আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা ● ১৬-৩১ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১-১৫ মাঘ, ১৪৩০

সমসাময়িক

দুর্নীতি, ইডি ও তৃণমূল


পশ্চিমবঙ্গবাসীর জীবনে যখনই রঙ্গ তামাশার ঘাটতি পড়ে, তখনই রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা একযোগে প্রভূত রোমাঞ্চের যোগান দিয়ে থাকে। সম্প্রতি সন্দেশখালীতে স্থানীয় তৃণমূল নেতার বাড়িতে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট তথা ইডির অভিযান নিয়ে এরকমই এক ধুন্ধুমার চিত্রনাট্য তৈরি হল। সকাল সকাল ইডির আধিকারিকরা কেন্দ্রীয় পুলিশবাহিনীর লস্কর নিয়ে পৌঁছেছিলেন সন্দেশখালীর তৃণমূল নেতা শেখ শাজাহানের বাড়িতে, রেশন দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্ত চালাবেন বলে। কিন্তু নেতা এলাকায় তালেবর মায় বাহুবলী। রাজ্য পুলিশের মমতায় এবং রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বলিয়ান নেতা এত সহজে মাথা নোয়াতে রাজি নন। ফলে এলাকায় তার বাহিনীকে ডেকে এনে তদন্তকারী আধিকারিকদের খানিক কিল চড় মেরে ফেরত পাঠিয়ে দেন। তারপর নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এলাকায় তার বাহিনী আরও খানিক তান্ডব চালায়। এই গোটা ঘটনায় কিছু সাংবাদিকও মারধর খেয়েছেন। অতঃপর গোটা রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক বিরোধীরা সরকারকে ধিক্কার জানাচ্ছেন আর সরকার ও তার নেত্রী ইডিকে ষড়যন্ত্রকারী বলে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছেন। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের আমজনতা আবারও নীরব দর্শক হিসাবে বুড়ো আঙুল চুষছেন।

তৃণমূলের এই বাহুবলী নেতার কীর্তি কাহিনি ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের পাতায় বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। নিজ রাজনৈতিক এলাকায় সে প্রায় একটি সমান্তরাল প্রশাসন চালায়। তার নিজস্ব ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী আছে। এদের সাহায্যে সন্দেশখালী অঞ্চলে বিঘার পর বিঘা জমি দখল করে বা কিনে মাছের ভেড়ি বানিয়ে তার আর্থিক জোর বেড়েছে। অভিযোগ যে বহুক্ষেত্রেই চাষের জমিতে জোর করে নোনা জলে ঢুকিয়ে তাকে ভেড়িতে পরিণত করা হয়েছে। এলাকার মানুষ কিছু প্রতিবাদ করতে পারেননি কারণ পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসনের আশীর্বাদের হাত এই দুষ্কৃতির মাথায়। তদন্ত আধিকারিকদের পেটানোর ৯ দিন পরেও এখনও অবধি পুলিশ এই রাজনৈতিক দুষ্কৃতি ও বকলমে তৃণমূলী নেতার খোঁজ পায়নি, যদিও রাজ্যের পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা বলেছেন অপরাধীদের কেউই ছাড়া পাবেনা। এলাকার মানুষ তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা রোজই বলে দিচ্ছেন কোথায় এই দুষ্কৃতি গা ঢাকা দিয়ে আছে। তবু শিশুসুলভ সরল পুলিশ, রাজ্য বা কেন্দ্র কেউই তাকে খুঁজে বার করতে পারছেন না। এহেন কাহিনি যে চলচ্চিত্রের বাইরে বাস্তবের মাটিতেও ঘটতে পারে পশ্চিমবঙ্গ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।

যে কোনো বিচক্ষণ মানুষমাত্রই জানেন দুষ্কৃতীদের রাজনৈতিক দলের সাথে এক ধরণের গোপন বোঝাপড়া হয়ে থাকে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে তো বটেই। তবে তৃণমূল দলটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই দলের সাথে রাজনৈতিক দুষ্কৃতীদের বোঝাপড়া নেই, তারাই আদতে দলটার মূল চালিকাশক্তি। এরাই নির্বাচনী ময়দানে তৃণমূলের বাহুবল, লোকবল-এর যোগানদাতা। আবার দরকারে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে বেমালুম কব্জা করে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করে আনার কুশীলব এরাই। তর্কের খাতিরে কেউ বলতেই পারেন যে এসব ঘটনা আগেও তো ঘটেছে। ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু তারা কখনোই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারেনি। আজকে তৃণমূল নামক দলটার নীতি এরাই প্রায় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ঠিক এই কারণেই তৃণমূলের ছোট বড় একাধিক নেতা আজ হয় জেলের ভেতরে অথবা জেলে যাওয়ার অপেক্ষায়। তৃণমূল নেত্রী দাবি করছেন যে এসব কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র। কিন্তু পাঠক মনে এই প্রশ্ন কি উঁকি দেয়না যে যাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে রটনা তাদের বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা কীভাবে উদ্ধার হচ্ছে? এরা যদি এতই সৎ তাহলে তদন্তকারী অফিসারদের মারধর করে এলাকা ছাড়া করার দরকার কেন পড়ল? এদের সঙ্গে নিশ্চয়ই উমর খালিদ, আনন্দ তেলটুমবে, স্ট্যান স্বামীর তুলনা চলেনা। এরা যে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের শিকার তা আজ সর্বজনবিদিত। কিন্তু এই তৃণমূলের মাস্তান, রাজনৈতিক কর্মীদের সম্পর্কে একথা কেউ বলবে না, যতই তাদের নেত্রী ‘আমরা সবাই চোর’ বলে মিছিল করুন। 

আসল কথাটি অবশ্য নেত্রী বলে ফেলেছেন যে নির্বাচনী ময়দান খালি করতে কেন্দ্রীয় সরকার এইসব তদন্তকারী সংস্থা পাঠিয়েছেন। ঠিকই, একদা বীরভূমের অনুব্রত মন্ডলের সাথে যে কৌশল খাটানো গেছে, বস্তুত তারই নির্মাণ আবার চলছে। এটা ঘটানো যাচ্ছে কারণ যারা অভিযুক্ত তাদের সম্পর্কে জনমত মোটেই সুবিধার নয়। এদের প্রত্যেকের হিসাব বহির্ভুত সম্পত্তি রয়েছে এবং এরা স্থানীয় মানুষের ওপর অত্যাচার করেই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করেছে তা প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং বিজেপি যে এইসব বাহুবলীদের গারদে ভরে নির্বাচনী ময়দানে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে তাতে বিস্ময় কিসের। 

অভিযুক্তের বক্তব্য না হয় চিরকালই ‘আমি কিছু করিনি, যা করেছে ওই পাড়ার ভোলা’। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যারা সিপাই, গোয়েন্দা নিয়ে আবির্ভুত হলেন এই দুর্নীতির বিচার করতে তাদের দক্ষতাই বা কিরকম। গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংবাদমাধ্যম বা বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে যে তৎপরতার সাথে তারা হানা দেন এবং প্রায় রোমহর্ষক তল্লাশির বিবরণ পেশ করেন, বিজেপির স্নেহছায়ায় থাকা দূর্নীতির কারবারীদের প্রতি তাদের নজর পড়ে না। এ রাজ্যে অধুনা বিজেপির দলনেতা একসময় সংবাদমাধ্যমের সামনে ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। তখন তিনি ছিলেন তৃণমূলে। আজ তিনি বিজেপির বিধায়ক অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত নেই। সন্দেশখালীর ঘটনার মূল অভিযুক্তদের সাথে একদা তারই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার পরও আজ তাকে ডেকে কেউ প্রশ্ন করছে না। সুতরাং এহ বাহ্য যে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা আদতে কেন্দ্রের প্রভুদেরই বশংবদ। যেদিকে তারা আঙ্গুল দেখাবেন তদন্ত এই ঢালেই বইবে। তাই গত দুই বছর যাবৎ এ রাজ্যের বুকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাপাদাপির পরেও তদন্তের কোনো নিষ্পত্তি হয়না। দু একজন মন্ত্রী জেলে গিয়েছেন বটে, তবে তা সাময়িক না চিরস্থায়ী তাও কেউ নিশ্চিত বলতে পারবে না। কিন্তু যা সবাই বুঝে গেছেন তা হল এই গোটা নাটকের শেষে এক অবস্থায় থেকে যাবেন যারা এই দুর্নীতির শিকার - ঘর বানানোর টাকা না পাওয়া, নিম্নমানের রেশন সামগ্রী পাওয়া, চাকরি না পেয়ে প্রতারিত হওয়া মানুষরা। রাজনৈতিক স্বার্থে চালিত তদন্তের এই ভাঁড়ামোর একমাত্র দুর্ভাগা ভাঁড় এরাই।

এই অলীক কুনাট্যের বাইরে বেরিয়ে যেই রাজনৈতিক শক্তির কাজ ছিল মানুষকে চোর এবং সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একজোট করা, সেই বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা কি? নিয়মিত মিটিং মিছিল হচ্ছে এটা ঠিক। সেই মিটিং-মিছিল থেকে তারা দাবি করছেন চোরদের ধরে জেলে ভরতে হবে। দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে এক স্বচ্ছ ব্যবস্থার দাবি তারা জানাচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে সে দাবি আদায় হবে? তারা একবার তদন্তকারী সংস্থার কাছে দাবি জানাচ্ছেন, অন্যদিকে আদালতে গিয়ে কিছু মামলার শরিক হচ্ছেন। কিন্তু তাতে কি এই ঘটনাপ্রবাহে কোনো বদল আসবে? তারা দাবি তৈরি করলেন, বহু মানুষের জমায়েত করলেন কিন্তু আন্দোলনের মেজাজ গত ১০ বছরে তৈরী হল কি? সারদা থেকে নারদা, রেশন থেকে চাকরি কোন দুর্নীতি নিয়ে কি তারা সাধারণ জনতাকে উদ্বেলিত করতে পারলেন? মেজাজি আন্দোলন যে কেন্দ্রের পরাক্রমী সরকারকেও বিচলিত করে কৃষক আন্দোলন সেই নজির রেখেছে। কিন্তু এ রাজ্যে বামপন্থী শক্তি আন্দোলনের সেই তীব্রতা তৈরি করতে পারল না। ফলে এ রাজ্যের মানুষ বিকল্প খুঁজবেন কোথায়! চোর এবং সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত - এই দুষ্টচক্রের বাইরে আসার রাস্তা বামপন্থীরা তৈরি করবেন কবে?