আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

প্রবন্ধ

পাভলভ, লেনিন, ধর্ম, সোভিয়েত রাশিয়া

আশীষ লাহিড়ী


প্রাচ্য-পাশ্চাত্যর টানাপোড়েনে খ্রিস্টীয় অর্থোডক্স চার্চের ঘাঁটি হয়ে-ওঠা পুরোনো রাশিয়ায় কুসংস্কার আর চার্চাধিপত্য বৈজ্ঞানিক বিকাশের পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছিল। পশ্চিম ইউরোপের রেনেসাঁস-উত্তর এনলাইট্‌ন্‌মেন্ট যুগের প্রভাবে সেই অচলায়তনে কিছুটা ধাক্কা লাগলেও, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কুপ্রভাব রুশ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রইল। সেটাকে ভাঙবার জন্য দরকার হল একটা পরিকল্পিত রাজনৈতিক আর সামাজিক বিপ্লব, আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি যার বুনিয়াদ। নতুন ধরনের অর্থব্যবস্থার তাগিদে পরিকল্পিতভাবে অতি দ্রুত বিকশিত হল বিজ্ঞান-প্রযুক্তি। সেইসঙ্গে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক যুক্তিশীলতার দ্বন্দ্বও প্রকট হল।

১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে ইভান পাভলভকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি ধর্মবিশ্বাসী? উত্তরে মৃদু হেসে তিনি বলেছিলেনঃ

শোনো ভাই, আমার ধার্মিকতা, আমার ঈশ্বরবিশ্বাস, আমার চার্চে যাওয়া এসব নিয়ে অনেকে অনেকরকম কথা বলে। এর মধ্যে কোনো সত্য নেই, সবটাই কল্পনা। আমি লেখাপড়া করেছিলাম ধর্মীয় বিদ্যালয়ে (সেমিনারিতে)। ধর্মীয় ইস্কুলের বেশিরভাগ ছাত্রর মতো আমিও ইস্কুলে থাকতেই ধর্মে বিশ্বাস হারিয়ে নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলাম।

এই শেষ বাক্যটি খুব কৌতূহলজনকঃ ধর্মীয় ইস্কুলে পড়েছিলেন বলেই তিনি - তিনি শুধু নন, আরও অনেক ছাত্র - নিরীশ্বরবাদী হয়ে উঠেছিলেন। অর্থাৎ ধর্মীয় ইস্কুলের অভিভাবন তাঁদের মনে বিপরীত ভাব জাগিয়েছিল। বোঝা যায়, সংশয়হীন আপ্তবাক্যকে মেনে নিতে পারেননি তিনি; তাঁর সংশয়ী মন বিচারশীলতাকে প্রাধান্য দিত। পরবর্তীকালে তিনি দেখিয়েছিলেন, মস্তিষ্কের বিভিন্ন প্রকার হয়; তারই ওপর অনেকখানি নির্ভর করে ব্যক্তিমানুষের মনের প্রবণতাঃ কেউ আপ্তবাক্যে বিশ্বাসপ্রবণ; কেউ সংশয়ী, যুক্তিবাদী। যারা তাঁর কথায় একধরনের 'দৃঢ়' মস্তিষ্কের অধিকারী তারা ঈশ্বরের ধারণাটিকে যুক্তির আলোকে বাজিয়ে নিয়ে পরিত্যাগ করতে পারে, তার জন্য তাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়না। অন্য কোনো একটা উৎস থেকে, হয়তো বিজ্ঞান থেকে, রাজনীতি থেকে, তারা নিরাপত্তা খুঁজে পায়। কিন্তু বেশিরভাগ লোকেরই, এমনকী বিজ্ঞান-জানা লোকেরও মস্তিষ্ক তাঁর কথায় ‘দুর্বল’, তারা আপ্তবাক্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল, সর্বশক্তিমান কোনো মুশকিল-আসানের অভিভাবন ছাড়া তাদের ভয় কাটেনা। সেটা সত্য না মিথ্যা, সেটা বিবেচ্য নয়; সেটা স্বস্তি দেয়, ভয় কাটায়, এটাই বড়ো কথা। মিথ্যা অভিভাবনের মধ্য থেকে স্বস্তির বোধ খুঁজে নেওয়ার এই প্রক্রিয়াটাও বিবর্তনের পথেই বিকশিত হয়েছে। এটা বাস্তব। সুতরাং তিনি নিজে আকৈশোর ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেও, ঈশ্বরভিত্তিক ধর্ম যে বহু মানুষের কাছে মৌলিক অর্থে একটা প্রয়োজনীয় জিনিস, এটা বুঝতেন। তাই অন্য কোনো শক্ত বিশ্বাসের বুনিয়াদ তৈরি না-করে জোর করে কাউকে তার ধর্মাচরণ থেকে বিরত করার তিনি বিরোধী ছিলেন।

১৯৩১ সালে ম্যাক্সিম গোর্কিকেও পাভলভ বলেছিলেন,

আমি একেবারে ছেলেবেলাতেই ধর্মবিশ্বাস হারিয়েছিলাম। কী করে সেটা ঘটল, ব্যাখ্যা করা শক্ত। ভগ্‌ট আর মোলেস্কট-এর লেখায়, তারপর প্রকৃতি বিষয়ক বিজ্ঞানে আমি বুঁদ হয়েছিলাম। সারাজীবন তো এই ক্ষেত্রেই কাজ করলাম; আমার কারবার বস্তু নিয়ে।

১৯৩৫ সালে ৮৬ বছর বয়সে পাভলভ বলেছিলেনঃ

আমার বাবা ছিলেন যাজক, আমি বড়ো হয়েছিলাম ধর্মীয় পরিবেশে, কিন্তু বছর পনেরো-ষোলো বয়সে হরেক রকম বই পড়ে আমার মত বদলে ফেলি।

পাভলভের কিশোরকালের প্রিয় লেখক জেকব মোলেস্কট (১৮২২-১৮৯৩)-এর ‘জীবনচক্র’ বইটি উনিশ শতকের বস্তুবাদকে জোর মদত জুগিয়েছিল। হল্যান্ডের এই চিকিৎসক ও শারীরতত্ত্ববিদ এ বইতে ‘বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তর’ খোঁজার দাবি তোলেন। রক্ত আর বিপাকক্রিয়া (মেটাবলিজ্‌ম) নিয়ে তাঁর গবেষণা শারীরবৃত্তীয় রসায়নের বিকাশে প্রভাব ফেলেছিল। আবেগ আর চিন্তারও শারীরবৃত্তীয় বনেদ আছে, এই মতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। “ফসফরাস নেই তো চিন্তাও নেই” - এ ছিল তাঁর এক বিশেষ প্রিয় উক্তি।

বাস্তবিক, ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত যে-সময়টা পাভলভ চার্চের বিদ্যালয়ে পড়তেন, সেটা রাশিয়াতে মস্ত পরিবর্তনের কাল। পশ্চিমের বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার দ্রুত প্রসার ঘটছিল তখন। ডি. আই. পিসারেভ (১৮৪০-১৮৬৮) বিজ্ঞানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইগুলির সহজ ও জনপ্রিয় ভাষ্য রচনা করতেন। যেমন, ডারউইনের ‘অন দ্য অরিজিন অফ স্পিসিস’ বেরোবার পাঁচ বছর পর তিনি অবিশেষজ্ঞ মানুষের জন্য ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের এক সহজবোধ্য রুশ ভাষ্য হাজির করেছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন জার-বিরোধী নিহিলিস্ট। অর্থোডক্স চার্চের সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন; রাষ্ট্রবিরোধী, চার্চবিরোধী কথাবার্তার জন্য জেলও খেটেছিলেন কয়েক বছর। শুধু পাভলভ নয়, লেনিনের প্রজন্মেরও বহু মানুষ এই অতি স্বল্পায়ু লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

ধর্মতত্ত্ব আর মানবিকী বিদ্যার ছাত্র ইভান পাভলভ-এর মনে এইসব লেখকদের জীববৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা গভীর ছাপ ফেলেছিল। বিজ্ঞানই মানুষের অবস্থার উন্নতি ঘটাবে, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। বিজ্ঞানকে তিনি মানুষের মননের মহত্তম বহিঃপ্রকাশ মনে করতেনঃ

আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানের প্রগতি মানুষকে সুখ দেবে। আমি বিশ্বাস করি মানুষের মনন আর তার মহত্তম বহিঃপ্রকাশ– বিজ্ঞান– মানবপ্রজাতিকে রোগভোগ, বুভুক্ষা, বৈরিতা থেকে মুক্তি দেবে, মানুষের দুঃখকষ্ট কমাবে। এই বিশ্বাসই আমাকে কাজ চালিয়ে যাবার শক্তি জুগিয়েছে, এখনও জোগায়।

কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বেশ ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যায়। বিপ্লবের ঠিক পরেই তিনি লেনিনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ল্যাবরেটরি বিদেশে কোথাও স্থানান্তরিত করে দেওয়া হোক। লেনিন রাজি হননি; বরং পাভলভের বিজ্ঞান গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সেই দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতেও সমস্তরকম সুযোগ-সুবিধার এবং বিশেষ 'রেশন'-এর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেসময় একটা কথা চালু হয়েছিলঃ "পাভলভের কুকুররা রাশিয়ার চাষিদের থেকে ভালো খায়।"

সোভিয়েত বিজ্ঞাননীতি তাঁকে অভিভূত করলেও, সোভিয়েত ধর্মনীতির সঙ্গে তাঁর মত কোনোদিনই পুরোপুরি মেলেনি। না-মেলার পেছনে শুধু মানবিকতা নয়, ছিল বিজ্ঞানও। পাভলভ মার্কসবাদী ছিলেন না, কিন্তু দৃঢ় মস্তিষ্ক আর দুর্বল মস্তিষ্কের টানাপড়েন নিয়ে যে-ভাবনা তিনি উপস্থিত করেছিলেন তা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায়। যান্ত্রিক বস্তুবাদের সঙ্গে অবশ্য একেবারেই খাপ খায় না। পাভলভ যান্ত্রিক বস্তুবাদী ছিলেন না। সুতরাং তিনি বুঝেছিলেন ধর্মকে জোর করে বাতিল করে দিলে উলটো ফল ফলবে। ধার্মিকতার প্রতি আঘাত এলে ধার্মিকরা এমনকী শহিদত্ব বরণ করতেও পিছপা হবে না; আর সেটা হলে ‘দুর্বল’ মস্তিষ্কের অধিকারী অধিকাংশ লোকের ধর্মপ্রবণতা বাড়বে বই কমবে না। তিনি বলেছিলেনঃ

আমি মনে করি, মানুষকে তার আচরিত ধর্মের বদলে অন্য কোনো ধর্ম না-দিয়ে তার ধর্ম ছিনিয়ে নেওয়াটা ঠিক না। একজন বলশেভিকের কাছে ঈশ্বরবিশ্বাস অপ্রয়োজনীয়, কারণ সে যে অন্য একটা ধর্মবিশ্বাস পেয়ে গেছে, যার নাম কমিউনিজম।

পাভলভ বিজ্ঞানী ছিলেন, যুক্তিবাদী দেশপ্রেমিক ছিলেন, কিন্তু ময়দানে নেমে কোনওদিন রাজনীতি করেননি। কিন্তু লেনিন তো তা নন। তিনি তো রিয়েল পলিটিক্স করা মানুষ। অথচ ধর্ম বিষয়ে পাভলভের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে লেনিনের ভাবনাচিন্তার খুবই মিল ছিল। বিপ্লবের ঠিক পরের সেই টালমাটাল দিনগুলিতে লেনিনের স্থিতধী প্রজ্ঞা দু'দিক থেকে সোভিয়েত সমাজের ও বিজ্ঞানের বিকাশে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছিল। এক, পাভলভের মতো তিনিও বুঝেছিলেন, এককোপে ধর্মকে কেটে ফেলা যায় না, সেকাজ করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তাই অতি উৎসাহে যেসব বিপ্লবী মারমার করে ধর্ম তাড়াতে উঠেপড়ে লাগলেন, এমনকী ধর্মীয় কারণে বিজ্ঞানীদের বিরোধিতা করলেন, তিনি তাঁদের সংযত করলেন, যিনি নিজে ছিলেন আপোসহীন নাস্তিক। কম্‌সোমল (নিখিল সোভিয়েত লেনিনবাদী তরুণ কমিউনিস্ট সঙ্ঘ) যখন তেড়েফুঁড়ে ইস্টার উৎসব পালনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামল; লেনিন তার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য, পার্টির সাপেক্ষে না হলেও রাষ্ট্রর সাপেক্ষে ধর্ম ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব ব্যাপার, সেখানে রাষ্ট্রর কোনো ভূমিকা থাকবে না, সমর্থনের তো নয়ই, বিরোধিতারও নয়। একজন পার্টি সদস্যর পক্ষে ধর্মপালন - ব্যক্তিগত ধর্মপালনও - কখনওই অনুমোদনযোগ্য নয়; কিন্তু রাষ্ট্রর একজন সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে সেকথা খাটে না। কাজেই ইস্টার উৎসব জোর করে বন্ধ করা অযৌক্তিক। তাঁর মতে ‘বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তিতর্কর মাধ্যমে জনগণকে নাস্তিকতায় এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্বদর্শনে উদ্বুদ্ধ করার গুরুত্ব সমধিক। এই উদ্দেশ্যে প্রায়শই যেরকম মোটাদাগের প্রচার চালানো হত তার সমালোচনা করেছিলেন তিনি।

একদল অতি উৎসাহী বিপ্লবী চেয়েছিলেন, সোভিয়েত বিপ্লবের কিংবা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শনের বিরোধী ‘বুর্জোয়া’ বিজ্ঞানীদের বর্জন করতে। লেনিন প্রবলভাবে বিরোধিতা করেছিলেন এই দৃষ্টিভঙ্গির। এর ফলে সোভিয়েত যুগে বিজ্ঞানের যে কত উন্নতি হয়েছিল তার অনেক প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে। ইভান পাভলভের কথা তো বহুবিদিত। কিন্তু এমন ঘটনা আরও অনেক। বিশিষ্ট ডারউইনপন্থী জীববিজ্ঞানী কে. এ. তিমিরিয়াজেভ (১৮৪৩-১৯২০) যখন জীবনের একেবারে শেষ পর্বে সোভিয়েত রাষ্ট্রর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন তখন লেনিন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। "এতদিন কোথায় ছিলেন?" বলে হয়রান করেননি বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে। তিমিরিয়াজেভ অনেকদিন ধরেই চাইছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিশেষ বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান গবেষণার কাজ চলুক। তাঁর এই ইচ্ছা পূরণ করেনি জার-শাসনতন্ত্র, কিন্তু লেনিনের সরকার করেছিল। মৃত্যুর অব্যবহিত আগে তিমিরিয়াজভ-এর পরিচালনায় একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয় সোভিয়েত রাশিয়ায়। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের সময় মেনশেভিক গোষ্ঠীভুক্ত বিজ্ঞানী ইগর ট্যাম যখন বলশেভিক নেতা লেনিনের পক্ষে ভোট দিলেন, লেনিন সেই সমর্থনকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিলেন।

বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এ. এফ. ইয়োফ তো সরাসরি সোভিয়েত-বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়ে ১৯১৭ সালে একদল রুশ বিজ্ঞানীর সঙ্গে ক্রিমিয়া চলে গিয়েছিলেন। তারপর যখন প্রতিবিপ্লবী বাহিনীর সঙ্গে সোভিয়েত ফৌজের লড়াই চলছে, লড়াইয়ের ফলাফল অনিশ্চিত, সেই বিপদসংকুল সময় বেশ খানিকটা ঝুঁকি নিয়ে তিনি পেত্রোগ্রাদ ফিরে আসেন, সোভিয়েত দেশকেই আপন দেশ বলে মেনে নেন। তাঁর প্রাক্তন সোভিয়েত-বিরোধিতা নিয়ে একটা প্রশ্নও তোলেননি লেনিন। বিপ্লবের অব্যবহিত পরের অবিশ্বাস্য কঠিন দিনগুলিতে এই ইয়োফ-ই হয়ে উঠেছিলেন সোভিয়েত পদার্থবিজ্ঞানের শিরোমণি। কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান (সলিড স্টেট ফিজিক্স), তড়িৎ-চুম্বক গবেষণা, তেজস্ক্রিয়া, পরমাণু পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর ষাট বৎসর পূর্তিতে ছাত্র পিওতর কাপিৎসার শ্রদ্ধা নিবেদন অমর হয়ে আছেঃ

আপনিই তো সোভিয়েত পদার্থবিজ্ঞানের স্রষ্টা। আপনি সুখী হোন! আমরা কামনা করি আরও অনেক অনেক বছর আপনি আমাদের পিতাস্বরূপ বিরাজ করুন, যে-পিতাকে আমরা সকলে ভালোবাসব, এবং যাঁর কাছ থেকে আগের মতোই প্রশ্রয় পাব।

অথচ লেনিন সেদিন অসহিষ্ণু হয়ে সোভিয়েত পদার্থবিজ্ঞানের ‘পিতাস্বরূপ’ ইয়োফ-এর সোভিয়েত-বিরোধী অতীত নিয়ে প্রশ্ন তুললে কারা পেত এই অসাধারণ মানুষটির বৈজ্ঞানিক মেধার সুফল? হয়তো নাৎসি জার্মানি, নিদেনপক্ষে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন আর আমেরিকা।

বিজ্ঞানের দর্শন বিতর্কেও এই নমনীয়তা ছিল লেনিনের বৈশিষ্ট্য। জার্মানিতে যেমন ‘ইহুদি বিজ্ঞান’ মার্কা মেরে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন একদল প্রসিদ্ধ আগমার্কা ‘জার্মান’ বিজ্ঞানী, সোভিয়েত দেশেও তেমনি ওই তত্ত্বকে ‘ভাববাদী’ ছাপ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার একটা হাস্যকর হুজুগ উঠেছিল। লেনিন সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আর তা নিয়ে যেসব দার্শনিক প্রশ্ন উঠছে, দুটো কিন্তু আলাদা জিনিস। প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে আপত্তি তোলা পাগলামি; কিন্তু ওই তত্ত্ব-জাত দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা অবশ্যই চলতে পারে।

লেনিন ঠিকই বুঝেছিলেন যে কমিউনিস্ট-শাসিত আপাত-ধর্মবিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রের তলায় তলায় বইছে প্রাতিষ্ঠানিক অর্থোডক্স চার্চের চোরাস্রোত। কিন্তু ক্রমে বাইরের শক্তির বিরোধিতার মোকাবিলা, দেশের দ্রুত আর্থিক বিকাশের তাড়না আর ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ফ্যাসিবাদী যুদ্ধ, এসবের চাপে রাষ্ট্র যেন সেটা দেখেও দেখল না। সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র আর পার্টি যেন আগেকার যুগের সর্বজ্ঞ ধর্মপ্রতিষ্ঠানেরই জায়গা নিল। কোন পথে এগোবে বিজ্ঞান, সেটা ঠিক করে দিল রাষ্ট্র, যেটা মূলত সামরিক স্বার্থের পথ। সেই পথের পথিকরাই রাষ্ট্রের প্রিয়; অন্যরা পরিত্যাজ্য। অবশেষে সেই রন্ধ্রপথেই একদিন সোভিয়েত রাষ্ট্রর বিলয় ঘটল।

______________________________

1) George Windholtz, ‘Pavlov’s Religious Orientation’, Journal for the Scientific Study of Religion, 1986, 25(3), 320-327.
2) Ibid
3) Ibid
4) Ibid
5) Ibid
6) Helena Sheehan, Marxism and the Philosophy of Science: A Critical History, Verso, London 2017, p. 155.
7) Ibid., p. 157.
8) Istvan Hargittai, 'Buried Glory: Portraits of Soviet Scientists', OUP, 2013.
9) Helena Sheehan, p. 155.