আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

সমসাময়িক

উচ্চশিক্ষায় মুষলপর্ব


বাংলার স্কুলশিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা তো হয়েই ছিল, বাদ ছিল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের দড়ি টানাটানিতে এই উচ্চশিক্ষার হালও আজ বেহাল। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কার কর্তৃত্ত্ব বজায় থাকবে, ক্ষমতা প্রদর্শনের এই পাগলামিতে উচ্চশিক্ষায় অগ্রগামী এই রাজ্যটির অবস্থা আজ করুণ।

বাঙালি যে উচ্চশিক্ষায় বিমুখ, অযোগ্য এমন নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বা পরিচালনাতেও সে হতবুদ্ধি এমন নয়। বরং অতীত ও সাম্প্রতিক খবরাখবর তার উল্টো কথাটাই ঘোষণা করে। ২০২৩ সালের বিজ্ঞান গবেষণায় দেশের সর্বোচ্চ 'ভাটনাগর পুরস্কার' প্রাপক ১২ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে ৪ জনই বাঙালি। দেশের উৎকৃষ্ট উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একাধিক অধিকর্তা বাঙালি। দেশে ও বিদেশে একাধিক প্রথিতযশা বাঙালি অধ্যাপক ও গবেষক রয়েছেন যাঁদের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। বাংলায় প্রায় ৪০টির উপর বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থা রয়েছে। দেশের অন্যতম অগ্রগণ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলার মাটিতেই গড়ে উঠেছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তো গোটা বিশ্বের কাছে এক শিক্ষণীয় প্রতিষ্ঠান। তাই দক্ষতার বিচারে বাঙালি ও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার কোনো অবকাশ নেই।

কিন্তু বিগত কয়েক বছর যাবৎ রাজ্য সরকার ও রাজ্যে কেন্দ্রের শাসকের প্রতিভূ রাজ্যপালের অবিমিশ্র দড়ি টানাটানি খেলায় এই রাজ্যের উচ্চশিক্ষায় যে বিরূপ প্রভাব পড়ছে তার খেসারত আগামী একাধিক প্রজন্মকে দিতে হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ নজির দেশের অন্য কোথাও নেই যেখানে রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে এবং রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপোষক হিসাবে দুই যুযুধান পক্ষ হয়ে পালওয়ানির ময়দানে তাল ঠুকছেন। একদিকে রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃত্ব কায়েম করতে উপাচার্য কে হবেন তার চাবিকাঠি নিজেদের হেফাজতে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে রাজ্যপাল নিজের আচার্যের ক্ষমতা দেখাতে সেই উপাচার্য নিয়োগে বেনজির নজরদারি চালাচ্ছেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পাড়ার খেলার দলের অধিনায়ক বদলের মতো যখন তখন নিয়োগ বা বরখাস্ত করছেন। অন্যদিকে রাজ্যের সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মবিধি পাল্টে উপাচার্য নিয়োগের কমিটি থেকে আচার্যের প্রতিনিধিকে কোণঠাসা করতে চাইছে। এর ফল, রাজ্যের প্রায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই আর স্থায়ী উপাচার্য নেই। অস্থায়ীভাবে উপাচার্য নিয়োগ করে কাজ চলছে। এই সংঘাত সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়িয়েছে এবং সুপ্রিম কোর্ট ঠিক করে দিচ্ছেন রাজ্যে উপাচার্য বাছাই কমিটিতে কারা থাকবেন। এ লজ্জা কোথায় রাখবে বাঙালি?

যদিও এই বেনজির স্থিতাবস্থায় রাজ্য সরকার ও রাজ্যপালের কোনো হেলদোল হয়েছে বলে মনে হয় না। তারা এখনও আপন ছন্দে বাংলার উচ্চশিক্ষার আদ্যশ্রাদ্ধে ব্যস্ত। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ঘিরে এক হাস্যকর নাটক তাঁরা মঞ্চস্থ করলেন। সমাবর্তনের ঠিক আগের দিন রাজ্যপাল তাঁরই নিয়োগ করা অস্থায়ী উপাচার্যকে বরখাস্ত করে দিলেন। ঠিক তখনই অতি দ্রুততার সাথে রাজ্য সরকার বরখাস্ত উপাচার্যকেই সম্মতি দিলেন সমাবর্তন সমাধা করার। অথচ এর আগে এই উপাচার্যকেই রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বৈঠক ডাকতে অনুমতি দেয়নি। একই অবস্থা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। একদা দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দুই বছর যাবৎ কোনো স্থায়ী উপাচার্য নেই। রাজ্য সরকার যাকে অস্থায়ী উপাচার্য করলেন তাকে আচার্য তথা রাজ্যপাল বরখাস্ত করে অন্য একজনকে দায়িত্ব দিলেন। এরপরে রাজ্য সরকার তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বৈঠক ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। এই অবস্থা রাজ্যের কম বেশি প্রায় প্রতিটি রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজমান। রাজ্যপালের নিয়োগ করা উপাচার্যদের বেতন আটকাতে রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়েছে। অবশেষে কোর্টের দরবারে সেই ঝগড়া গড়িয়েছে।

রাজ্যে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও এই তামাশার বাইরে রয়েছে। রাজ্যের একমাত্র আইআইটি বা এনআইটি-তে রাজ্য সরকারের মাথা গলানোর উপায় নেই, ফলে সেখানে এই গোলযোগ উপস্থিত হয়নি। অন্যদিকে রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার অন্য সমস্যা। সেখানে উপাচার্য কেন্দ্র ঠিক করে দেয়। ফলে রাজ্যের সরকার সেখানে কিছু বলতে পারে না। যদিও কেন্দ্র মনোনীত সেই উপাচার্য দায়িত্ব পেয়ে তার দপ্তরের এমনই অপব্যবহার শুরু করলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা হয়ে গেল রাজ্য ও জাতীয় ইস্যু। তাই নিয়ে তাল ঠোকা শুরু হল দুই যুযুধান রাজনৈতিক ক্ষমতার। যার ফলশ্রুতি উপাচার্য তাঁর পদ থেকে অবসর নেওয়া মাত্র রাজ্য পুলিশ পৌঁছে গেল তার দরজায় হাজিরা তলব নিয়ে। এক কদর্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হল দেশের অন্যতম প্রাচীন ও জগতবিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিস্থানটি নিয়ে।

যে কোনো কাজের পিছনেই এক ধরনের যুক্তি থাকে। রাজ্যের শাসক দলের যুক্তি হল তারা যেহেতু রাজ্য সরকার পোষিত বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অর্থ যোগায়, সুতরাং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শেষ কথা তারাই বলবে। অধুনা জেল নিবাসী রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী সেই কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন। অন্যদিকে রাজ্যপালের যুক্তি হল যেহেতু তিনি আচার্য সুতরাং তাঁকে ব্রাত্য করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা হবে, এটা তিনি মানবেন না। আসলে মনে তাঁদের যে কথাটি রয়েছে তা হল, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা হবে কার ইচ্ছে মতো। এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই ইচ্ছা রাজ্যের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তাঁরা পোষণ করছেন। দুই পক্ষই শিক্ষার উন্নতিকল্পে নিজেদের মাতব্বরি চাইছেন এমনটা নয়। তাহলে অন্তত উপাচার্য নিয়োগ ও প্রতিষ্ঠানের জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের জন্য প্রয়োজন, তাতে এমন বাগড়া তাঁরা দিতেন না। রাজ্যের সরকারের একমাত্র লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অর্থ ব্যয়ে তাঁদের একচ্ছত্র দখলদারি। শিক্ষার উন্নয়নে ব্যয় হওয়া অর্থের আনুষঙ্গিক উপরি যাতে নিজেদের দলীয় অনুগতদের পকেটস্থ হয় তার দিকেই তাঁদের লক্ষ্য। অন্যদিকে কেন্দ্রের সরকার চায় রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত নাক গলিয়ে তাকে কেন্দ্র সরকার অভিমুখী করে তোলা যাতে তাঁরা কেন্দ্রীয় রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে। তাই সবকিছু ছেড়ে উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলায় তাঁরা মেতেছেন। পরিস্থিতি এমন যে রাজ্যপাল উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে মামলা লড়ছেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যার খরচ যোগান দেবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আসলে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় দু' পক্ষ একই কাজ করতে চাইছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল তাকে দু' পক্ষই অবলুপ্ত করতে চায়। ফলে আজকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মসমিতির নির্বাচন হয় না, মনোনয়ন হয়। তারপর পছন্দমত উপাচার্য নিয়োগ করে পুরো পরিচালনাই বকলমে রাজ্যের সরকার করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও একই ধারা। সেখানেও সমস্ত পরিচালন সমিতিগুলো নির্বাচিত নয়, মনোনীত। এই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিই আজ এদেশের দস্তুর। লড়াই কেবল কে কর্তৃত্ব করবে তা নিয়ে চলছে।

এই লড়াইয়ের ফল ভুগছে এদেশের নবীন প্রজন্ম। বাংলার মতো রাজ্যে যেখানে বিজেপি-র সরকার নেই সেখানে রাজ্যপাল মারফত প্রতিদিন এরকম কাজ ঘটে চলেছে। শিক্ষা যা কিনা রাজ্য ও কেন্দ্রের যৌথ সাংবিধানিক অধিকার, সেখানে কেন্দ্র যেমন প্রতিদিন তার সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন করছে তেমনই রাজ্য সরকার কেবল তার অধিকারটুকু বুঝে নিতে রাজি কিন্তু দায়িত্ব নিতে নয়। শিক্ষা দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার এবং রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারেরই দায়িত্ব সেই অধিকার রক্ষা করা। যেহেতু শিক্ষাদান কোন লাভজনক ব্যবসা নয় ফলে সরকারকেই তার আর্থিক দায়ভার বহন করতে হয়। দুনিয়ার সমস্ত উন্নত দেশগুলোতে সেই রীতিই চলে আসছে। কিন্তু সেখানে সরকার অর্থ সাহায্য করে বলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনায় অতিরিক্ত খবরদারি চালায় না যা এ দেশের শাসকদের কাছে বিস্ময়ের। তাঁদের ধারণা তাঁরা অর্থ দিচ্ছেন বলেই সব বিষয়ে শেষ কথা বলার অধিকারী তাঁরাই। অবশ্যই দেয় অর্থের খরচ কিভাবে হল তার হিসাব তাঁরা চাইতে পারেন, কিন্তু কেন এভাবে খরচ হল সেটা তাঁদের পরিচালকদের থেকেই শিখতে বা বুঝতে হবে। এই বোধ এদেশের শাসকদের মধ্যে বিরল।

দুই সরকারের ঝগড়ায় রাজ্যের উচ্চশিক্ষার নাভিশ্বাস উঠে গেছে। পড়ুয়ারা বিভ্রান্ত, শিক্ষকরা অসহায় কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কেউই আদতে পরিচালনা করছেন না। কেন্দ্রের সরকার একদিকে যেমন বদ্ধপরিকর এ রাজ্যের উচ্চশিক্ষার মরণ ঘটাতে, তেমনই রাজ্যের সরকারও উদাসীন। তারা লড়াই করতে যত ব্যস্ত তার কানাকড়িও নন রাজ্য পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। এ পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষার সাথে যুক্ত সমস্ত মানুষকে এক বৃহৎ আন্দোলনের রাস্তায় যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। রাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ রাজ্যের মানুষের অর্থ ও পরিশ্রমের ফল। ফলে এগুলো বাঁচাতে গেলে আজ সবাইকেই পথে নামতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমনকী শিক্ষকরাও পার্টিজান রাজনীতির যাঁতাকলে পড়ে নিজেদের শুভবুদ্ধি হারিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান না বাঁচলে যে তাঁরাও বাঁচবেন না এই দেওয়াল লিখন তাঁরা পড়তে ভুলেছেন। ছাত্র ছাড়া শিক্ষকের কোন প্রয়োজন সমাজে থাকে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান না বাঁচলে সাধারণের জন্য শিক্ষার দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে একথা আজ জনসাধারণকেও বুঝতে হবে। ফলে এই লড়াই কেবল আজ যাঁরা প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গ শুধুমাত্র তাঁদেরই নয়, বরং গোটা সমাজের। সেই ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এ রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করা সম্ভব নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার পচন ধরলে জাতির মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী। বাঙালি কি এই আত্মহনন মেনে নেবে?