্বাস করেন যে তৃণমূল দলটির চালিকাশক্তি স্থানীয় রাজনৈতিক মাফিয়া নয়। পূর্বতন সরকারের দিকেও অভিযোগের আঙুল বহুক্ষেত্রে উঠেছে। সে সময়েও এরকম মুড়িমুড়কির মতো না হলেও স্থানীয় রাজনৈতিক মাস্তানদের রাজনীতিতে ছড়ি ঘোরানোর অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু একটি বৈশিষ্ট্যে বর্তমান শাসকদল একেবারেই আলাদা। আগে অভিযোগ উঠলে পুলিশ প্রশাসন অন্তত ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে পুলিশ প্রশাসনের সেই আপাত নিরপেক্ষ চরিত্রটিও বিসর্জন গিয়েছে। তারই নিদর্শন সন্দেশখালির ঘটনাপ্রবাহ।

পাঠক খেয়াল করবেন এলাকার মানুষের অভিযোগের মমর্বস্তু কিন্তু এটা নয় যে শেখ শাজাহান বা তার অনুচরেরা অত্যাচার করছে। এটা মানুষ জানেন যে দুর্বৃত্ত মাত্রেই এই আচরণ করবে এবং নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে ভয়ের পরিবেশ তৈরী করবে। বরং মানুষ যা মানতে পারছেন না তা হল অভিযোগ করার পরেও পুলিশ প্রশাসন অপরাধীকে কেবল বাঁচাতে তৎপর নয়, বরং তার গ্রহণযোগ্যতা যাতে বজায় থাকে তা নিশ্চিত করছে। অভিযোগ পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর রাতের অন্ধকারে তৃণমূল দুর্বৃত্ত এবং পুলিশ মিলেমিশে কাজ করছে এটাই মূল অভিযোগ। পরিস্থিতি এমনই যে মহিলারা অত্যাচারের বিবরণ দিতে গিয়েও স্পষ্ট বিবরণ দিচ্ছেন না যাতে তাঁদের পরিচয় বেরিয়ে আসতে পারে। আর পুলিশ প্রশাসন এই ভয়ের পরিবেশ কাটানোর বদলে যুক্তি সাজাচ্ছেন যে আসলে এমন কিছু ঘটেনি, একটা গুজব তৈরী করে অশান্তি ঘটানো হচ্ছে। তাই নিয়মনীতিকে গুলি মেরে পুলিশ ইচ্ছেমতো ১৪৪ ধারা জারি করছে। উদ্দেশ্য যদিও এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে আরও নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা। যদিও আদালত সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে এমন পদক্ষেপ বেআইনি। হয়ত পুলিশ আবার কোনো নতুন ফিকির খুঁজে বার করবে।

এই গোটা ঘটনাদুটি স্পষ্ট অভিঘাত তৈরী করেছে জনমানসে। প্রথমত রাজ্যে যেখানে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল শক্তিসঞ্চয় করেছে সেখানে অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে আরও গুরুতর সমস্যা তৈরী যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। তবে আশার কথা অভিযুক্তেরা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত না হওয়ার কারণে এখনও অবধি এ অভিযোগ তোলা যায়নি। কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর বিষয় হল তৃণমূল কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে গোটা রাজ্য প্রশাসনের নির্লজ্জ দুর্বৃত্তায়ন। পুলিশ প্রশাসন বরাবরই শাসকদের পক্ষেই কাজ করে, কিন্তু শাসকের হয়ে দুর্বৃত্তের মত আচরণ করার নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয়, যা কেবল বর্তমান রাজ্য পুলিশেরই বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছে। এখানে পুলিশ প্রতিবাদী ছাত্রকে খুন করায় অভিযুক্ত, রাতের অন্ধকারে প্রতিবাদীদের বাড়ি ভাঙচুরে অভিযুক্ত। আর এখানেই উঠে আসে সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রবণতা - গোটা সমাজের দুর্বৃত্তায়ন। যদি প্রশাসন দুর্বৃত্তের মতো আচরণ করে তবে আমজনতাকেও সেই প্রবৃত্তি আত্মস্থ করতে হয় বাঁচার তাগিদে। আর ঠিক এই কারণেই এই রাজ্যের রাজনীতি ক্রমেই আরও হিংসাত্মক ও প্রাণঘাতী এক পরম্পরায় পর্যবসিত হয়েছে। যে কোনো রাজনৈতিক বিবাদে প্রাণহানি আজ এ রাজ্যে জলভাত। আর এই অসহিষ্ণুতা কেবল যে রাজনৈতিক আবহেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়। তা ছড়াবে গোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে, জাতিতে, ভাষায়। ঠিক এই কারণেই আজকে রাজ্যে বিজেপির মতো দল বেড়ে উঠতে পারছে। এই বিপদ যদি এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা অনুধাবন করতে না পারেন তাহলে এই পরিবেশের বিরুদ্ধে কোনো নাগরিক প্রতিরোধটুকুও আর থাকবে না। তখন ভাবের ঘরে চুরি বই অন্য উপায় থাকবে না।