আরেক রকম ● একাদশ বর্ষ নবম সংখ্যা ● ১-১৫ মে, ২০২৩ ● ১৬-৩১ বৈশাখ, ১৪৩০

সম্পাদকীয়

এনকাউন্টার-রাজের রাজনীতি


দেশের অগ্রগতি বিজেপি-র নেতৃত্বে যে ‘বন্দে ভারত’-এর গতিতে এগোচ্ছে তা নিয়ে যদি কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে তাকান উত্তরপ্রদেশের দিকে। বিগত দুই-তিন দশকে দেশে রিয়েলিটি টিভি-র বাজার লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। মানুষ গোগ্রাসে গিলেছে রিয়েলিটি বিনোদন। কিন্তু কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছিল। সেই ফাঁক ভরাট করেছে উত্তরপ্রদেশ। সরাসরি বাড়িতে বসে জনগণ দেখেছেন দুষ্কৃতি আতিক আহমেদ এবং তার ভাইকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হচ্ছে। পুলিশের জিম্মায় থাকাকালীন বিচারাধীন বন্দীকে রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে! আর গোটা দেশে বিজেপি বলছে যে তারা নাকি সুশাসন নিয়ে আসবে ক্ষমতায় এলে।

আতিক আহমেদের হত্যা পুলিশ এনকাউন্টারে হয়নি। কিন্তু ২০১৭ সালে বিজেপি তথা অজয় সিংহ বিস্ত ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে উত্তরপ্রদেশে ১০,০০০-এর বেশি পুলিশ এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে, যাতে মৃত্যু হয়েছে মোট ১৮৩ জন বিচারাধীন অপরাধীর। এই বিষয়ে অজয় সিংহ বিস্তের কথা খুব স্পষ্ট। অপরাধীদের গুলি করে হত্যা করার মধ্যে তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না। আদালতে শুনানি হবে, সেখানে অভিযুক্ত তার কথা বলার সুযোগ পাবে, পুলিশ তার কথা বলবে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধী সাব্যস্ত হলে আদালত সাজা ঘোষণা করবে। সংবিধান বর্ণিত এই নীতি তথা পদ্ধতিতে বিশ্বাস নেই সংবিধানের শপথ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের। একটি হিংস্র, আইনহীন পুলিশতন্ত্র কায়েম হয়েছে উত্তরপ্রদেশে।

তথাকথিত এই এনকাউন্টার রাজনীতির সমর্থনে বিজেপি ও তাদের কর্মী সমর্থকরা বলে থাকেন যে উত্তরপ্রদেশকে অপরাধমুক্ত রাজ্য বানানোর জন্য এই পদক্ষেপগুলি আবশ্যিক। অপরাধমুক্ত উত্তরপ্রদেশ গঠন করতে হলে অপরাধীমুক্ত শাসকদল থাকা দরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে বিজেপি-র নির্বাচিত বিধায়কদের ৫০ শতাংশের বিরুদ্ধেই অপরাধমূলক মামলা রুজু রয়েছে। ব্রীজভূষণ শরণ সিংহ, যিনি উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত সাংসদ, যার বিরুদ্ধে একাধিক ফৌজদারী মামলা রুজু রয়েছে এবং বর্তমানে যার বিরুদ্ধে দেশের পদকজয়ী কুস্তিগির-রা যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনে প্রতিবাদ করছেন, তার বিরুদ্ধে অজয় সিং বিস্তের পুলিশের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং বিজেপি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছে। আসলে বিষয়টি জলের মতন স্পষ্ট। বিজেপি করলে কেনো অপরাধই গুরুতর নয়। কিন্তু বিজেপি-র বিরুদ্ধে বা বিজেপি-র রাজনীতির বিরুদ্ধে কিছু করলে বিজেপি তার প্রবল ক্ষতি করবে, বিশেষ করে সেই ক্ষতি করার মধ্য দিয়ে যদি তাদের রাজনৈতিক লাভ হয়।

আসলে, উত্তরপ্রদেশের এনকাউন্টার রাজনীতিকে দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে তাদের সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী নীতির নেপথ্যে। যেকোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় হিংসা একটি আবশ্যিক উপাদান। কিন্তু শুধুমাত্র হিংসা সংঘটিত করলেই তা যথেষ্ট নয়। হিংসার একটি দৃশ্য নির্মাণ (spectacle) ফ্যাসিবাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে শুরু করে আফরাজুল হত্যা অথবা দিল্লি দাঙ্গায় নিরীহ মুসলমানকে পেটানো, সবই করা হয় ক্যামেরার সামনে। তারপরে সেই দৃশ্য ইন্টারনেট মারফত পৌঁছে যায় কোটি কোটি মানুষের মোবাইলে। অতএব আতিক খানকে প্রকাশ্যে হত্যা কোনো বেহিসেবী পদক্ষেপ নয়। প্রকাশ্যে হত্যা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আতিকের হত্যার কিছুদিন আগে তার ছেলের এনকাউন্টারের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এই হিংসার দৃশ্য নির্মাণ এবং তাকে ভোগ করা ফ্যাসিস্ত রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এই দৃশ্য নির্মাণের প্রয়োজনীয়তার নেপথ্যে রয়েছে দুটি রাজনৈতিক প্রবণতা। প্রথমত, হিংসার দৃশ্য নির্মাণ এবং তার বহুল প্রচারের মাধ্যমে ফ্যাসিস্তদের যে জনভিত্তি তাকে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে তাদের রাজনীতির যেই হিংস্র ভিত্তি তা বজায় রাখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কাউকে রেয়াত করা হবে না, বিশেষ করে মুসলমান এবং সামগ্রিকভাবে সেইসব জনগোষ্ঠী যারা অবদমিত তাদের কিছুতেই বাড়তে দেওয়া হবে না। তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার নানান ফন্দিফিকির এমনিতেই মজুত আছে। আর সবশেষে রয়েছে সরকার অনুমোদিত ঠ্যাঙারে বাহিনী এবং তাদের বন্দুক। অতএব, চিন্তা নেই। আমাদের রাজত্ব কায়েম রয়েছে হিংস্র ক্ষমতার মাধ্যমে। একে রোখে কার সাধ্য! অন্যদিকে, বার্তা দেওয়া হচ্ছে তাদের যারা এখনও ফ্যাসিবাদী এই ঝোঁকের বিরুদ্ধে রয়েছে। বার্তাটি স্পষ্ট। ক্ষমতার এই নতুন অবতারের কাছে বন্দুকের নল সত্যিই শক্তির উৎস। আদালত নয়, সরকারের চোখে কেউ অপরাধী হলেই চলবে গুলি, মৃত্যু হবে প্রকাশ্য রাজপথে। অতএব, সাধু সাবধান।

তবু, একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এই ভয়াবহ হিংস্রতা মানুষ মেনে নিচ্ছে কেন? কেন প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে না জনগণ? প্রতিবাদ তো দূরের কথা, যেন প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে এই এনকাউন্টার রাজনীতির পক্ষে। কিন্তু কেন?

এর উত্তর জটিল। তবু কয়েকটি কথা বলা যেতে পারে। উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রয়েছে বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, শাসক রাজনীতিক এবং মিডিয়ার হাতে। এর অধিকাংশ আদতে সমাজের উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি। দলিত, মুসলমান, ওবিসি, বা অন্যান্য নিপীড়িত অংশের প্রায় কোনো অংশীদারত্ব এই ক্ষমতার কেন্দ্রে নেই। এই পরিস্থিতিতে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে যে রাষ্ট্রের হিংসার উপর যে একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে, তার বিরুদ্ধে নিপীড়িত শ্রেণির প্রতিনিধিরা বাধ্য হয় হিংসার আশ্রয় নিতে। কিন্তু বর্তমান উত্তরপ্রদেশে একদিকে যেমন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, অন্যদিকে এই বার্তা পরিষ্কারভাবে দেওয়া হচ্ছে যে এই ক্ষমতা বলপ্রয়োগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাগ্রস্ত নয়। এমনকি সাংবিধানিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তারা এনকাউন্টারের মাধ্যমে দেখিয়ে দিচ্ছে যে ক্ষমতার দাপট কতটা হতে পারে। তাই এই ক্ষমতার সামনে মাথানত করানোর চেষ্টা করানো হবে সবাইকে।

অন্যদিকে, যেহেতু এই ক্ষমতার কেন্দ্রে গরীব, বঞ্চিত মানুষরা নেই, তাদের জন্য লাগবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। তাদের বোঝানো হয়েছে যে মুসলমানরা তোমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই আতিক খানকে গুলি করে হত্যার মধ্যে শত্রুনিধনের কাহিনি তুলে ধরা হচ্ছে, এবং যেহেতু এই মাফিয়ারাও সমাজে গরীব মানুষদের উপরে অত্যাচার চালায়, তাই তারা ক্ষমতার কেন্দ্রে কোনোভাবে না থেকেও যেন এক বিকৃত ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং তথাকথিত সুরক্ষার এই রাজনীতি বিজেপির মূল রাজনৈতিক নীতিতে পর্যবসিত হচ্ছে।

একটি ফ্যাসিস্ত সরকার শুধুমাত্র ক্ষমতা এবং শক্তির ভিত্তিতে চলতে পারে না। মানুষের সমর্থন না পেলে কোনো ক্ষমতাই টেকে না। বর্তমান উত্তরপ্রদেশে বিজেপি প্রায় একটি ফ্যাসিস্ত ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে যেখানে ক্ষমতা এবং হিংসার দৃশ্য নির্মাণ প্রায় দৈনন্দিন ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় পুলিশ নির্মমভাবে বিরোধীদের অত্যাচার করেছে, জেলে পুরেছে, আন্দোলনকারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভেঙে দেওয়ার ছবি গোটা দেশ দেখেছে। এনকাউন্টার এই প্রক্রিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সর্বাধিক হিংস্র সংস্করণ। হিংসা বাদ দিয়ে এই রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন গুজরাত ছিল ভারতীয় ফ্যাসিবাদের প্রথম ল্যাবরেটরি, যেখানে হিন্দুত্বের ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে কী করণীয় তার প্রথম পাঠ তৈরি হয়েছিল। অজয় সিং বিস্তের নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ হিন্দুত্বের দ্বিতীয় ল্যাবরেটরি যেখানে হিন্দুত্বের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরে তার থেকে অকৃত্রিম ফ্যাসিবাদে উত্তরণের পাঠ পড়া হচ্ছে।

এই পরীক্ষানিরীক্ষা যেখানে আরএসএস-বিজেপি লাগাতার করে চলেছে সেখানে বিরোধীরা কী করতে চাইছেন এখনও পরিষ্কার নয়। অবিলম্বে একটি কর্মসূচীর ভিত্তিতে বিজেপি-র বিরুদ্ধে গণআন্দোলন যদি না গড়ে তোলা যায়, তাহলে সমূহ বিপদ। আমরা আশা করব বিরোধী শক্তিসমূহ পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযত রাজনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করবে।