আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

জনস্বাস্থ্য পরিষেবা

প্রতীশ ভৌমিক


সরকারি অবহেলায় আজ দুর্বল দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সেই সুযোগে কর্পোরেটরা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুকৌশলে দখল নিচ্ছে। পরিষেবা মিলছে, তবে মূল্যের বিনিময়ে।

ঔপনিবেশিক আমল থেকে ব্রিটিশ প্রশাসন নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবায় দৃষ্টিপাত করে। রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, স্যানিটেশন ও রোগ প্রতিরোধই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই কারণে কলেরার মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলাও সম্ভব হয়েছিল। দেশজুড়ে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা হল সমস্ত সংগঠিত ক্রিয়াকলাপের সমষ্টি যা রোগ প্রতিরোধ করে, জীবন দীর্ঘায়িত করে, দক্ষতার প্রচার করে, মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ায়।

ভারতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেশ কিছুকাল ধরেই অবহেলিত হয়ে আসছে। আজকের সময় মাতৃমৃত্যুর হার ১১.৯ শতাংশ এবং বিশ্বের সমস্ত শিশুমৃত্যুর ১৮ শতাংশ, যা এখনও ভারতেই ঘটে, এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। ১,০০০ শিশুর মধ্যে এদেশে ৩৬.৬ শিশু ৫ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়। ভারতে মোট মৃত্যুর ৫৩ শতাংশ মৃত্যুর কারণ সংক্রামক রোগ।

ন্যাশনাল হেলথ মিশন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রচার জনগণকে প্রভাবিত করতে চায়, যদিও এমন উদ্যোগগুলি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক দ্বারা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। যদিও ভারতের গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, সাব-সেন্টার এবং সরকারি হাসপাতাল সহ একাধিক স্বাস্থ্য কাঠামো রয়েছে। কর্মসূচিগুলিকে অবশ্যই ভারতীয় জনস্বাস্থ্য স্ট্যান্ডার্ডস নথি দ্বারা নির্ধারিত মানগুলি অনুসরণ করতে হবে, প্রয়োজনে সংশোধনের দরকার হতে পারে, আর সেখানেই রয়েছে খামতি।

ইতিহাস বলে, জনস্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং তৃতীয় স্তরে সংগঠিত। প্রাথমিক স্তরে রয়েছে সাব-সেন্টার এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র (পিএইচসি)। মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে কমিউনিটি হেলথ সেন্টার (সিএইচসি) এবং ছোট উপ-জেলা হাসপাতাল। অবশেষে, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জনস্বাস্থ্য পরিষেবার শীর্ষ স্তর হল তৃতীয় স্তর, যা মেডিকেল কলেজ এবং জেলা/সাধারণ হাসপাতাল নিয়ে গঠিত। পিএইচসি, সিএইচসি, উপকেন্দ্র ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসকের অপ্রতুলতা, চিকিৎসা কর্মচারী, ওষুধ ও অন্যান্য যন্ত্রাদির অভাবে পরিষেবা ক্রমাগত তলানিতে ঠেকেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের জন্য সাব-সেন্টারগুলি গ্রামীণ জনগণকে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করার জন্যও কাজ করে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও উন্নত গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যমান, ডাক্তার এবং প্যারামেডিকস সহ বৃহত্তর স্বাস্থ্য ক্লিনিক হিসাবে কাজ করে। তবে পরিস্থিতি খারাপ থাকাতে একটু জটিল ক্ষেত্রে রোগীদের স্থানীয় সাব-সেন্টার থেকে পিএইচসি-তে রেফার করা হয়, অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর জন্য বহু ক্ষেত্রে সমস্যা আরও জটিল হয়, রেফারেল সংক্রান্ত কেস বাড়তে থাকে, ক্রমশঃ উচ্চ পর্যায়ে চাপ বাড়তে থাকে। সাব-সেন্টার থেকে পিএইচসি-গুলি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপর বৃহত্তর জোর দিয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষার উন্নতির জন্যও কাজ করে। কমিউনিটি হেলথ সেন্টারেও রাজ্য সরকার থেকে অনিয়মিত সাহায্য ও ফান্ডের অভাবে সমস্যাগুলো অব্যহত থাকে। ইউনিটগুলি প্রসূতির যত্ন, নবজাতক/শিশুর যত্ন, সপ্তাহের প্রতিদিন রক্তসরবরাহ সময়ে হচ্ছে কিনা দেখে। উপ-জেলা/উপ-বিভাগীয়/তালুক হাসপাতালগুলি উপ-জেলা সদরে অবস্থিত এবং কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করার কথা। তালুক হাসপাতালগুলি তালুক সদর দফতরে অবস্থিত; সেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার কথা। তালুক হাসপাতালে একটি পরীক্ষাগার এবং একটি ফার্মেসি থাকে যা রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করে। হাসপাতালের জরুরী বিভাগ ২৪ ঘন্টা কাজ করে, যে সমস্ত রোগীদের জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন তাদের অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা করতে চিকিৎসকরা চেষ্টা করেন। তালুক হাসপাতালগুলি জেলার নিচে এবং ব্লক স্তরের সিএইচসি-গুলির উপরে রয়েছে। তালুক হাসপাতাল এসসি (সাব-সেন্টার), পিএইচসি (পাবলিক হেলথ সেন্টার), সিএইচসি (কমিউনিটি হেলথ সেন্টার) এবং জেলা হাসপাতালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হিসাবে কাজ করে। জেলা হাসপাতালগুলিতেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পরিষেবা দেওয়া হয়। এছাড়াও রাজ্যস্তরে মেডিকেল কলেজগুলোতে চিকিৎসকরা দিনরাত এক করে কাজ করেন।

২০১১ সালের আদমশুমারী অনু্যায়ী ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ও জনস্বাস্থ্যের অবস্থার অসামঞ্জস্য লক্ষনীয়। গ্রামীন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় বেড নেই, চিকিৎসক আছে কিন্তু ন্যূনতম একজন MBBS ডাক্তার নেই, চিকিৎসা সরঞ্জাম বা ওষুধ নেই, নেই এ্যাম্বুলেন্স, তবে নীল সাদা রঙে সেজেছে সর্বত্র। নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে। ঠিকা প্রথায় নিযুক্ত বহু চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মচারীরা, বহু জায়গায় তাও নেই।

স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে এক বিশেষ সমস্যা হল মানুষের অপুষ্টি। অপুষ্টি বলতে বোঝায় মানুষের খাদ্যগ্রহণের সঙ্গে যে শক্তি এবং পুষ্টি গ্রহণ করে তার স্বল্পতা, বাহুল্যতা অথবা অসামঞ্জস্যতা। অপুষ্টি বলতে শরীরের দুটো অবস্থাকেই বোঝায়। প্রথমটা অপর্যাপ্ত পুষ্টি, উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, বয়স অনুযায়ী কম ওজন এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানের অপ্রতুলতা। অপরটি হল মাত্রাতিরিক্ত ওজন, ফলত খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণে অসংক্রামক ব্যাধি সমূহ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার ইত্যাদি বাড়ছে।

বিশ্বব্যাঙ্কের হিসেব বলে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে যে সমস্ত দেশের শিশুরা সবথেকে বেশি অপুষ্টির শিকার ভারতবর্ষ তাদের মধ্যে অন্যতম এবং তা আফ্রিকার সাব-সাহারান দেশগুলির অপুষ্ট শিশুদের সংখ্যার দ্বিগুণ। বিশ্বের অভুক্ত মানুষের সূচি অনুযায়ী ভারতের স্থান এই সময়ে ১১১, পৃথিবীর সবচাইতে বেশি অভুক্ত মানুষের দেশগুলির সংখ্যা মোট ১২৩, এমনকি উত্তর কোরিয়া এবং সুদানের থেকেও নিচে। ভারতের ৪৪ শতাংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম এবং ৭২ শতাংশ শিশু রক্তাল্পতার শিকার। বলা যেতে পারে সমস্ত পৃথিবীর তিনজন অপুষ্ট শিশুদের মধ্যে একজন ভারতবর্ষের অধিবাসী।

ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস-বি, এম ডি আর টিবি, ম্যালেরিয়া এবং নিউমোনিয়া রোগের উপদ্রব-এর কারণ হল মানুষের শরীরে ওষুধের অকার্যকারিতা বেড়ে যাওয়া ভারতবর্ষে সংক্রামক রোগসমূহ হিসেবে চিহ্নিত। ন্যাশনাল হেলথ প্রোফাইল ২০১৭ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ভারতে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর বিস্তার ও প্রসার এই বিশ্বের এইচআইভি এইডস রোগাক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। ভারতের জাতীয় এইডস নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বা ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অরগানাইজেশন একটি সরকারি সংস্থা হিসেবে এইচআইভি এইডসের ব্যাপকতা হ্রাস করতে সবরকম চেষ্টা করে চলেছে। এক্ষেত্রে এনজিওগুলোর ভুমিকাও রয়েছে। ডায়ারিয়া বা পেটের অসুখজনিত রোগগুলি শিশুমৃত্যুর প্রাথমিক কারণ - অনুন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং অপর্যাপ্ত শুদ্ধ ও নিরাপদ পানীয় জল। বিশ্বে জলাতঙ্ক রোগের প্রাদুর্ভাব ভারতবর্ষে সবচাইতে বেশি। ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া একটি মরশুমি স্বাস্থ্য সমস্যা এবং এই সমস্যা বহুদিন থেকেই ভারতে বিদ্যমান। ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বেশি এবং মৃত্যুর হারও বেশি। এই রোগ ২০১২-১৩ সালে অনেক কমে গিয়েছিল কিন্তু আবার ২০১৪ সালে বৃদ্ধি পেলেও ২০১৫ সাল থেকে এই রোগের প্রকোপ কমতে থাকে। ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া এডিস মশা বাহিত রোগ এবং একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা। ডেঙ্গু রোগের আকস্মিক আবির্ভাব ঘটেছিল ১৯৫০ সালে এবং তারপর থেকেই তা চলছে এবং গত দুই দশক ধরে এর প্রকোপ অনেকটাই বেড়েছে। ২০১২ সালে ভারত প্রথমবার 'পোলিওমুক্ত দেশ' হিসেবে গণ্য হয়। বিগত ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য পরিকল্পনার উন্নতি সত্ত্বেও ভারতে নবজাতকদের প্রতি পর্যাপ্ত যত্নের অভাব এবং প্রসবকালীন অব্যবস্থার কারণেই শিশুরোগ এবং শিশুমৃত্যু অব্যহত। প্রতি বছর কুড়ি লক্ষেরও বেশি শিশুর মৃত্যু হয় বিভিন্ন রকম প্রতিরোধ-অযোগ্য সংক্রমণের জন্য।

ইমিউনাইজেশন বাজেটে ঘাটতির জন্য মাত্র ৪৩.৫ শতাংশ শিশুকেই সম্পূর্ণ টিকাকরণ করানো গিয়েছিল। 'ফিউচার হেলথ সিস্টেম কনসর্টিয়াম'-এর পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার উপর করা এক সমীক্ষায় জানা গেছে যে এই টিকাদান প্রক্রিয়ায় অধিক এলাকার অন্তর্ভুক্তি গঠনের পথে বাধা হচ্ছে ওই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান, দ্বিতীয়ত অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী এবং তৃতীয়ত, টিকাদান গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুভুতির অভাব। গ্রামীণ এলাকাগুলিতে হাসপাতাল, রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামোজনিত ত্রুটি রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরও অভাব আছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এবং নবজাতকদের প্রয়োজনীয় যত্নের বিষয়ে পদক্ষেপজনিত অবহেলাই অধিক হারে শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ।

অপর্যাপ্ত শৌচালয়, উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে, অপরিস্রুত পানীয় জলের কারণে কয়েক লাখ মানুষ বিভিন্ন রকম পেট সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয় এবং অনেক মানুষ হেপাটাইটিস-এ, আন্ত্রিক জ্বর, আন্ত্রিক কৃমির সংক্রমণ জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পরিস্রুত জল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে ভূগর্ভস্থ জল দূষণ, অতিরিক্ত আর্সেনিক সম্পন্ন জলই মানুষের ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছে।

গর্ভাবস্থায় মাত্র ১৫ শতাংশ মায়েরা প্রয়োজনীয় যত্ন পায় এবং মাত্র ৫৮ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা প্রয়োজনীয় আয়রন ট্যাবলেট ও অন্যান্য ওষুধ পায়। নারীস্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো যেমন গর্ভাবস্থায় অপুষ্টি এবং স্তন্যদানের সময় শরীরের ক্ষতি হয়ে থাকে। পাশাপাশি স্তন ক্যান্সার আজ নারীদের অন্যতম প্রধান মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি সমস্যা হল মাতৃত্বকালীন মৃত্যু। এছাড়াও ম্যালিগ্ন্যান্ট ম্যালেরিয়া, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, সংক্রামিত ক্ষত থেকে শুরু করে ক্যানসারে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারত তার জনগণের স্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে। এই পরিবর্তনের প্রভাব অর্থনৈতিক বিকাশ, পুষ্টির পরিস্থিতি, বন্ধ্যাত্ব রোধ এবং মৃত্যুর হারেও দেখা গেছে এবং ফলস্বরূপ, বিভিন্ন রোগের পরিসংখ্যান পরিবর্তিত হয়েছে। সংক্রামক রোগগুলি নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সেগুলি এখনও দেশের রোগব্যাধিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে রেখেছে। সংক্রামক রোগে মৃত্যু এবং বিকলাঙ্গত্ব হ্রাসের সাথে সাথে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সার, মানসিক ব্যাধি এবং জখমের মতো দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগের প্রবণতাতে বৃদ্ধি ঘটেছে। ভারতীয়রা বিশেষত এথেরোস্ক্লেরোসিস (ধমনী গাত্রে কোলেস্টেরল জমার দরুণ) এবং করোনারি ধমনীর রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে। এর কারণগুলি হল বিপাক সংক্রান্ত ও জিনগত প্রবণতা এবং করোনারি ধমনী ভাসোডাইলেশনে বা সম্প্রসারণের কুপ্রভাব ইত্যাদি। বায়ু দূষণের ফলে এযাবৎ মোট ১২ লাখেরও বেশি ভারতীয় মারা গেছেন। সম্প্রতি দুবাই, সিওপি ২৮ সম্মেলনে জাতিপুঞ্জের সভাপতি সতর্ক করেছেন পরিবেশ ও উষ্ণায়ন নিয়ে, কার্বন নির্গমনের কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি নিয়ে অথচ তার পরবর্তী পদক্ষেপের দেখা মেলেনি।

ভারতে গ্রাম এবং শহুরে বস্তি উভয় ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে গত কয়েক দশক ধরে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র এবং সংগঠনগুলি স্থায়ীভাবে বস্তি এলাকার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথাও বলেছেন। স্বল্পস্থায়ী জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি, একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যাতে সংক্রামক রোগের বিস্তার আটকাতে বস্তিবাসীদের প্রতিষেধক দেওয়া হচ্ছিল। এত বিশাল কাজের বিস্তৃত পরিধি যা ১৪০ কোটি মানুষের জন্যে পরিকল্পনা করে, তার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যখাতে ন্যৃনতমভাবে কেন্দ্রীয় বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০২৩-২৪ স্বাস্থ্য বাজেটে জিডিপি-র ০.৩৫ শতাংশ। অথচ ২০১২ সালে কেবলমাত্র জিডিপি-র ২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল, তারপর থেকে তা ক্রমশ কমেছে। যেখানে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র জিডিপি-র ১৬ শতাংশ, কানাডা, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি জিডিপি-র ১০ শতাংশ বরাদ্দ করে। এছাড়া নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশ জিডিপি-র ৯ শতাংশ টাকা স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করে। আমাদের দেশের জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামো ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে, টিকাপ্রদান কর্মসূচীতে তামিলনাড়ুতে 'Integrated Vaccine Complex' গড়ে তোলা হয়েছিল; হঠাৎ করে তার পরবর্তী পদক্ষেপ স্থগিত হয়ে গিয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ব ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোর বেসরকারিকরণ দেশের স্বনির্ভরতাকে দুর্বল করেছে। তার প্রমান মিলেছে দুটি করোনা ভ্যাকসিন তৈরিতে। নিজস্ব পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি কোম্পানীকে বরাত দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ঠিকা প্রথায় নিয়োগ এবং বেসরকারিকরণের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিষেবার হাল অত্যন্ত খারাপ। বিদেশি কর্পোরেট ও প্রাইভেট সংস্থাগুলো বিভিন্ন স্তরের পরিষেবার ক্ষেত্রে এই দুর্বলতা চিহ্নিত করে এই সমস্ত পরিষেবার জনগণের কাছে বিক্রি করছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে। জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের অর্জিত অধিকার ক্রয় করতে হবে মানুষকে। সরকারের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে নয়া কৌশল, বিভিন্ন স্তরে ডায়গ্নোসিস পদ্ধতি থেকে ওষুধসহ চিকিৎসা সামগ্রী ও অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা - সর্বত্রই বেসরকারি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। নয়া উদারনীতির বিপুল চাপে গড়ে উঠবে স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার বাজার। সমাজ উন্নয়ন কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিকল্পনাকে ধ্বংস করে বাজারের হাতে তুলে দিতে জমি তৈরি করছে এই সরকার। 'ন্যাশনাল হেল্থ প্ল্যান ১৯৮৩' যা কিনা আগেই বিস্তারিতভাবে ব্যখ্যা করা হয়েছে, সেই চারটি অংশ মূলতঃ বিনামূল্যে বিস্তৃত প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য স্বেচ্ছাসেবকদের যুক্ত করা, সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারী চিকিৎসা ও বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে গরিব মানুষের চিকিৎসার বদল ঘটানো। 'আয়ুষ্মান ভারত'-এর নামে মুনাফা বাড়াতেই কর্পোরেট বীমা কোম্পানিগুলোকে যুক্ত করছে সরকার। চিকিৎসা ও রোগনির্ণয়কে সামনে রেখে হাসপাতাল ও ওষুধ-এর মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেটওয়ার্ক এবং রাষ্ট্রের দ্বারা গরিব মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বদলে দিতে চলেছে এই সরকার। ইতিমধ্যেই কর্পোরেট ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপকভাবে প্রচার চলছে যে, সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মতো হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মানুষের নাকি তেমন ভরসা নেই।