আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা ● ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● ৩-১৮ ফাল্গুন, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

সংসদীয় গণতন্ত্রের সংকট


শেষ হল সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশন। ২০১৯ সালে যেই লোকসভা গঠিত হয়েছিল তা ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন কীর্তি স্থাপন করেছে এই কথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মানুষ অনেক আশা নিয়ে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের লোকসভায় পাঠায়, এই ভেবে যে মানুষের জীবনের কথা, তাদের সমস্যার কথা আলোচিত হবে লোকসভায়, যার ভিত্তিতে নতুন আইন তৈরি হবে জনস্বার্থে।

কিন্তু সপ্তদশ লোকসভা বসেছে গড়ে বছরে মাত্র ৫৫ দিন, যা একটি স্বতন্ত্র রেকর্ড। এর আগে কোনো লোকসভা এত কমদিনের জন্য অধিবেশনে বসেনি। গোটা একটা লোকসভার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল কোনো ডেপুটি স্পিকারকে নির্বাচিত না করে। এর কারণ হল এই যে সাধারণত ডেপুটি স্পিকার পদটি বিরোধী দলের জন্য বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ক্ষমতার অহংকারে মত্ত মোদী সরকার বিরোধী দলগুলিকে বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিতে রাজি নয়। তাই ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হল না।

এই একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই দেশে গণতন্ত্রকে কীভাবে দুর্বল করেছে মোদী সরকার। সপ্তদশ লোকসভায় মোট ২২১টি বিল পাশ হয়েছে। এর ৫৮% পাশ হয়েছে সংসদে বিল পেশ হওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে। জম্মু ও কাশ্মীরকে ভেঙে তিন টুকরো করার মতন বিল অথবা মহিলা সংরক্ষণের মতন গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পেশ হওয়ার দুইদিনের মধ্যে পাশ করানো হয়েছে। ৩৫% বিল পাশ হয়েছে এক ঘন্টার কম সময় আলোচনা করে। অর্থাৎ দেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে প্রায় কোনো আলোচনা ছাড়াই বিল পাশ হয়ে গিয়েছে সংসদে। বিজেপি তথা এনডিএ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা গায়ের জোরে প্রয়োগ করে সংসদকে নিছক সরকারের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। যেখানে আলোচনা, যুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে কোনোরকম ঐক্যমত্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করা হয়নি। মাত্র ১৬% বিলকে সংসদের বিভিন্ন কমিটিতে আলোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। পঞ্চদশ লোকসভায় ৭১% বিল আলোচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডাকে প্রায় গায়ের জোরে আইনে পর্যবসিত করা হয়েছে। বিরোধীরা প্রতিবাদ করলেও তাকে গ্রাহ্য করা হয়নি।

বিরোধী স্বর কতটা শোনা যাচ্ছে বা তার মর্যাদা কতটা দেওয়া হচ্ছে তা গণতন্ত্রের মানের একটি সূচক হিসেবে গ্রাহ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিগত সপ্তদশ লোকসভার ক্ষেত্রে বলা যায় সবরকমভাবে বিরোধীদের সংসদের মধ্যে অপদস্থ করা হয়েছে, তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। বিরোধীদের তরফ থেকে পেশ করা কোনো মুলতুবি প্রস্তাবকে গ্রাহ্য করা হয়নি। নজিরবিহীনভাবে ১৪৬ বিরোধী সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। মানহানির মামলার অজুহাতে রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে যা খারিজ হয়। মহুয়া মৈত্রের মতন বিরোধী সাংসদকে সম্পূর্ণ একতরফাভাবে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। গণতন্ত্রের পীঠস্থান বলে স্বীকৃত ভারতের লোকসভায় যেভাবে বিগত পাঁচ বছর ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অধিকার খর্ব করা হয়েছে তার তুলনা গোটা পৃথিবীতে বিরল।

এই সমস্ত প্রবণতার সঙ্গে আরেকটি যেই মারাত্মক প্রবণতা এই সংসদের মেয়াদকালে দেখা গেল তা ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটিকে যেন প্রায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের চেহারা দেওয়া হল। যেই অনুষ্ঠানে দেশের আদিবাসী রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত আমন্ত্রিত হননি, সেখানে নানান সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা গেল প্রধানমন্ত্রীকে। ঘটা করে পুজো করে সংসদ ভবন উন্মুক্ত হল। এই অনুষ্ঠানটি বিরোধীরা বয়কট করেছিল রাষ্ট্রপতিকে নিমন্ত্রণ না করার প্রতিবাদ জানিয়ে। একই সঙ্গে সংসদে বিরোধীদের অধিকার খর্ব করা তথা তাদের কথা বলতে না দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধীরা সংসদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। কিন্তু অনুষ্ঠানের সর্বাধিক সাংকেতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল একটি রাজদণ্ডকে সংসদে স্থাপিত করা। ভারত ১৯৫০ সালে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সবরকমের রাজা-রাজড়াদের দিন শেষ হয়। কিন্তু দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে দেখতে পছন্দ করেন না। তাই তাঁর রাজদণ্ডের দরকার পড়ে। জনগণের প্রতিনিধিদের মাঝে একটি 'রাজদণ্ড'কে স্থাপিত করে এই বার্তাই যেন দেওয়া হল যে খাতায়-কলমে দেশটি সংসদীয় গণতন্ত্র হলেও স্বৈরাচার এবং একনায়কতন্ত্রকে যেন সরকারীভাবে শীলমোহর দেওয়া হল এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

ইতিমধ্যে দেশে 'রাম রাজত্ব' আগত। রাম মন্দিরের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। সপ্তদশ লোকসভার শেষ অধিবেশনের শেষ দিনে তাই মোদীর জয়গান গেয়ে অধিবেশন সমাপ্ত হল। রাম মন্দির উদ্বোধনকে একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হল সংসদের অভ্যন্তর থেকে। এবং মোদী ভজনায় নিবেদিত মন্ত্রী এবং শাসকদলের সাংসদরা মোদীকে প্রায় রামের মতন মহান নায়কের স্থানে অভিষিক্ত করলেন। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারতের প্রাণকেন্দ্রে পুঁতে দেওয়া হল হিন্দুত্ব এবং একনায়কতন্ত্রের পতাকা।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচন তাই কোনো সাধারণ নির্বাচন হবে না। এই নির্বাচনের ফলাফলের উপর নির্ভর করবে যে ভারতবর্ষ দেশটি কি আর আদৌ খাতায়-কলমেও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারবে? নাকি হিন্দুত্ব এবং একনায়কতন্ত্রের বিষাক্ত মিশ্রণে ভারতের সংবিধানকে পরাভূত করে জন্ম নেবে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা? বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে রক্ষা করা তাই সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের অবশ্যকর্তব্য।

কিন্তু ভারতের জনগণের জীবনে যদি শাসকদলের অত্যাচার একমাত্র দুর্ভাগ্যের কারণ হত তাহলে তার প্রতিকার করা সহজ হতো। জনগণের দুর্ভাগ্য এই যে সম্মুখে ফ্যাসিবাদ এবং একনায়কতন্ত্রের বিপদ দেখেও আমাদের দেশের বিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি দেশের মানুষের স্বার্থকে নিজেদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থের থেকে ছোটো করে দেখে। তাই অনেকদিন আলাপ আলোচনা চালিয়ে বিরোধী জোটের নামে জনগণের সামনে তারা কোনো আশাব্যঞ্জক রাজনৈতিক শক্তিকে খাড়া করতে পারেননি। আগামী কয়েকদিনে যদি সেই রাজনৈতিক জোট দেশজুড়ে তৈরি না হয়, তাহলে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র যে গভীর সংকটে পড়বে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।