আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

প্রবন্ধ

বাংলা ছবির ভাল-মন্দ

প্রবুদ্ধ বাগচী


কোভিড-পর্বের দীর্ঘ লকডাউন যাদের জীবিকায় তেমন অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি, ঘরবন্দি দশায় আর যাই হোক তাঁরা নানা মাধ্যমে প্রচুর ফিল্ম দেখার সুযোগ পেয়ে গেছিলেন। ইউটিউব তো ছিলই, তার সঙ্গে জুড়ে গেল নতুন প্ল্যাটফর্ম ওটিটি - বছরান্তে অল্প কিছু টাকা দিলে নানা ভাষায় অফুরন্ত নতুন পুরোনো ফিল্ম দেখার দেদার সুযোগ, বাড়তি খরচ বলতে ইন্টারনেট চালানোর কিছু ডাটা চার্জ যা আগেই অনেক সস্তা হয়ে গেছে। সিনেমা হল বন্ধ, কবে খুলবে ঠিক নেই। আর বাড়ির চার দেওয়ালে কখনও মুঠোবন্দি মোবাইলে বা ল্যাপটপ বা স্মার্ট টিভির পর্দায় দেখা চলতে লাগল ছবি। বাংলা ছবিও এর মধ্যে ব্রাত্য ছিল না।

সেই সবাক চলচ্চিত্রের দিন থেকেই মানুষের ছবি দেখার ধরন ও অভ্যাস পাল্টে পাল্টে গেছে। সিনেমা হলের রমরমার কালে ছুটির দিনে দুপুরে বা সন্ধ্যায় মানুষ বাংলা ছবি দেখতে যেতেন সপরিবারে। প্রমথেশ বড়ুয়া, কানন দেবী, সায়গলদের পরে এই ম্যাটিনি আইডলের জায়গা নিয়েছিলেন সুচিত্রা-উত্তম। আশির দশক থেকে অবস্থা পাল্টিয়ে কখনও রঞ্জিত মল্লিক বা চিরঞ্জিত, পরে প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় দর্শকদের এই চাহিদা পূরণ করে ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রিকে চালু রেখেছিলেন। এটাকে সবাই বলেন মেনস্ট্রিম ছবির এলাকা। এর বাইরেও ছবি হয়েছে বইকি। বাঙালির চলচ্চিত্র জগতের তিন দিকপাল সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল এই বাংলা ছবির আওতা থেকেই নিজেদের প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। পাশে পাশে আছেন তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, দীনেন গুপ্ত, অজয় কর, অসিত সেন প্রমুখ। পরে এসেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, ঋতুপর্ণ ঘোষ, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। আরও সাম্প্রতিকে নতুন ঘরানার ছবি করে নাম করেছেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটি, মৈনাক ভৌমিক, অনীক দত্ত, ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী ইত্যাদি একদল তরুণ মনের পরিচালক।

কথাটা হল, সব দেশে সব কালেই ছবির রুচির একটা ভিন্নতা থাকে। বাংলা ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। সব সময়কালেই এক ধরনের পপুলিস্ট ছবি তৈরি হয় গড়পরতা দর্শকের আবেগের মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে, সেগুলো যে খারাপ ছবি তা নয়। এইসব ছবি ভাল ব্যবসা করে, প্রযোজকের লগ্নি করা টাকা ফিরিয়ে দেয়, কিন্তু তার একটা ন্যুনতম রুচিগত মান থাকে। ‘জনরুচি’ শব্দটা যে সব ক্ষেত্রেই খারাপ এমন কিন্তু নয়। তিরিশের দশক থেকে আশির দশক অবধি বাংলার মূলস্রোতের ছবি হয়তো বিষয় হিসেবে একই ধরনের রোমান্টিকতার আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে কিন্তু ছবির নির্মাণ, বিশেষ করে সঙ্গীত তো ভীষণ সফল। উত্তমকুমারের ছবির সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, সুচিত্রা সেন বা সুপ্রিয়া চৌধুরীর কন্ঠে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তো প্রায় কিংবদন্তী। পাশাপাশি অনুপম ঘটক, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, ভি. বালসারা, রবিন চট্টোপাধ্যায়ের মতো নামী সুরকার প্রত্যক্ষ যুক্ত থেকেছেন বাংলা ছবির সুর রচয়িতা হিসেবে। তাঁদের তৈরি গান সুরের বিচারে একের পর এক হিট। তবে গানগুলির বিষয় নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি, যদিও ওইভাবে কূট প্রশ্ন তুলে নিজেদের ‘অতি-বুদ্ধিমান’ প্রমাণ না করতে চাওয়াই ভাল। তার সোজাসাপটা কারণ হল, যেকোনো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মূলধারার এক ধরনের ছবি সফল না হলে কিন্তু ভিন্ন ভাবনার ছবি তৈরি ও বিপন্নের পরিবেশ তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। ভিন্ন ধারার ছবি আসলে এই মূল ধারার ছবির সঙ্গে এক রকমের সংলাপ বুনতে বুনতে তৈরি হয়। সত্যজিৎ নিজেই বলেছিলেন, তিনি মূলধারার বাংলা ছবিগুলি দেখেন শুধু এইটুকু শেখার জন্য যে কোন কোন কাজ তিনি করবেন না! এই বিনিময়টা খুব জরুরি।

বাংলা ছবি নিয়ে আক্ষেপ করতে বসে অনেকেই দেখি এই বিষয়টা পাশে সরিয়ে রাখেন। এটা ঠিক যে উত্তমকুমারের আকস্মিক মৃত্যু বাংলা ছবির পালের হাওয়া কেড়ে নেয় - কার্যত ‘অনাথ’ বাংলা চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন স্রোত যিনি নিয়ে আসেন তাঁর নাম অঞ্জন চৌধুরি। বাংলা সিনেমায় শুরু হয় ‘শত্রু’-যুগ। তুলনায় নায়ক ইমেজের বাইরে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়েও কীভাবে একটা ছবিকে বিপুলভাবে সারা বাংলায় ছড়িয়ে দিয়ে হিট করানো যায় তার মোক্ষম ফরমুলা ছিল অঞ্জনের মুঠোয়। পরে এই রসায়ন আয়ত্ত করে ফেলেন স্বপন সাহা, হরনাথ চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বা প্রভাত রায়। সেই সময় শোনা যেত, স্বপন সাহা নাকি একই সঙ্গে তিনটে ফ্লোরে তিনটে আলাদা আলাদা ছবির শুটিং করে থাকেন। আর ‘শত্রু’-উত্তর সেই সুপারহিট ছবির তালিকায় এইভাবেই এসে পড়েছিল অঞ্জনের ‘গুরুদক্ষিণা’ (১৯৮৭), চিরঞ্জিতের ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ (১৯৮৯), স্বপনের ‘বাবা কেন চাকর’ (১৯৯৮) ইত্যাদি ইত্যাদি - এই তিনটে ছবির বাণিজ্যিক সাফল্য ছিল চোখ ধাঁধানো। গ্রাম বাংলার মানুষরা তো বটেই শহরেও এইসব ছবির বক্স অফিস হিট ছিল কিংবদন্তী - এখনও নাকি এঁদের রেকর্ড ভাঙার মতো ছবি তৈরি হয়নি বলে শোনা যায়।

নিঃসন্দেহে এগুলো খুব বুদ্ধিদীপ্ত বা ভাবনা-জাগানিয়া ছবি নয়। তাতে কিছু আসে যায় না। খেয়াল করার বিষয়, এইসব ছবি যখন রমরমিয়ে চলছে তার পাশে পাশেই নতুন ধারার তথাকথিত গুড ফিল্ম-ও কিন্তু তৈরি হচ্ছে। সুবিখ্যাত সত্যজিৎ ও মৃণাল এই আশি-নব্বইয়ের দশকে অনেকটাই পরিচিত, তাঁদের প্রযোজক পাওয়ার সমস্যা তেমন ছিল না, কিন্তু এই সমস্যা ছিল সেই সময়ের নতুন চলচ্চিত্রকারদের যারা তাঁদের পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য বহন করে ভাল ছবি বা রিয়ালিস্টিক ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। ১৯৭৭-৮২ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেও কিছু ছবি তৈরির জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন, সেগুলো সবই ‘ভালো ছবি’র জন্যই ব্যয় হয়েছিল। অবশ্য এর আগের জমানাতেও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় জমানার পশ্চিমবঙ্গ সরকারও তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’-র মতো ছবি প্রযোজনা করে। আবার সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটি বামফ্রন্ট পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরই আর্থিক আনুকূল্যে নির্মিত। একটা-দুটো ছবি নয়, এই সময়টায় প্রচুর ভালো বাংলা ছবি তৈরি হয়েছে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ‘গৃহযুদ্ধ’, গৌতম ঘোষের ‘দখল’ বা ‘পার’, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ‘চোখ’ এর পাশে তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’, তপন সিনহা-র ‘আদালত ও একটি মেয়ে’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, রাজা সেনের ‘দামু’ ইত্যাদি প্রত্যেকটি ছবি দর্শকধন্য হয়েছে বা নানারকম পুরস্কার পেয়েছে মূলস্রোতের পপুলিস্ট ছবির বাইরেও। আসলে ওই গ্রামে-গঞ্জে হিট ছবিগুলো না চললে, ফিল্মের মূল অর্থের লগ্নি ফেরত আসে না; আর তা না এলে অন্য ধরনের ছবিতে লগ্নি করতে প্রযোজকরা আগ্রহ দেখান না। মনে রাখতে হবে, প্রাক-বিশ্বায়ন যুগে বাংলা ছবির বাজার ছিল তুলনায় অনেক সীমাবদ্ধ। আর মূম্বাই বা চেন্নাইয়ের মতো বাংলা ছবিতে খুব বড়ো মাপের বিনিয়োগকারী আদপে নেই - আজও বাংলা ফিল্মে প্রধান বিনিয়োগ হয় অন্য সুত্রে পাওয়া কিছু বাড়তি অর্থ, খুব সুপরিকল্পিত ফিন্যান্স ক্যাপিটাল নয়। খেয়াল করা দরকার, আশির দশকে ‘সঞ্চয়িতা’ ও বর্তমান শতকের প্রথম দশকে ‘সারদা’ বা ‘রোজভ্যালি’র মতো চিটফান্ডের বেআইনি অর্থ নিয়োজিত হয়েছিল বাংলা ছবিতে। মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’, তপন সিনহার ‘আদালত ও একটি মেয়ে’ বা গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ - তিনটে ছবিরই প্রযোজক ছিলেন চিটফান্ডের মালিক।

কিন্তু হালের বাংলা সিনেমার প্রধান সমস্যা হল, রুচি ও মননশীলতা। অথচ সবার উপভোগের মতন বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে অত্যন্ত কম। যেটুকু বা তৈরি হচ্ছে তা দর্শকের কাছে পৌঁছতে পারছে আরও কম। আর মূলধারার পপুলিস্ট ছবি থেকে প্রযোজকরা যে লগ্নি ফেরত পেতেন তাও আজ কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নেই। এর একটা বড়ো কারণ অবশ্য সিনেমা হলগুলির অবলুপ্তি। একসময় সারা রাজ্যে সাড়ে সাতশোর মতো ছবি দেখানোর প্রেক্ষাগৃহ ছিল; আজ কমতে কমতে সেটা সম্ভবত পঞ্চাশেরও নিচে। জেলা বা মহকুমা শহরগুলোতেও আজকে তৈরি হয়ে গেছে মাল্টিপ্লেক্স, যেখানে বাংলা ফিল্মের গড়পড়তা টিকিটের দাম অন্তত দুশো টাকা। একটা সময় ফিল্ম সিনেমাহলে রিলিজ হলেই তা সিডি/ডিভিডি হয়ে খোলাবাজারে বিক্রি হতে চলে আসত - ষাট/সত্তর টাকায় একটা ডিভিডি কিনলে তাতে তিনটে তো বটেই ক্ষেত্রবিশেষে পাঁচটা ছবিও দেখা যেত। এতে অবশ্য প্রযোজকের কোনো লাভ ছিল না বরং এটা ছিল তার বাণিজ্যিক ক্ষতির দিক। এখন সেই ঝুঁকির পাল্লা আরও ভারি। বিকল্প হিসেবে ছবির স্যাটেলাইট রাইট বিক্রি ও ইদানিং ওটিটি চ্যানেলে ছবি চালানো বিনিয়োগকারীর পক্ষে একটা বাড়তি আয়। কিন্তু এ দুটোর কোনোটাতেই বোঝার উপায় থাকে না, আদপে দর্শক ছবিটা দেখছেন কি না। সরাসরি হলে ছবি দেখার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় অনেক অনায়াসে। আমরা জানি, নিজের ছবি প্রথম দিন সিনেমাহলে রিলিজ হলে সত্যজিৎ কেমন উত্তেজিত থাকতেন। তরুণ মজুমদার লিখেছেন, প্রথম শোয়ের দিন প্রেক্ষাগৃহের প্রোজেকশন রুমে পরিচালক-প্রযোজকসহ আরও অনেকে উপস্থিত থেকে দর্শকের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা নিয়মিত ঘটনা ছিল।

মোদ্দা কথা হল, মূলধারার বাংলা ছবি যা সবাই বসে দেখতে ও উপভোগ করতে পারেন তার সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। একসময় তাপস পাল, প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, অভিষেক চট্টোপাধ্যায় - এঁরা এইসব ছবিকে বহন করেছেন। পরের দিকে জিৎ বা দেব চেষ্টা করেছেন ওই ঘরানা বজায় রাখার। চেনা ছকের ঢিসুম ঢিসুম থেকে বেরিয়ে এঁরা সবাই এখন অন্যরকম ছবি করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগই ব্যাটেবলে হচ্ছে না। এর একটা কারণ উপযুক্ত বুদ্ধিদীপ্ত পরিচালকের অভাব আর দ্বিতীয়টা হল ছবির পরিবেশ-পরিসীমা একদম গণ্ডিবদ্ধ হয়ে যাওয়া। আজকের যেকোনো বাংলা ছবি দেখতে বসলে ধরেই নেওয়া যায় বাইপাসের ‘মা’ ফ্লাইওভার আর নিউটাউনের ঝকঝকে বহুতল ফ্ল্যাটের ডাইনিং রুম সেখানে দেখানো হবে। সেই ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা কেউই বাস ট্রাম অটো চাপে না, দামি গাড়ি চেপে হুস হুস করে ঘুরে বেড়ায়, কাটগ্লাসের পাত্রে বন্ধু-বান্ধবী-প্রেমিক-প্রেমিকা সমেত মদ্যপান করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেইসব বান্ধবী বা প্রেমিকার ক্লিভেজ ধরা হয় ক্লোজ শটে, পায়ের পাতা থেকে হাঁটুর ওপর অবধি ক্যামেরা প্যান করতে থাকে অনবরত অথচ ঠিকঠাক যৌনদৃশ্য রচনা করতে গিয়েও হোঁচট খায়। আবার এইসব উচ্চবর্ণ চরিত্রগুলো ব্র্যান্ডেড জামা-কাপড়ে সুসজ্জিত হলেও অনায়াসে মুখখিস্তি করে - তার আবার অনেকটাই ইংরিজিতে। এই হল আজকের বাংলা ছবি, যার মূল উপজীব্য অতি আধুনিকদের নিজেদের সম্পর্কের টানাপোড়েন, বাংলা কথায় যার বিশেষণ হল নিতান্তই ছেঁদো। এই ছবি সবার ভাল লাগা মুস্কিল, লাগছেও না।

অবশ্য সবাই এমন তা নয়। তরুণ মজুমদারের উত্তরসূরি হিসেবে নন্দিতা-শিবপ্রসাদ জুটি বেশ কিছু উপভোগ্য ছবি করেছেন যা ছ্যাবলামি না-করেও হিট হয়েছে। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবিতে বৈচিত্র্য খুবই উল্লেখযোগ্য, ছিমছাম ছবি করিয়ে হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই ভাল কাজ করছেন। আছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো আরও কেউ কেউ। কিন্তু এত কিছুর পরেও দিনের শেষে হিসেব নিলে দেখা যায়, আজকের বাজারে ‘হিট’ বলতে যা আদপে বোঝাচ্ছে তা আগের হিসেবের থেকে ঢের কম। নব্বইয়ের শুরুতে যখন সিনেমা হলে গড় টিকিটের দাম ছিল পাঁচ টাকারও নিচে তখন ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ প্রায় একশো কোটির ব্যবসা করেছিল, যা বাংলা সিনেমায় সর্বকালীন রেকর্ড। সবাই একরকম ছবি করবেন তা হতে পারে না, তবে সবার জন্য ভাল ছবি করলে তা চলবে না, এমন নয়। দর্শকের মন ও মেজাজ আগের মতো নেই, তাও ঠিক। কিন্তু একজন পরিচালককে ছবি করতে হলে সেই ‘পালস’টাও বোঝা দরকার, নির্বাচন করা দরকার ভালো গল্প। ভি. শান্তারামের মতো প্রযোজক পরিচালক, শুধু ‘পলাতক’ সিনেমার মূল গল্পটা শুনেই বুঝে গিয়েছিলেন এই ছবির অপার সম্ভাবনা - তরুণ মজুমদারকে তিনি পুরো স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তাঁর মতো করে ছবিটা করার। একটা সময় বিভিন্ন সিনেমার হল মালিকরা, কী কলকাতায় কী মফস্বলে ছবির সম্ভাবনা বুঝে নিজেরাই তাতে বিনিয়োগ করতেন, এই অভিজ্ঞতাটা খুব দরকার। সবাই নিশ্চয়ই মনে করতে পারবেন, কলকাতার প্রিয়া সিনেমা হলের মালিক দত্ত পরিবার ‘পূর্ণিমা পিকচার্স’ ব্যানারে সত্যজিতের ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। আজকের প্রযোজকরা এই দূরদৃষ্টির ছাপ রাখতে পারছেন বলে মনে হয় না।

ছবি দেখা ও দেখানোর পরিকাঠামো আজ আর আগের মতো নেই। তার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। রাস্তা খুঁজতে হবে এই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়েই। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির জন্য যদি ভালো রুচিশীল ছবি তৈরি করা যায় তবেই ভিন্ন ধারার ছবি বিকশিত হওয়ার জায়গা পাবে। এখন আর সরকারি উদ্যোগে তেমন ছবি তৈরি হয় না, না হওয়াই ভালো - তাই ব্যক্তিগত প্রোডাকশন হাউসগুলির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। তাঁরা যদি তাঁদের মতো অভিনিবেশ নিয়ে যোগ্য পরিচালকদের ছবি করতে উৎসাহ দেন তাহলে ভিন্ন ধারার ছবিগুলোও ডানা মেলার একটা আকাশ পায়। বাংলা সিনেমার এইটাই তো অতীত, আর এইটাই তার ভবিষ্যৎ।