আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ডুংকিঃ বিশ্বায়নের ভারবাহীরা

উর্বী মুখোপাধ্যায়


পর পর দুবার হল-মুখো হলাম ২০২৩-এ। এবং দুটিই শাহরুখ খানের ছবি। আমার বয়স এবং রাজনৈতিক অবস্থানে সাদৃশ্য থাকলেও আগেই জানিয়ে রাখি আমি শাহরুখ ভক্তদের দলে নই। এই ডিসক্লেমার দিয়ে লেখা শুরুর মূল কারণটা বোধহয় অন্যত্র। আশৈশব সত্যজিৎ-মৃণাল সেন-এ জারিত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা এই আমার এখনও অসুবিধা হয় তথাকথিত বাণিজ্যিক মূলধারার ছবিতে উপস্থাপিত বিষয় নিয়ে সিরিয়াস কথা বলতে। কিন্তু বিকল্পধর্মী ছবির মৃত্যু হয়েছে অনেককাল। সরাসরি ভাবধারার কথা বলতে সিনেমা বানানো এখন প্রায় অবলুপ্তির পথে। প্রায় তিরিশ বছর ধরে পুঁজিবাদের অপ্রতিরোধ্য জয়যাত্রায় বাজার-বিমুখী কোনো মতবাদ প্রতিষ্ঠা প্রকল্পে নির্মিত চলচ্চিত্র হতে পারে সে কথা আমরা প্রায় সবাই ভুলতে বসেছি। মনে আছে প্রবল সংশয় নিয়ে নয়ের দশকে ‘রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান’ দেখতে গিয়েছিলাম। আমার সেই প্রথম শাহরুখ খানকে বড় পর্দায় দেখা। একেবারেই অনায়কোচিত চেহারার ছেলেটার সামাজিক উল্লম্বনের অভীপ্সার কাহিনীর সঙ্গে একমত না হলেও খুব পরিচিত ঠেকেছিল। সে সময়ে বিশ্বায়নের প্রথম ধাক্কায় গলায় টাই-ঝুলিয়ে 'ইউরেকা ফোবস' বা ক্রেডিট কার্ড বেচে জীবনে ‘সেটল্ড’ হওয়ার স্বপ্নে মশগুল আমাদের পারিপার্শ্বিক তরুণ সমাজ। তাদের জেন্টলম্যান হওয়ার অভীপ্সার সঙ্গে এই সিনেমার মূল গল্প মিলে গিয়েছিল। তারপর নানাভাবেই শাহরুখ খান তাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছেন অভীপ্সার রোল মডেল রূপে। শুধু তাঁর অভিনীত চরিত্র অনাবাসী ভারতীয় চরিত্র রাহুলরাই নয়, তাঁর গায়ের গ্যাপের জাম্পার থেকে শুরু করে সুইৎজারল্যান্ডের ট্রেনে চড়ার ছোট্ট লাফ বা লন্ডনের রাস্তায় ক্রিকেটের ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে গাড়ি চালানো সব সেই অভীপ্সার অঙ্গ হয়ে গিয়ে এক প্রজন্মের স্বপ্নকে জারিত করেছে।

সত্যি কথা বলতে গেলে শাহরুখের মতো আর কেউ সিনেমার পর্দায় ঠিক ততটা ভালো আদর্শ অনাবাসী ভারতীয় চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি - যিনি লন্ডন নিউইয়র্ক সর্বত্র তাঁর নিজস্ব কেতায় জীবন কাটান, যদিও অন্তস্থলে থেকে যান এক আদর্শ ভারতীয়। এভাবেই নতুন সহস্রাব্দে বিশ্বায়িত জগতে শাহরুখের ইমেজ প্রতিষ্ঠিত করছিল এক নতুন স্বপ্নের নায়ককে। অসম্ভব মেট্রোপলিটান এক ব্যক্তিত্ব যে পাঞ্জাবের সর্ষে ক্ষেতেও আদতে তাঁর নাগরিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে এক শাইনিং ভারতের প্রতীক রূপে পর্দায় উপস্থিত থাকতে পারে সেরকম এক চরিত্র। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই শাহরুখের ছবি দেখেছি, কিন্তু তা অনেকটা বিশ্লেষণ করার দায় থেকে। বুঝতে চেয়েছি, কীভাবে এক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শাহরুখের এই চরিত্রায়ন এক রূপক হয়ে উঠছে। সে সময়ের আই.টি. ড্রিম, সঙ্গে বিদেশে পড়তে যাওয়া, বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের মখমলে সবুজ লন, সেখানে প্রায় শ্বেতাঙ্গিনীর মতো চেহারার ভারতীয় নায়িকার সঙ্গে প্রেম অথবা বিবাহ-উত্তর জীবনে স্টিল অ্যান্ড গ্লাস বিল্ডিং-এর জানালা দিয়ে পশ্চিমী শহরের স্কাইলাইন এক বিশ্বায়িত পৃথিবীর সুখনীড়ের কল্পনার টেমপ্লেট খাড়া করে দেয়। আমচি মুম্বাই বাতিল হয়ে যায় স্বপ্নের লোকেশন হিসেবে। এইসব বিদেশী স্পেসে পৌছে যাওয়া যায় খুশিমতো। নয়ের দশকের শেষ দিকে অবশ্য সুইৎজারল্যান্ডের পাহাড় বা মরিশাসের সাদা বালুকাবেলা মিলত শুধুই স্বপ্নে, বিশ্বায়িত জগতে তার চিত্রায়নের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসে, আর শুধুই স্বপ্ন নয়, পড়তে, নয়তো কর্মসূত্রে নয়তো নেহাতই দেশে পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে, নয়তো নেহাতই ছুটি কাটাতে এই রাহুলরা বড় সহজে দেশের সীমানা পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল, বিদেশী মাটিতে তাদের ঘর বানাচ্ছিল। সেখানে অক্ষত থেকে যাচ্ছিল তার ভারতীয়ত্ব ঠাকুরঘর আর জাতীয় পতাকায়।

আমিও প্রায় একই সময়ে বিলেতে পড়তে গিয়েছিলাম, স্কলারশিপ সহ এবং আইনি পথে। সে সময়ে আমার স্কলারশিপের পরিমাণ শুনে দেশে সবাই আশ্চর্য হলেও সেখানে পদার্পণ করেই বুঝেছিলাম বাড়ি ভাড়া আর সপ্তাহে দশ পাউন্ডের বাজার করার পর এমনকী ফোন কলটাও করতে হবে হিসেব করে। তবুও সেখানে আমরা ছিলাম প্রিভিলেজড। অক্সফোর্ড স্ট্রীটে লন্ডনের মেমেন্টো-বেচা সুরজিত একদিন ঈর্ষান্বিত গলায় বলেছিল, "তু তো লিগাল হ্যায়"। ভিসা রিনিউয়ালের সময়ে দেখেছি কীভাবে পর্যাপ্ত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স না থাকায় সেলফ ফিনান্সিং ছাত্রদেরও রাতারাতি দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হতো। অন্যদিকে দেখেছিলাম পশ্চিমী দুনিয়ায় আশ্রয়প্রার্থীদের দুর্গতি। তখনো পূর্ব ইউরোপ পড়ে যাওয়ার ঘা শুকোয়নি। একবার ট্যাক্সির মধ্যে আমার আর আমার সুপারভাইজারের মধ্যে মার্ক্সিজম নিয়ে বিতর্কের মধ্যস্থতা করেছিলেন রুশ ট্যাক্সি ড্রাইভার যিনি আদতে লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। ইতালিতে আমাদের হোটেলের ঘর পরিষ্কার করতে এসে শ্রীলঙ্কার তামিল যুবকটি আমার স্বামীকে স্বদেশীয় ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, সাশ্রু নয়নে বলেছিল দেশে গোলমালের সময়ে সে পালিয়ে আসে দেশ থেকে, এখন সে দেশের সব রেকর্ডেই মৃত। তাই দেশে ফিরতে চাইলেও সে আর পারবে না দেশে ফিরতে।

কিন্তু মূল গণমাধ্যমে বিশ্বায়ন তখনও উপস্থাপিত হচ্ছিল এক মুক্তবিশ্বের প্রতীক রূপে। যেখানে সীমানার বিভাজন নেই, যেখানে রাষ্ট্রীয় খবরদারি নেই, সে স্বপ্নের জগতে মেরিট বা প্রতিভা থাকলেই এক ব্যক্তিমানুষের সাফল্য সুনিশ্চিত। এবং তার মূর্তিমান প্রতীক শাহরুখের মতো রুপোলি পর্দার নায়ক অভিনীত রাহুল চরিত্রগুলি। আমাদের মধ্যেও অনেকে এই সময়টাকে আগের যুগের বামপন্থীদের সেই স্বপ্নের আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে একাকার করে দেখছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী কাঠামোর আবর্তে সীমানা যত সহজে পণ্যের জন্য খুলে যায় ততটা যে সহজে মানুষ, বিশেষত গরিব মানুষের জন্য খোলে না সে কথা তখনও তেমনভাবে প্রচারিত হতো না। যে কারণে স্বপ্ন উঠত ফুলে ফেঁপে এই অভিবাসনের জন্য। অভিবাসিতের প্রাত্যহিক লড়াই প্রায় সবক্ষেত্রেই অনুল্লেখিত থাকত।

মনে আছে এই শতাব্দীর প্রথম দিকে একটা খবর প্রকাশিত হয়েছিল ইংলন্ডের পত্রিকায়। অমৃতসর থেকে হিথরোগামী প্লেনের চাকার জায়গায় দুজন লুকিয়ে চলে আসেন লন্ডনে। তার মধ্যে এক ব্যক্তির ঠাণ্ডায় মৃত্যু হয়, অন্যজনও প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় সেখানে পৌঁছান। এই ঘটনাটাতে সমসাময়িক মিডিয়ায় ভারতীয়দের অভিবাসন নিয়ে প্রচুর তীর্যক মন্তব্য শোনা যেত। এমনকী আমাদের কাছেও লোকে প্রশ্ন করত, তোমাদের দেশে কি কিছু নেই? কেন সবাই এখানে আসতে চায়? অনেকটা সেসব মন্তব্যের আবর্তেই আমিও গবেষণার পর সেখানে চাকরি নিইনি। কিন্তু তা অন্য প্রসঙ্গ। আসলে যেটা বুঝেছিলাম বিশ্বায়ন আদতে কোনো সীমানা মোছেনি, নতুন করে সেসব সীমানা এঁকেছে মাত্র।


বিশ্বায়িত পৃথিবীতে তাই জাতি-পরিচিতির পাশাপাশি অভিবাসনের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শ্রেণীগত পরিচিতি। পাশাপাশি ভাষাও ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বাইরেও কথোপকথনের অজুহাতে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। গরিব দেশ বড়লোক দেশের পার্থক্যরেখায় ভাষা ও সংস্কৃতিও নতুনভাবে ভেদরেখা টানতে সাহায্য করে। ফলে বিশ্বায়ন এক ধরনের লোকের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে যারা বিশ্বায়নের ভারবাহী বলে চিহ্নিত।

'ডুঙ্কি' শব্দটি আদতে ডঙ্কি বা গাধা বা ভারবাহী পশু যারা সীমানা পেরিয়েও চলে যায় তাদের নির্দেশিত করে। পাঞ্জাবি ভাষায় বে-আইনি অভিবাসনকে 'ডুঙ্কি' বলে, অর্থাৎ গাধার মতো সীমানা পেরিয়ে যাওয়া। পরিচালক রাজকুমার হিরানী সিনেমায় তথাকথিত সামাজিক বার্তা দেওয়ার জন্য সুবিদিত। এই ছবিকেও সে ধারায় ফেলে অনেকেই বলছেন এখানেও তিনি তেমনই একটি প্রাসঙ্গিক বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তাঁর এই ছবিগুলো অন্যান্য ছবির চেয়ে ভিন্ন স্বাদের। রাজকুমার হিরানীর অধিকাংশ ছবিতেই কোনো এক ব্যবস্থার গলদ এবং তার প্রতিকারে এক ব্যক্তি মানুষের লড়াই বা জয়ের গল্প বলা হয়। এ ছবিতেও আধুনিক পৃথিবীতে সীমানা ও অভিবাসনের সমস্যা কাহিনীর কেন্দ্রস্থলে। সে সমস্যার মোকাবিলা বা সমাধানের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যক্তি মানুষ নয়, বরং এক বিকল্প পথের গল্প বলা হয়েছে, এবং যেখানে শেষে নায়কের জয়কে ঠিক কীভাবে জয় বলা যায় তা নিয়ে ধন্দ থেকে যায়। আপাতভাবে বলা যেতে পারে, এখানে নায়কের আদত জয়ের ক্ষেত্র প্রেম, যা দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করে ফিরে আসে তারই কাছে। এদিক দিয়ে আলোচনা করে অনেকে এ ছবিকে শাহরুখ অভিনীত আরেক ছবি ‘বীর-জ়ারা’-র সঙ্গে তুলনা করছেন। হ্যাঁ, সেখানেও সীমানা ছিল, রাষ্ট্রীয় নিষেধাবলীর চাপে ক্লিষ্ট জীবনের ইতিবৃত্ত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানকার মতো একদল পরাজিত মানুষের গল্প ছিল না।

তাই আমার কাছে এই ছবিতে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে নয়ের দশকের সেই অনাবাসী ভারতীয় রাহুলরূপী শাহরুখের পরিবর্তে পরাজিত এক হার্ডি বা হরদয়াল ধিলোঁর চিত্রায়ণ, যে গাধার মতো সীমানা পেরোয়, এবং গাধার মতোই ফিরে আসে, কিন্তু কখনও সফল অনাবাসী হতে পারেনা। দেশের মাটিতেও সে তার ফৌজি সত্তা নিয়ে গর্বিত হলেও সে যখন গুলি খায় তখন তার কোনো ফৌজি সহযোদ্ধা নয়, পাঞ্জাবের লাল্টুর এক সাধারণ নাগরিক পাশে দাঁড়ায়। এমনকী তাঁর জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মানবোধও সহ নাগরিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়না। অন্যদিকে, এক অর্থে এ পোড়া দেশ থেকে সে ব্যক্তিগতভাবে কিছু না পেলেও বিদেশে সফল অনাবাসী হয়ে থাকতে গেলে কেন যে তাকে তার দেশের প্রতি বিরূপ হতে হবে সে যুক্তিও তার কাছে পরিষ্কার নয়। কারণ বিশ্বায়নে আপাত বিজ্ঞাপিত উন্নত জীবনযাত্রা কেন যে কোনো মানুষের সীমান্ত পেরোনোর কারণ হতে পারেনা তা সে ধরতে পারেনা। ঔপনিবেশিক ভাগ্যান্বেষণের চেয়ে পৃথক এ অভীপ্সার নিষ্ফল পরিসমাপ্তিই তাই এ সিনেমার গল্প। এ সিনেমায় হার্ডি বা হার্ডির বন্ধু কেউই সফল অনাবাসী নয়। কারণ তারা বহু কষ্টে তাদের অভীপ্সিত দেশে গিয়ে পৌঁছেছিল মাত্র, অধিকাংশ অভিবাসিত মানুষের মতোই তাদের উপার্জনে বাড়িতে কিছুটা স্বাচ্ছল্য আসে, কিন্তু তারা বিশ্বায়িত পৃথিবীতে টিকে থাকে ভারবাহী গাধার মতো। যাদের শ্রম জরুরি, কিন্তু শ্রেণী হিসেবে তারা কাম্য নয় কোনো জটিল অর্থনীতিতে।

ছবিটাতে তাই পরাজিত নায়কেরা কেউই স্টাইল স্টেটমেন্ট হননি। বোটক্স করা শাহরুখ কোনোভাবেই পুরোনো রাহুলদের মনে করাবে না। তাপসি পান্নুও থেকে যাবেন অভিনয়ের জন্য, নায়িকা হিসেবে নয়। বাড়ির মাথায় উড়োজাহাজের মতো জলের ট্যাঙ্ক বা স্বামীর চাকরি চলে যাওয়ার পর মাঝবয়সী স্ত্রীর পুরুষের মতো ফুলপ্যান্ট পরে অনভ্যস্ত হাঁটা আমাদের বিশ্বায়নের ধাক্কাগুলো মনে করাবে। এ ছবির অনেক ভ্রান্তি আছে, কিন্তু বিশ্বায়নের পৃথিবীতে সাধারণের স্বপ্নভঙ্গের যে সত্য আছে তার জন্যই এ ছবি মনে থাকবে অনেককাল।