আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

প্রবন্ধ

জাতিভিত্তিক জনগণনা কেন প্রয়োজন?

সমীরণ সেনগুপ্ত ও সৌম্যদীপ বিশ্বাস


২০২৩ সালের গান্ধী জয়ন্তীর দিন বিহার সরকার তাদের রাজ্যের জাতিভিত্তিক সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯.৭ শতাংশ মানুষ তফশিলী জাতি (SC), ১.৭% তফশিলী জনজাতি (ST), ১৫.৫% সাধারণ (GEN) এবং ৬৩.১ শতাংশ মানুষ অন্যান্য অনগ্রসর জাতির (OBC) অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে ৩৬% রয়েছেন অতি অনগ্রসর (EBC) অংশের মানুষ। পরবর্তীতে বিগত ৭ই নভেম্বর বিহার বিধানসভায় জাতিভিত্তিক আর্থসামাজিক সমীক্ষার রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়েছে। বিহারের এই তথ্য জনসমক্ষে আসার পর দেশজুড়েই জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি আরো জোরালো হয়েছে। দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি জোরের সাথে উত্থাপন করেছে। অন্যান্য অধিকাংশ বিরোধী দল, বিভিন্ন সামাজিক ও গণসংগঠন সমূহ ও এই দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তোলার জন্য বিরোধীদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু সমাজ’কে ভাগ করার অভিযোগ এনেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বোধহয় বিস্মৃত হয়েছেন যে আমাদের দেশে প্রায় দুই হাজারেরও অধিক সময় ধরে মনুবাদী প্রথায় ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি ভাগে হিন্দু সমাজ বিভক্ত হয়েই রয়েছে, বিরোধীদের আর নতুন করে ভাগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। জাতিভিত্তিক বৈষম্য এবং তথাকথিত নিম্নজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণির প্রতি উচ্চজাতের বৈরিতা ও ঘৃণা স্বাধীনতা প্রাপ্তির সাত দশক পরেও অনেকাংশেই রয়ে গেছে। বাবাসাহেব আম্বেদকর প্রণীত সংবিধান তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর জাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের মানুষকে যে অধিকার দিয়েছে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ন্যায় সুনিশ্চিত করার যে কথা সংবিধানে বলা হয়েছে তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। তথাকথিত নিচু জাতের মানুষের সুখ সমৃদ্ধি শখ আহ্লাদ সবই চাপা পড়ে গেছে ‘উচু জাতের’ অধিপত্যে। দেশের আর্থসামাজিক সমীক্ষাগুলোতেও এই ছবি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে।

ভারত সরকারের ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে’ ২০০৫-০৬ এবং ২০১৫-১৬ সালের তথ্য ব্যবহার করে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে (Examining multidimensional poverty reduction in India 2005/06 - 2015/16: Insights and oversights of the headcount ratio by Sabina Alkire, Christian Oldiges, Usha Kanagaratnam; Oxford Poverty and Human Development Initiative (OPHI), Department of International Development, University of Oxford, United Kingdom) দেখা যাছে ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৫-১৬ এইসময়কালে দেশে সামগ্রিকভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমলেও দরিদ্র মানুষের মধ্যে তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির সম্মিলিত শতাংশ গত দশ বছরে ৬.২ শতাংশ বিন্দু বেড়ে গেছে (সারণী-১)। ২০০৫-০৬ সালে গরীব মানুষের মধ্যে SC, ST ও OBC-র সম্মিলিত অংশ ছিল ৭৭.৬%, ২০১৫-১৬ সালে এসে এই সংখ্যা হয়েছে ৮৩.৮%। অথচ এই দশ বছরে দেশে গরীব মানুষের সংখ্যা কমেছে ২৭ কোটি। অর্থাৎ এই তথ্য থেকে এটাই বোঝা যায় যে তথাকথিত উচু জাতের (GEN) মানুষেরা তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মানুষের তুলনায় দারিদ্রতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়েছেন অনেক বেশি পরিমাণে।

সারণী-১

  2005-06 2015-16
ST SC OBC Other ST SC OBC Other
মোট জনসংখ্যা (%)* 8.6 19.1 40.3 29 9.4 20.7 43 22.5
সামাজিক বিন্যাস অনুযায়ী মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা (কোটিতে) 8.0 14.5 27.2 12.3 6.3 9.1 15.5 4.7
সামাজিক বিন্যাস অনুযায়ী মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা (%)* 12.4 22.7 42.5 19.2 17.1 24.7 42 12.6
  77.6   83.8  

* Note: Percentage distribution does not add up to 100.

Source:
● Examining multidimensional poverty reduction in India 2005-06 - 2015-16: Insights and oversights of the headcount ratio by Sabina Alkire, Christian Oldiges, Usha Kanagaratnam; Oxford Poverty and Human Development Initiative (OPHI), Department of International Development, University of Oxford, United Kingdom.

২০০৫-০৬ সালে বিভিন্ন ধর্মমতের মানুষের মোট জনসংখ্যার মধ্যে গরীব মানুষের সংখ্যা, শতাংশের হিসেবে সব থেকে বেশি ছিল মুসলিমদের মধ্যে ৬০.৮%। ২০১৫-১৬ সালেও সেই প্রবণতাই বিদ্যমান। হিন্দুদের মধ্যে মোট জনসংখ্যার ২৮.১% গরীব, খ্রিস্টানদের মধ্যে ১৬.৪%, মুসলিমদের মধ্যে ৩১.৪% এবং বাকি অন্যান্য ধর্মমতের মোট জনসংখ্যার ১২.৬% মানুষ এখনও দারিদ্রসীমার নিচে রয়েছেন।

জাতিভিত্তিক শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের অবস্থা

সারণী-২

  তফসিলি জনজাতি (ST) তফসিলি জাতি (SC) অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC) অন্যান্য/জেনারেল (Others)
ভারত (%)
স্বাক্ষর 69.6 72.4 76.9 85.9
মাধ্যমিক 9.9 11.5 13.5 15.8
উচ্চ-মাধ্যমিক 6 7.7 9.4 12.8
স্নাতক 3.3 4.1 5.9 12.3
স্নাতকোত্তর 0.7 0.9 1.2 3.4
  পশ্চিমবঙ্গ (%)
স্বাক্ষর 65.0 77.4 80.8 83.4
মাধ্যমিক 5.6 9.9 11.5 11.1
উচ্চ-মাধ্যমিক 3.5 4.7 6.3 8.8
স্নাতক 1.0 4.2 4.0 8.2
স্নাতকোত্তর 0.1 0.6 0.9 1.4
         
কম্পিউটার আছে এমন পরিবারের সংখ্যা (%) ভারত
4.8 5.5 8.2 19.3
পশ্চিমবঙ্গ
2.9 5.5 7.3 12.0

Source: NSS 75th round, July 2017 - June 2018, Household Social Consumption on Education in India, Ministry of Statistics & Programme Implementation, Government of India.

জাতিগত বৈষম্যের এই চিত্র শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্যেও স্পষ্ট ভাবেই দৃশ্যমান (সারণী-২)। ভারতে জেনারেল ক্যাটাগরির ৮৫.৯% মানুষ যেখানে স্বাক্ষর, সেখানে তফশিলী জনজাতির ৩০% বেশি মানুষ এখনও নিরক্ষর। মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর, শিক্ষাক্ষেত্রে যত উপরের স্তরে যাওয়া যায় বৈষম্যের ছবি তত বেশি করে প্রতীয়মান হয়। জেনারেল বিভাগের স্নাতক তফশিলী জনজাতির তুলনায় চার গুণ, তফশিলী জাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতির তুলনায় যথাক্রমে তিন ও আড়াই গুণ বেশি। ST, SC ও OBC-র সম্মিলিত স্নাতকোত্তরের শতাংশের থেকেও শুধুমাত্র জেনারেলের স্নাতকোত্তরের সংখ্যা ০.৬ শতাংশ বিন্দু বেশি। আমাদের রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রেও এই বৈষম্যের কোনো ব্যতিক্রম নেই বরং দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মানুষের পরিস্থিতিটা যে আরও বেশি খারাপ সেটা এই শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট হচ্ছে। বিদ্যাসাগরের বাংলায় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ৩৫% তফশিলী জনজাতির মানুষ নিরক্ষর। তফশিলী জাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতির তুলনায় দ্বিগুণ এবং তফশিলী জনজাতির তুলনায় আট গুণ বেশি স্নাতক জেনারেল বিভাগে। ST, SC অথবা OBC, কোনো জাতির মধ্যেই এখনও ১% মানুষও স্নাতকোত্তর নন। দেশ এবং রাজ্যে কম্পিউটার আছে এমন পরিবারের শতাংশের হিসেবেও জেনারেল ক্যাটাগরির সাথে SC, ST, OBC-দের বিস্তর ব্যবধান লক্ষণীয়।

কাজের চরিত্রের হিসেবে দেখা যাচ্ছে (সারণী-৩) ভারতে জেনারেল ক্যাটাগরির মোট কর্মী সংখ্যার ৩০% বেশি রেগুলার/স্যালারাইড কাজে নিযুক্ত, অথচ SC, OBC-দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা দশ শতাংশ বিন্দু কমে ২০%-এর আশেপাশে। তফশিলী জনজাতিদের মধ্যে যত জন কাজ করেন তার মাত্র ১২% রেগুলার/স্যালারাইড কাজে যুক্ত। অন্যদিকে, SC ক্যাটাগরির মোট কর্মী সংখ্যার ৩৮.২% ক্যাজুয়াল লেবার, ST-দের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২৮.৯%, OBC-দের মধ্যে ২০%, অথচ জেনারেল ক্যাটাগরির মোট কর্মী সংখ্যার মধ্যে ক্যাজুয়াল লেবারের সংখ্যা অন্যান্যদের তুলনায় অনেকটাই কম ১১%।

সারণী-৩

  তফসিলি জনজাতি (ST) তফসিলি জাতি (SC) অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC) অন্যান্য/জেনারেল (Others)
ভারত (%)
সেল্ফ-এম্প্লয়েড 58.8 42.1 59.9 58.2
রেগুলার ওয়েজ/স্যালারাইড 12.3 19.8 20.1 30.6
ক্যাজুয়াল 28.9 38.2 20.1 11.2
  পশ্চিমবঙ্গ (%)
সেল্ফ-এম্প্লয়েড 46.8 30.9 57.9 52.3
রেগুলার ওয়েজ/স্যালারিড 18.2 13.3 16.2 28.5
ক্যাজুয়াল লেবার 35 55.8 26 19.3

Source: Periodic Labour Force Survey, Annual Report (July 2021 - June 2022).

এই তথ্য থেকে পরিষ্কার যে দেশের কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্র, অসংগঠিত অংশে যুক্ত থাকা কর্মীদের অধিকাংশই তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির লোকেরা, এবং সংগঠিত অংশটা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই জেনারেল ক্যাটাগরির দখলে রয়েছে।

সারণী-৪

  তফসিলি জনজাতি (ST) তফসিলি জাতি (SC) অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC) অন্যান্য/জেনারেল (Others)
  ভারত সরকার (%)
গ্রুপ A পদে নিযুক্ত 5.9 13.0 16.6 64.6
গ্রুপ B পদে নিযুক্ত 7.1 16.8 16.7 59.5
গ্রুপ C পদে নিযুক্ত 7.8 17.7 22.8 51.7
  পশ্চিমবঙ্গ সরকার (%)
গ্রুপ A পদে নিযুক্ত 3.0 13.0 2.6 81.4
গ্রুপ B পদে নিযুক্ত 4.2 15.3 3.3 77.2
গ্রুপ C পদে নিযুক্ত 6.3 20.9 5.9 66.9

Source: Staff Census 2014-15, Government of West Bengal, Annual Report 2021-22, Ministry of Personnel, Public Grievances and Pensions, Government of India.

দেশের সংগঠিত অংশের কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় জায়গা হল সরকারি চাকরি, যুবক-যুবতীদের কাছে এই চাকরির চাহিদাও যথেষ্ট বেশি। মোট কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের (সারণী-৪) মধ্যে সব থেকে বেশি মাইনের অর্থাৎ গ্রুপ A পদের মোট কর্মী সংখ্যার ৬৪.৬% দখলে আছে জেনারেল ক্যাটাগরির। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই ছবিটা আরও ভয়াবহ। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের গ্রুপ A পদে কর্মরতদের ৮১.৪% জেনারেল ক্যাটাগরির দখলে। এই রাজ্যে সংরক্ষণের নিয়মটাই যে আইনের ফাঁক ব্যবহার করে প্রায় তুলে দেওয়া হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের শিক্ষা ও কাজের তথ্য (NSS 75th round, July 2017 - June 2018, Household Social Consumption on Education in India, Periodic Labour Force Survey, Annual Report (July 2021 - June 2022) থেকে দেশে এবং এই রাজ্যে মুসলিমদের সাথে অন্যান্য বাকি ধর্মের মানুষদের পার্থক্যটা চোখে পড়ার মত। স্বাক্ষরতার হার থেকে শুরু করে স্নাতক অথবা স্নাতকোত্তর সর্বস্তরেই মুসলিমরা পিছিয়ে রয়েছেন। মোট কর্মী সংখ্যার মধ্যে রেগুলার/স্যালারইড কাজে যুক্ত মুসলিমদের শতাংশ অন্যান্যদের মোট কর্মী সংখ্যার শতাংশের তুলনায় কম, অন্যদিকে মোট কর্মী সংখ্যার মধ্যে ক্যাজুয়াল লেবারের সংখ্যার শতকরা হারে মুসলিমরাই হিন্দু খ্রিস্টান বা অন্যান্য সকলের থেকে বেশি।

এই সমীক্ষাগুলোর প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেশের শিক্ষা, কর্মসংস্থানের যে করুণ চিত্র চোখের সামনে উঠে আসে তাতে এ কথাই প্রমাণ হয় যে তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর জাতি এবং সংখ্যালঘু অংশের মানুষেরাই হলেন মূলত দেশের বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত, খেটে খাওয়া গরীব মানুষ। জাতিভিত্তিক জনগণনা এই যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা বঞ্চনার অবসানের প্রথম ধাপ।

জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রাসঙ্গিকতা

ব্রিটিশ সরকার ১৮৮১ সালে শুরু করে ১৯৩১ সালে শেষবার জনগণনা করার সময় ভারতে জাতগণনা করেছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তফশিলী জাতি ও তফসিলী জনজাতির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হলেও জাতিভিত্তিক জনগণনা দেশের নেতারা করেননি, কারণ তারা হয়ত মনে করেছিলেন যে এর ফলে সমাজে জাতিদ্বন্দ্ব বাড়বে। দেশের নেতারা হয়তো ভেবেছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকারের নেতৃত্বে তৈরি হওয়া সংবিধানের বাস্তবায়নে দেশে জাত প্রথা অবলুপ্ত হবে। এই কারণেই সংবিধানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা প্রথমে রাখা হয়েছিল দশ বছর। আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও সংরক্ষণ ব্যবস্থা যে শুধু বহাল রাখতে হয়েছে তাই নয় দেশের বহু জাতির মানুষ নতুন করে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার আওতায় আসতে চাইছেন, এই দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন সংগঠিত করছেন। সুতরাং জাতি ভিত্তিক জনগণনা না করায় দেশে জাতি প্রথা কিন্তু উঠে যায়নি।

বিগত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে অনগ্রসর জাতির মানুষেরা নিজেদের অধিকারের দাবিতে রাস্তায় নেমে এসেছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন। এইসবের পরিপ্রেক্ষিতেই গঠিত হয়েছিল ‘মণ্ডল কমিশন’। ডঃ বি. পি. মণ্ডলের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন দেশের অনগ্রসর শ্রেণীর (OBC) হিসেব কষে বলে যে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫২% হলেন এরা। সংবিধানের ১৫(৪) নম্বর ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্র তফশিলী জাতি ও জনজাতির বাইরেও বিভিন্ন অনগ্রসর শ্রেণিকে সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পশ্চাদপদ বলে ঘোষণা করতে পারে। সংবিধানের এই ধারাকে বিবেচনায় রেখেই ১৯৮০ সালে ‘মণ্ডল কমিশন’ ৫২% অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের জন্য সরকারী ব্যবস্থার শিক্ষায় এবং চাকরিতে ২৭% সংরক্ষণের জন্য সুপারিশ করে, যা ভি. পি. সিংহ সরকার ১৯৯০ সালে প্রবর্তন করে। আজ মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ প্রবর্তন হওয়ার পরে তিন দশক অতিক্রান্ত। এই তিন দশকে দেশে সংরক্ষণ নীতির ফলে অনগ্রসর শ্রেণির মানুষেরা কতটা লাভবান হলেন? আর কোন কোন জাতি এখনও পশ্চাদপদতার অন্ধকারে নিমগ্ন রয়েছে, যাদের জন্য সংরক্ষণ নীতি চালু করা প্রয়োজন? সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের পরেও অতিক্রান্ত হয়েছে ১৭ বছর। মুসলিম সমাজের বর্তমান অবস্থাটাই বা কেমন? এই সমস্ত গুরুতর প্রশ্নের কোনো তথ্যনিষ্ঠ উত্তর সরকারের কাছে নেই। জাতিভিত্তিক জনগণনা না হওয়ায় দেশে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষেরা অথবা জেনারেল ক্যাটাগরির মানুষের সংখ্যাটা আসলে ঠিক কত সেই হিসেবও সরকারের কাছে নেই। কেবলমাত্র নমুনা সমীক্ষার শরণাপন্ন হয়ে তার থেকে OBC এবং জেনারেল ক্যাটাগরির হিসেব কষেই সরকারকে পরিকল্পনার কাজ চালাতে হয়। নমুনা সমীক্ষার সংখ্যা বড় অঙ্কের হলেও সেটা কোনভাবেই জনগণনার বিকল্প হতে পারেনা। সারণী-৫-এ ২০১৫-১৬ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত জাতিভিত্তিক জনসংখ্যার হিসেব শতাংশে দেখানো হয়েছে।

সারণী-৫

  তফসিলি জনজাতি (ST) তফসিলি জাতি (SC) অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী (OBC) অন্যান্য/জেনারেল (Others)
  ভারত সরকার (%)
2021-2022 9.8 20.0 45.8 24.4
2019-2021 9.5 21.7 41.6 26.4
2017-2018 9.6 19.4 45.0 26.0
2015-2016 9.2 20.6 42.2 27.2
  পশ্চিমবঙ্গ সরকার (%)
2021-2022 6.2 30.5 18.3 45
2019-2021 5.9 27.1 12.2 52.5
2017-2018 5.7 23.9 15.4 55.8
2015-2016 6.3 28.4 11.8 51.8

Source:
● Periodic Labour Force Survey, July 2021 - June 2022.
● National Family Health Survey - 5, 2019-2021.
● NSS 75th round, July 2017 - June 2018, Household Social Consumption on Education in India.
● National Family Health Survey - 4, 2015-2016.

এখানে OBC এবং জেনারেল ক্যাটাগরির সংখ্যার তারতম্য বেশ চোখে পড়ার মতো। কোনো সমীক্ষায় ভারতে OBC-দের সংখ্যা ৪২% তো অন্য কোনো সমীক্ষায় এই সংখ্যা ৪৬%। সমীক্ষাগুলোর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে জেনারেল ক্যাটাগরির মানুষের সংখ্যা কখনো ৪৫ শতাংশ তো কখনও ৫৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের এই হিসেবে যে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে সেটা বোঝাই যাছে। জাতিভিত্তিক জনগণনা করলে একদিকে যেমন কোন জাতির মানুষ কত সংখ্যায় রয়েছেন সেই তথ্য উঠে আসবে তার পাশাপাশি জাতিভিত্তিক আর্থসামাজিক অবস্থানও জানা যাবে। এই তথ্যকে বিবেচনায় রেখে দেশের বা রাজ্যের সরকারগুলো, জনগণের জীবনযাপনের মানোন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা জাতিসমূহের উচ্চগামিতাকে ত্বরান্বিত করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারবে। দেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় সুনিশ্চিত হবে, যা গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করবে।

জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করার যুক্তি কি?

দেশে তফশিলী জাতি ও তফশিলী জনজাতি মিলিয়ে সংরক্ষণ রয়েছে ২২.৫%। সংরক্ষণের উর্দ্ধসীমা ৫০%-এর বেশি করা যাবেনা এই যুক্তি দেখিয়ে ‘মণ্ডল কমিশন'-এর হিসেবে অন্যান্য অনগ্রসর জাতির সংখ্যা ৫২% হলেও তাদের জন্য শিক্ষায় চাকরিতে সংরক্ষণ রয়েছে ২৭%। কিন্তু জাতিভিত্তিক জনগণনা হলে এবং তার ফলে দেশে OBC অংশের মানুষের প্রকৃত সংখ্যা জানা গেলে এই ২৭% সংরক্ষণের শতাংশ বৃদ্ধির দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠবে। এই কারণেই তথাকথিত উচু জাতের একাংশের মানুষ ৫০% সিলিং-এর উল্লেখ করে জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করছেন। অথচ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই ৫০% সিলিং লঙ্ঘন করেই সংবিধান সংশোধন করে ST, SC, OBC অংশকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সবর্ণদের মধ্যে অর্থনেতিকভাবে পশ্চাদপদ অংশের জন্য ১০% সংরক্ষণের ব্যবস্থা চালু করেছে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা হলেও সুপ্রিম কোর্ট এর বিপক্ষে রায় দেয়নি।

বিজেপি কেন জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধী?

২০১৪ এবং ২০১৯-এর নির্বাচনে তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতি সকলেরই ব্যাপক জনসমর্থন বিজেপি পেয়েছিল। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনগুলোতেও তারা এই অংশের মানুষের সমর্থন পাচ্ছে। এরপরেও বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জোর গলায় জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতা করছে কেন? আসলে এই অংশের মানুষের সমর্থন বিজেপি কোনো সামাজিক ন্যায়ের কর্মসূচীকে সামনে রেখে পায়নি। তারা এই সমর্থন আদায় করেছে নানাবিধ সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে। একদিকে তারা ST, SC, OBC-দের মধ্যে তুলনায় সচ্ছল অংশের বিরুদ্ধে এই অংশের অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জাতি সমূহকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আবার উচু জাতের সমর্থন বজায় রাখতে তাদের মধ্যে পূর্বে উল্লেখিত ১০% সংরক্ষণ চালু করেছে। একই সাথে ‘হিন্দু সমাজ’কে ঐক্যবদ্ধ করতে গোটা দেশজুড়ে তারা ছড়িয়ে চলেছে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ। তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মানুষকে তারা বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছে যে তাদের লড়াই ‘উচু জাতের’ বিরুদ্ধে নয়, তাদের লড়াই মুসলমানদের বিরুদ্ধে, মুসলমানরাই তাদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, মুসলমানরাই দায়ী তাদের পশ্চাদপদতার জন্য। দীর্ঘদিন ধরেই দেশের মধ্যে এই বিদ্বেষের বীজ তারা বপন করে চলেছে, এখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে থাকায় এই কাজে তাদের আরও সুবিধে হয়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে জাতিভিত্তিক জনগণনা হলে তাদের এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আঘাত নেমে আসবে। কারণ জাতিভিত্তিক জনগণনা প্রমাণ করে দেবে হিন্দুত্বের নামে আরএসএস-বিজেপি সমস্ত হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইলেও তথাকথিত উচু জাতের হাতেই রয়েছে শিক্ষা, চাকরি এবং ক্ষমতার চাবিকাঠি। তফশিলী জাতি, তফশিলী জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর জাতির মতই দেশের মুসলিম সমাজেরও সিংহভাগ মানুষই গরীব, খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষ। জাতিভিত্তিক জনগণনায় এই তথ্য উঠে এলে ST, SC, OBC এবং সংখ্যালঘু মানুষের কাছে বিজেপির বিদ্বেষপূর্ণ মিথ্যার ফানুস চুপসে যাবে। এরপর যদি পশ্চাদপদতার অন্ধকারে থাকা এই মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে তবে বিজেপির সাজানো বাগান অচিরেই নষ্ট হবে। সংবিধান পাল্টে দিয়ে ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গড়ে তোলার যে স্বপ্ন আরএসএস-বিজেপির রয়েছে সেটাও পন্ড হবে। কয়েক যুগ ধরে দেশে যে উচু জাতের মানুষের আধিপত্য চলে আসছে তা ভেঙে পড়বে। এই আশঙ্কাতেই নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরোধিতায় কোমর বেঁধে নেমেছে।

জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবস্থান কি?

রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ তুলে বাবাসাহেব আম্বেদকরের মূর্তির পাদদেশে ধর্নায় বসেছিলেন কিন্তু জাতিভিত্তিক জনগণনার বিষয়ে তার অবস্থানটা স্পষ্ট করতে পারলে রাজ্যবাসী উপকৃত হতেন। কেন্দ্রীয় সরকার না করলেও এই রাজ্যে জাতিভিত্তিক জনগণনা করতে তাঁর অসুবিধেটা কোথায়? সরকারি সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি এবং জেনারেল ক্যাটাগরির সংখ্যায় যে ব্যাপক গরমিল রয়েছে সেটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক বোর্ড গঠন করলেই যে সেই সম্প্রদায়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় সুনিশ্চিত হয়না সেটাও সরকারী সমীক্ষাগুলোর তথ্য থেকেই স্পষ্ট। এই কারণেই কেন্দ্রের সরকার রাজি না হলে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উচিত রাজ্যভিত্তিক জাতিগণনার কাজ সম্পন্ন করা।

দেশের সংবিধানে সমস্ত মানুষকে সামাজিক ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সমাজের প্রকৃত তথ্য না থাকলে এই কাজ কিভাবে সম্ভব? টাকা-পয়সা-সুখ-সমৃদ্ধি কেবল মাত্র একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা দীর্ঘদিন চলতে পারেনা। দেশের সংবিধানকে মান্যতা দিতে, আম্বেদকর-ফুলে-পেরিয়ার-হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের দেখানো সামাজিক ন্যায়ের পথ-কে প্রতিষ্ঠিত করতে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে জাতিভিত্তিক জনগণনা তাই সময়ের দাবি। লোকসভা নির্বাচন সমাসন্ন, এই নির্বাচনে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকেরা একসুরে জাতিভিত্তিক জনগণনার দাবি তুলে এই দাবিকে নির্বাচনের অন্যতম চর্চার বিষয়ে পরিণত করতে পারবে কিনা সময়ই সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে।