আরেক রকম ● দ্বাদশ বর্ষ প্রথম সংখ্যা ● ১-১৫ জানুয়ারি, ২০২৪ ● ১৬-২৯ পৌষ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

নতুন বছর নতুন আশঙ্কা


স্বাগত নতুন বছর ২০২৪।

বছরের সূচনা লগ্নে সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করাই প্রচলিত রীতি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই চিরাচরিত এষণা এড়িয়ে যাওয়াই সঙ্গত। সদ্য সমাপ্ত বছরে বিশেষত সাম্প্রতিক অতীতে যে সব ঘটনাবলী একের পর এক ঘটে চলেছে তা মোটেও হিতকর নয়।

রাষ্ট্র এখন সবকিছু ছেড়েছুড়ে ধর্ম ফেরি করতে ব্যস্ত। মন্দির নির্মাণ সম্পন্ন হলে অথবা নির্মীয়মান মন্দির দর্শন করলে দেশের সব মানুষের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে নিয়মিত নিদানপত্র প্রচার করা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। সরকারি আনুকূল্যে শুরু হয়ে গেছে 'বিকশিত ভারত সঙ্কল্প যাত্রা'। এই সব বিষয় কতটা বাস্তবধর্মী এবং যুক্তিগ্রাহ্য তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। তবে একাধিপত্যবাদের দাপটে কোনো ধরনের আলোচনা কি সম্ভব?

সাম্প্রতিক উদাহরণ সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। ১৭টি নতুন বিল মাত্র ১৮ দিন স্থায়ী অধিবেশনে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। ৪ঠা থেকে ২১শে ডিসেম্বর অঙ্কের হিসেবে ১৮ দিন হলেও বাস্তবে মাত্র ১৪ বার অধিবেশন বসেছিল। ঘন্টা-মিনিটের হিসাব করলে তা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের জন্য কোনো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে না।

এখানেই শেষ নয়। লোকসভা ও রাজ্যসভার ১৪৬ জন সাংসদকে শীতকালীন অধিবেশন থেকে বহিষ্কার করায় আলোচনার ন্যূনতম সুযোগও অন্তর্হিত হয়। ১৩ই ডিসেম্বর সংসদ কক্ষের দর্শক আসন থেকে দুই যুবকের আকস্মিক লম্ফন এবং ধোঁয়া বোমা নিক্ষেপ করায় লোকসভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সরকারের অনুগত প্রচারমাধ্যম বিষয়টিকে ২০০১-এ সংসদ ভবনে সন্ত্রাসী হামলার উদযাপন হিসেবে প্রচার করতে থাকে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায় যে শাসকদলের জনৈক সাংসদের সুপারিশে ওই দুই যুবক তথাকথিত নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশ করেছিল। বিরোধী পক্ষের সাংসদরা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করায় তাঁদের শীতকালীন অধিবেশন থেকে বহিষ্কার করা হয়। স্বভাবতই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো বিবৃতি দেননি। লোকসভার স্পীকার নীরব। নীরব রাজ্যসভার অধ্যক্ষ তথা উপরাষ্ট্রপতি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যুবকদের সংসদে আগমন থেকে শুরু করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিষয়টি কি পূর্বপরিকল্পিত?

এমন এক আবহে ১৮ই ডিসেম্বর সোমবার লোকসভায় নতুন টেলকম বিল পেশ করলেন কেন্দ্রীয় তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিক্স এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। নতুন টেলিকম বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে ব্রিটিশ আমলের টেলিগ্রাফ আইন, ওয়্যারলেস টেলিগ্রাফি আইনের বদলে এটাই সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রটির নিয়ন্ত্রণের নতুন আইন হয়ে উঠবে। কিন্তু ওই বিলের একাধিক ধারা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছিল। অভিযোগ, জাতীয় নিরাপত্তার অছিলায় যে কোনও সংস্থার টেলিযোগাযোগ পরিষেবার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেওয়ার বা বন্ধ করার বল্গাহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তা ছাড়া, নতুন বিলের খসড়ায় ইন্টারনেট নির্ভর ফোন এবং বার্তাকেও ‘টেলিযোগাযোগের’ আওতায় আনা হয়েছে। এবং আইন বাস্তবায়নের তদারকি করার জন্য ব্রডকাস্টিং অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (BAI) নামে একটি নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব রয়েছে।

গত আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন টেলিযোগাযোগ বিলের খসড়া পাশ হয়েছিল। সরকারের যুক্তি ছিল, ১৩৮ বছরের পুরনো ব্রিটিশ জমানার টেলিগ্রাফ আইন ইন্টারনেট নির্ভর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী নয়। জাতীয় নিরাপত্তার কারণে নেট-নির্ভর টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধীদের একাংশের এবং বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ভবিষ্যতে প্রস্তাবিত ওই আইন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা অস্বীকার করা যায় না।

মাত্র দু' দিনের মধ্যেই প্রায় বিরোধীশূন্য লোকসভায় বুধবার (২০শে ডিসেম্বর, ২০২৩) পাশ হয়ে গেল নতুন টেলিকম বিল। রাজ্যসভায়ও অতি দ্রুততার সঙ্গে পাশ করিয়ে নেওয়া হয় নতুন টেলিকম বিল। এমনকী আরও দ্রুততম সময়ে সোমবার ২৫শে ডিসেম্বর, ২০২৩ রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেয়ে যাওয়ার পর এখন এটাই দেশের নতুন টেলিকম আইন।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, টেলিকম ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই)-এ সমস্ত নিয়ন্ত্রণ সেপ্টেম্বর মাসে তুলে দেওয়া হয়েছে। ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে টেলিকমে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়পত্র দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত, এই ক্ষেত্রে ৪৯ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন ছিল। এতদিন পর্যন্ত ভারতে খুচরো ব্যবসা, বিমান পরিবহণ, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন, বায়োটেকনোলজি, স্বাস্থ্য পরিষেবা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংবাদমাধ্যম ছাড়া অন্য বিষয়ভিত্তিক সম্প্রচার, বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশ উৎপাদন, কয়লা উত্তোলনের মতো কিছু ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন ছিল। কয়লা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনও হয়েছিল। কিন্তু এখন চতুর্দিকে বিরাজ করছে কেমন যেন এক নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা।

প্রায় বিরোধী শূন্য সংসদে যে ১৭টি বিল বিনা আলোচনায় পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 'দণ্ডসংহিতা' বিলসমূহ। বিরোধী পক্ষের সাংসদদের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে যেভাবে বিলটি পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করা হয়েছে তা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্তমূলক। এমনকী এই বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী থেকে শুরু করে প্রাক্তন বিচারপতি ও প্রশাসকদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে বলেও জানা যায়নি। আগামীদিনে একাধিপত্যবাদ যে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দ্বিধা করবে না সেই আশঙ্কা থেকেই যায়।

এখনও বাকি আছে নতুন সম্প্রচার (ব্রডকাস্টিং) বিল, যা আইনে রূপান্তরিত হলে সমস্ত প্রচার প্রক্রিয়া সেন্সর করা যাবে। খসড়া সম্প্রচার বিলের বিষয়বস্তু মূল্যায়ন কমিটির (সিইসি) বিধান, সম্প্রচারকদের শুধুমাত্র এই সিইসির মাধ্যমে স্ব-প্রত্যয়িত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে বলা, সংবাদ মাধ্যমের পক্ষে অনুসরণ করা কঠিন হবে। প্রস্তাবিত সম্প্রচার বিল টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং রেডিওর মাধ্যমে সম্প্রচার পরিষেবাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, যা সরকারকে বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সর করার অনুমতি দেবে। বিলটি বাস্তবায়িত হলে সরকার অপছন্দের বিষয়কে মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা পেয়ে যাবে। ২০২৩-এর মধ্যে খসড়া সম্প্রচার বিলের উপর মতামত জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করা আছে। আপাতত অনাগত সরকারি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই। তবে সাম্প্রতিক অতীতের অভিজ্ঞতা গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য মোটেও সুখকর নয়। বিকল্প চিন্তার পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত করে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্র সতত সক্রিয়। কাজেই আশঙ্কা-আতঙ্ক নিয়েই শুরু হোক নতুন বছর।