আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

প্রবন্ধ

নাচনি জীবনকথা

সৃজা মণ্ডল


‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী উর্বশী’ - যার নূপুর নিক্কনে আনন্দযজ্ঞের আবাহন ধ্বনিত, কিন্তু যখন তাকে দেখা যায় কোলাহল মুখর কুৎসিত নগরের ভিড়ে - তার চোখের কালিতে লেখা থাকে লাঞ্ছনা পীড়িত জীবনের কথা। সুরেলা ঝুমুরের কন্ঠে আর নৃত্যের ঝংকারে মুখরিত নূপুর নিয়ে যে মেয়েরা সাবেকি মানভূম এবং ছোটনাগপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে নাচ-গান-কৌতুকের পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেই ‘নাচনি’-ও, “ন বিটি ন। লাচনী কারঅ মা লয়, ই সমসারে লাচনী কন হ মানুষ লয়। উ অ্যাকটি মানুষের পারা পাথরের ঢেলা। পাথর, পাথর...। মানুষ লয় - পাথর” - কথাসাহিত্যিক সুব্রত মুখোপাধ্যায় নাচনি জীবনের এই বাস্তব চিত্রটি আমাদের সামনে নিয়ে আসেন তাঁর ‘রসিক’ উপন্যাসে।

নাচ আর ঝুমুর গান নিয়ে রসিকের ঝুমুরিয়া কল্পনাকে জীবন্ত করে তোলে নাচনি। তবে নাচনির কোনো সামাজিক স্বীকৃতি নেই। তবু ওদের মনের কোণে লুকিয়ে থাকে ঘর বাঁধার বাসনা। ঘরের উঠোনের তুলসীমঞ্চ আর মনসার থান ওদের জীবনে জড়িয়ে আছে। মেটে রান্নাঘরের উনুনের পাশে বসে যে নাচনি রান্না করে, তাকে আর চেনা যায় না নাচের আসরে। হাতের মুদ্রায়, কোমর দুলিয়ে, ভ্রূকুটি আর চোখের মদির ইশারা ও উগ্র প্রসাধন তাকে মোহিনী করে তোলে।

প্রখ্যাত গবেষক সুধীরকুমার করণের মতে, “নাচনী বা নর্তকী আঞ্চলিক ভূ-স্বামীদের রক্ষিতা, আশ্রিতা এবং অনুগতা; ভূ-স্বামীদের বিলাসকক্ষের নৃত্যগীতবিশারদা নর্মসহচরী”। নৃতাত্ত্বিক পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর লেখা থেকে জানা যায় নাচগানের সঙ্গে যুক্ত নাচনিরা দরিদ্র, নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। মানভূম পুরুলিয়ার মুচি, ডোম, সাঁওতাল, তাঁতি, জেলে, কামার - এইসব অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলারা ঝুমুরের অমোঘ আকর্ষণে ঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, নাচনি হয়ে সুরের জীবন কাটায়, কেউ বা পিতা-মাতার দারিদ্র্যের কারণে বিক্রি হয়ে যাওয়া, কেউ বা নারী পাচারকারীর শিকার। অভাবের তাড়নায় পুরুলিয়ার রসনা সরদানকে তার বাবা মাত্র চার বছর বয়সে ষাট টাকায় বিক্রি করে দেন রসিক কালীনাথ সিংহ সর্দারের কাছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘রসিক’ উপন্যাসে আমরা দেখি মা হয়েও বিরলা শুধুমাত্র অর্থের জন্য মেয়ে মালতীকে তরণী সেনের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। মেয়েকে ঠেলে দেয় নাচনি-জীবনের দিকে -
“মা জননী দুই হাত পেতে গ্রহণ করে মেয়ের দরুন অগ্রিম মূল্য। কাগজগুলি হাতের মুঠিতে চেপে ধরে বলে, ...মালতী আমার এক ছটাক জমিই বঠে”।

আবার জ্যোৎস্না কর্মকারের ‘পৃথিবী’ গল্পে দেখা যায়, আধুলি যখন মদন নামে এক যুবকের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখার অপরাধে গ্রামের প্রধান-উপপ্রধানের নির্দেশে গ্রাম ত্যাগ করার শাস্তি পায়, তখন রসিক গৌর ঠাকুর আধুলিকে নাচনি হবার প্রস্তাব দেয় এবং আধুলি গৌর ঠাকুরের সঙ্গে পালিয়ে যায় - “গৌর ঠাকুর এগিয়ে এলেন আধুলির দিকে। আধুলির হাত ধরে জোর গলায় বললেন - নাচনি হবি আধুলি? তো চ আমার সঙ্গে”।

সাহিত্যিক সৈকত রক্ষিতের ‘আমপাত চিরি চিরি’ উপন্যাসে উঠে এসেছে নাচনি হয়ে ওঠার আরেক নির্মম উদাহরণ।রবন এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ষোড়শী রবন মনোহরকে ভালোবেসে তার গ্রাম খড়িদুয়ারা থেকে পালিয়ে অন্তরীন হয়েছিল ইঁচাডি গ্রামে। পালাবার পর থেকে রবন আর মনোহর দুজনেরই খোঁজ শুরু হয়। অবশেষে রবনকে খুঁজে পায় মনোহরের গ্রামের ছয় জন মাতব্বর। তারা রবনকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। মনোহর প্রতিবাদ করতে পারেনা। রবনকে ঝুমুর গান-নাচ শিখিয়ে অর্থোপার্জনের সহজ পথ খুঁজে নেয় ইঁচাডি গ্রামের পাড়ূ, জিতেন, হলধর, রাধু, কাশীনাথের মতো লোভী, কামার্ত মানুষ। সান্ধ্য আসরের শেষে একেক রাতে রবনকে শয্যাসঙ্গিনী হতে হয় একেক জনের। সমাজে রবনের নারীর সম্মান নিয়ে বাঁচার কোনো স্থান নেই, সে হয়ে ওঠে একজন বহুজনভোগ্যা। তার বেঁচে থাকার একমাত্র পথ।

এমনই এক নাচগানের আসরে হঠাৎ হাজির হয় খড়িদুয়ারা গ্রামের পাঁচজন সাঁওতাল। রবনের গ্রাম ছেড়ে পালানোর অপরাধে সে সমাজচ্যুত। সাতষট্টি মৌজার সাঁওতালরা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয় চাল, ভেড়া বাদ দিয়েও নগদ অর্থ দিতে হবে হাজার এক। এই হাজার টাকা জরিমানার সূত্রেই রবনের নাম হয়ে যায় ‘হাজারী’ - সে আর সাঁওতাল নয়, মাহাতো নয়, রবনও নয় - সে ‘হাজারী বাই’ - এক খেমটি।

অকর্ষণযোগ্য পাথুরে উঁচু-নিচু জমি তথা টাড়-ডুংরি বনভূমির দেশ মানভূম ঝুমুরের দেশ। আর এই ঝুমুরের একনিষ্ঠ প্রতিপালক নাচনি সম্প্রদায়। নাচনি সম্প্রদায়ের ইতিহাসে লুকিয়ে আছে রাজা-জমিদারদের প্রতিপত্তির কাহিনি। কথিত আছে, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের রাস উৎসবে একটানা ১৪ দিন ঝুমুর ও নাচনি নাচের আসর বসিয়ে বাগমুন্ডির রাজা মদনমোহন সিংহদেব রাজকোষের বিপুল অর্থ খরচ করে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া, পাতকুমের রাজার সঙ্গে বাগমুন্ডির রাজার ঝুমুর গানের প্রতিযোগিতা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। কাশীপুরের পঞ্চকোট রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন প্রখ্যাত নাচনি শিল্পী সিন্ধুবালা দেবী। রাজদরবারে বা জমিদার বাড়িতে গীত ঝুমুরই 'দরবারি ঝুমুর', গাম্ভীর্যে মাঠেঘাটে গাওয়া ঝুমুরের থেকে খানিক উচ্চমার্গীয়। মূলত রাধাকৃষ্ণের চিরায়ত লীলাবিষয়ক গানই ঝুমুরের বিষয়। পুরুলিয়ার ঝুমুর গবেষক জলধর কর্মকারের বয়ানে পাই, সে সময়ে নাচনিরা যে নাচ নাচতেন তা মূলত জমিদারি, বৈঠকি ও ধুমড়ি পর্যায়ের। এগুলো আদিরসাত্মক। এই নাচে নাচনির রসিকেরা মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন আর নাচনিরা পরতেন ঘাংরি (ঘাগরা)। কোমরে কোমর-বন্ধনী। নাগড়া, ঢোল, সানাই, বাঁশি, মাদল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে হতো এই নাচ।

১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে ছোটো ছোটো জমিদাররা স্থায়ীভাবে জমিদারিত্ব লাভ করেন। অষ্টাদশ শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত মানভূম-সিংভূম-পুরুলিয়া এবং রাঁচি-হাজারিবাগ অঞ্চলে অনেক ছোটো জমিদার বা সামন্তপ্রভুরা বাইজি নাচে বিনোদন খুঁজতেন। তবে মোঘল বাদশাহদের মতো ‘বাইজি’ রাখা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই নিম্নবর্গীয়, অবহেলিত, প্রান্তিক মেয়েদের নাচের জন্য আনা হতো। এই নাচিয়ে মেয়েরা হয়ে গেল নাচনি। সেই থেকেই সূত্রপাত। আজকের এই নাচনি নাচ আসলে সেই সময়কার মানভূম-সিংভূম অঞ্চলের বাইজিদের নাচ। নাচনি রেখে তারা নিজ আভিজাত্য ও বিলাসিতার পরিচয় দিতেন। নিজস্ব পারিবারিক জীবনের বাইরেও তারা বাইজিদের স্বতন্ত্র বাসস্থান ও ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। পরে ওই বাইজিদের সন্তান-সন্ততিরা বিত্তশালীদের কাছে কোনো স্বীকৃতি পেত না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপালনের ব্যয়ভার থেকেও বাইজিদের বঞ্চিত করা হত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইজিদের জীবনেও নেমে এসেছিল শোচনীয় দুর্দশা।

সামন্তপ্রভু ছাড়া সাধারণ একশ্রেণীর মানুষও বাইজি রাখার বিষয়ে আকৃষ্ট হয়। অথচ তাদের বাইজিকে ঘরে পুষে রাখার মতো সঙ্গতি নেই। তবে পুরোমাত্রায় আছে তাদের পৌরুষ ও আকাঙ্ক্ষা। স্বাভাবিকভাবে তাদের হাতে ‘বাইজি’ হয়ে উঠল ‘বাই’। এবং এই ‘বাই’ পোষার খরচ জোগাড় করতেও তারা কাজে লাগাল ‘বাই’কে, তারা তাকে মহল থেকে নিয়ে এল বাইরে। মাঠে-ঘাটে-মেলাপ্রাঙ্গনে। বহু মানুষের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যমে, রসিক সংগ্রহ করতে লাগল তার মুদ্রা।

রসিক-নাচনির নৃত্য ও সংগীতের গুরু তিনি, নৃত্য পরিচালক। আসরের সূত্রধর, সংগীতশিল্পী, প্রয়োজনে বাদ্যযন্ত্রীও তিনিই। আবার নাচনির পালক-পোষক, অভিভাবক, প্রভু, দেহসঙ্গী - এক কথায় সবই। অচ্ছেদ্য উভয়ের পারস্পরিক নির্ভরতা। নয়ের দশকে পুরুলিয়া-মানভূমের টাঁড় জমিতে রসিক জীবনের উত্থান-পতন, হাসি-কান্নার স্বর প্রত্যয়ের সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রসিক’ উপন্যাসে। ১৯৯১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সেই উপন্যাস। যেখানে তরণী সেন প্রভঞ্জনের কাছে জানতে চায় রসিক কে। ঝুমুর গানের ওস্তাদ প্রভঞ্জন বলে, রসিক সে, যে প্রেমের রসটি বোঝে। এই বোঝাবুঝি একজনেতে হবার নয়। তাঁর জন্য রসিকের দরকার। রসিক হল “নাগর কালা আর নাচনি তাঁর প্রেমময়ি রাধারানী”।

নাচনির ওপর রসিক-এর অধিকার। সে-ই নাচনির মালিক। নাচনির সঙ্গে রসিক-এর গান্ধর্ব-সম্পর্ক। রসিক-এর বিষয়-সম্পত্তির অধিকারী স্ত্রী ও সন্তানরা। নাচনির সেখানে কোনো বৈধ অধিকার নেই। নাচনি-সহবাসে পিতৃত্বের দাবি মানতেন না রসিক। তাই নাচনির গর্ভসঞ্চার হলেই তাকে নষ্ট করে দিতেন। এমনকি অসুস্থ হলেও সেই নাচনি তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। সেই উদাহরণ আমরা পাই নিমাই ভট্টাচার্যের লেখা ‘নাচনী’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে কুষ্ঠ রোগী হিসেবে নাচনি কমলাকে আমরা খুঁজে পাই। সুস্থ হয়ে কমলা হাসপাতালের অলিন্দে অপেক্ষা করে তার রসিক গঞ্জুর জন্য, স্বপ্ন দেখে গঞ্জু তাকে নিতে আসবে মোটরে চড়ে। কিন্তু গঞ্জু তাকে নিতে আসে না। একদিন কমলা-ই চলে যায় গঞ্জুর কাছে। কিছুদিন পর কমলা ফিরে আসে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে। গঞ্জু তাকে নেয়নি - “কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, না ডাক্তারবাবু, কেউ আমাকে নিল না। এতদিন ধরে কতজনের কাছে ঘুরলাম, কতজনকে নাচ দেখালাম, গান শোনালাম কিন্তু কেউ আমাকে রাখল না”।

যৌবন গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যেতে থাকে নাচনিদের মন, তখন সেই মন ক্রমশ হতাশাগ্রস্ত হয়, আচ্ছন্ন হয়ে যায় বাঁচতে না পারার সংকটে। তখন কেবল স্মৃতিনির্ভর তাদের বেঁচে থাকা। সৈকত রক্ষিতের উপন্যাসের নাচনি হাজারীরও শরীর আর সায় দেয় না। তবুও সে আসরের অপেক্ষায় থাকে। আর এখানেই উপন্যাসের নাচনি ‘হাজারী’ আর বাস্তবের পুরুলিয়ার প্রবীণ নাচনি ‘বিমলা’ এক হয়ে যায়। বিমলা দেবী এই বয়সেও কোমরে পেটি বাঁধা ঘাগরা উড়িয়ে নাচতে না পারলেও, পায়ে তাল ঠুকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলেও, দুটো ভবপ্রিতার ঝুমুর গাইতে চান।

নানা প্রতিবন্ধকতা ও পরাধীনতার মধ্যেও নাচনির একটা নিজস্ব অহংকার থাকে। তার অহংকার রূপের, যৌবনের। নাচনির যৌবন ও কৃৎকৌশলের ওপরই আসরের দর্শকের সংখ্যা নির্ভর করে। ফলে যৌবনবতী নাচনির কদর সবসময়। সব রসিকই তাদের নিজেদের অধিকারে রাখতে চায়। কিন্তু সবসময় তা সম্ভব হয় না। আর সেই ক্ষমতা হারানোর হতাশা থেকেই আসে নাচনি হরণের প্রসঙ্গ। একসময়, মানভূমের নাচনিরা ছিল লুণ্ঠনযোগ্যা এবং অধিকৃত নাচনি তার মালিকের সম্পদ বা পৌরুষের প্রতীক। কোনও কোনও রসিক নিজের অহংকার জাহির করার জন্য ঘরে একটির বদলে দুটি নাচনি রক্ষিতা হিসেবে রাখে। আসলে দুটো নাচনিকে একসঙ্গে নাচিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায় নিজের আত্ম-অহংকার। সৈকত রক্ষিতের ‘খেমটি’ গল্পে সেই ছবিই আমরা দেখতে পাই।

‘খেমটি’ গল্পে প্রৌঢ় হাতিরাম মাহাতো অনেকদিন ধরেই যমুনাকে করায়ত্ত করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। একদিন তার গ্রামের কিছু লোকজনকে নিয়ে সে শালডিহা গ্রামে নাচনি নাচের আসরে গেল। আসর শেষ হতেই, ভোরের অন্ধকারে, মুহূর্তের জন্য একলা পেয়ে হাতিরামের দল পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসে বছর কুড়ি-বাইশের যমুনাকে। শালের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পালিয়ে এসে তারা চেপুয়া গ্রামের হাতিরামের ঘরে এনে কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দিল তাকে। তালা পড়ল বাইরে থেকে। যদিও হাতিরামের আরেকটি নাচনি আছে, ভেদি। কিন্তু ভেদিকে বাদ দিয়ে হাতিরামের এখন কাঁটাডি গ্রামের বনমালীর দল থেকে ছিনিয়ে আনা যমুনাকে নিয়েই কল্পনার ভুবন গড়ে উঠতে থাকে। এবং একদিন ঘটল অঘটন। যেদিন প্রথম হাতিরাম, যমুনাকে ঘরের বাইরে বের করেছিল, ভেদির সঙ্গে তাকেও সে স্নান করাতে নিয়ে গেছিল নদীতে, সেদিনই কাঁটাডি গ্রামের বনমালী ঢুকে পড়ল চেপুয়া গ্রামে।

এবার ওই যমুনাকে নিয়ে তার আগের মালিক বনমালীর সঙ্গে বর্তমান মালিক হাতিরামের মুখোমুখি সদলবল সংঘর্ষের উপক্রম হল। শুরু হল বোলচাল, পৌরুষের চিহ্নস্বরূপ লাঠি এবং গোঁফ নিয়ে উত্তপ্ত কথা ছোঁড়াছুড়ি। শেষে তারা ফয়শালার রাস্তায় আসে। বনমালী ও হাতিরামকে দুপাশে সরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই ভিড়টিও দুভাগ হয়ে যায়। এবার রাস্তার মাঝে খেমটিকে দাঁড় করিয়ে বলা হল - “যে ভাড়ুয়ার খেমটি হয়ে সে থাকতে চায়, সেদিকেই সে স্বচ্ছন্দে হেঁটে চলে যেতে পারে। চলে যাক”। যমুনা দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নিচু করে। তারপর হঠাৎ রাস্তা থেকে মাঠের দিকে নেমে ছুটতে থাকে সে। এক অনিশ্চিত আশ্রয়ের সন্ধানে। পুরুষদের দুটি দলও ছুটতে থাকে তাকে লক্ষ্য করে। নাচনি জীবনের এক কদর্য চিত্র গল্পকার সৈকত রক্ষিত এঁকেছেন মরমী দক্ষতায় -
“সেই অশ্রুসজল মুখ তুলে একটিবারের জন্য সে চেয়ে দেখল দুটি পক্ষকে। দুটি পক্ষ ঘিরে অজস্র মানুষের মুখ। লালসা ও কৌতুক তাদের প্রতিটি দৃষ্টিকে বাঙ্ময় করে রেখেছে। যমুনার মনে হল সবকটা মুখই তার পরিচিত ও অভিন্ন। সে হাতিরামকে দেখল। দেখল বনমালীকেও। কঠিন মুখ করে লাঠি উঁচিয়ে তারা পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের চোখে কোনো করুণা নেই, প্রেম নেই, শুধুই রিরংসা। তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাদলের শব্দ যেন দামামা হয়ে বেজে উঠছে তার কানের দুপাশে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ রাস্তা থেকে মাঠের দিকে নেমে যায় আর পাগলীর মতো ছুটতে শুরু করে”।

এই গল্পে রয়েছে পুরুষদের কব্জায় থাকা নাচনিদের জীবন, নাচনি লুণ্ঠন এবং তার স্বত্ব নিয়ে রসিকদের মধ্যে হানাহানিতে নারীত্বের অবমাননা। নাচনি হরণের প্রসঙ্গে দেখা যায় দুই রসিকের দ্বন্দ্বের কুৎসিত শিকার নাচনি। নাচনিও যে একজন নারী - সেই বোধই হারিয়ে যায় পৌরুষের গর্বে উন্মত্ত রসিকদের মন থেকে। নাচনি রসিক দ্বারা নিপীড়িত হলেও, তাকে ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। কারণ, রসিক ছাড়া সে অসম্পূর্ণ ও উপার্জনহীন। ফলে কোনও নাচনি লুণ্ঠিত হলেও, সে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন রসিকের সঙ্গে জীবন জুড়ে নেয়, ক্রমে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। গল্পে যমুনার মাধ্যমে সেই মনোভাবই ফুটে উঠেছে -
“একটি পুরুষের প্রবল গ্রাস থেকে বেরিয়ে এলেও আরেকটি পুরুষেই তার নিয়তি। তা না হলে কে তাকে নাচাবে? কার মাদলের শব্দছন্দে, পায়ে রিনঝিন নূপুরের ধ্বনি তুলে, বাতাসে উড়িয়ে দেবে তার রঙিন ঘাগরা?”

অর্থনৈতিক প্রান্তসীমায় বাস করা নাচনিদের গৃহ কাঠামো, সাজসজ্জা এবং তাদের প্রাত্যহিকতার ছবি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৈকত রক্ষিত তাঁর ‘ধূলা উড়ানি’ উপন্যাসে -
“...হাজারী এসে দাঁড়াল বাবলা গাছে আড়াল করা কুঁড়ে ঘরটির সামনে। ঘর আর উঠোনকে সীমানার মধ্যে রেখে যে কাঁচা পাঁচিলটা একসময় ছিল, এখন সেটা নেই বললেই চলে। ফাটল ধরেছে যত্রতত্র। ভেঙেও পড়েছে। ছাগল শাবকগুলি ভাঙা পাঁচিলের ডাই করা মাটিতে লাফালাফি করে। আগাছা খায়। টিনের কপাট দেওয়া ঘরটা এখনো আছে বটে, তবে সেটাও নামমাত্র। তার চালা কোথাও বসে গেছে। কোথাও বাঁশ-বাতা সুদ্ধু ভেঙে পড়েছে। ঘরের দেয়াল বেয়ে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে নেমে ধুয়ে দিচ্ছে দেয়ালের মাটি। যেন ঠ্যালা মারলেই ধ্বসে পড়বে”।

চৈত্র মাসেই গ্রামে গ্রামে নাচনি নাচের আসর বসে। একটা সমতল উঁচু মাটির ঢিপি। আয়তন নির্দিষ্ট নয়। ঐ ঢিবিটাই মঞ্চ বা আখড়া। মঞ্চের ওপর কোথাও ত্রিপল, কোথাও বা কোনো পাতলা আচ্ছাদন। চারদিকে বসেন দর্শক শ্রোতা। জেনারেটর চালিয়ে আলো ও মাইকের ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধে হতে না হতে দূরবর্তী গ্রাম থেকে ভেসে আসে একটানা ডুগডুগি বাজনা। সৈকত রক্ষিত ফুটিয়ে তুলেছেন নাচনি নাচের আসর, নাচনির সজ্জা -
“মঞ্চের ধারে ধারে, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসেছিল ওস্তাদরা। বাঁশিকার পোঁ ধরল। বেজে উঠল হারমোনিয়াম। তারপর ঘুঙুর বাঁধা পায়ে ,রিনিঠিনি ছন্দ তুলে, ঠমকে ঠমকে এগিয়ে এলো হাজারী। হিমানী পাউডারে রাঙানো মুখ। গালে ঝিলিক দিচ্ছে গোলাপি প্রলেপ। ঠোঁটে চটচটে পুরু লিপস্টিক। আলো পড়ে সারা অঙ্গ থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে রূপের জৌলুশ। পারার গুঁড়ো”।

হারমোনি আর ফুলেট বাঁশির আবহে শোনা যায় খেমটির কাতর কণ্ঠ -
“হামার ভাবিতে জনম গেল
হামার কাঁদিতে জনম গেল
বঁধু তুমারি তরে...”

রসিকের উদ্দেশ্যে গেয়ে ওঠা গানের এমন কলি যে কোনো রসিকেরই বুক গর্বে ও পৌরুষে ফুলে ওঠে। সে তখন মঞ্চে চরকির মতন ঘুরতে থাকা খেমটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দর্শকদের দেখায় আর নিজের ঢোলটিকে ছাতির ওপর ফেলে গোঁফে তা দিতে দিতে ভুট ভুট হাসে।

দর্শকরা খুশি হয় রসিকের পৌরুষ দেখে। এই পৌরুষের কাছে তার নারীটি অবদমিত হয়েই থেকে যায়। রসিকের বানিজ্যিক তাগিদে সাড়া না দিয়ে উপায়ও থাকত না নাচনির। যখন থেকে সে সাড়া দিল, যখন থেকে সে পুরুষের ইশারায় নাচল, তাকে নাচাতে লাগল পুরুষ, তখন থেকে সে হারাল তার অন্তিম মূল্যটুকু। এই অবমূল্যায়ন তথা অবক্ষয়ের কারণেই, সে একই সঙ্গে অসহায়, উৎপীড়িতা, সে বাই থেকে খেমটি, নাচনি ইত্যাদি। সমাজ-মানুষের কাছে নারী হিসেবে তার যৎসামান্য মর্যাদাও সে ঘুঙুরের ছন্দে আর মাদলের বোলে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হল। বাধ্য হল চোখের জল দিয়ে বিনোদনের ঝুমুর রচনা করতে।

গল্পকার সৈকত রক্ষিত তার ‘মুসরিয়া বাই’ গল্পে নাচনি জীবনের যে নতুনত্ব দিকটির প্রতি আলোকপাত করেছেন তা হল স্ত্রী ও নাচনি সহযোগে রসিকের সহবাস ও দাম্পত্য জীবনযাপন। একই ঘরে নাচনি ও স্ত্রী নিজেদের মতো জীবনযাপন করে থাকে। তবে কখনও কখনও তাদের মধ্যে কোন্দলের জন্ম নেয়। তখন রসিক নাচনির পক্ষ অবলম্বন করে। গল্পে দেখা যায় রসিক পটকন সিং লুটে আনা নাচনি মুসরিয়াকে নিয়ে ব্যস্ত এবং তার স্ত্রী আদরির প্রতি তার তাচ্ছিল্য ও অনাদরই বেশি -
“একটি ঘরে পটকন সিং থাকে তার বৌ আদরিকে নিয়ে। যদিও তার মনের ভেতরে কোথাও এতটুকু আদরির স্থান নেই। নাচনি নাচনি করে সে চব্বিশ ঘণ্টা পাগল। যে নাচনির, পরপুরুষের সংসারে এলেও সাংসারিক কাজ - পাট করার কথা নয়। রসিক পুরুষটি নাচনিকে পাটরানী করে রাখে। সে সময়ে সময়ে খায়দায়, রূপপালন করে। ইচ্ছে হলে ছোটখাটো কাজ করলেও করতে পারে। তবে এই নিয়ে রসিকের বউয়ের সঙ্গে কোনো সংঘাতে সে যায় না। তেমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে, নাচনি হয়ে রসিকই লিয়াই-ঝগড়া করে তার বউয়ের সঙ্গে। বউকে সে উঠতে বসতে চাকরানি করে রাখে”।

স্ত্রীর প্রতি অবহেলা আর নাচনির প্রতি মনোযোগ রসিকের সঙ্গে তার স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ককে দুর্বিষহ করে তোলে।নাচনি ও স্ত্রী উভয়েরই প্রতি রসিক চরম অসম্মান প্রদর্শন করে। সে নাচনিকে তোষামোদ করে, পোষে অর্থ সংস্থানের যন্ত্র হিসাবে। আবার স্ত্রীকে লাঞ্ছনা দিয়ে প্রতিপালন করে সংসারের কর্মযজ্ঞকে সচল রাখতে। একই ঘরে দুই নারীর সঙ্গে সহবাস করলেও মানসিক ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হয় না। নারী মন অনুধাবনের ক্ষমতাও থাকে না রসিকের। এতে নারীত্বের চরম অবমাননা ঘটে।

সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘রসিক’ উপন্যাসে, পাণ্ডবকুমারের স্ত্রী লতা স্পষ্ট করে তোলে নাচনি আর কুলবধূর বিভেদের অবস্থানটি -
“আমি আর উ এক লই। আমি তুমার বিটার বিহা করা কুলের বউ। আর উ বিটিছেল্যাটি লুঠে আনা নাচনী। ...লতা বলে যায়, আমার হাথের অন্নজলেই সমসারের কনহ বারণ নাই। আর উ নাচনী বিটিছেল্যাটি হেঁশেলের হাঁড়ি ছুঁত্যে পাইবেক নাই। ...তুমার বিটা আমার মরদ। আর উ বিটিছেল্যাটির রসিক। উয়ার সঙ্গে আমার মরদের লাচা গানা অভিনয়ের সম্পক্ক”।

পাণ্ডবকুমারকে নাচনি বিজুলিবালা ও কূলবধু লতার সঙ্গে এবং ধ্রুবকুমারকে নাচনি কুসমি ও কূলবধু অমলার সঙ্গে সুখি দাম্পত্যে সহাবস্থান করতে দেখা যায়। তবে এই সহাবস্থানে কিছু নিয়ম আছে। যেমন, নাচনির কোনও অধিকারই নেই গৃহের হেঁসেলে প্রবেশ করার। তার একটাই কাজ রসিকের সেবা করা - “লাচলির লেগ্যে সমসারে একটিই ধম্ম। উয়ার রসিকের মান রাখা”।

নাচনি তার ধর্মানুযায়ী সর্বদাই রসিককে মান্যতা দেয়। সে রসিককে স্বামী জ্ঞানে পুজো করে। এক্ষেত্রে নাচনির প্রেম ও রসিককে ঘিরে যে পারিবারিক আবহটি তার চারপাশে গড়ে ওঠে তা একপ্রকার মরীচিকাই। ধ্রুবকুমারের মুখে নাচনির বাস্তব সংসারিক অবস্থানটি প্রকাশ পেয়েছে প্রচণ্ড রূঢ়তায় -
“এ সংসারে নাচনী কারো মা নয়, বিটি নয়, ঘরণী নয়। নাচনীর সিঁথার সিঁদুর – সে তো সাঙা করা পরিহাসের দাগ। তার সঙ্গে সাত পাক ঘোরার কোনও ব্যাপার নেই। এবং সেই মোতাবেক এ সংসারে রসিক-নাচনীর সম্পর্কটি নেহাতই অভিনয়ের ডোরে বাঁধা”।

নাচনি জীবনের এই ধ্রুব সত্য-কুলের বউ নয় সে, সমাজের চোখে পতিত, রসিকের সংসার সে আগলে রাখলেও রসিকের কাছেও তার মান নেই। তার হাতে বাড়া ভাত রসিকের মুখে তোলা মানা।

একসময়ে নাচনিদের জীবনের অন্তিম পরিণতি ছিল আরও নির্মম। ‘নাচনির কথা’ বইয়ে মহাশ্বেতা দেবীর কলমে পাই, “পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়াতে নাচনি মেয়েদের মৃত্যু হলে, তাঁদের দাহ বা সমাধি হয় না। তার মৃতদেহ যায় ভাগাড়ে”।মৃতা নাচনির পায়ে দড়ি-বেঁধে, ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ অমানবিকভাবে মৃতদেহ টেনে নিয়ে যেত। নাচনির মৃতদেহ তখন শকুন-শেয়ালের খাদ্য। নাচনি রাজবালা তন্তুবায়ের রসিক খোকা তন্তুবায় মারা গেলে তাঁকে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয় এবং কিছুদিন পর উরমা হাটতলায় একটি মহুল গাছের তলায় রাজবালা মারা যান। কেউ দেহ সৎকারের জন্য আসেনি। তারপর মৃতদেহে পচন শুরু হলে হাটে গন্ধ ছড়াবে বলে কয়েকজন মিলে তাঁর দেহটি দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে গিয়ে নদীর ধারে ভাগাড়ে ফেলে দেয়। সেই বাস্তব উঠে এসেছে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘রসিক’ উপন্যাসে। কুসমির লাশ ভেসে উঠেছিল নদীতে। হত্যা নয়, আত্মহত্যা। প্রহ্লাদ ডোম এসেছে তাকে নিয়ে যেতে। তার একার হরিধ্বনিই যথেষ্ট। পায়ে দড়ি বেঁধে নদীর কাছে ফেলে আসা কুসমি “...চলে যাচ্ছে নদীর টানে টানে। প্রহ্লাদের হাতের দড়ির অন্য প্রান্ত তার একখানি পায়ে বাঁধা। সেই আলতা পরা পা উঁচু হয়ে আছে। আর একটি পা মাটিতে। কুসমি এগিয়ে চলেছে মাটি কামড়ে, মাটির দোলায় চড়ে। ...সেই মাটি কামড়ে চলে যাওয়ার অন্তরালে এখন এক নূতন সুরের সূত্রপাত হয়েছে। ...কুসমি নবনূতন আনন্দের গানের ভিতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নদীর দিকে”।

রসিকের পরিবারের নিয়ম নেই মৃতদেহ ছোঁয়ার। এমনকি নাচনি মারা গেলে দুফোঁটা চোখের জল ফেলাও তাদের মানা। রসিকের পরিবারের কোনো অশৌচ নেই। সমাজের এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলে প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যম্ভাবী। নাচনির মৃতদেহ সৎকার করা ডোম প্রহ্লাদের জবানিতে লেখক শুনিয়েছেন -
“প্রহ্লাদ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ই কথা অ কি তুমরা জান্য নেই যে তুমাদের কনহ অশুচ নাই। সব অশুভ আমার। ...বছরভর ই এলাকায় যত লাচনী মা সগ্যে যান সকলের অশুচটি যে আমকেই মাইনতে হয়”।

তবে এখন এই বীভৎস সামাজিক রীতি অবলুপ্তপ্রায়।

যে নাচে সে-ই ‘নাচনি’ - সমাজ-নিন্দিত, আপাত-ব্রাত্য এই নৃত্যকলায় নাচ এবং নাচের শিল্পী, উভয়েই নাচনি। কিন্তু যখন কোনো নাচনি দারিদ্র্য উপেক্ষা করে ঝুমুর তথা নাচনি নাচকে কেন্দ্র করে একাগ্র ধ্যানে নিমজ্জিত, তাকে দেখলে আমরা শুধু বিহ্বলই হইনা, তাকে দেখলে মন বড় স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। তিনি বিমলা দেবী। গানেই তার কষ্টের পরিচয় নিহিত। যখন তিনি গেয়ে ওঠেনঃ “কত আসে কত যায়/ কত দিন কত মাস/ কত ভাবি কত কাঁদি/ তবু সাড়া পাই না তোমার/ বলি ও হরি বড়োই দুর্ভাগ্য আমার/ আমার না হইল আশার সুংসার...”।

নাচনির জীবন সুখ ও আনন্দের নয়। রূপ-যৌবন ও শারীরিক সামর্থ্য নিঃশেষিত হলে নাচনিদের জীবন আর সত্যিকারের জীবন থাকে না, সে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ।ব্যতিক্রম সিন্ধুবালা দেবী, পস্তুবালা দেবী। প্রয়াত নাচনি সিন্ধুবালা দেবী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘লালন’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০৩ সালে পুরুলিয়া জেলা বইমেলায় তৎকালীন জেলাশাসক শাল, শাড়ি ও অন্য উপহারের ডালি দিয়ে সংবর্ধিত করেছিলেন সিন্ধুবালা দেবীকে। পস্তুবালা দেবীও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘লালন পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০১৮ সালে। পুরুলিয়া শহরের উপকণ্ঠে সুরুলিয়া ডিয়ার পার্কের বিপরীতে 'দুর্বার মহিলা সমিতি'র সাহায্যে গড়ে উঠেছে 'নাচনি উন্নয়ন মঞ্চ'-এর অফিস। বর্তমানে নাচনিরা পান শিল্পী ভাতা। কিন্তু তাদের সীমাহীন দারিদ্র্যের কোনো বদল ঘটে না।

পুরুলিয়ার প্রান্তভূমিতে নাচনির উপার্জিত অর্থ রসিক ভোগ করেন, সেখানে নাচনির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা গৌণ। তাদের অসহায়তার আর একটি কারণ, তারা প্রায় সকলেই নিরক্ষর ও অর্জিত জ্ঞান সবটাই শুনে বা দেখে। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, একজন রসিকের একাধিক নাচনি থাকতে পারে, কিন্তু নাচনির ক্ষেত্রে একই সঙ্গে একাধিক রসিকের কাছে থাকা যায় না। তবে রসিকের জন্যই নাচনির অস্তিত্বসহ সমগ্র শিল্পটিই বেঁচে আছে। নাচনির যৌবনের আকর্ষণ তাঁর কাছে সত্য, কিন্তু শিল্পের টান আরও বড় সত্য। ঘর এবং বাইরের দ্বন্দ্ব তাঁর অবিরত। অনেক ঝুমুর কবি রসিক হয়েছিলেন শিল্পের টানে। ভালোবেসে। এঁরাও শিল্পী।রসিকদের মধ্যেও দু’টি শ্রেণি - একদল শিল্পের অনুরাগী, অপরদল দেহের। যাঁরা গান বাঁধেন না, প্রচলিত গানেই আসর মাতান, তাঁরা পেশাদার রসিক। এদের সংখ্যাই বেশি এবং এরাই নাচনির উপার্জিত অর্থের সিংহভাগ ভোগ করেন। বৃদ্ধা নাচনি ভিক্ষাজীবী হয় এদেরই জন্য।

মনে রাখতে হবে, রসিক না থাকলে নাচনির অস্তিত্বও নেই। নাচনির সঙ্কট আর রসিকের সঙ্কট এক সুতোয় বাঁধা। নাচনি পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রৌঢ়া নাচনি পস্তুবালার কথায়, “অল্পবয়সি মেয়েরা আজকাল আর কেউ নাচনি হতে চায় না...”। পাশে বসা রসিক বিজয়ের অস্ফুট কণ্ঠে শোনা যায় পরের কথাটি, “রসিক হতেও কেউ চায় না গো।” তাই দিনশেষে নাচনি-রসিক সকলেরই জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাঁদের শিল্পের ভবিষ্যৎ-ও।


তথ্যসূত্রঃ
• জলধর কর্মকার; ২০০১; নাচে নাচনী যৌবন; পুরুলিয়াঃ সাহিত্য সংসদ।
• জ্যোৎস্না কর্মকার; ১৯৮২; পৃথিবী; টুনির বারোমাস এবং খিদে; কলকাতাঃ পুস্তক বিপণি।
• নিমাই ভট্টাচার্য; ১৯৬১; নাচনী; কলকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স।
• Pashupati Prasad Mahato; 1987; The Jhumur and Nachni dance; The Performing Arts of Jharkhand. Calcutta: B. B. Prakasan.
• প্রবীর সরকার; ২০২১; নাচনিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে এখন শুধুই হতাশা; আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন।
• সুব্রত মুখোপাধ্যায়; ২০০২ (দ্বিতীয় সংস্করণ); রসিক; কলকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
• সুধীরকুমার করণ; ১৯৬৫; সীমান্ত বাঙলার লোকযান; কলকাতাঃ এ. মুখার্জী অ্যাণ্ড কোং প্রাঃ লিঃ।
• সৈকত রক্ষিত; ১৯৯১; আমপাত চিরি চিরি; কলকাতাঃ পুনর্বসু পত্রিকা।
• সৈকত রক্ষিত; ১৯৯৬; ধূলা উড়ানি; কলকাতাঃ প্রমা প্রকাশনী।
• সৈকত রক্ষিত; ২০১০; মুসরিয়া বাই; দশটি গল্প; কলকাতাঃ পরশপাথর প্রকাশন।
• সৈকত রক্ষিত; ২০১৫; খেমটি; উত্তরকথা; কলকাতাঃ পারুল প্রকাশনী।