আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

ভাঙা ক্যামেরায় লেখা থাকল নিষিদ্ধ ইশতেহার

আবীর মজুমদার


"ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।
"
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মধ্যবিত্ত কূপমণ্ডুকতা থেকে বেরিয়ে এসে দিগন্তে বিলীন হতে চেয়েছিলেন, আর সেই আরব বেদুইনরাই প্রায় চার হাজার বছর আগে প্যালেস্টাইনের মরুপ্রান্তরে খুঁজে পেয়েছিল তাদের স্থায়ী ঠিকানা। লেবানন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ছিল প্যালেস্টাইনের বিস্তৃতি। ইতিহাস বিজড়িত সেই জনজাতির ঠিকানা প্যালেস্টাইন আজ শুধু সীমাবদ্ধ ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক আর গাজা স্ট্রিপের দুটি অঞ্চলে। ১৮৯৭ সালের ২৯ আগস্ট গ্রেট ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদতে সুইটজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জায়নবাদীদের (Zionist) মহা সম্মেলনেই তৈরি হয় ইহুদীদের রাষ্ট্রগঠনের রূপরেখা। তারপরে এল ইতিহাসের সেই বিতর্কিত দিন। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর। ব্রিটেনের ‘ফরেন সেক্রেটারি’, অর্থার জন ব্যালফোর একটা চিঠি লিখলেন ইহুদী নেতা লায়োনেল ওয়াল্টার রথস্চাইল্ডকে। সেই চিঠিতে লেখা ছিল -

Dear Lord Rothschild,

I have much pleasure in conveying to you, on behalf of His Majesty's Government, the following declaration of sympathy with jewish Zionist aspirations which has been submitted to, and approved by the cabinet 'His Majesty's' Government view with favour the establishment in palestine of a national home for the Jewish people, and will use their best endeavour to facilitate and achievement of this object...

...I should be grateful if you would bring this declaration to the knowledge of the Zionist Federation.

Arther Jan Balfore

এই একটি মাত্র চিঠি বদলে দিয়েছিল প্যালেস্টিনিয় মানুষের জীবনের চিত্রনাট্য। আরবদের স্বভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, তাদের জমি কেড়ে, দিয়ে দেওয়া হল বহিরাগত ইহুদীদের। ব্যালফোরের এই ঘোষণাকালে ওই অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ আরবীয় আর ইহুদীরা ছিল ৬৫ হাজার। তার মধ্যে আবার ৩৫ হাজার ইহুদী ছিল প্যালেস্টাইনের আদি বাসিন্দা। ওই অঞ্চলের ৯৭.৫ শতাংশ জমি ছিল প্যালেস্টিনিয়দের। আর ২.৫ শতাংশ ছিল ইহুদীদের। এই হঠাৎ উচ্ছেদে শিকড় ছেড়ে উদ্বাস্তু হলেন হাজার হাজার স্থানীয় প্যালেস্টিনিয়। ইতিহাসের এই গভীর ক্ষত সভ্যতার বুক চিড়ে আজও রক্তগঙ্গা হয়ে বহমান। শুরু হল প্যালেস্টিনিয়দের প্রতিরোধ সংগ্রাম। জেরুজালেম বিদ্রোহ (১৯২০), জাফা বিদ্রোহ (১৯২১), এল বেরাক বিদ্রোহ (১৯২৯) ইত্যাদি তারই পরিণতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদীদের ওপর অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্যালেস্টাইনের একটা বড়ো অংশ ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইনের উপর ব্রিটিশ আধিপত্য বন্ধ হলে সেই জায়গায় শুরু হল ইহুদীদের আক্রমণ। ১০ লক্ষ আরব জনজাতি দেশছাড়া হয়ে আশ্রয় নিল সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, মিশরের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে। ১৯৬৪ সালে আরবজাতির অবিসংবাদিত নেতা ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে গড়ে উঠল প্যালেস্টাইন মুক্তি সংস্থা (পি.এল.ও.)। প্রায় তিন দশক রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধের পর ১৯৯৩ সালে নরওয়ের রাজধানী অসলো-তে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে রক্তাক্ত এই অধ্যায়ের একটা সামরিক অবসান হলেও ইজরায়েলের আগ্রাসন চলতেই থাকল। কালের নিয়মে পি.এল.ও.’র হাত থেকে ক্ষমতা চলে যায় ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন ‘হামাস’-এর হাতে। পি.এল.ও.-র সাবেকি বামপন্থী আন্দোলন থেকে সরে এসে হামাস কার্যত একটি আত্মঘাতী, ব্যক্তিসন্ত্রাসে বিশ্বাসী জেহাদী সংগঠন হয়ে উঠল। সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি এবং মিডিয়া প্রচারে ব্যস্ত হয়ে উঠল যে হামাস আসলে একটি মুসলিম জঙ্গি সংগঠন। কিন্তু শোষণ, বঞ্চনা তীব্র হলে প্রতিবাদও ব্যাকরণ মেনে চলে না। আজ কার্যত ইজরায়েলের কারাগারে বন্দি প্যালেস্টিনিয় জনগণের প্রতিবাদ প্রতিরোধ ওই ব্যাকরণ মেনে চলেছে না। এটাই বাস্তব। ব্রিটেনের ‘ডিভাইড এ্যান্ড রুল’ নীতি এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের ষড়যন্ত্রের স্ফুলিঙ্গ ২০২৩-এও দাবানলের রূপ নিয়েছে প্যালেস্টাইনে।

"আজ ফুলের ভেতর বীজের ভেতর ঘুনের ভেতর শুধু আগুন আগুন আগুন।" - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


শোষণে অন্ধকার যতই কালো হোক তারই বুক চিড়ে ছড়িয়ে পরে শিল্পের প্রতিবাদ। সেরকমই প্রতিবাদ ধ্বনিত হল Guy Davidi এবং Emad Burnat-এর যৌথ উদ্যোগে নির্মিত তথ্যচিত্রে। '5 Broken Cameras'-র পরিচালকের ভাষায় - This film is about how suffering you can grow something. গোটা ছবিজুড়েই নির্মাণ করা হল আগ্রাসী ইজরায়েলী সেনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্যালেস্টিনিয়দের প্রতিরোধের লড়াই। দৃশ্যে দৃশ্যে প্রতিভাত হল অমানবিক নৃশংসতার বিকৃত মন্তাজ। ছবিতে ধরা পড়ল মৃত্যু উপত্যাকার চিত্র। যেখানে বারুদের গন্ধে জেগে ওঠে শৈশব। প্যালেস্টিনিয় পরিচালক এমাদ বার্ণাত (Emad Burnat) তাঁর পাঁচটা ভাঙা ক্যামেরা দেখিয়ে বলেন, "আমরা আমাদের পরিস্থিতি গোটা পৃথিবীকে দেখাব বলে ছবিটি নির্মাণ করেছি"।

পাহাড় ঘেরা প্যালেস্টাইন গ্রামে চোখ জুড়ানো অলিভ বাগানের ছবি। সেই অলিভ বাগানগুলোকে জোর করে দখল করতে চায় ইজরায়েলের সৈন্যরা। যে ক্যামেরা দিয়ে Emad নিজের প্রথম সন্তানের ছবি তুলেছিল জীবনের সন্ধিক্ষণে সেই ক্যামেরার ফোকাস্ ঘুরে গেল অন্য অভিমুখে। গ্রামবাসীদের অনুরোধে নিজের সস্তা ক্যামেরা দিয়ে Emad তুলে ধরলেন ২০০৫ সালে প্যালেস্তাইনে, ইজরায়েলী সৈন্যদের অত্যাচার এবং বিপন্ন সমায়ের রক্তক্ষরণের চিহ্ন। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় প্যালেস্টিনিয়দের সম্মিলিত প্রতিবাদ। তাঁদের মুখে শ্লোগান - "This is our land. You stole our villages". একজন গ্রামবাসী একটি অলিভ গাছকে জড়িয়ে ধরে যখন বলেন, "...এটা আমাদের গাছ, তোমরা আমাদের গ্রামটা চুরি করেছ...", তখনই সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে দেশান্তরে। বিস্তীর্ণ কাঁটাতারের এপারে দাঁড়িয়ে লুন্ঠনের ছবি তুলতে থাকেন Emad। গ্রেনেড হামলায় ভেঙে যায় তাঁর প্রথম ক্যামেরা। গুলি লেগে ভেঙে যায় তাঁর দ্বিতীয় ক্যামেরাটিও। ইজরায়েলী সেনারা Emad-এর বাড়িতে হানা দিয়ে ভেঙে ফেলে তাঁর তৃতীয় ক্যামেরাটিকেও। নিষিদ্ধ হয় ছবি তৈরির কাজ। জেল হয় Emad-এর। ২০০৭-০৮ সালে ইজরায়েলী ফৌজিরা অলিভ বাগানে আগুন লাগিয়ে দেয়, গুলি লেগে ভেঙে যায় Emad-এর চতুর্থ ক্যামেরাটিও। শ্যুটিং-এর সময় দুর্ঘটনায় আহত হন পরিচালক এবং বোমার আঘাতে ভেঙে যায় Emad-এর পঞ্চম ক্যামেরাটিও।

২০ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর ষষ্ঠ ক্যামেরা দিয়ে ছবি নির্মাণের কাজ শেষ করেন পরিচালক। ভয়ঙ্কর ঘৃণার বাতাবরণে জীবন বিপন্ন করে নির্মিত এই তথ্যচিত্রটি আবারও প্রমাণ করে যে কখনও কখনও ক্যামেরা বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী। প্রতিবাদী তথ্যচিত্রের সাম্রাজ্যে '5 Broken Cameras' আজীবন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবে আমাদের মননে।

বুডরুশঃ প্রতিবাদ প্রতিরোধের তথ্যচিত্র

২০০৯ সালে ব্রাজিলের পরিচালক জুলিয়া বাচা (Julia Bacha) ইতিহাসের সন্ধানে ক্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন বর্তমান প্যালেস্টাইনের আঙিনায়। ওয়েস্ট ব্যাংকের সীমানা ঘেঁষা এক প্যালেস্তিনিয় গ্রামের নাম বুডরুশ (Budrus)। কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী ঐ অঞ্চলের মানুষের মুখ্য পেশা হল অলিভ চাষ। গ্রামের মানুষ প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে অলিভ গাছগুলোকে। জীবন দিয়ে আগলে রাখে তাদের প্রিয় অলিভ বাগানগুলোকে। পরিচালক গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে গ্রামের মানুষের জীবনকথার অনুসন্ধান করলেন। একজন বৃদ্ধা বলেন, "...ওরা (ইজরায়েলী ফৌজ) যদি আমাদের অলিভ বাগানগুলোকে দখল করতে চায় আমরা প্রাণ দিয়ে তা আটকাবো। অলিভ বাগান দখল হওয়ার চেয়ে আমাদের মৃত্যুও ভালো।..."

নিরাপত্তার নামে ইজরায়েলী আর্মি প্যালেস্টাইনের ১১০ কিলোমিটার দখল করে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিতে চায়। তাদের আসল লক্ষ্য অলিভ বাগানগুলো দখল করা। গ্রামের মানুষের প্রতিবাদ ক্রমশ প্রতিরোধে পরিণত হয়। জীবন থাকতে গ্রামবাসীরা ছাড়বে না তাদের জমির অধিকার। আয়েদ মোরার নামে একজন গ্রামবাসী বলেন, "...আমরা যুদ্ধ চাই না, আমি আমার ছেলেমেয়েদের বড় করতে চাই, তাদের শান্তি আর উন্নতি চাই।..." বুলডোজার দিয়ে ইজরায়েলী ফৌজ গুঁড়িয়ে দিতে চায় গ্রামের কবরস্থানকেও। একই সাথে চলতে থাকে স্থানীয় মানুষদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। ইজরায়েলী সেনা বুলডোজার দিয়ে অলিভ গাছ তুলে নিয়ে গেলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা সেই গাছ উদ্ধার করে আবার স্বস্থানে রোপণ করে। অলিভ গাছগুলো যে আসলে তাদের মা, আবার সন্তানও বটে! ইজরায়েলী ফৌজের অত্যাচার এবং স্থানীয় মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকল এই তথ্যচিত্রটি। ছবির শেষে দেখি প্যালেস্টিনিয় জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের কাছে হার মানে ইজরায়েলী ফৌজ। গ্রামের মানুষ ভেঙে দেয় কাঁটাতারের দেওয়াল। জুলিয়ার ক্যামেরা অসাধারণ এক দৃশ্য উপহার দেয় আমাদের। আমরা দেখি পড়ন্ত বিকেলে আকাশের এক টুকরো আলো আর স্থানীয় মানুষরা সবাই অন্ধকারে। তাদের দেখা যাচ্ছে না। শুধু মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলো যেন গোধূলিবেলায় উন্মুক্ত আকাশের কাছে একটু আলোর সন্ধান করছে। বুডরুশ-এর লড়াই উদ্বুদ্ধ করল আশেপাশের গ্রামগুলোকেও। তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের কাছে সেদিন সাময়িকভাবে হলেও হার মেনেছিল ইজরায়েলী ফৌজের আগ্রাসন। অহিংস আন্দোলনই হয়ে উঠেছিল স্থানীয় গ্রামবাসীদের হাতিয়ার। শেষ দৃশ্যে দেখি আয়েদ মোরার গ্রামবাসীদের মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের হাতে পোস্টার, তাতে লেখা আছে - 'Stop Stealing Land'.

এমাদ ও আয়েদ (Ayed Arafah)-এর মতই প্যালেস্টাইনের আরেকটি প্রতিবাদের নাম দারীন তাতুর (Dareen Tatour)। প্যালেস্টাইনের ৩৭ বছরে মেয়ে দারীন প্রতিবাদ করেছিল কবিতা লিখে। ৫ মাস তাকে জেলে বন্দি করে রাখলেও থামিয়ে রাখা যাযনি তার প্রতিবাদ। ২০১৫ সালে ‘জনগণের প্রতিরোধ, প্রতিরোধই স্বাধীনতা’ নামে একটা কবিতা লিখে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবের আগুন। ‘প্যালেস্টাইন ফিরে দেখা’ নামে একটা ওয়েবসাইট চালু করে দারীন এমন সব তথ্য তুলে দিয়েছেন দেশবাসীর উদ্দেশ্যে যা জন্ম দিয়েছে এক প্রতিরোধের ঝড়। জ্বলন্ত প্যালেস্টাইনে হিংসার আগুন কবে নিভবে জানা নেই। আর এই আগুনকে জিইয়ে রেখেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের লাভের হিসেবে ভাগ করে নেবে। তবুও কবোন্ধ সময়েই শিল্পের কিছু বীজ মহিরূহ হয়ে উঠবে। চলচ্চিত্র, কবিতা, গানে ধ্বনিত হবে প্রতিবাদের ঢেউ। এই মুহূর্তে আমরাই বা কি করে অরাজনৈতিক হয়ে থাকি?, তাই প্যালেস্টাইনের কবি মারওয়ান মাখউল-এর ‘রাজনৈতিক’ কবিতার মতোই বলতে ইচ্ছে করছে -
"রাজনৈতিক নয়
এমন কবিতা লিখতে হ'লে
আমাকে পাখির কথা শুনতে হবে
আর, পাখির কথা শুনতে হলে
যুদ্ধবিমানগুলিকে তো চুপ করাতেই হবে!
"
(অনুবাদঃ বিপুল চক্রবর্ত্তী)

বোমারু বিমান সরে গিয়ে প্যালেস্টাইনের আকাশ মুখরিত হোক শিশুর উল্লাসে, সেই অপেক্ষাতেই রইলাম আমরা।