আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

সমসাময়িক

বিবর্তনহীন বিজ্ঞানশিক্ষা?


খবরটা অনেকেই দেখেছেন।

ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) দশম শ্রেণীর পাঠ্যক্রম থেকে 'বিবর্তন' বিষয়ক অধ্যায় বাদ দিয়েছে। শুধুমাত্র যারা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, তাদের জন্য বিবর্তন পাঠ্যক্রমে থাকবে। অর্থাৎ এখন থেকে দশম শ্রেণীর শেষে ছাত্র-ছাত্রীরা বিবর্তন বিষয়ে কিছু জানতে পারবে না। “কেন আমি বাবা-মায়ের মত?”এই প্রশ্নের উত্তর স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী তার স্কুলজীবনে আর পাবে না।

বিবর্তন তত্ত্বের মধ্যে জীবনের উৎস সম্পর্কিত ধারণা ও তার প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে জীবন একবার সৃষ্টি হয়ে গেলে তার পরিবর্তন ও বিকাশ কী করে হয়েছিল, সেটাই বিবর্তন বিজ্ঞানের মূল আলোচ্য বিষয়। বিবর্তন আলোচনা অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই বিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় কীভাবে পর পর প্রজন্ম ধরে প্রজাতির বংশগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হয়।

বিবর্তন আধুনিক বিজ্ঞানের একটি ভিত্তিপ্রস্তর। বিবর্তন প্রাকৃতিক কারণের দ্বারা প্রাণের বিকাশকে ব্যাখ্যা করে। এটি প্রমাণ করেছে, মানুষ জীবজগতের অন্য সদস্যদের মতই আরেকটি সদস্য, একই ধরণের জৈবিক নিয়ম দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যায়। একই সঙ্গে, মানুষ সহ প্রতিটি জীবই অনন্য, প্রতিটি জীবই তার বিশেষ বিবর্তনীয় ইতিহাসের ফসল।

বিবর্তন নিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের অসুবিধা আছে। “ঈশ্বর ছয়দিনে বিশ্ব সৃজন করিলেন”-এর মত আপাত-সরল ধারণার প্রতিস্পর্ধী কোনো ধারণা দেওয়া এমনিতেই কঠিন কাজ। “বিশ্বজোড়া প্রাণের জাল ও তার মিথস্ক্রিয়া” ইত্যাদি বুঝিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা বাস্তবত অত্যন্ত দুরূহ। দুটি বিপরীত ধারণার সম্মুখীন হলে মানুষ সাধারণত সরল ধারণাটি বেছে নেয়। আর যদি একটি ধারণার চর্চা একেবারেই না হয় তাহলে অবশ্য “ঈশ্বর ছয়দিনে বিশ্ব সৃজন করিলেন” এই ধারণাই সমাজে প্রসার লাভ করবে।

ইতিহাসে দেখা যাবে ক্যাথলিক ও ইসলামিক দুনিয়ায় বিবর্তনকে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেবার প্রচেষ্টা চলছে বহু দশক ধরে। অধিকাংশ ইসলামিক দেশে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় না। শুধু ইসলামিক দুনিয়া নয় - যদিও বিবর্তনকে জীববিজ্ঞানের একটি মৌলিক উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হয় তবুও, আজও বিবর্তনবাদ আমেরিকান সমাজে বিতর্কিত রয়ে গেছে, প্রায় অর্ধেক ব্যক্তি মানব বিবর্তনকে প্রত্যাখ্যান করে (গ্যালাপ, ২০১৯)। ভারতে অবশ্য বিবর্তনবাদ পড়ানোর ক্ষেত্রে আগে বাধা আসেনি।

করোনা অতিমারি চলাকালীন সিলেবাস হ্রাসের অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসাবে এটি প্রথম বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর নথিতে দেখা যাচ্ছে যে বিবর্তনবাদ 'বিষয়বস্তু যৌক্তিককরণ'-এর পদক্ষেপ হিসাবে স্থায়ীভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে! বিবর্তন প্রক্রিয়া ছাত্রদের বৈজ্ঞানিক মেজাজ এবং একটি যৌক্তিক বিশ্বদর্শন বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব ছাত্রদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করে।

বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদ অধ্যায় অপসারণ করার সমালোচনা করে, "শিক্ষার সঙ্গে প্রতারণা" বলে দাবি করে, সারা দেশে ১,৮০০-রও বেশি বিজ্ঞানী, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা প্রচারকারীরা একটি খোলা চিঠি লিখেছেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি)-কে।

আসল সত্যটা লুকিয়ে আছে অন্য কোনোখানে। এনসিইআরটি অনুমোদিত পাঠ্যক্রম ধর্মনিরপেক্ষ ছাত্র তৈরি করতে পারে না। তা হলে বিজেপি আর ক্ষমতায় থাকবে না।