আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা ● ১-১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ● মাঘ ১৭-ফাল্গুন ২, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

রাজনীতির রাম


২২ জানুয়ারি ২০২৪ দিনটি শুধুমাত্র যে একটি ঐতিহাসিক দিন তা নয়। ২২ জানুয়ারি ২০২৪ দিনটিকে আগামীদিনের ভারত একটি ঐতিহাসিক বিভাজিকা হিসেবে দেখবে। এই দিনটিতে ১৯৫০ সালে তৈরি হওয়া গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে কবরে পাঠানো হয় এবং ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা সমস্ত রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে হিন্দুধর্ম তথা হিন্দুত্বকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়। আজ থেকে কয়েক দশক পরে ভারতের ইতিহাস বইয়ে ২২ জানুয়ারি ২০২৪ দিনটিকে এই ভাষায় ব্যাখ্যা করলে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না।

আজ থেকে মাত্র ৩২ বছর আগের কথা। আজ যেখানে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী সেখানেই একটি প্রাচীন মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল। ধর্মের জিগির তুলে আরএসএস-বিজেপি মসজিদটিকে ধ্বংস করে। সেই ধ্বংসকারীরাই আজ দেশের সরকার চালাচ্ছে। তবু, বাবরি মসজিদ যখন ধ্বংস হয়েছে, সেই সময়েও অধিকাংশ দেশের মানুষ মনে করেছিলেন যে যা হয়েছে অন্যায় হয়েছে। সাধারণ মানুষ আশা রেখেছিলেন সংবিধানের উপর, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর - যে হ্যাঁ একটা বিশাল বড় অন্যায় ঘটে গেছে, কিন্তু এর পুনরাবৃত্তি আমরা হতে দেবো না, এবং মসজিদ ধ্বংসকারীদের আমরা ক্ষমা করব না।

৩২ বছর ধরে সরযূ এবং গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। বাবরি মসজিদের জমিকে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয় সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে। এবং বিগত ২২ জানুয়ারি দেশের প্রধানমন্ত্রী, সরকার-সহ গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা মন্দির উদ্বোধনে মাতোয়ারা হয়ে যায়। গোটা দেশজুড়ে হিন্দু আবেগ তৈরি করা হয় রাম তথা রাম মন্দিরকে ঘিরে। বলা হয় যে ৫০০ বছর পরে মন্দিরে ফিরছেন রাম লালা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে স্মরণ করানো হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ দ্বারা তৈরি করা মিথটি যে রামজন্মভূমি মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। পাঁচশ বছর পর সেই মন্দির পুনর্গঠিত হল। অথচ ২০১৯ সালের রায়তেও সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে বাবরি মসজিদ কোনো মন্দির ধ্বংস করে বানানো হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু এই সূক্ষ্ম বিতর্ক করার ইচ্ছে কারোর নেই। হিন্দু জাগরণ ঘটেছে প্রধানমন্ত্রী মোদীর নেতৃত্বে, পাঁচশ বছরে যা কেউ করতে পারেনি, তাই করলেন মোদী - রাম লালাকে ঘরে ফেরালেন।

এই আখ্যান কেন ২০২৪ সালে তৈরি করা হল, তা বুঝতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ২০২৪ কোনো সাধারণ বছর নয়। এই বছরে দেশে লোকসভা নির্বাচন হবে। অতএব মন্দির সম্পূর্ণভাবে তৈরি না করে, শঙ্করাচার্যদের কার্যত উপেক্ষা করে, রাম মন্দির উদ্বোধনের উদ্দেশ্য এটা নয় যে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে মন্দির উদ্বোধন না হলে রাম রুষ্ট হবেন! রাম মন্দির উদ্বোধনের আসল উদ্দেশ্য হিন্দু জিগির ও আবেগের উপর ভর করে ২০২৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ। তাই গোটা অনুষ্ঠানটিকে সাজানো হয়েছিল এমনভাবে যাতে বিজেপি-র প্রাণভ্রমরা নরেন্দ্র মোদীর উপর থেকে ক্যামেরা না সরে যায়। তিনিই যজমান, তিনিই প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন, তিনিই উপবাস করেছেন মন্দির উদ্বোধনের জন্য, তিনিই আদবানির সেই কুখ্যাত রথের সারথি ইত্যাদি। মোদী ও রাম ছাড়া আর কোনো ব্যক্তিকে গুরুত্ব দেওয়াই হয়নি। কারণ একদিকে যেমন মোদীর আত্মপ্রচারের লোভ, অন্যদিকে সংঘ পরিবারের জননেতাকে হিন্দু হৃদয় সম্রাটের কিংবদন্তীতে পরিণত করার এহেন সুযোগ নির্বাচনের আগে অপব্যবহার করার মতন মূর্খ বিজেপি-আরএসএস নয়।

আবার দুটি বার্তা দেওয়াও আবশ্যিক। প্রথমত, রাম জন্মভূমি আন্দোলনটি যে আরএসএস-এর হাতে প্রাণ পেয়েছিল তা ভুলে গেলে চলবে না। মোহন ভগবতের উপস্থিতি এবং মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধানমন্ত্রীর পাশে বসে পূজা করা এই বার্তাই দেয় যে মোদী বড় নেতা হলেও আরএসএস এখনও বিজেপি-র নিয়ন্ত্রক শক্তি। তাই হিন্দুত্বের রাজনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আরএসএস প্রধান উপস্থিত থাকবেন না, তা হয় না। মোদী এবং মোহন ভগবতের রাম মন্দিরের ভিতরের ছবি আসলে একটি নতুন ভারতের ছবি যেখানে হিন্দুত্বের বেদীতে রাষ্ট্র তথা হিন্দুদের প্রধান সংগঠন একইসঙ্গে পূজা করে। রাষ্ট্র এবং হিন্দুত্বের সর্ববৃহৎ সংগঠন আরএসএস-এর এই সহাবস্থান এবং রামের মন্দিরে মাথা নত করা এই বার্তাই দেয় যে রাষ্ট্র এবং আরএসএস-এর মধ্যেকার বিভাজিকা ক্রম অদৃশ্যমান। রাষ্ট্র এবং আরএসএস-এর মতাদর্শ এখন একই বিন্দুতে এসে মিলেছে। রাষ্ট্র আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়, হিন্দুত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে দীক্ষা নিয়েছে।

তৃতীয় যেই ব্যক্তি মন্দিরের গর্ভগৃহে মোদীর সঙ্গে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিগত কয়েক বছর ধরে উত্তরপ্রদেশে ফ্যাসিস্ত কায়দায় সরকার চালিয়ে আরএসএস তথা বিজেপি-র মধ্যে নিজের জায়গা পোক্ত করেছেন যোগী। রামের পায়ের সামনে বসে কি আরএসএস-বিজেপি মোদীর উত্তরসূরী কে হবে তার গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিল? অন্তত ২২ জানুয়ারি-র অনুষ্ঠান দেখলে এই কথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

মন্দিরের গর্ভগৃহের দৃশ্য থেকে এবারে তাকানো যাক অযোধ্যা তথা গোটা ভারতের দিকে। যেই পরিমাণ উন্মাদনা একটি মন্দিরের উদ্বোধনকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছিল তার কোনো পূর্ব উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। এই উন্মাদনা যেমন একদিকে ধর্মের জিগিরের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে, তেমনি মনে রাখতে হবে যে এর মুখ্য চালিকাশক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা। দীর্ঘ দিন বিজেপি আন্দোলন করেছে যে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানাতে হবে। দেশের অধিকাংশ হিন্দু মানুষ তাদের এই দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেনি। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরে হিন্দুত্বের যে উগ্র আখ্যান বিজেপি ক্ষমতার দ্বারা নির্মাণ করেছে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, সংসদ এবং সর্বোপরি হিন্দুধর্ম।

বিজেপি যে শুধু হিন্দু ধর্মালম্বীদের মনে সুড়সুড়ি দিয়েছে তা নয়, তারা ক্ষমতার দ্বারা হিন্দুধর্মের নিয়মকেও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে। হিন্দুধর্মের ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে অগ্রগণ্য শঙ্করাচার্যরা যেখানে মন্দির উদ্বোধন এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠার রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কেউ তাকে খুব বেশি পাত্তা দেয়নি কারণ ক্ষমতাবান মোদী তা নিয়ে চিন্তিত নন। তাই ধর্মীয়গুরুরা যাকে ধার্মিকভাবে মান্যতা দিচ্ছেন না, সেই রাম মন্দিরে বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠাকে ঘিরে সাধারণ হিন্দুদের আবেগ যেন বাঁধ মানছে না। অর্থাৎ ধর্মীয় রীতিনীতি নয়, ক্ষমতার দ্বারা স্বীকৃত বিধিকেই বিধি বলে মেনে নিয়ে আবেগে ভাসছেন সাধারণ হিন্দু জনগণ। মোদী যখন বলছেন যে ২২ জানুয়ারি দিওয়ালি পালন করা হোক, তখন কবে দিওয়ালি পালন করা উচিত হিন্দু মতে তা না ভেবেই প্রবল বিক্রমে দিওয়ালি পালন করা হল, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা তা করতে বলেছে বলে। এক অর্থে তাই বলা যায় যে ২২ জানুয়ারি হিন্দুধর্মের রাজনীতিকরণ হল। রাজনৈতিক হিন্দুধর্মের জন্ম হল সেদিন যা ধর্মীয় রেওয়াজ নয়, ক্ষমতার অঙ্গুলিনির্দেশে নিজের আচার-অনুষ্ঠান নির্ধারিত করে।

এই ছবিরই উলটো দিক রাষ্ট্রের ধর্মীয়করণ। প্রধানমন্ত্রী একটি মন্দিরের উদ্বোধন করছেন, বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন, যেখানে তিনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছেন। পুলিশ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা, ইসরো ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্থা সেদিনের অনুষ্ঠানে সরকারীভাবে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ওই দিনটিতে ছুটি পর্যন্ত ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্র এবং ধর্মের এহেন মেলবন্ধন ভারতের ইতিহাসে এর আগে দেখা যায়নি। মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার দ্যর্থহীন ভাষায় এই বার্তাই দিয়েছে যে দেশটি হিন্দু রাষ্ট্র বকলমে হয়েই গেছে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণার অপেক্ষা।

সেদিনের অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অতিথিদের তালিকা অন্য এক বার্তা দেয়। বলিউডের তারকা, ক্রিকেটার ইত্যাদি তথাকথিত সেলিব্রিটিদের ঢল নেমেছিল সেদিন অযোধ্যায়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এমন একটি অনুষ্ঠান হলে সেলিব্রিটিরা সেখানে হাজির থাকবেন এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তারা তাদের উচ্ছ্বাস গোপন করেননি। বরং দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে এহেন অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে তারা গর্বিত। কিন্তু মুকেশ আম্বানি, লক্ষ্মী ও সুনীল মিত্তালদের মতন বড় শিল্পপতিদের যখন এহেন সরকার পোষিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় তখন বিষয়টি ভিন্ন মাত্রা পায়।

দেশের কর্পোরেট শ্রেণি এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন একে অপরের মধ্যে বিলীন হয়ে যায় তখন তাকে ফ্যাসিবাদ বলে। এই সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদের জনক মুসোলিনি। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিল্পপতিদের স্বার্থ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বার্থকে প্রায় একই আসনে বলে দেখানো হচ্ছে। এখন হিন্দুত্বের জয় ঢাকে যখন সেই শিল্পপতিদেরই আবার কাঠি দিতে দেখা যায়, তখন মনে হয় বিপদটি মুসোলিনি বর্ণিত ফ্যাসিবাদের থেকেও বেশি। সংখ্যাগুরুর ধর্মের সঙ্গে যদি রাজনীতি এবং শাসক শ্রেণি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তাহলে দেশের গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কতটা সুরক্ষিত রয়েছে সেই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।

২২ জানুয়ারি ২০২৪ এক নতুন ভারতের দৃশ্যকল্প আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, যেখানে শিল্পপতি এবং রাষ্ট্র দ্বারা প্রযোজিত একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আমাদের দেশকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এই প্রবণতার মুখ্য কাণ্ডারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেকে অভিষিক্ত করে ফেলেছেন। এহেন নতুন ভারতের নির্মাণে সংখ্যালঘুদের কোনো ভূমিকা নেই। হিন্দুত্ববাদ বিরোধী মানেই দেশবিরোধী। মোদীর বিরোধীতা করা মানেই হিন্দুত্বের বিরোধিতা যার মানে আবার দেশ বিরোধিতা। এই রাজনৈতিক আখ্যানটি প্রতিনিয়ত গড়ে তোলা হচ্ছে।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ধর্ম-রাজনীতি-পুঁজিপতিদের এহেন মেলবন্ধন দেশের জনগণের সামনে বিশাল বিপদ নিয়ে আসে। ১৯৩০-৪০ সালের জার্মানি, পরবর্তী কালের মুসলমান মৌলবাদী দেশগুলির দিকে তাকালে দেখা যায় যে এই প্রবণতার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। অতএব, ধর্মনিরপেক্ষ উদার ভারতকে বাঁচানোর লড়াই আসলে দেশের মানুষকে বাঁচানোর লড়াই। এই সংগ্রাম দীর্ঘ হলেও লড়তেই হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।