আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

সমসাময়িক

একনায়কতন্ত্র-র প্রতিষ্ঠা!


প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো সংক্ষেপে পিআইবি, ভারত সরকারের মুখপাত্র। পিআইবি সরকারের পরিকল্পনা, নীতি, কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করে। শতাব্দী প্রাচীন সংস্থাটি ১৯১৯-এর জুন মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী সিমলায় স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই নিয়ম মেনে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কোনো ছেদ পড়েনি।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে স্থাপিত হলেও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিআইবি এখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন। আগে শুধুমাত্র ছাপানো কাগজ মারফত পিআইবি-র বিবৃতি বা প্রেস রিলিজ প্রচার করা হতো। একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে পিআইবি ডিজিটাল মাধ্যমেও সরকারের সিদ্ধান্ত সম্বলিত প্রেস রিলিজ প্রকাশ ও প্রচার করে। মূলত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলেও সংবিধান স্বীকৃত ২২টি ভাষার মধ্যে ডোগরি, পাঞ্জাবি, বাংলা, ওডিয়া, গুজরাটি, মারাঠি, মেইতি (মণিপুরি), তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, কোঙ্কনি, উর্দু এবং হিন্দিতে নিয়মিত সরকারি ভাষ্য পাওয়া যায়।

সেই নিয়মে সম্প্রতি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। ২৪শে জানুয়ারি, ২০২৪-এ আয়োজিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকের যে সিদ্ধান্ত পিআইবি প্রেস রিলিজ মারফত প্রকাশ/প্রচার করেছে তা এককথায় অনবদ্য। ৭৭৩ শব্দের বিবৃতিটি হিন্দি ভাষায় রচিত। ইংরেজি অনুবাদ অনুপস্থিত। তবে উর্দু, মণিপুরি, মারাঠি, পাঞ্জাবি, গুজরাটি ও ওডিয়া অনুবাদ উপলব্ধ। পিআইবি প্রচারিত ১৯৯৯৩৮৫ নম্বরের এই প্রেস রিলিজটি কেন ইংরেজি সহ অন্যান্য সংবিধান স্বীকৃত ভাষায় পরিবেশন করা হয়নি তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। তবে উত্তর কে দেবে?

হিন্দি ভাষার আগ্রাসী আধিপত্যের প্রচেষ্টা অব্যাহত। হয়তো এটা তারই একটা প্রকট দৃষ্টান্ত। হিন্দির প্রসারকল্পে এহেন আধিপত্যবাদী আচরণ নীরবে মেনে নিতে দেশবাসী এখন কমবেশি অভ্যস্ত। কাজেই এর মধ্যে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রক থেকে পেশ করা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু আলোচ্য প্রেস রিলিজটি থেকে বোঝার উপায় নেই কোন মন্ত্রক থেকে এমন ব্যতিক্রমী প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। গত ২২শে জানুয়ারি, ২০২৪ অযোধ্যার প্রস্তর মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা জানিয়েছে যে এর ফলে ভারতীয় সভ্যতার ৫০০ বছরের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। ১৯৪৭-এ দেশের শরীর স্বাধীন হলেও এহেন ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে দেশবাসীর আত্মা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যখন থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার বৈঠক হচ্ছে, এমনকী ব্রিটিশ আমলের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকেও এমন ঐতিহাসিক ঘটনার কথা উল্লিখিত হয়নি। প্রেস রিলিজের প্রতি ছত্রে একবার করে প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি-বন্দনা করে মন্ত্রীসভার সদস্যরা জানিয়েছেন যে শুধুমাত্র মন্ত্রী হিসেবেই নয় এই মূহর্তটি তাঁদের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। পাথরের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রের মনোবল ও সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে। মন্ত্রীসভার সদস্যরা আরও জানিয়েছেন একশো বছর ধরে দেশবাসী একজোট হয়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলনে শামিল হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই সাফল্য অর্জন করা গেছে। দেশে নবযুগ এসে গেছে। পরিশেষে মন্ত্রীসভার এই বৈঠককে সহস্রাব্দের সেরা বৈঠক বললেও অতিশয় উক্তি হবে না বলে জানানো হয়েছে।

দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে আবেগ-উচ্ছ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। দলের সমর্থকদের মধ্যেও তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা থাকতেই পারে। বাস্তবে বর্তমান ভারতবর্ষে প্রায় প্রতিদিনই তেমনই ঘটে চলেছে। রাস্তার মোড়ে টাঙানো বিশাল কাট আউট থেকে শুরু করে পোস্টার-ফেস্টুন পর্যন্ত সর্বত্র তাঁর ছবি বিরাজমান। এমনকী সরকারের প্রতিটি বিজ্ঞাপনেও তাঁর ছবি থাকা এখন আবশ্যিক। এহেন আগ্রাসী প্রচার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা বা প্রশ্ন তোলা সমীচীন নয়। অমৃতকালে এমনটা হতেই পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের শীর্ষ স্তরে যখন প্রধানমন্ত্রীর স্তুতি-বন্দনা সম্পৃক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্যোগে আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মাদির প্রশস্তি মন্ত্রীসভার বৈঠকে আলোচনা করা যায় কিনা তা সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে মন্ত্রী হওয়ার পর মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর গুণগান-স্তুতিবন্দনা মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত মানে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত।

২২শে জানুয়ারি, ২০২৪-এ পাথরের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রচার প্রভূত উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে এহেন উত্তেজনা চরম পর্যায়ে উন্মাদনায় পর্যবসিত হয়েছে। পাথরের মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান উপলক্ষে ২৪শে জানুয়ারি, ২০২৪-এ আয়োজিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত আগামী দিনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম সরকারি পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হলে বিস্মিত হওয়ার অবকাশ থাকবে না।